পূর্বেই স্থির
করেছিলাম, যে এ যাত্রা ডাইরি লিখব। সেই মোতাবেক, শৌভিকের মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও
একটি স্থুলাকৃতি প্যাড এবং পেন সঙ্গেও নিয়েছিলাম। কিন্তু গোটা ভ্রমণ পর্বে এক
ছত্রও লিখে উঠতে পারিনি। এ বারের যাত্রাপর্বটা শুরু থেকেই ছিল মহা গোলমেলে। মাস
দুই-তিন আগে, সম্ভবত তখন এপ্রিল মাস, বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্ব তুঙ্গে,
শৌভিক হুগলী জেলার ওসি ইলেকশন, কখন বাড়ি ফেরে, কখন যে অফিস যায়- সাংসারিক কোন দায়দায়িত্বের
কথা বলতে গেলেই প্রতিনিয়ত শুনতে হয়, “দাঁড়া আগে ইলেকশন পর্ব মিটুক।” এই চূড়ান্ত
ব্যস্ততার মধ্যে ঘুরতে যাবার বায়না যে নেহাত বাতুলতা, তা সহজেই বোধগম্য। বিগত
নভেম্বরে ঐ আসাধারণ উত্তর বঙ্গ ভ্রমণের পর, খুব যে একটা বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছিল
এমনও নয়। মুস্কিল বাঁধালেন, আমার এক সহযাত্রী। মধ্যবয়সী সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক, কোন
এক জাহাজ কোম্পানিতে সম্ভবত করণিক হিসাবে কর্মরত,
মাঝে মধ্যেই ওঠেন আমাদের চার্টার্ড বাসটিতে। উনি এত বেশি গল্প করতে ভালবাসেন, যে
ওনাকে দেখলেই আমার আতঙ্ক লাগে। দিব্যি সুখে দিবানিদ্রা দিতে দিতে অফিস যাব, তা নয়,
গপ্পে বুড়ো বকেবকে আমার মাথা খারাপ করে দেবে। ওনার গল্পের বিষয় দুটি, প্রথমত ওনার
পুত্র, যে কিনা সদ্য মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, জাহাজ কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে ।ভদ্রলোক
নিতান্তই পুত্রগত প্রাণ, উনি আজো নিজের পুত্রের সব কাজ নিজে হাতে করেন, এবং আমাকেও
এন্তার জ্ঞান দেন, কি ভাবে সন্তান মানুষ করতে হয়। অস্বীকার করব না, শুনতে মন্দ
লাগে না। ওনার গপ্পের দ্বিতীয় প্রিয় বিষয় হল, ভ্রমণ। ওনাদের একটা দল আছে, যারা
দীর্ঘ বিশ-পঁচিশ বছর ধরে এক সাথে ঘুরে বেড়ায় এবং এই দলের সংখ্যা ক্রমঃবর্ধমান। উনি
আমাকে, শৌভিক এবং তুত্তুরিকে এই দলের সদস্য করে নিতে বদ্ধ পরিকর। যত বলি, “আরে মশাই,
আপনি চাইলেই কি আমরা যেতে পারব? আমার অফিস, মেয়ের স্কুল আর বরের দেশোদ্ধার সামলে
তবে না দেশভ্রমণ। তার থেকে আমি বরং একটু ঘুমোই-”। ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা, “আরেঃ সব
ম্যানেজ হয়ে যাবে। ইচ্ছেটাই আসল। জান আমরা একবার ট্রেন মিস করেছিলাম। সেই গল্পটা
কি তোমাকে বলেছি?” আমার মুখে চোখে বোধহয় সামান্য ঔৎসুক্য ফুটে উঠেছিল, উনি দ্বিগুণ
উৎসাহে শুরু করলেন, “ সেবার আমাদের লাদাক যাবার কথা।ঐ প্লেনে উঠলাম আর হুশ করে লাদাকে
গিয়ে নামলাম ঐ রকম ছোঁচা প্ল্যান নয়। রীতিমত হাওড়া থেকে কালকা মেলে চণ্ডীগড়, চণ্ডীগড় থেকে
গাড়িতে মানালি হয়ে লাদাক। আর ফেরার সময় কাশ্মীর হয়ে নামা।” নড়ে চড়ে বসলাম, ঈশ এত ভাল ট্যুর, বলা যায়
স্বপ্নের ট্যুরে ট্রেন ফেল, এ গল্প না শোনাই ভাল। খামকা মানসিক অবসাদ বৃদ্ধি করে
কি লাভ? এর থেকে একটা ছোট্ট ঘুম দিয়ে নিলে তোফা হত। ভদ্রলোক আমার মনোগত ইচ্ছেকে
পাত্তাই দিলেন না, “ শোন না, সন্ধ্যা পৌনে আটটা নাগাদ ট্রেন, আমি অফিস থেকে হাফ ডে
নিয়ে বেরোলাম, কোথায় ট্রেনে ডিনার করব বলে, পার্ক সার্কাস আরসেলান থেকে মাটন
বিরিয়ানি কিনলাম, অথচ তোমার বৌদি আর সময়ে তৈরি হতেই পারল না। যত বলছি হল? আর দেরী
করলে কিন্তু ট্রেন পালাবে, কে শোনে আমার কথা? সব সেরে যখন ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে বেরোলাম
তখন সন্ধ্যা সাতটা।” “বাবা গো? পৌনে আটটায় হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়বে, আর আপনারা
বাগুইআটি থেকে যাত্রা শুরু করলেন সন্ধ্যা সাতটায়? ঐ অফিস টাইমে?” ভদ্রলোক বিমর্ষ
হয়ে বললেন, “কি বলবে বল? ট্রেনটা যে আমার স্বর্গত শ্বশুর মশাইয়ের সম্পত্তি নয়,
সেটা কে বোঝাবে। তাও ট্যাক্সি ড্রাইভার বেশ ভালোই চালিয়েছিল। আমরা ঠিক পৌনে আটটায়
হাওড়া ষ্টেশন পৌঁছলাম, পোঁছে দেখি চোখের সামনে দিয়ে কালকা বেরিয়ে যাচ্ছে।” “ঈশ।
আমি হলে তো কাঁদতে লাগতাম।” “ঐ তো। আমার গিন্নীও তাই করল। আগে আমার গুষ্ঠি উদ্ধার
করল, তারপর রেল কোম্পানির। তাতেও যখন হল না, তখন কাঁদতে লাগল।” “ তা তো কাঁদবেই
বাবা। অনেক দিন আগের কথা না? আপনার স্ত্রী তখন নিশ্চয় নবঢ়া ছিলেন।” “ কে বলল
তোমায়? দু-তিন বছর আগের কথা হে। আমার ছেলে সবে জয়েন্ট পাশ করে হলদিয়া কলেজে ভর্তি
হয়েছে।” দেখলাম মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন। উনি বেশ খানিকটা গজগজ করে আবার শুরু
করলেন, “ সে কি অবস্থা। এদিকে ছেলেটা হোঁদলুর মত দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস কাঁদতে কাঁদতে
আত্মীয়স্বজনদের ফোন করছে আর আমার নামে নালিশ করছে-”। “আপনার নামে? আপনি কি করলেন?”
“ সেটাই তো। কে বোঝাবে বল। গোদের ওপর বিষফোঁড়া আমার অন্যান্য সহযাত্রী বৃন্দ।
তারাও আমায় ফোন করে ধমকাচ্ছে, যে আপনি ইচ্ছে করে ট্রেন মিস করেছেন। আপনার আমাদের
সাথে যাবার ইচ্ছাই ছিল না।” “ কি জ্বালা বাবা। ওদের এত গাত্রদাহ কেন?” “ আমার
কপাল। শোনই না, আমি এত গালাগাল খেয়েও ভেবে চলেছি, কি করে সবদিক সামলানো যায়। আগে
আমার সহযাত্রীদের বললাম, আপনারা যান, আমরা আপনাদের দিল্লীতে ধরব। তারপর আমাদের
অফিসের যে ট্রাভেল এজেন্ট আছে, তাকে বললাম, কালকে সকালেই দিল্লী যাবার তিনটে টিকিট
চাই। প্লেনে বুঝলে কি না! ওর সাথে ধার-বাকি চলে, বললাম বাপু ফিরে এসে তোর টাকা
দেব, তুই এ যাত্রা উৎরে দে বাপ। রাতে আর ফ্ল্যাটে ফিরলাম না। পড়শিদের কাছে কি করে
মুখ দেখাবে আমার গিন্নী, তাই হাওড়া স্টেশনেই একটা হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন প্লেন
ধরলাম।” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, “যাক!” ভদ্রলোক বিষণ্ণ ভাবে হেসে বললেন, “কি
যাক? কিছুই যায়নি গো। আমরা যখন দিল্লী পৌঁছলাম, কালকা দিল্লী ছেড়ে চলে গেছে।” “হে
ভগবান!” “আবার কি। তারপর দিল্লী থেকে বাস ধরে চণ্ডীগড়। রাত আড়াইটে তে পৌঁছলাম। যাক
ওখানে ওদের সাথে দেখা হয়ে গেল, বাকি ট্রিপে আর সমস্যা হয়নি।” মানতে বাধ্য হলাম, কি
অতুলনীয় ধৈর্য ভদ্রলোকের, ট্রেন ফেল করার গল্প শেষ হলে, উনি মানালি হয়ে লাদাক এবং
লাদাক থেকে কাশ্মীর হয়ে নামার গল্প শুরু করলেন। সুন্দরী লাদাকের বর্ণনা শুনে,
মোহিত হয়ে গেলাম। অফিসে নেমে দুটো মেসেজ করলাম, একটা শৌভিককে আর একটা দেবুকে,
বক্তব্য এক, “চল লাদাক যাই।” শৌভিক তো জবাব দেবার প্রয়োজনই বোধ করল না, বেলা দুটোয়
দেবুর জবাব ঢুকল, “ এত ছোট বাচ্ছা নিয়ে লাদাক যাওয়া যায় না।” চ্যাপ্টার ক্লোজড,
ভেবে দুটোকেই গালমন্দ করে, কাজে মন দিলাম।
সেদিন রাত প্রায় পৌনে এগারোটা তখন, শৌভিক
সবে ফিরে খেতে বসেছে, দেবুর ফোন, “এই শোন। উটি যাব ভাবছি, যাবি?”
(চলবে?)
No comments:
Post a Comment