Saturday 1 February 2020

অনির ডাইরি, ২৯শে জানুয়ারী ২০২০


মা, বড়মামার মুখে গল্প শুনেছে তুত্তুরী আর বুল্লু দাদা। সেই যে আশির দশকের গপ্প- যখন ঘুম ভাঙাত, “ইয়ে আকাশবাণী হ্যায়-”।ভোরের বাতাসে উনুনের ধোঁয়ার বাস-দুধ চিনি দেওয়া চায়ের সাথে থিন অ্যারোরুট আর আনন্দবাজার নাকি যুগান্তর- । ঘড়ি বেঁধে দূরদর্শন সম্প্রচার- মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত। নিয়ম করে ঘুরত সূর্য- চন্দ্র। বদলাত ঋতু। হত ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক পরীক্ষা। ঝুড়ি আর বস্তা করে নম্বর আনত ক্ষীরেরতলা গলির কাঁঠাল গাছ ওয়ালা চাটুজ্জে বাড়ির তিনটে ছানা- যেমন আনে তুত্তুরী। অতঃপর? মা আর মামাদের মাথায় পড়ত সটাসট্ চাঁটি আর ঠকাঠক গাঁট্টা। দিদি( আসলে দাদুর দিদি) বলত, “সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেয়েছিলি?আর খেও না। মা সরস্বতী রাগ করেন-। ” এটা অবশ্য মাও বলে তুত্তুরীকে। পাশ থেকে ফোড়ন কাটে বাবা- “হ্যাঁরে? তুই সত্যি ফিজিক্স নিয়ে পড়েছিলি?”
 হিমেল রেশ থাকতে থাকতেই এসে পড়ত সরস্বতী পুজো। পাল্লা দিয়ে লাফাত খুদে মা আর মামাদের দল।  ঠাকুর আনবে কখন? ঠাকুর সাজাবো কখন? রিক্সা চেপে কোলে করে ঠাকুর আনত দাদু/ছোট দাদু। সাজানোর গুরুদায়িত্ব ছিল দাদুর একার। সহকারী তিন খুদে মাতব্বর। একতলার ঠাকুর ঘরের পলেস্তারা ওঠা দেওয়াল ঢাকা পড়ত মামমামের(দিদা) দামী সবুজ দক্ষিণী সিল্কের আবরণে। কালো ফুটিফাটা রোয়াকে দণ্ডায়মান দুই থামের গায়ে বাঁধা হত কলাগাছ। তার সামনে বসত স্বস্তিকা আঁকা মাটির ঘট আর সশীষ ডাব। প্রায় মধ্যরাত জুড়ে বাড়ি সাজাত দাদু। বছর ভর জমানো সিগারেটের বাক্স থেকে বেরিয়ে আসত রাঙতার পাহাড়। নিপুণ হাতে ফুল কাটত দাদু। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ময়দা ফুটিয়ে আঠা বানিয়ে দিত বড় দিদা। সটাসট চিপকাত ফুল। মাঝে ছোট্ট ব্রেক। আটটা থেকে দূরদর্শনে বাংলা সিরিয়াল- সেবার সিরিয়ালের মাঝপথে আচমকা বস্ত্র উন্মোচন করে সুইমিং পুলে নেমে গেলেন নায়ক এবং নায়িকা। যাঁদের একজন এখনও মাননীয় মন্ত্রী আর অপরজন পরাজিত সাংসদ। জলে নেমে প্রগাঢ় আলিঙ্গন এবং ইয়ে- । ফিকফিক করে হেসেই চলেছিল মা আর বড় মামা- ছোট মামা তখন বড্ডই ছোট। কান মুলে ভাগিয়ে দিয়েছিল ছোট দাদু। সেই গল্পও শুনিয়েছে মা- তুত্তুরী যে মায়ের প্রাণের বন্ধু।

গল্প শুনতে শুনতে মনে হয় যেন সাদা কালো চলচ্চিত্র দেখছে তুত্তুরী। বড় বাড়ি, যৌথ পরিবার। শতেক জটিলতা অস্বাচ্ছন্দ্য ছাপিয়ে উৎসবের অনাবিল আনন্দ। বড় রঙীন ছিল মা আর মামাদের শৈশব। আজও মায়ের চোখে-মনে লেগে আছে সেই রঙ। নিশ্বাসে ভালো লাগা তথা ভালো থাকার আস্বাদ। বড় সাধ হয় মায়ের,যদি ভাগ করে নিতে পারত ঐ আস্বাদ- তুত্তুরীর সাথে। সাধ তো হয়, কিন্তু কর্মক্ষেত্র আর ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য- ব্যাপারটা মায়ের একদমই বাগে আসে না। ট্রেনিং দেবার সময় তো মা দিব্যি শেখায়, দপ্তরী কাজই হোক বা বাড়ির কাজ নিজেকে নিঙড়ে দেবেন না, না বলতে শিখুন- দিনান্তে নিজেকে সময় দিতে কখনই ভুলবেন না, ইত্যাদি প্রভৃতি।
কিন্তু বাস্তব জীবনে কাজটা সাংঘাতিক দুরূহ। নাক কান মোলে মা।  সাংসারিক কাজকে অবহেলা করে যদি আপিসে মন বসায়, বাড়িটা হয়ে যায় শৌচাগার। আর শৌচাগারদ্বয় কি হয়, সে কথা নাই বা কইলাম। আর উল্টোপুরাণ পড়লে, অর্থাৎ দপ্তরী কাজকে পিছনে ফেলে যদি সংসারে মন বসায় মা- পরদিন অফিস যেতে নির্ঘাত ব্যথা করে পেট- জোড়ে নাকেকান্না। বাপরেঃ আপিসে গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে কাজ। চামচ দিয়ে খুঁড়তে হবে পাহাড়।

এতদসত্ত্বেও উৎসবের সময় কেমন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় মায়ের বাড়ি আর আপিস। আহাঃ ওটাও তো মায়ের পরিবারই। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা বলতে পারেন গায়ে পড়েই এগিয়ে আসে সবাই- হয়েই যায় যোগাড়যন্ত্র। তুত্তুরীর বুজু সরস্বতী তো সাদা সেলোফেনের জামা পরে বসেই থাকে বছর ভর বইয়ের আলমারির মাথায়। বোতলে করে গঙ্গা জল এনে দেন ডিএম অাপিসের বৃদ্ধ অজিত দা। রমেশ আর বিদ্যুৎ মামা জোগাড় করে আনে পূজার যাবতীয়  উপকরণ। শাড়ির বস্তা নিয়ে হাজির হয় মাম্পি মাসি। “ম্যাডাম!হলুদ শাড়ি নেবেন না?তুত্তুরীর জন্য তো একটা নিন।  পয়সা না হয় নাই দিলেন-”। তুত্তুরীর যদিও একটা হলুদ শাড়ি আছে। প্রিয়াঙ্কা মাসি এসে শিখিয়ে যায় ভোগের খিচুড়ি রান্নার কৌশল- ঝুমা মাসি ঠেলে পাঠায় তুত্তুরীর জন্য হলুদ ঝুটো গয়না কিনতে।  “আমি পারব না-। ঝামেলা বাড়াস না তো” গজগজ করতে করতে করতে ফুল-ফল-বাজার করে আনে বাবা।ঝ্যাঁটা-ন্যাতার দাপটে পালায় ধুলো আর ময়লার গুষ্টি।  বাষট্টি বার ডাইনিং চেয়ারে ওঠানামা করে শিকলি টাঙায় মা আর তুত্তুরী- দরজায় দরজায় আঁকা হয় আল্পনা। ফ্ল্যাটের গ্রীলের গেটে বাঁধা হয় কলাগাছ- সকাল থেকে রান্না হয় খিচুড়ি- বেগুনী - কুলের অম্বল আর পায়েস। কুলের অম্বল রাঁধতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায় তুত্তুরীর মায়ের। এ কোন কুল এনেছে আমার বর? বোম্বাই কুল? এই কুলের অম্বল থুড়ি চাটনি রাঁধব? বাড়ি হয়ে যায় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গেলর ম্যাচ- দ্বৈরথ চলতেই থাকে বাঙাল-ঘটির। স্নান সেরে টুকটুকে লাল শাড়ি পরে  ঘর আলো করে এলো চুলে ফল কাটতে থাকে তুত্তুরীর কাকিমা।নিপুণ হাতে সেজে ওঠে নৈবেদ্য। কাকাই এর পিছনে তেলের গামলা নিয়ে ঘোরে তুত্তুরী মা- “পুজোটা করে দে না টুকলু বাবা-সোনা ছেলে। ” বাঙাল-ঘটির দ্বৈরথ ভুলে সুর মেলায় তুত্তুরীর বাবা আর দাদুও। দাদু তো সটান হুমকিই দেয়-“বাড়ির পুজো বলে কথা। পরের বছর থেকে দায়িত্ব নাও টুকলু। ” কাকিমার মন খারাপ কাঁসর ঘন্টার জন্য। মা বুদ্ধি দেয়-“কাঁসার থালাকে বেলুন দিয়ে পেটা না বাপু- দিব্যি আওয়াজ হবে-”।  আর এত কিছুর মধ্যেই কোথা দিয়ে যেন মায়ের ছোটবেলায় পৌঁছে যায় তুত্তুরী-ধূপদীপ জ্বেলে ভুলভাল উচ্চারণে পাতি পাঁচালি খুলে পুজো করে মা- তুত্তুরী শোনে মা বলছে- “আই লাভ ইউ বুজু সরস্বতী। ভালো থেকো সোনা-”।

No comments:

Post a Comment