Thursday 7 July 2016

অনির ডাইরি ৭ই জুলাই, ২০১৬


[৬ই জুলাই এর পর থেকে]
করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভূয়সী প্রশংসা শুনেছিলাম বহুজনের মুখে, এ ট্রেন নাকি কখনও বিলম্বে পৌছায় না। নিজের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই চেন্নাই সেন্ট্রালে পৌঁছে দিল করমণ্ডল। আমাদের মস্তকে বজ্রাঘাত, পরবর্তী ট্রেন নীলগিরি এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা রাত সোয়া নটায়। এতক্ষণ আমরা করব কি? চেন্নাই পৌঁছে কি করা যায়, এই নিয়ে অবশ্য জল্পনাকল্পনা সেদিন সকাল থেকেই চলছিল। একবার ভাবা হল, যে কোন হোটেলে একটা ঘর নিয়ে আপাত সন্ধ্যা যাপন করা হবে, পরে ঠিক হল, একটা গাড়ি ভাড়া করে মেরিনা বিচটা ঘুরে আসা যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না। বাতানুকূল প্রিপেড ওয়েটিং রুমেই আমরা কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যাটা। ঝকঝকে ওয়েটিং রুম, মুহূর্তে মুহূর্তে সাফাই কর্মীরা সাফ করে দিয়ে যাচ্ছেন, এমনকি শৌচাগারও তকতক করছে। মহিলা শৌচাগারের সামনে একটা লম্বা খোলা বারন্দা, সেখান থেকে এক নজরে অনেকটা শহর দেখা যায়। আপাত দৃষ্টিতে বেশ গোছান শহর, বাস-অটো এবং তাদের আরোহীগণ সকলেই বেশ নিয়মানুবর্তীই মনে হল। কোন ভাবেই অফিস টাইমের কলকাতার সাথে এই শহরকে মেলাতে পারলাম না। আমার মুগ্ধতা দেখে দেবু পত্নী অন্বেষা বলেই ফেলল, “ দক্ষিণ ভারত খুব পরিষ্কার অনিন্দিতা দি। উত্তর ভারতের সাথে একে মেলাতে চেষ্টা কর না।”
দক্ষিণ ভারতের আর একটা বড় সমস্যা হল ওঁদের খাদ্যাভ্যাস। যা শুনেছি ঐ টক ইডলি-ধোসা-ভন্ডা খেয়েই কি কাটাতে হবে আগামী কয়েক দিন। সেদিন রাতে অবশ্য আমরা বিরিয়ানি খেয়েছিলাম। চেন্নাই স্টেশনের বিরিয়ানি রীতিমত দেবভোগ্য বস্তু। তবে আদতেই কলকাতার বিরিয়ানির মত নয়। আর পরিমাণেও একটু কম। ওঁরা দেখলাম বিরিয়ানির সাথে রায়তা, স্যালাড এর সাথে সাথে কৌটো করে একটা গ্রেভি দেয়। ভেবেছিলাম রায়তা হয়তো মাত্রাতিরিক্ত টক হবে, আশ্চর্য হলাম, বেশ মিষ্টি মিষ্টি খেতে। যদিও সেরাতে কেউই গ্রেভিটা চেখে দেখার সাহস দেখায়নি।
পরদিন ভোর বেলায় নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা আগেই নীলগিরি এক্সপ্রেস আমাদের পৌঁছে দিল মেটুপাল্লাম স্টেশনে। ছটা বাজব বাজব করছে, তখনও সূর্য ওঠেনি, মেঘলা প্রভাতের ঘোলাটে আলোয় মনটা ভরে গেল। আগের দিন রাতেই বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে, ভেজা ভেজা স্টেশন, সদ্যস্নাত ঘন সবুজ গাছপালায় ঘেরা, দূরে নীলগিরি পাহাড়ের অবয়ব ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। মেট্টুপাল্লাম থেকে টয় ট্রেনে যেতে হয় উটি। দূরত্ব মাত্রই ৪৬ কিলমিটার। গাড়িতে যেতে লাগে দুঘণ্টা। আর টয় ট্রেনে প্রায় সোয়া পাঁচ ঘণ্টা। ১৯০৮ সালে ব্রিটিশরা বানিয়েছিল এই লাইন। তারপর থেকে এর যথাবিহিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলেও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হয়নি। এমনকি স্টেশনগুলিও সেই ঔপনিবেশিক জমানার ঐতিহ্যবাহী। ইউনেস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দিয়েছে। নীলগিরি পাহাড়কে বেষ্টন করে, অজস্র ছোট বড় টানেলের মধ্যে দিয়ে কু-ঝিকঝিক করতে করতে গজেন্দ্রগমনে চলে এই রেলগাড়ি। সবথেকে মজার ব্যাপার হল, এই গাড়ির ইঞ্জিন এর সামনে থাকে না। পিছন থেকে ঠেলে নিয়ে যায়, একদিকে ঘনজঙ্গল, ওপর দিকে খাদের মধ্যে দিয়ে। কপাল ভাল থাকলে পথে বেশ কিছু জীবজন্তুরও দেখা মিলতে পারে। আর একটা মজার ব্যাপার আছে, আরোহীদের সামান্য অনুরোধেই দাঁড়িয়ে যায় এই ট্রেন। আপনি