Wednesday, 6 July 2016

অনির ডাইরি ৬ই জুলাই, ২০১৬




উটি সম্পর্কে যদিও কোন সম্যক ধারণা ছিল না, তবু দেবুর প্রস্তাবে অসম্মত হবার মত কিছু পেলাম না। তাছাড়া আমরা উভয়েই দেবুর কাছে একটা ব্যাপারে কৃতজ্ঞ। গত বছরে দেবু আমাদের একটা বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। ব্যাপারটা কি হয়, না, ২০১৪র নভেম্বরে আমাদের পুরি যাবার কথা ছিল। সেই ২০১৩র সেপ্টেম্বরে ৩দিনের শিমলা ট্রেনিং এর দৌলতে দিল্লী-আগ্রা-সিমলা ঘুরে আসার পর আর আমাদের কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। শৌভিকের বিডিও গিরি তখন পুরোমাত্রায় চলছে। প্রায় প্রতিদিনই শুনি, “ এই মাসটাই শেষ, এবার উঠেই যাব। ব্লক থেকে উঠেই বেড়াতে যাব।” করতে করতে বছর ঘুরে গেল, কোথাও আর যাওয়া হল না, শেষে হতাশ হয়ে আমরা ঠিক করলাম, পুরিই যাব। দিন পাঁচেকের জন্য পুরি থেকেই ঘুরে আসা যাক। আমাদের উভয়েরই বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করা হল, ওনারা আমাদের সাথে যেতে ইচ্ছুক কি না? আমার শ্বশুর-শাশুড়ি পত্রপাঠ সে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেও আমার বাবা-মা রাজি হয়ে গেলেন। ২৩শে নভেম্বর, ২০১৪ রাতের ট্রেনে যাওয়া এবং ২৯শে নভেম্বর শনিবার প্রাতেঃ ফেরা। সেই মোতাবেক পাঁচ দিন হোটেল বুক করা হল, ট্রেনের টিকিট, আমার ছুটি, মেয়ের স্কুল, কাজের মাসি সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। এমনকি শৌভিকের ছুটিও ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ মঞ্জুর করে দিল। জীবনে প্রথম বার সমুদ্র দেখবে বলে তুত্তুরি ও প্রবল উত্তেজিত, প্যাকিং ও প্রায় শেষ। শুক্রবার সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে ফিরে অন্তিম পর্যায়ের প্যাকিং করছি, রবিবার সন্ধ্যায় ট্রেন, শৌভিক ব্লক থেকে সবে ফিরেছে, এমন সময় বড় সাহেবের ফোন। ছুটি ক্যান্সেল নয় বটে, তবে এখন না যাওয়াই ভাল। সামারি রিভিশন চলছে, ইলেকশন কমিশন কখন কি চেয়ে বসে, এমতবস্থায় বিডিও তাঁর দপ্তরে না থাকলে কি করে হবে। শৌভিক যথাসম্ভব করুণ সুরে বোঝাতে চেষ্টা করল, বাড়িতে বউ-বাচ্চা মানসিক ভাবে বেড়াতে যাবার জন্য তৈরি, আর অফিস নিয়েও কোন সমস্যা হবে না। প্রয়োজনে দুরাভাসের মাধ্যমেই ও সব রিপোর্ট পাঠাতে পারবে---। কোন লাভ হল না। শেষ মুহূর্তে বিরাট টাকা গুনাগার দিয়ে ট্রেনের টিকিট গুলো কান্সেল করা গেলেও, হোটেল বুকিং কান্সেল হল না। ওরা লিখে দিল, এক বছরের জন্য বুকিং পিছিয়ে দেওয়া হল।  এক বছরের মধ্যে যে, কোন সময় আমরা যেতে পারি। তবে কোন টাকা ফেরত ওরা দেবে না। নভেম্বর থেকে আমরা ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করছি, পুরী যেতেই হবে, কিন্তু শারীরিক কারণে আমার বাবা-মা আর কিছুতেই যেতে রাজি হলেন না, বহু কাকুতিমিনতি করেও লাভ হল না। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি টপকে এপ্রিল- মে মাস এসে গেল, ওঁদের সিদ্ধান্ত বদল হল না। কি হবে? পাঁচ দিনের জন্য একটা গোটা ঘরের ভাড়া গোনা হবে, অথচ সেই ঘরে কেউ থাকবে না? অগত্যা শৌভিক বলল, দুজনেরই বন্ধুবান্ধবদের বলে দেখা হোক, যদি কাউকে না পাওয়া যায় তাহলে সেই আপনি আর কপনিই ভরসা। শেষ পর্যন্ত সে যাত্রা দেবু আমাদের উদ্ধার করেছিল।
দেবুর ফোনটা সেদিন রাতে যখন এল, তখন আমরা নৈশ ভোজ সারছি, উটি সম্পর্কে আমার বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। দেবু স্পষ্ট জানাল, “ দেখ আমরা করমণ্ডল এক্সপ্রেস ধরে চেন্নাই যাব, করমণ্ডল চেন্নাই পৌছয় বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, সেখান থেকে রাত নটা নাগাদ নীলগিরি এক্সপ্রেস ছাড়ে, পর দিন ভোর বেলা পৌছয় মেট্টুপাল্লাম। মেট্টুপাল্লাম থেকে টয় ট্রেনে উটি। রাজি আছিস তো বল?” আমি সবে তেই রাজি, গৃহকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মুহূর্তের জন্য নাক সিটকে, কাঁধ ঝাঁকালেন, অর্থাৎ যা ভাল বোঝ কর। দেবু কে জানিয়ে দিলাম, আমরা যেতে রাজি।
আমাদের ট্রেন ২৬শে জুন দুপুর বেলা ২।৫০এ। মাঝের কয়েকটা মাস, নির্বাচন এবং অন্যান্য উত্তেজনায় কেটে গেল, ২৪শে জুন  অফিস  থেকে ফিরবার সময় বাসে জানালাম, আগামী কয়েকদিন থাকছি না। জনৈক উৎসুক সহযাত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাবেন? বললাম, শুনে উনি খুশি হয়ে বললেন, “ বেশ মোটা গরম জামা নিতে ভুলবেন না কিন্তু।” গরম জামা? গরম জামা কেন নিতে যাব খামোখা? কলকাতা গরমে সিদ্ধ হচ্ছে, গুগল বলছে উটির সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাত্র ২০ ডিগ্রী, ঐ তাপমাত্রায় বাচ্ছার একটা ফুলহাতা জামা নিলেই তো হয়? অবিশ্বাসীর সুরে প্রশ্ন করলাম, “আপনি কবে গিয়েছিলেন, মানে কোন ঋতুতে?” উনি মাতব্বরি ঢং এ বললেন, “ঘোর গরমে। ভাল কথা বলছি, না শুনলে বাচ্ছা নিয়ে বিপদে পড়বেন।” প্যাকিং প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাও তুত্তুরির একটা ফুলহাতা সোয়েটার নিলাম, আমার চাদর, শৌভিকের গুগুলের ওপর অখন্ড বিশ্বাস, তাই ওর কিছুই নেওয়া হল না। ফুল হাতা শার্টই নাকি যথেষ্ট। রবিবার বেলা এগারোটার মধ্যেই দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষ করে গড়াগড়ি খাচ্ছি সকলে, ভাবলাম, অন্তিম মুহূর্তে একবার ফেসবুকটা দেখেই নি, বন্ধুরা কে কি করছে, পড়তে পড়তে দেখি, আমারই এক সহপাঠী উটির ছবি লাগিয়েছে, মোবাইলের ছোট স্ক্রীনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিছু না বুঝলেও একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, ওঁরা সপরিবারে মোটা মোটা উলের সোয়েটার, জ্যাকেট পরেছে এবং তার ওপর চাদর জড়িয়েছে। সর্বনাশ, চুলোয় যাক দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা, ট্রেনে ঘুমোবার অনেক সময় পাব, আগে গরম জামা গোছাই। অতঃপর পুনরায় দৌড়াদৌড়ি, নতুন করে সব প্যাকিং করে যখন আমরা তালাচাবি মেরে ওলায় উঠলাম, ঘড়ির কাটা দেড়টা ছুঁইছুঁই।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment