Thursday 13 February 2020

অনির ডাইরি, ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০


ঝুমা বলল, “ম্যাডাম, একটা অনুরোধ করব?” বাপরেঃ এদের এত ভালোবাসি, তাও এদের এত সঙ্কোচ আর ভণিতা। বললাম, ঝট করে বলেই ফেলো। আব্দেরে  আর্জি জানালো, “ সামনে আমার মেয়ের জন্মদিন। ওর জন্মদিনের কার্ডটা আপনি লিখে দেবেন-”। কার্ড অর্থাৎ নিমন্ত্রণ পত্র? এ আর এমন কি ব্যাপার? জানতে চাইলাম কার নামে কার্ড হবে? কবে? আর ঝুমার মেয়ের ভালো নামটা-
শুনলাম- সুদ্যুতি। বাপরেঃ ঐ পুঁচকেটার এত ভারি নাম? যাকে দেখলেই বলি, “মিষ্টি খাবো?” প্রথম দেখেছিলাম, টিম চুঁচুড়ার অফিস পিকনিকে, সে বিগত বছরের কথা। কয়েক মাস হল এনসিএলপির চার্জ নিয়েছি। ঝুমা তার ম্যানেজার। ঠিক টিম চুঁচুড়ার প্রত্যক্ষ সদস্য নয়। সত্যি? বললে ঝুমা মানবে?
পিকনিকে ঝুমার হাত ধরে যিনি এলেন তাঁকে দেখে তো পুরো চুঁচুড়া টিম ক্লিন বোল্ড। তিনি এলেন- লকড়ি কি কাঠি গাইলেন- সকলের প্রাণেশ্বরী হয়ে বিদায় নিলেন। শুনলাম তাঁর নাম মিষ্টি। সেই থেকেই শুরু, “মিষ্টি খাবো” উপাখ্যান। তিনি আবার তুত্তুরীর প্রগাঢ় অনুরক্তা। তুত্তুরী হল, তাঁর ভট্টাচার্য দিদি। ভাবুন খালি !
তো মিষ্টি ওরফে সুদ্যুতির জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পত্র লিখে ফেললাম সময় করে, এ আর এমন কি কথা। বাঁধা গৎ- মাননীয় মহাশয়, অমুক তারিখে আমাদের পৌত্রী/দৌহিত্রীর শুভ জন্মদিন উপলক্ষে মদীয় বাসভবনে/ অমুক স্থানে প্রীতিভোজে যোগদান করিয়া বাধিত করিবেন ইত্যাদি-। ঝুমার মুখটা হাঁড়ি হয়ে গেল পড়ে। পছন্দ হল না। লিখতে হবে, প্রাণের কথা-
লিখতে বসে দেখলাম, ব্যাপারটা বেশ কঠিন। আমি পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি তুত্তুরীকে নিয়ে। অতটা না পারলেও পারি ভাইপোদ্বয় বাবু বা বুল্লু বাবুকে নিয়ে। যাদের শৈশবের সাক্ষী আমি। কিছুটা হলেও সুকন্যার উটো বাবুকে নিয়েও- রোজই শুনি যে তাঁর কৃতকর্মের উপাখ্যান। মিষ্টিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখলাম- কিছুই জানি না তো মিষ্টি খাবোর সম্বন্ধে। অগত্যা শরণাপন্ন  হলাম ঝুমার। কিছু তো বলো- কেমন ছিল সে? কেমন অনুভূতি হয়েছিল প্রথম দর্শনে? টেকো ছিল কি? নাকি একমাথা ঝুমুর ঝুমুর চুল? কি বলে ডাকে, দাদু-ঠাম্মা বা দাদু-দিদা? শোনাও কিছু দুষ্টুমির গল্প। মায়ের চোখ দিয়ে দেখি মিষ্টির শৈশব-
দিন দুয়েক বাদে পেলাম এক সদ্যোজাত এক নিঁখুতির ছবি। ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবছিল সে। সাথে ঝুমার কিছু হাতে লেখা, কিছু টাইপ করা চিঠি- মায়ের থেকে ভালো বোধহয় কেউ আঁকতে পারে না, শৈশবের ছবি। ঝুমার চোখ দিয়ে দেখলাম, ওয়াকার চড়েই, দাদুর দই বাটি ধরে চম্পট দেওয়া- দেখলাম, ঘুরে ঘুরে সবার পাত থেকে চিংড়ি মাছ তুলে নেওয়া- ঠাম্মার সাথে প্রবল ঝগড়া এবং ভাব, প্রথমবার পাহাড় দেখার উত্তেজনা- পাহাড় থেকে নেমে ঠাম্মার ঘরের দেওয়াল জুড়ে পাহাড় রচনা। অনুভব করলাম, প্রথম কথা বলতে পারার আনন্দ- প্রথমবার খাট থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ার যাতনা।
ঝুমার কথাগুলোই গুছিয়ে দিলাম কার্ডে। যথারীতি এবার সবার দিলখুশ। ছেপে এল হলদে সোনালী কার্ডে মিষ্টির জন্মদিনের আমন্ত্রণ পত্র। সাথে নির্দেশ- ভট্টাচার্য দিদিকে নিয়ে না গেলে মিলবে না প্রবেশাধিকার। ভট্টাচার্য দিদির এদিকে হেবি গোঁসা। আমি কোন ওর জন্মদিনে যাব? ও তো আসেনি? কি উদ্ভট লজিক মাইরি। অগত্যা দিতে হল কানমলা। সেজেগুজে গেলাম মা-মেয়েতে। ওদিক থেকে এলেন বর্মন সাহেব, অরুণ বাবু, রমেশ আর বিদ্যুৎ। সেজেগুজে পরী হয়ে ঘুরছিল মিষ্টি। দেখেই যথারীতি,“মিষ্টি খাবো” বলার সিথে সাথেই চকাস্।  আজ রীতিমত দরাজ দিল আমাদের মিষ্টি-
বনেদী বাড়ির হার্দিক অভ্যর্থনায় অভিভূত হয়ে, ম্যাজিক দেখে, পর্যায়ক্রমে তপসে মাছের জিভ পোড়ানো ফ্রাই, টক দই আর সর্ষে মাখোমাখো ঘটৎকচ মার্কা পার্শে, কলাপাতা মোড়া আঙুল পোড়ানো পাতুরী, সুগন্ধী পোলাও, মুর্গীর ঠ্যাং, ক্ষীরের মত পায়েস খেয়ে যখন উঠতে যাচ্ছি, পাতে পড়ল ইয়া বড় একখানি দরবেশ। আরেঃ এতো আমার ছোটবেলার দরবেশ- ফ্যাকাশে হলদে রঙের বোঁদের লাড্ডুর মাঝে একখানি কাজু, একটা দামড়া কিশমিশ, আর ইতি উতি লুকিয়ে থাকা খোয়া ক্ষীরের ডেলা। মনে পড়ে গেল, চাটুজ্জে বাড়ির সমস্ত শুভ কাজে বসত ভিয়েন, তৈরি হত এমনি দরবেশ। মনস্থ করে ফেললাম- এবার থেকে টিম চুঁচুড়ার সমস্ত খাবার প্রোগামের মিষ্টির কনট্র্যাক্ট ঝুমাকেই দেওয়া হবে। মিষ্টির মা যদি না মিষ্টি আনে, আনবে কেটা শুনি-

No comments:

Post a Comment