( ১০ ই জুলাইয়ের পর)
দৌড়ে যখন গাড়িতে উঠলাম, ততক্ষণে সব কটা ছাতার হাল কাহিল। আমরাও বেশ ভালই ভিজে গেছি, কিন্তু মজার কথা হল বৃষ্টিটাও ধরে গেছে। পরবর্তী গন্তব্য পাইকারা লেক। জঙ্গলের মধ্যে বিশাল হ্রদ। উটি এলে পাইকারা লেকে বোটিং করা অবশ্যকরণীয় । আমরা ছয় জন, একটু বেশি টাকা দিয়ে আট সিটার বোট বুক করা হল। কাউন্টার থেকে জানাল বোটটি আপাতত যাত্রী নিয়ে হ্রদ পরিভ্রমণে গেছে, মিনিট বিশেক দাঁড়াতে হবে।
পাইকারা লেকের সামনে একটা ছোট্ট ঢাকা দেওয়া ক্যাফে আছে। হিহি করতে করতে সেখানই ভিড় জমালাম আমরা। বৃষ্টি না হলেও হ্রদ থেকে উঠে আসা কনকনে হাওয়া হাড় পর্যন্ত কাঁপিয় দিচ্ছিল। ধূমায়িত নীলগিরির কফিও গা কাঁপুনি বন্ধ করতে পারছিল না। মিনিট বিশেক অপেক্ষা করার পর শৌভিক বলল, “নাঃ জেনে আসি বোটটা এসেছে কি না।” জেনে আবার আমাদের ডাকতে আসবে? অগত্যা বাকিরাও ওকে অনুসরণ করলাম। টিকিট কাউন্টারে কেউ কিছু বলতে পারল না, বোট কোথায়, কখন আসবে- শৌভিকের ইংরাজি, হিন্দি সবই ব্যর্থ হল, অবশেষে দৈহিক বিভঙ্গের দৌলতেই হয়তো, কাউন্টার ক্লার্ক কি বুঝল জানি না, ঠেট তামিলে (তামিলই হবে!) কিছু বলে, ইঙ্গিতে দেখাল, বোট চড়তে হলে জেটিতে যাও। কাউন্টারেই যদি এই হাল হয় তো জেটিতে কি হতে পারে সহজেই বোধগম্য। জেটিতেও ঐ একই ঘটনার পুনরাভিনয় ঘটতে দেখা গেল। যত বলা হল, আমরা স্বতন্ত্র ভাবে নৌবিহার করব বলে, এক গাদা গাঁটগচ্চা দিয়ে এইট সিটার বোট বুক করেছি, ততো তামিল মাঝি (মাঝি ছাড়া আর কি বা বলা যায়?) হাত-পা মাথা নাড়ে। শেষে হতোদ্যম হয়ে মাঝির ইশারা মত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল ঢাকা বোটেই চড়া হল। আমাদের সমগ্র দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের সবথেকে হতাশা জনক অধ্যায় ছিল এই পাইকারা লেকে বোটিং। বিশেষ করে ৯ মাইলে ঐ দুরন্ত অভিজ্ঞতার পর প্রত্যাশাও ছিল অনেকটাই বেশি। বোটের খোলের ভিতর দিকে জানলা দিয়ে প্রকৃতি দর্শন আদৌ আমাদের মন ভরাতে পারল না। বোটের খোলা অংশে যাবার চেষ্টা করলেই মাঝি বাবু তার মাতৃ ভাষায় ধমক দিচ্ছিলেন, ঘোরাবার কথা ছিল বিশ মিনিট, দশ মিনিট চক্কর কেটেই বোট ফিরে যেতে উদ্যত হল, আমাদের সব উত্তেজনা ততক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমরা কিছু না বললেও সহযাত্রী স্থানীয় লোকজন চিৎকার করতে লাগল, মাঝিও ততোধিক সেয়ানা, কিনারায় গেল না বটে তবে বাকি দশ মিনিট শম্বুক গতিতে পাড়ের কাছেই ঘুরতে লাগল। বিরক্ত হয়ে বোট থেকে নেমে মনে হচ্ছিল, এবার ফিরে গেলেই হয়, কিন্তু ড্রাইভার সাহেব অনুরোধ করলেন, পাইকারা ফলসটা দেখে যাবার জন্য। প্রাকৃতিক ঝর্না নয়, স্থানীয় হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্টের জলাধার থেকে ছাড়া জলে তৈরি। নিমরাজি হয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে করতে চললাম আমরা।