নেমে নৈঃস্বর্গিক সৌন্দর্যের স্বাদ গ্রহণ করে, প্রাণ খুলে ছবি তুলে যতক্ষণ না আবার সওয়ার হচ্ছেন, দাঁড়িয়েই থাকে এই খেলনা রেলগাড়ি। আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রতিটি আরোহী যতক্ষণ না ট্রেনে উঠছেন এক পাও নড়ে না এই গাড়ি। যাত্রীদের সেলফি তোলার আদিখ্যেতা দেখে শুধু মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে হুইসিল বাজায়। কুন্নুর পর্যন্ত কয়লার ইঞ্জিন, কুন্নুর থেকে উটি ডিজেল ইঞ্জিন টানে। এই ট্রেনে গার্ড সাহেবের কোন খাস কামরা নেই, ট্রেনের একদম অগ্রে আছে কেবল একটি বারন্দা, প্রায়শই সেখানে আরোহী বিশেষত আরোহিণীরা উঠে সেলফি তোলেন, এবং গার্ড সাহেব বিনা বাক্যব্যয়ে নেমে দাঁড়ান।
আমাদের মত যারা কালকা থেকে সিমলা টয় ট্রেনে গেছেন, তারা এই দুই টয় ট্রেনের মধ্যে কোন মিল পাবেন না। সিমলার টয় ট্রেন অনেক বেশি রাজকীয়। হয়তো সিমলা উপনিবেশিক ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল বলেই, ওখানে প্রথম শ্রেণীতে চা এবং প্রাতরাশ তথা রাতের ট্রেনে নৈশাহার সরবরাহের অত্যন্ত সুব্যবস্থা থাকে। সিট গুলিও রিক্লাইনিং কৌচ, অর্থাৎ আপনি আরাম করে বসতে পারবেন। কিন্তু এখানে শক্ত সোফার মত লম্বা লম্বা সিট, প্রতিটিতে সিট নাম্বার ফেলা আছে। প্রতিটি সোফায় চার (নাকি পাঁচ?) জন করে বসার কথা। কামরায় উঠেই মন খারাপ হয়ে গেল, আমাদের অংশে মুখোমুখি আট (নাকি দশ?) জনের বসার কথা। এত গাদাগাদি করে বসা যায়? তারওপর এত ভোরে উঠলাম, সকাল সাত টায় ছাড়ার কথা, এরা কি কিছুই খেতে দেবে না? লক্ষণ সুবিধের লাগল না, সবাই দেখলাম স্টেশন থেকে ইডলি-ভণ্ডা কিনেই খাচ্ছে, শেষে দেবু আর শৌভিক গিয়ে রেল ক্যান্টিন থেকে শিঙারা আর কফি নিয়ে এল। আজব দেখতে শিঙারা গুলো, অনেকটা তেকোনা প্যাটিসের মত চ্যাপ্টা, আমাদের শিঙাড়ার প্রায় দুগুণ, কিন্তু ভিতরে আলু পেলাম না, কেবল পেঁয়াজ ভাজা ভর্তি। মনে হচ্ছিল পেঁয়াজ ভাজা দিয়ে কড়কড়ে করে ভাজা পরোটা খাচ্ছি। শত অনুরোধেও অন্বেষা ঐ শিঙারা দাঁতে কাটল না। পাগল, পাঁচ ঘণ্টা পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, পথে কোথাও শৌচাগারের চিহ্ন ও পাব কি না সন্দেহ।
কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় ট্রেন ছাড়ল, দক্ষিণ ভারতে কি কোন ট্রেন লেট করে না? কে জানে? ঈশ্বরের দয়ায় আমাদের কামরায় কেবল এক সদ্য বিবাহিত তামিল দম্পতি ছাড়া আর কেউই উঠল না। আমাদের কামরাটা ঠিক গার্ডের বারন্দার পিছনেই ছিল, অর্থাৎ সবার আগে। নিজ নিজ আসনে না বসে আমরা প্রায়ই উঠে দাঁড়িয়ে সেই অবর্ণনীয় নিস্বর্গের স্বাদ নিচ্ছিলাম। চারদিকে ঘন এলাচের জঙ্গল, মাঝে একাকিনী সরু রেল লাইন। কত যে অজস্র বর্ণের ফুল ফুটে আছে, মনে হবে যেন কোন দক্ষ মালির হাতে লাগানো। ঝিকঝিক করে হেলতেদুলতে চলছে ট্রেন, পথে একটা ময়ূর কোথা থেকে উড়ে চলে গেল, গাছে গাছে অজস্র বাঁদর, অবহেলা ভরে তাকাচ্ছে আমাদের ট্রেনের দিকে, এমনকি পাখি গুলো ও পাত্তা দিচ্ছে না। সকলেই নিজ নিজ প্রাত্যহিক কর্মে নিরত।মাঝে মাঝেই কামরার আলো জ্বলে উঠছে, আর মুহূর্তের মধ্যেই ট্রেন ঢুকে পড়ছে এক গহিন অন্ধকার টানেলের মধ্যে। আবার কোথাও ঝমঝমিয়ে ট্রেনের পাশ দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝোরা। উত্তর বঙ্গের ঝোরা গুলির সাথে এদের কোন মিল নেই। হিমালয়ের গাম্ভীর্য বা আভিজাত্য নীলগিরির নেই। এখানের পাহাড়, ঝোরা, জঙ্গল কিছুই আপনার মনে ভয় বা সম্ভ্রম জাগায় না, বড় বেশি লাস্যময়ী নীলগিরি, নীরবে আপনাকে ভালবাসতে বাধ্য করে।
[চলবে]
#AnirDiary #AninditasBlog
https://amianindita.blogspot.in

No comments:

Post a Comment