Thursday, 13 February 2020

অনির ডাইরি, ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২০


রক্তাক্ত আনন্দবাজারটা লাট খেয়ে পড়েছিল ডাইনিং টেবলের ওপর। তার উপরে দুইটি রক্তাভ গোলাকার চুলের ব্যাণ্ড। ঠকঠক করে ঢুকল তুত্তুরীর বাবার মেসেজ, সকালেও কচিঘাসের মত শ্যামল বরণ ছিল যাদের, তারাই আপাততঃ সুকন্যার উপহার দেওয়া জল রঙ মেখে, মেটে লাল। লাল রঙ মেখেছে তুত্তুরীর দুই হাত, গাল, গলা এবং জামা। শিয়ালদহ মেন লাইনের বিখ্যাত সিগন্যালিং এর কাজের দৌলতে, আটকে আছে তুত্তুরীর মা দুটি স্টেশনের মাঝে, দীর্ঘক্ষণ। বেশ কয়েকবার বেজে গেছে তুত্তুরীর ব্যগ্র তথা আর্ত কণ্ঠস্বর, “ব্যাণ্ড কিনে আনো মা।কালই লাগবে- ”
স্কুল থেকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে, মেয়ের আমার খুশির সীমা নেই। আপদ স্কুলের ফরমাইশ, দুহাতে দুইটি লাল ব্যাণ্ড পরে যেতে হবে চিড়িয়াখানা। নতুবা, আবাসিক ভেবে খাঁচায় পুরে দেয় যদি-। কখন ফিরবে মা? হাঁ করে ঘড়ি দেখে তুত্তুরী। দৌড়ে চলা মিনিটের কাঁটা টেনে নিয়ে যায় ঘন্টার স্থূলাকৃতি কাঁটাকে- । তাও বাড়ি ফেরে না মা।
  ভারি হয়ে আসে মায়ের চোখের পাতা, মনের কোণে জমতে থাকে, দিনভর ছায়াযুদ্ধের ক্লেদ আর তিক্ততা।  আসেপাশে সকলেই চলেছে কাজে। রাতভর ডিউটি করবে এরা, তারপর ভোরের ট্রেন ধরে বাড়ি। বাড়ি ফিরে নিজের হাতে বড় গ্লাস ভর্তি চা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে চড়াবে রান্না। কারো বর, খেয়ে কাজে বেরোবে। তো কারো ছেলে। রান্না শেষে, কাচতে বসবে জামাকাপড়। মধ্যাহ্নভোজের পর সামান্য জিরিয়ে নিয়েই শুরু করবে রাতের রান্না। বর-ছেলের খাবার গুছিয়ে, রাতের খাবার টিফিন বাক্সে ভরে কাজে বেরোবে আবার। এত ব্যস্ততার মধ্যে এই ট্রেন যাত্রাটুকুই এদের বিনোদন। কত যে খোশ গল্প করে এরা, সামনের আয়ামাসি যেমন শুনিয়েই চলেছে, প্রথম উড়োজাহাজে চড়ার অভিজ্ঞতা। হাঁ করে শুনছে, দুটো সিটে বসা আটজন মানুষ। শুনছে তুত্তুরীর মাও। যে বাড়িতে রাতের আয়ার কাজ করেন, তাদের সৌজন্যেই সম্প্রতি প্লেনে চড়েছেন- গিয়েছিলেন সুদর চেন্নাইয়ের লাগোয়া কোন সমুদ্র শহরে। সেখানকার পাঁচতারা হোটেলে কার যেন বিয়ে ছিল-। পাঁচতারা হোটেলের খাবার বিন্দুমাত্র মুখে রোচেনি ওণার। “ম্যা গো! কোন সোয়াদ নেই-। বিরিয়ানিতে নেই কোন খুশবু-। ” বিরিয়ানি ছেড়ে এবার সদলবলে ঢুকলেন উড়োজাহাজের শৌচাগারে। যাবার সময় ভয়ে ওপথ মাড়াননি। ফেরার সময় বমি করতে গিয়ে তো রীতিমত উচ্ছ্বসিত। মিথ্যা ভয় দেখিয়েছিল, বৌদি, পুঁচকে শৌচাগারে ঢুকলে যদি আটকে যায়-। তুত্তুরীর মা বলতে গেল,“ তুত্তুরী আর আমি দুজনে একসাথে ঢুকি তো, মা না গেলে জিন্সের ইয়ে-।” বলতে গিয়েও বলতে পারে না মা। আমি কত্ত বার প্লেনে চেপেছি- বলাটা অকারণ বড়লোকী দেখানো হয়ে যাবে না? এই দুঃসহ ভিড়ে একা হয়ে যাবে না তুত্তুরীর মা? আয়া দিদি ততোক্ষণে অবশ্য শৌচাগার থেকে মূত্রে উপনীত হয়েছেন। সাইন্স সিটি টপকে কোন নির্মীয়মান আবাসনের ভিতর যেন ঢুকেছিল দাদা। অন্ধকারে ঝোপের ঘাড়ে, যেই না- অমনি এসে হাজির এক অনামুখো ট্রাফিক পুলিশ। সটান ফাইন- ৫০০ট্যাকা। দাদা যত বলে, “ আমি তো ডায়বেটিস রুগী, আমি তো ওষুধ খাই। আমি তো চাপতে পারি না-”। পুলিশ তাও শোনে না। শেষে কড়কড়ে ৩০০টি হিসুর টাকা দিয়ে মুক্তি পেল দাদা। বাড়ি এসে দাদা সমানে বলে যাচ্ছে, “আমার হিস্যুর ট্যাকা, তোর হজম হবে?” আয়া দিদির চোখ ছলছলিয়ে উঠল, “তুই ট্যাফিক পুলিশ, তুই রাস্তা দেখ। তা না। কে কোথায় মুতছে, ঝোপে ঝাড়ে, তোর দেখার কি দরকার শুনি? ৩০০ ট্যাকায় দু পেলেট বিরিয়ানি হয়ে যায়- ।” কেউ বুঝি ফেলল দীর্ঘশ্বাস। এক রাতের রোজ ৩০০ টাকা পায় এরা- 
কোন স্টেশনে যেন থমকে দাঁড়াল ট্রেনটা, দুজন নামল তো ছয়জন উঠে পড়ল গোঁতাগুতি করে। এত ভিড়ের মধ্যেও একজনকে পথ ছেড় দিল বাকিরা। আহাঃ পোয়াতি না। ঢাউস উদর মহিলা জমিয়ে বসলেন জানলার ধারে। এতক্ষণ ঐ সিটটি ছিল সবৎসা এক মহিলার। তাঁর বাচ্ছাটির বয়স বড় জোর দুই-ইতিমধ্যে দুপ্যাকেট পাঁপড় ভাজা নষ্ট থুড়ি উদরস্থ  করেছেন তিনি। মা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই, উঃ উঃ করে মায়ের মুখটা ঘুরিয়ে নিচ্ছিল নিজের দিকে। মা উঠে যাবার পর দিব্যি বসে আছে, স্ফীতোদরা রমণীর পাশে। দিব্যি গল্প ফেঁদেছেন যিনি সিট ছেড়েছেন, আর যিনি সিট দখল করেছেন দুজনে। এপাশ ওপাশ থেকে পড়ছে ফোড়ন। পোয়াতি মেয়েমানুষের কি করা উচিৎ- অনুচিৎ এই আলোচনার ফাঁকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে বাচ্ছাটা। একটা হাতে ঝুলছে দুই পায়ের ফাঁকে, অন্যটি রাখা আছে পার্শ্ববর্তিনীর স্ফীত উদরের ওপর। যাদের জাত-ধর্ম ছাড়ুন, ভাষাটাও আলাদা। অন্যমনস্ক ভাবে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় তুত্তুরীর মা-  কাল বুঝি ভালোবাসার দিন? ধীর গতিতে চলতে থাকা ট্রেনের জানলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে ঢুকে আসে বসন্তগন্ধী হাওয়া। অন্য কি যেন গল্প জোড়ে আয়া মাসিরা- এইটুকই প্রাণখুলে বাঁচা। ট্রেন থেকে নামলেই তো আবার শুরু প্রাত্যহিক ইঁদুর দৌড়-

No comments:

Post a Comment