গাড়ি যেখানে নামাল, সেখান থেকে পাঁচশ মিটার হেঁটে যেতে হয় পাইকারা ফলসে। উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা, বেশ ফাঁকা, আমাদের মত এক আধজন টুরিস্ট ছাড়া প্রায় কেউই নেই। পথের এক ধারে ফাঁকা ফাঁকা জঙ্গল, অপরদিকে নিচু উপত্যকা, সেখানে গরু চড়ছে মৃদু মন্দ হাওয়া দিচ্ছে, হাঁটতে মন্দ লাগছিল না। পাঁচশ মিটার শেষ হলে টিকিট কাউন্টার, সেখান থেকে চওড়া চওড়া সিঁড়ির ধাপ নীচে নেমে গেছে, পাশেই একটা জলাধার, নতুনত্ব কিছুই নেই, বেশ খানিকটা নেমেও কোন জলপ্রপাতের চিহ্ন চোখে পড়ল না। রেগে আমি আর অন্বেষা ঠিক করলাম আর নামবই না। আকাশ মেঘলা, কখন আবার বৃষ্টি আসে, এই দেখার জন্য সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। দেবু তবু আশাবাদী, আর একটু নীচে নামলে কি কিছুই দেখা যাবে না? জলপ্রপাত যখন, জলটা নিশ্চয় কোথাও না কোথাও পড়বে। পুটপুটকে কাঁধে চড়িয়ে কয়েক ধাপ নেমে দেবু সহর্ষে বলল, “নেমে আয়। আছে! আছে!” শৌভিক ছবি তুলছিল, ও আগে দৌড়ল, পিছু পিছু বাকিরা। নেমে চূড়ান্ত হতাশ হলাম, শিশু জলপ্রপাত, উচ্চতা ফুট খানেক মাত্র।
বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে আমরা সবে ফিরব বলে ঘুরেছি, ঝমঝম করে বৃষ্টি, তেমনি জোর হাওয়া। ছাতা গুলো মটমট করে আমাদের মাথার ওপরেই ভেঙে গেল, জনবিরল জঙ্গুলে এলাকা, কাছাকাছি কোথাও দাঁড়াবার মত জায়গা পর্যন্ত নেই। শেষ পর্যন্ত যখন হোটেলে পৌঁছলাম, ঘড়ির কাঁটা আড়াইটে ছুঁয়ে গেছে। সকলে ভিজে চুপচুপ করছি। সবথেকে খারাপ অবস্থা জুতগুলোর। ফার্ন হিলে সাড়ে তিনটে অবধি লাঞ্চ আওয়ার, তারপর টুকটাক খাবার পাওয়া গেলেও ভরপেট লাঞ্চের আশা দুষ্কর। যে যার বর, তাকে হুঁশিয়ারি দিল, ভেজা জামাকাপড় পাল্টে মিনিট পনেরোর মধ্যেই নামতে হবে, নাহলে ফার্ন হিলের কফি শপই ভরসা। আগের দিন রাতে তুত্তুরির আবদারে, আমরা হাক্কা নুডলস আর স্প্যাগেটি খেয়েছিলাম, এত ভাল স্প্যাগেটি (উইথ পেস্টো সশ) আমি কখনও খাইনি। ঠিকই করেছিলাম, এই কটা দিন আমরা সকালবিকাল শুধুই স্প্যাগেটি খাব। পেস্টো ছাড়া বাকি সশ গুলোকেও তো খেয়ে দেখতে হবে, সে আশায় জল ঢেলে দিল শৌভিক। ও কার্ড রাইস খাবে, কার্ড রাইস ছাড়া আর কিছুই খাবে না। স্বপ্নসুন্দরী শ্রীদেবী নাকি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, উনি আজীবন শুধু কার্ড রাইস খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারেন, আর কৃষ্ণমচারী শ্রীকান্ত কোথাও বলেছিলেন উনি প্রত্যহ প্রাতরাশ সারেন শুধুই কার্ড রাইস দিয়ে, তাই শৌভিককেও খেতেই হবে। যত বোঝাই ওরে ভাই, সাদামাঠা দই ভাত, বাড়িতে মাঝে মাঝে গরমকালে আমিই বানাই, দুদ্ধর্ষ কার্ড রাইস। ঠাণ্ডা দই আর ভাত মিশিয়ে, গরম তেলে (আমি সর্ষের তেল দি, এরা নাকি জিঞ্জিরি অয়েল দেয়) শুকনো লঙ্কা, কালো সর্ষে আর কারি পাতা ফোড়ন দিয়ে ঐ ভাতে মেশানো, সাথে পরিমাণ মত নুন আর আচার মিশিয়ে নিলে খারাপ লাগে না। কিন্তু সে নাকি বাঙালি দই ভাত, শৌভিক অথেনটিক কার্ড রাইস খাবেই। অগত্যা ওকে সঙ্গ দেবার জন্য আমরাও রাজি হয়ে গেলাম, তবে কার্ড রাইস নয়, আমাদের জন্য খিচুড়ি।
পুটপুট রোজই খিচুড়ি খায়, তার অবশিষ্টাংশ দিয়েই অন্বেষার দ্বিপ্রাহরিক আহার হয়ে যায়, আজ আমি আর দেবুও তাই অর্ডার দিলাম। যথাসময়ে ধপধপে পোর্সিলিনের বাটি করে এল, কার্ড রাইস আর খিচুড়ি। পইপই করে বলেছিলাম খিচুড়িতে যেন মাখন অবশ্যই দেয়, দিয়েছে নিশ্চয়, কোন গন্ধ নেই তার। বেশ বিস্বাদ, নুন, ঝাল, মিষ্টি কিছুই বুঝলাম না। আর দই-ভাত এক চামচ খেয়ে শৌভিক বলল, “মন্দ নয়, তবে না দইয়ে কোন স্বাদ আছে না ভাতে। এমনকি নুন পর্যন্ত দেওয়া নেই। যাকগে দুদিন ধরে যা হাই ক্যালোরি খাবারদাবার খাচ্ছি আজ পেটটা একটু রেস্ট পাওয়াই ভাল।” আমার মনের কথাটা দেবুই বলে দিল, “এবেলা সিদ্ধসাদ্ধা খাচ্ছি বটে, তবে রাতে কিন্তু পরোটা আর মাটন খাওয়া হবে আগেই বলে দিচ্ছি।”
রাতে সত্যিই লাচ্চা পরোটা আর মাটন রোগন জোস খাওয়া হয়েছিল, লাল খসখসে আটার সেঁকা পরোটা, তাতে তেলের নামগন্ধ নেই আর রোগন জোস বলে যেটা দিল এক গামলা লাল ঝোলে পাঁচ পিস বোনলেস সুসিদ্ধ মাটন। খেতে একদম টিক্কা মশালার মত। শেষ পাতে একটু মিষ্টি না হলে কি বাঙালীর মন ভরে, ওঁরাই বলল, পরোটা (অর্থাৎ আটার তন্দুরি রুটি) মাংসের সাথে গুলাবজাম খেয়ে দেখতে। এক প্লেট গুলাবজাম দেড়শ টাকা, তাতে নাকি মাত্র তিন পিস থাকে। পঞ্চাশ টাকার পান্তুয়া! তার ওপর আবার ট্যাক্স, না জানি কি দেবভোগ্য বস্তুই না হবে। যখন এল সত্যি সত্যি আকাশ থেকে পড়লাম, এইটুকু ছোট্ট চার আনার সাইজের তিনটি সুজির বল চটচটে গরম রসে ভাসছে। খেতে মন্দ ছিল না, কিন্তু কমপক্ষে ছটা খেলে তবে মনে হবে একটা বাঙালি পান্তুয়া খেলাম। খাবার শেষে ওরা যখন জিজ্ঞেস করছিল, “হাউ ডু ইউ লাইক দা ফুড স্যার-” দেঁতো হাসি হেসে বললাম “ভেরি গুড”( অবশ্যই যখন আমার দিকে তাকিয়েছিল) - মন চাইলেও তো আর সর্বত্র সত্যি কথা বলা যায় না।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment