চতুর্দিক সাদা। চোখ
ঝলসানো ধপধপে সাদা নয়, বরং নরম, কোমল, আরামদায়ক চোখ জুড়ানো সাদা। কি রকম যেন
ধোঁয়াটে। চোখ খুলেই হিমির মনে হল, ও নির্ঘাত হাসপাতালে আছে। চোখ বন্ধ করতেই
স্মৃতিপটে জেগে উঠল সেই দুটো চোখ। উফ! কি নির্মম, হিমশীতল, ঘন কৃষ্ণবর্ণ এক জোড়া
চোখ। বাকি মুখটা কাপড় জড়ানো, পরিষ্কার বাংলায় ওকে প্রশ্ন করেছিল।হিমি আপ্রাণ
চেষ্টা করছিল, উত্তরটা মনে করার, কিন্তু তীব্র আতঙ্ক বারবার ভুলিয়ে দিচ্ছিল
সবকিছু। উত্তরটা ওর জানা ছিল। আফ্রিকার কোন শপিং মলে ঠিক এভাবেই ওরা বহু লোককে
হত্যা করেছিল। সার দিয়ে সবাইকে দাঁড় করিয়ে, কেবল একটা প্রশ্ন করেছিল, যাতে বোঝা
যায় কারা ওদের ধর্মাবলম্বী আর কারা নয়। যারা উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছিল তাদের আর
বেঁচে থাকতে দেয়নি ওরা।
হিমির বস ওদের ধর্মানুসারী, কাগজে
আফ্রিকার ঘটনাটা পড়ে এত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল হিমি যে পরদিনই অফিসে গিয়ে বসকে
জিজ্ঞাসা করেছিল উত্তরটা। বস ভাবতে এত সময় নিয়েছিলেন যে, হিমি অসহিষ্ণু হয়ে বলেই
ফেলেছিল, “এত সময় লাগালে, ওরা আপনাকেও ছাড়বে না!” বাড়ি ফিরে নিজের বরকে আর
শিশুকন্যাকে পাখি পড়া করে শিখিয়েছিল উত্তরটা। সৌর বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “এখানে ও সব
হবে না রে বাবা। তুই নিশ্চিন্ত থাক।” তাও হিমি আশ্বস্ত হয়নি, কে জানে বাবা,
ভারতবর্ষের ওপর সকলের এত রাগ। আর আজ হিমি নিজেই মনে করতে পারছে না! কি বলেছিলেন
স্যার, নাফিসা ? নাকি আয়েশা? জবাব দিতে পারবে না হিমি, আতঙ্কের সাথে সাথে তীব্র
অভিমান ওর কন্ঠ রোধ করছিল। কেন ওরা এভাবে নির্বিচারে মানুষ খুন করছে?
খুব একটা দামি
নয় মলটা, বেশির ভাগই অফিস ফেরতা মধ্যবিত্ত, সবৎসা গৃহবধূ আর কলেজে পরা উঠতি
প্রেমিক-প্রেমিকা। হিমিও তো এসেছিল অফিস ফেরত ক্রিম কিনতে। ওর মেয়ে চিকেন ভর্তা
খেতে খুব ভালবাসে, ক্রিম দিলে স্বাদটা ভালো হয়। সবে ক্রিম এর কার্টনটা হাতে নিয়েছে
এমন সময় প্রবল শোরগোল, ফটফট করে গুলি চালানোর আওয়াজ। লুকানোর সুযোগ দেয়নি ওরা।
বাথরুম থেকে টেনে টেনে সবাইকে বার করেছে, ন্যূনতম প্রতিরোধ যারা দেখাতে গেছে গুলি
খেয়ে লুটিয়ে পড়েছে তৎক্ষণাৎ। হিমির চোখের সামনে এক প্রতিবাদী বৃদ্ধ শিখের মাথায়
গুলি করল। রক্ত আর ঘিলু ছিটকে এসে লাগল তাকে থরেথরে সাজানো সুদৃশ্য খাবার গুলির
গায়ে। থরথর করে কাঁপছিল হিমি। আত্মপক্ষ সমর্থনে কিনা জানে না, কিন্তু
উগ্রপন্থীগুলো প্রত্যেককে হত্যা করার সোচ্চারে বলছিল, এটা কিছু বছর আগে ঘটে যাওয়া
এক দাঙ্গার প্রতিশোধ। কোথায় একদল পাষণ্ড নির্বিচারে কিছু মানুষকে হত্যা করেছিল,
তার জন্য তো হিমি কোন অংশে দায়ী নয়। বরং দাঙ্গাকারীদের যখন কোর্ট কঠিন সাজা
দিয়েছিল, হিমি উল্লসিত বোধ করেছিল। যে
গণধর্ষিতা মায়ের চোখের সামনে তার শিশুকন্যাকে আছড়ে মেরেছিল নরাধম পশু গুলো তার
বেদনা এই আতাতায়ীদের থেকেও বেশি উপলব্ধি করেছিল হিমি।নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে
হুহু করে কেঁদে ফেলেছিল তার দুঃখে।
এই সব ভাবতে
ভাবতেই লোকটা এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে, পরিষ্কার বাংলায় প্রশ্ন করেছিল, উদ্যত
বন্দুক তাগ করে। হিমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “নাফিসা”। তারপরই চোখ বন্ধ করে
ফেলেছিল দম চাপা আতঙ্কে। শুধু মনে পড়েছিল পুটুস অপেক্ষা করছে।
এটা যদি
হসপিটালই হয়, তাহলে ডাক্তার, নার্স, স্যালাইন কিছুই নেই কেন? এমনকি হাসপাতালের সেই
চেনা গন্ধটাও নেই।হিমি একা দাঁড়িয়ে আছে, সকালে যা পরে বেরিয়েছিল, এখনও তাই পরে
আছে, শুধু রঙগুলো অস্বাভাবিক হাল্কা প্রায় সাদাটে লাগছে। হয়তো পারিপার্শ্বিকের
প্রভাব। কাধের ব্যাগটা নেই। ব্যাগটা কোথায় গেল? ব্যস্ত হয়ে পড়ল হিমি। সৌরকে খবর
দেওয়াটা জরুরী। অফিস থেকে বেড়িয়ে জানিয়েছিল মল ঘুরে বাড়ি ফিরবে। সৌর চিন্তা করবে।
কখন বাড়ি ফিরতে পারবে কে জানে? পুটুসের মাসির বাড়ি যাবার সময় হয়ে এল কি? কটা দেখতে
গিয়ে দেখে হাতে ঘড়িটা নেই। কোথায় ফেঁসেছে ও।
চারিপাশ যেন
সাদা মেঘে ঢাকা, না জানি কতক্ষণ ধরে ঘুরছে হিমি, একটাও চেনা লোক দেখতে পেল না।
উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে, মনে হাজার প্রশ্ন জবাব দেবার কেউ নেই। ভুল বললাম, চারিদিকে
অগণিত মানুষ। অথচ কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সবাই কি মৌন ব্রত ধারণ করল নাকি?
রিমি একাধিক লোককে জিজ্ঞেস করল, কেউ বলতে পারল না ও কোথায় আছে। সবথেকে আশ্চর্যের
কথা হল, এখানে নানা প্রজাতির মানুষ আছে, কেউ শ্বেতাঙ্গ, কেউ বা কৃষ্ণাঙ্গ, কেউ পীত
বর্ণ, কারো ছোট চোখ থ্যাবড়া নাক আবার কারো শরীরে খাঁটি আর্য রক্ত সোচ্চারে নিজের
উপস্থিতি ঘোষণা করছে। মূল্যবান জামাকাপড় পরা মানুষ ও যেমন আছে তেমনি লেঙটি পরা
লোকজনেরও অভাব নেই।এমন কি আলখাল্লা পরা আরব দেশীয় লোক ও আছে। হিমি যাকে যে ভাষাতেই
প্রশ্ন করুক না কেন, সকলেই বাংলায় জবাব দিল। কেউ বলতে পারল না ও কোথায় আছে। কেউ
জানে না। পুটুস বারন্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মা কখন আসবে আর পুটুসের মা পথ
হারিয়ে ঘুরে মরছে, বুক ফাটা কান্না এত ক্ষণে গলা চিরে বেরিয়ে এল। “আ- হা-হা-হা”
করে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে হিমি। গ্রাম্য মহিলাদের মত বুক চাপড়ে চাপড়ে “পুটুস-
পুটুস রে” বলে, হঠাৎ এক স্নেহময় হাতের স্পর্শে চমকে উঠল।
সাদা বোরখা
পরা এক মধ্যবয়সী মহিলা, পাকিস্তানী বর্ষীয়সী অভিনেত্রী সামিনা পিরজাদার মত দেখতে,
ওর পাশে বসে ওর পিঠে হাত বোলাচ্ছে। দেখে ভারতীয় মনে হয় না, মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দা
বোধ হয়। হিমি অশ্রু সজল চোখে তার দিকে তাকাল, মহিলা বাংলায় বলল, “কাঁদে না বেটি।
কাঁদে না। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে। প্রিয়জনেদের জন্য দিল খুব দুখবে। ভুলে যাবার
