Saturday, 25 January 2020

অনির ডাইরি ২৩শে জানুয়ারী, ২০২০


আপন আপন ব্যস্ত জীবনের গোলকধাঁধা থেকে কয়েক মুহূর্ত চুরি করে, যাঁরা কাল ভরিয়ে দিয়েছেন আমার ফেবুর দেওয়াল বা মেসেঞ্জারের ইনবক্স বা হোয়াটস্অ্যাপ,তাঁদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।  অনেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন একসাথে একাধিক মাধ্যমে, আর মাম্পির মত গুটি কয়েক পাগলি সবকিছুর পর আবার ফোন করেও--। কুর্নিশ আপনাদের সকলকে। আপনাদের শুভেচ্ছার জন্য বড় বেশী ভালো কেটেছে গতকাল দিনটা।
আর পাঁচটা বাঙালী মায়ের মত নাহলে হয়তো আমারও মনে হত, মায়ের আবার জন্মদিন! ভূতের আবার জম্মতিথি!প্রণম্য মহামানবের সাথে জন্মদিন ভাগ করে নেবার অন্যতম সুবিধে হল ছুটি। একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার অপরিসীম আনন্দ-।  অতঃপর? অন্যদিনের মতই, গাছেদের সাথে কথোপকথন-। শীত শেষ হয়ে আসতে চলল, এখনও বন্ধ্যা আমার পেটুনিয়া ওরফে পেটু। গায়ে গতরে বেড়েছে খুব, শুধু ফুল ফোটানোতেই এত অনীহা কেন বাপু? বেড়েছে গোলাপ ওরফে গোলাপীও-। জামাকাপড় শুকাতে দিতে গেলেই আমার বরকে তিনি সোহাগ করে কাঁটা ফুটিয়ে দাম্পত্যকলহ বাঁধান- এখনও নিষ্ফুল। বাড়ছে আদরের ক্রোটন যার ডাক নাম ক্রোটু, ছাঁটা সত্ত্বেও বাড়ছে এদিকওদিক দিয়ে পয়সাপাতা, এমনকি ক্যাকটাসও, বাড়ছে না কেবল সাধের ঘৃতকুমারী। আজ তো মায়ের জন্মদিন, আজ তো ফুল ফোটাও পেটু বা গোলাপী। 

জন্মদিন মানেই স্মৃতিমেদুরতা, দেশবরেণ্য নেতার সাথে জন্মদিন ভাগ করে নেবার সুফল হল, প্রাক ফেবু যুগেও চট করে কেউ ভুলত না শুভেচ্ছা জানাতে। আর ভুলে গেলে? উথলে উঠত অভিমান। সাক্ষী সঞ্চিতা। কি রেগেই না গিয়েছিলাম সেবার প্রিয় বন্ধুর ওপর। বাড়তে থাকা বয়স আর চড়তে থাকা আত্মবিশ্বাস অবশ্য বহুকাল হল মুছে দিয়েছে ঐসব ছেলেমানুষী আবেগ। তবু আজও বসে থাকি কয়েকটা ফোনের অপেক্ষায়। তাদের ফোন, যারা তখন ছিল আসেপাশে, যখন দিগশূন্যপুরের মাঠে হারিয়েছিলাম খেই। 
সাদাকালো আশি-নব্বইয়ের দশক। হাওড়া ইছাপুরের সিংহ বাড়িতে ২৩শে জানুয়ারী দিনটা ছিল নিছক উৎসব। উৎসবের হাওয়া বইত গোটা মধ্যহাওড়া জুড়েই। সকাল থেকে বেরোত প্রভাত ফেরি। ছাতে ছাতে উড়ত ত্রিরঙা। অবসর সম্মিলনীর মাঠে, ঠিক মধ্যাহ্নে ফাটত বোমা। জীবিত থাকলে  তাঁর যত বছর বয়স হত, ততোগুলি বোমার সেলাম জানাত অবসর। বড়দার হাত ধরে দেখতে যেত সেদিনের ঝুনু। নেতাজীর সাথে সাথে ঐদিন গুনু আর ঝুনুরও জন্মতিথি ছিল যে। দিদা আদর করে ডাকত ঝুমি। ১৯৯৮এ দিদা চলে যাবার পর, আর কেউ ডাকেনি ঐ নামটা ধরে। চাইও না কেউ ডাকে- আবার যখন দেখা হবে, সেই তামুক পাতা চিবানো বৃদ্ধার সাথে, অন্য কোন দুনিয়ায়- আবার ডাকবে সে। শুধুই সে।

খাকি ব্যাগে, জোড়া বোতলে করে ভোর-ভোর আসত হরিণঘাটার দুধ। পায়েস রাঁধত বড়মাসি। ঘণ দুধের  পায়েসের মাঝে এক আধখানা কাজু। জন্মদিনে ভোর ভোর উঠে গুরুজনদের প্রণাম করা ছিল প্রাথমিক কর্তব্য।  মাঝে মাঝে বায়না জুড়তাম।  শাড়ি পরিয়ে দাও মা। পিসির হাত দিয়ে কাছেই শীতলাতলায় পুজো পাঠাত ঠাকুমা। প্রসাদ বলতে ছোট্ট গুজিয়া অথবা প্যাঁড়া। আগের রাতেই জ্যাঠাইমা এনে রাখত নলেন গুড়ের নরম পাকের সন্দেশ,কালোজাম আর পেস্ট্রি। সুগার এন স্পাইজ বা ক্যাথলিনের মত নামি দোকান তখনও হাওড়ায় বিস্তার করেনি শাখা? স্থানীয় বাজারেরে দাবার ছকের মত দেখতে পেস্ট্রি। তাই মনে হত অমৃত। জন্মদিনের একমাত্র দুঃখ ছিল মায়ের অফিস। কেন্দ্র সরকারী কর্মচারী, তাও পোস্ট আপিসে কাউন্টার ডিউটি।  কোন দিন ছুটি পায়নি মা। শুধু সে বছর বাদে, যে বছর শতবর্ষে উপনীত হন তিনি।
বড় মাসির বাড়ি যেতে দেরী হলে সাইকেল নিয়ে সটান হাজির হত বড়দা বা মেজদা। রডে বসে পা দোলাতে দোলাতে ইছাপুর। সোনা-মিন্টুদের বাড়িতে তখন ভাড়া থাকত বড়মাসিরা। একতলার অপরিসর দালানে মাসিদের হাতে তৈরি লাল-নীল উলের আসন পেতে বড় মাসিকে ঘিরে আয়তাকারে খেতে বসতাম আমরা পাঁচ ভাইবোন। রাজার মত বসতেন বড় মেসোমশাই।  টুক টুক করে কত কি যে রাঁধত বড়মাসি। খেতে খেতেও ঝগড়া করত “গুণু আর ঝুনু”। কি বোকাই না বানাতে ছোটদা তুমি আমায়! তখন ইমরান খাঁ-ওয়াসিম আক্রমের ইন্দ্রজাল আচ্ছন্ন ক্রিকেট জগৎ। মনে আছে, তুমি দাবী করতে তুমি পাকিস্তানের সমর্থক?  কম কিলিয়েছি রেগে গিয়ে? আর নাহলে বলত, ঝুনুকে নয়, গুণুকে সবাই বেশী ভালোবাসে। “জিজ্ঞেস করে দেখ-”। কি বোকাই না ছিলাম। সত্যিই জনে জনে প্রশ্ন করে বেড়াতাম। হ্যাঁ গো, তুমি কাকে বেশী ভালোবাসো? ছোটদাকে? না আমায়?
প্রতি জন্মদিনে বাঁধা উপহার ছোট বা সেজ মাসির হাতে বোনা সোয়েটার। নাক টানলে আজও পাই হাতে বোনা নতুন সোয়েটারের সুঘ্রাণ। একটাও বাতিল করেনি মা। যত্নে রাখা সেই সব সোয়েটার পরে আজও ঘোরে আমার কন্যা। আর মেজদা দিতে বই। হাওড়ার বাড়ির আলমারি ভর্তি যত বই, তার শতকরা ৭০ শতাংশই তো তুমি দিয়েছিলে মেজদা। শেক্সপীয়রই বলো বা শার্লক হোমস্ অথবা দেশী নিহাররঞ্জন বা হেমেন্দ্রকুমার রায়- তুমি না থাকলে জমতই না পরিচয়।
১৫ই জানুয়ারী ১৯৯৯, বড়দার বিয়ে, তারপর কেমন যেন গুরুত্ব হারাল ২৩তারিখটা। নবোঢ়া তন্বী শ্যামা বড় বৌদির চলনে-ঠমকে-গমকে মুগ্ধ সিংহ-ঘোষ তথা চাটুজ্জে বাড়ি। বৌদির নিঁখুত পরা শাড়ি, কাজলটানা চোখ, চুড়ির রিনিঝিনি, ২৩শে জানুয়ারীকে একডজন গোল দিল ১৫ই। বছর তিনেক বাদে ২৮শে ফেব্রুয়ারি এল মেজবৌদি। গুরুগম্ভীর মেজদা এত ফাজিল বউ কি করে জুটিয়েছিল কে জানে? বৌদি নয়তো ইয়ার। দাদাদের থেকে বৌদিরা কবে যেন অনেক বেশী কাছের লোক হয়ে উঠল। সেজদা-ছোটদা যখন টোপর পরছে, তখন পুরোদস্তুর জীবন সংগ্রামে ব্যাপৃত আমি। জন্মদিন পালনের সময় কোথায়? তবুও আসত ফোন। ঠিক এসে পৌঁছে যেত স্নেহোপহার। দূরাভাষের ওপাড় হতে কাতর অনুরোধ- আসিস একবার। পায়েস করেছি দুই ভাইবোনের জন্য-।
কবে যেন চাকরী পেলাম-কবে যেন তার সাথে আলাপ হল। বিয়ে হল। সেসব মনে হয় স্মরণাতীত কালের কথা। এখন তো শালকিয়ার ভট্টাচার্য পরিবারের মেজ বউ। জিতেন বাবুর আদরের বড় বৌমা- টুকলুর বউদি আর উমার স্নেহশীলা দিদিভাই। সবার ওপর- তুত্তুরীর মা। যে বোঝেই না,কেক ছাড়া আবার জন্মদিন কি করে হয়? দাদু,ছোটেদাদু,  ছোটো-মুষ্টু বা মামা-মামিদের সামান্য ফোনে কেন ছলছলিয়ে ওঠে মায়ের চোখ। কিন্তু ওঠে তো। কি করি? যতই কঠিন হোক আত্মবিশ্বাসের খোলস, সেদিনের ঝুনু যে আজও বেঁচে আছে আজকের অনির ভিতর। আর সে যে বড় ভালোবাসার কাঙাল- মাথার ওপর থেকে যে হারে সরছে গুরুজনদের স্নেহছায়া, বড় ভয় পায় সে, তাই তো জন্মদিনের শুভক্ষণে তার একটাই প্রার্থনা, তোমাদের সুস্থ থাকাটাই আমার সবথেকে বড় উপহার। আজকে শুধু আজকের দিনে আঁকড়ে ধরতে চাই আমার প্রতিটি প্রিয়জন, প্রতিটি প্রিয়বন্ধুকে, আর বলতে চাই- যাই হোক না কেন, আমায় ছেড়ে যেও না। সময় যত জোরেই দৌড়ক না কেন,বিশ্বাস করো, আমি বদলাইনি। তোমরাও যেন বদলে যেও না-।

No comments:

Post a Comment