শেষ শীতের কামড় কি না জানি না, সামান্য জ্বরজ্বর ভাব, কাতর হয়ে কিয়ৎক্ষণের জন্য বন্ধ করেছিলাম চোখের পাতা- আচমকা-“মা। মা। শিগ্গির ওঠো। ” তুত্তুরীর আর্ত স্বরে ঘুম পালাল জানলা দিয়ে- কি হল? ধড়মড় করে উঠে বসছি, তুত্তুরী বলল,“ সব্বনাশ হয়েছে মা। গিজার বার্স্ট করেছে-”। অ্যাঁ? গিজার বার্স্ট করল কি করে? পড়িমরি করে বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে খেয়াল হল, আমার কন্যার ওষ্ঠাধর প্রগাঢ় তথা ঝিকিমিকি বেগুনী। ঐ একই রঙ শোভা পাচ্ছে তুত্তুরীর নাকে, গালে, দুই হাতে তথা জামায়। এতক্ষণে অনুধাবন করলাম, ঘুমের ঘোরে শুনতে ভুল করেছি। তুত্তুরী বলেছে বা বলতে চেয়েছে, তা হল- গ্লিটার পেনটা বার্স্ট করেছে। বেচারা গ্লিটার পেনের আর দোষ কি, তাকে খুলে তার রিফিলের পিছন দিকটা যদি মুখে ঢোকানো হয়-
টুকটুকে পার্পল রঙা ছোট্ট জিভটা আর অপরাধী আঁখিদ্বয় যেন টাইম মেশিন, চোখের সামনে ভেসে উঠল এমনি এক অলস দ্বিপ্রহর। বাবা- মা অফিসে, মস্ত বড় বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করছে। উত্তরপশ্চিমের ঘরের চারটে জানলা দিয়ে ছুটে আসছে রোদ আর হাওয়া। খুলে রাখা জানলার কাঠ পাল্লায় বসে,গম্ভীর গলায় ডাকছে কাক-কদাচিৎ এসে বসছে পায়রা আর ঘুঘু। একলা একটা মেয়ে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে ঠাকুমার বিয়ের সাবেকী কারুকাজ করা খাটটাকে ঘিরে। দেওয়াল ঘেঁষে রাখা দেরাজের ওপর বসানো বাবার ঠাকুরদার আমলের নীলরঙা দেওয়াল গিরি। যার তলার পাত্র তথা পলতের কলটা ব্রোঞ্জের। দুটো পলতে। চিমনিটাও কেমন চ্যাপ্টা। লোডশেডিং হলে বুড়ো দেওয়ালগিরি একাই একশ। কান ধরে পড়তে বসায় মা-। ব্রোঞ্জের নক্সী বাটির ওপর পলকাটা কাঁচের পাত্রের ভিতর টলটলে কেরোসিন। নিজের অজান্তে কখন যে পলতে ধরে টানাটানি করতে শুরু করেছিল মেয়েটা। যখন খেয়াল হল- দেখা গেল দুদুটি পলতেই তলার কেরোসিন তেলের পাত্রে সাঁতার কাটার বৃথা চেষ্টা করে টুপ করে ডুবে গেল। অতঃপর? অফিস ফেরৎ মায়ের স্কেল পেটা? দৌড়ল মেয়েটা- বিশাল দালান টপকে, একুশ খানা সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে, একতলার দালানকে আড়াআড়ি পার হয়ে, কালো ঠাকুরঘরের রোয়াকের বুক বরাবর ছুট্টে উঠোনের ওপাড়ে সাবেকী রান্নাঘর।ঘড়িতে বেলা বারোটা বাজল বুঝি, সবে জলখাবার খেতে বসেছেন বৃদ্ধা ঠাকুমা। জলখাবার বলতে যৎসামান্য এক-দুখানি হাতে গড়া রুটি, খানিকটা ট্যালট্যালে গরম ডাল আর চিনি। কখনও বা ডালও হত না, নিছক চিনি-জল দিয়েই রুটি খেতেন চাটুজ্জে বাড়ির দোর্দণ্ডপ্রতাপ গিন্নী। মেয়েটা গিয়ে কেঁদে পড়ল- ঠাকুমা বাঁচাও। ঠাকুমার নির্দেশে, জলখাবার না খেয়েই দৌড়ে এল মেজো পিসি। বাবাদের দিদি। ভাইপো-ভাইঝিরাও বলে দিদি। কি দস্যি মেয়ে বাবা- বলতে বলতে, কাঁচ খুলে পরিয়ে দিল পলতে। মুছেও দিল কাঁচটা। যাবার সময়ে বলে গেল-“চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো।” ঘুম? ঘুম তো আসে না। বালিশে মাথা দিয়ে ঢিমে তালে ঘোরা সাবেকী ডিসি পাখার দিকে তাকিয়ে খানিক নিজের মনেই রাজারাণীর গল্প বলে মেয়েটা। খানিকভাব জমানোর চেষ্টা করে, জং ধরা কড়ি বরগার ফাঁক গলে ছোটাছুটি করা চড়াইদের সাথে।এমনকি পায়রা ধরার লোভে উঁকি মারা জেঠুর পোষা বেড়ালের সাথেও- পাত্তা পায় না মেয়েটা। বড় ব্যস্ত সবাই। ব-ড় বে-শীইইই ব্যস্ত। তারপর?
“ঠাকুমা।লাল ওষুধ আছে?” ঘড়িতে বোধহয় আড়াইটে-তিনটে। সদ্যস্নাতা ঠাকুমা,উঠোনের তারে মেলছিল সাদা শাড়ি। ও পাশের রোয়াকে ফ্যান গালছিল পিসি, ভাতের ডেকচি ফেলে দৌড়ে এল- লালে লাল মেয়েটার মুখ, সাদা টেপ ফ্রক। দুহাত দিয়ে টপটপ করে ঝরছে রক্ত। হাঁউমাউ করে উঠল বৃদ্ধা, “কি সর্বনাশা কাণ্ড রে। তোর বাপ-মা যে আমাদের ভরসায় রেখে গিয়েছিল-কি জবাব দেবো তাদের?” ঘাবড়ে গিয়ে মেয়েটা কিছুক্ষণ বাকহারা। তারপর, বাড়িয়ে দিল একটা খালি লাল ওষুধের শিশি। নতুন কেনা লাল ওষুধ, রাখা ছিল দেওয়াল আলমারিতে। হাত দিয়ে কর্কটা না খুলতে পেরে লাগিয়েছিল দাঁত- পরিণামে-- এখন শুধু একটু লাল ওষুধ যদি জোগাড় করে দেয় ঠাকুমা, বাকিটা জল ভরে আবার সাজিয়ে রাখবে আলমারিতে। বাবা বুঝতেও পারবে না-
বেগুনী জিভ বার করে বোদাকালী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুত্তুরী, আর তার মা না জানি অতীতের কোন গলিতে হারিয়ে হেসেই চলেছে। যা ব্যাটা- আজকের মত মাপ করে দিলাম তোকে। তোর মধ্যে দিয়েই তো ফিরে পাই হারিয়ে যাওয়া শৈশব। আর সেই মানুষটাকে,না জানি কোথায় হারিয়ে গেছে যে। আকাশের কোন তারাটায় তার বর্তমান বসবাস কে জানে?
No comments:
Post a Comment