চেষ্টা কর। না হলে এগোতে পারবে না। এখানেই আটকে থেকে যাবে।” কি ভুলে যাবে? হিমি
আবার জিজ্ঞাসা করল, “ আমি কোথায় মা? এটা কোন জায়গা?” মহিলা করুণ ভাবে বলল, “এটা
কোন জায়গা আমিও জানি না। মৃত্যুর অব্যবহিত পরে আমাদের এখানে আসতে হয়। জাগতিক টান
যতদিন না কাটে আমরা এখানেই থেকে যাই। তারপর কোথায় যায় জানি না। বেহেস্তে নাকি দোজখে,
নাকি আবার পৃথিবীতে ফিরে যায় তাও আমি জানি না। যারা এখান থেকে চলে যায় তারা আর
ফিরে আসে না।” হিমির অবিশ্বাসী মন, বেদনাতেও হেসে উঠল, পাগল মহিলা। মহিলা বেদনার্ত
চোখে তাকাল, “ না মা। এখানে কেউ পাগল নয়। তবে যারা নতুন আসে তারা কেউ বিশ্বাসই
করতে পারে না, যে তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।” সদ্য মৃত শব্দটা তপ্ত সীসার গুলির মত
হিমির কানে প্রবেশ করল। হিমির মন চিৎকার করে উঠল, না না না। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “
মা প্লিজ বল কি করে বাড়ি যাব? বাড়িতে আমার ছোট্ট মেয়েটা--” গলা বুজে এল হিমির। মহিলা
অল্প হাসলেন, কান্নার চেয়েও করুণ সে হাসি। “ বাড়ির জন্য আমারও বড় মন কেমন করে রে।
কবে এসেছি, আজো পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারলাম না। জানিস আমাদের দেশে বড় যুদ্ধ চলছে।
বারো মাস গুলি গোলা চলে, বোমা ফাটে, আকাশে বোমারু বিমান চক্কর কাটে। বেওয়া আমি এরই মাঝে কত কষ্ট করে মেয়েটাকে বড় করলাম। বিয়ে
দিলাম অথচ সেই মেয়ে আমার তালাকশুদা হয়ে ফিরে এল দু-দুটো বাচ্ছা নিয়ে। যুবতী মেয়ে
আমার, তায় রূপবতী, চারিদিকে কাক চিল উড়ছে, আইনশৃঙ্খলার বালাই নেই। দুশ্চিন্তায় ঘুম
আসত না। একদিন রাতে বুকে অসহ্য বেদনা, জ্ঞান হারালাম। চোখ খুলে দেখি এখানে। কত
কেঁদেছি জানিস? বুড়া বাবা না থাকলে কি হত কে জানে? নতুন যারা আমার বা তোর মত
দিশেহারা হয়ে পড়ে, বুড়া বাবাই তাদের সাহারা।”
মহিলা কিছুই
বলতে পারবে না বুঝতে পেরে হিমি ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। মহিলা ওকে জড়িয়ে ধরে বসে
রইলেন। মাথায় আলতো আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, হঠাৎ কাকে দেখে যেন বলে উঠলেন, “
খুব কাঁদছে। নতুন এসেছে তো। আপনিই পারবেন সামলাতে বুড়া বাবা।” মহিলার বুক থেকে মুখ
তুলে হিমি অত দুঃখেও হেসে ফেলল। সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে আদৌ বুড়ো নয়। কত হবে বছর
পয়তাল্লিশ, মাথায় ছয় ফুট তো বটেই। গৌর বর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, ঠোঁটের ওপর পাতলা
প্রজাপতি গোঁফ। রীতিমত সুদর্শন। কিন্তু কি পরেছে রে বাবা? মাথায় চকচকে পাথর বসানো
উষ্ণীষ, গায়ে সিল্কের ঝলমলে জোব্বা, তলায় চুড়িদার, কোমরে নাচের সময় মেয়েরা যেমন
পরে তেমনি সোনালি রঙের কোমরবন্ধনী, তাতে আবার একটা সুদৃশ্য তরোয়ালের খাপ ঝোলানো
আছে। যদিও খাপটা খালি।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment