[৭ই জুলাই এর পর থেকে]
রুখতে –চলতে আমাদের টয় ট্রেন এসে দাঁড়াল, এক টানেলের মুখে। এক দিকে বিশাল খাদ, অপরদিকে খাড়া পাহাড় আর জঙ্গল। খাদের ওপারে দূরে নয়নাভিরাম মেঘ মাখা মেট্টুপাল্লাম শহর তখনও বোধহয় ঘুম থেকে জাগেনি। যাত্রীরা যে যার ক্যামেরা বার করে খচাখচ ছবি তুলতে লাগলেন। দেবুর গিন্নী অন্বেষা আর কন্যা পুটপুট বাদে আমরা সকলেই নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। ইঞ্জিন গরম হয়ে গিয়েছিল, তাই জল দিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করে আবার ট্রেন ছাড়ল। এদিকে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে নটা ছুঁইছুঁই করছে, সেই কোন সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ শিঙারা আর কফি খেয়েছিলাম, খিদের চোটে নাড়ি ভুঁড়ি হজম হয়ে যাবার উপক্রম। ব্যাগে রাখা কেক বিস্কুট দেবু বার করতেই দিল না, বরং ওর ব্যাগ থেকে বার করল মালদার প্রজাপতি বিস্কুট। সে যে কি অসাধারণ খেতে তা ভাষায় অপ্রকাশ্য। আদতে স্থানীয় বেকারি বিস্কুট, আগে হাওড়াতেও পাওয়া যেত, প্রজাপতির মত দেখতে, একটু পোড়া পোড়া, ওপরে চিনি ছড়ানো। গোটা দুই ঐ বিস্কুট আর জল খেলেই পেট ভরে যায়।
প্রজাপতি বিস্কুট দিয়ে প্রাতঃরাশ সবে শেষ হয়েছে, এমন সময়, বেলা আন্দাজ দশটা নাগাদ ট্রেন এসে থামল একটা অনামি ছোট্ট ষ্টেশনে। ছোট্ট হলে কি হবে তবে তকতক করছে, এবং একটি পরিষ্কার শৌচালয় পর্যন্ত আছে। কেউ আদৌ এই ষ্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে বা নামে বলে মনে হয় না, কারণ জায়গাটি সম্পূর্ণ পাণ্ডববিবর্জিত। ষ্টেশনের দুএকটি কর্মচারী ভিন্ন কেবল একটি স্থানীয় লোক এক ঝুড়ি আম নিয়ে বসে আছে। দেবু দেখেই চিনেছে, “ কাঁচামিঠে আম রে! খাবি না?” খাব না আবার? দেবু দৌড়ল আম কিনতে, দেবুর গিন্নী অন্বেষা, আর কন্যা পুটপুট আর আমাদের তুত্তুরি ট্রেনেই বসে রইল, আমি আর শৌভিক নামলাম আস-পাশটা ঘুরে দেখতে। কোন প্লাটফর্ম নেই, লাফ দিয়ে মাটিতে নামলাম। একটু দুরেই একটা অগভীর খাদ, খাদের মধ্যে দিয়ে ঝমঝমিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা পাহাড়ি ঝর্না। খাদের ওপর কোন মান্ধাতার আমলে পাতা মোটা মোটা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে চলে গেছে সরু রেললাইন। চারদিকে ঘন জঙ্গল, কেবল ঐ ঝর্নার ধারে ঢালু পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ করা হয়েছে। কি চাষ করেছে বুঝলাম না, হয়তো চা অথবা কফি। পরে জেনেছিলাম ও গুলো নাকি গাজরের ক্ষেত। ক্ষেতের উত্তর- পূর্ব কোণে একটা বিশাল লম্বা ঘন সবুজ গাছ আর সেই গাছের নীচে একটা কাঠের বাড়ি, ঠিক যেন পটে আঁকা ছবি। কে থাকে ঐ বাড়িতে কে জানে?
আবার ট্রেন ছাড়ল, পরবর্তী স্টেশন কুন্নুর। কুন্নুর বেশ বড় ষ্টেশন। কুন্নুরে কয়লার ইঞ্জিন পালটে ডিজেল ইঞ্জিন লাগানো হয়। আপ এবং ডাউন দুটি টয় ট্রেনের মোলাকাত হয় কুন্নুরে। পরে জানা গিয়েছিল, যারা গাড়িতে মেট্টুপাল্লাম থেকে উটি যায়, তারা টয় ট্রেনের মজা নেবার জন্য একটা ছোট্ট সফর করে, উটি থেকে কুন্নুর পর্যন্ত। উটির প্রতিটি হোটেলের ট্রাভেল ডেস্ক থেকেই আপনাকে ঐ ট্যুরটা করতে বলবে, ওটা উটির স্থানীয় সাইট সিয়িং এর মধ্যেই পরে। কুন্নুরে পৌঁছে ডাউনের যাত্রীরা আবার আপের ট্রেনে উঠে পরে। কি ভাগ্যি কেউ আমাদের কামরায় হামলা করতে আসেনি। নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ বেলা বারোটা নাগাদ আমাদের ট্রেনটা উটি পৌছাল। ততক্ষণে বেশ ঝমঝমিয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, সাথে সাথে কনকনে হাওয়া। বাচ্ছা গুলো কে আপাদমস্তক গরম জামায় মুড়ে আমিও আচ্ছা করে চাদর জড়ালাম। উটি ষ্টেশনটা সম্পর্কে বলার মত কোন বিশেষত্ব নেই, যদিও এটাও নাকি সাহেব দের হাতে বানানো।
আমি আর অন্বেষা মালপত্র আর মেয়েদের নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শৌভিক আর দেবু গেল গাড়ি খুঁজতে। আমাদের হোটেলের নাম ফার্ন হিল স্টার্লিং রিসর্ট। স্টেশন থেকে তো বটেই এমনকি উটি শহর থেকেই বেশ দূরে। একটা অটো পাওয়া গেল, লটবহর নিয়ে তাতেই সওয়ার হলাম আমরা। বৃষ্টি আবার শুরু হওয়াতে, অটোটি প্লাস্টিকের পর্দা দ্বারা আবৃত। তারই ফাঁক দিয়ে যতটা দেখতে পেলাম বেশ ভাল লাগল শহরটাকে। ছিমছাম পরিষ্কার সাজানো- গোছান শহর। দেবু শুধু একবার ঘাড় ফিরিয়ে বলল, “ভাব, আমরা ফার্ন হিল স্টার্লিং রিসর্টে যাচ্ছি, অটো করে-।ওঁদের সিকিউরিটি গুলো চমকে যাবে মাইরি।” শৌভিক পিছন থেকে বলল, “সেটাই তো – দ্যাটস্ দা স্পিরিট।” যদিও ফার্ন হিলে পোঁছে বোঝা গেল, যে আমাদের মত বহু অথিতিই এখানে অটো করে আসে, সিকিওরিটি যথাবিহিত খাতির করেই অটোটাকে রাস্তা দেখিয়ে দিল।
ফার্ন হিলে পৌঁছে চোখ ধাধিয়ে গেল, একটা একক টিলার (পাহাড় বলাই সঙ্গত) ওপর অবস্থিত, ঝকঝকে শ্বেত অট্টালিকা। চতুর্দিক রামধনু রঙের ফুলগাছ আর ক্যাকটাস দিয়ে সাজানো। আমি ফুল বড় ভালবাসি, কিন্তু ফুলের নামের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ। বিশ্বাস করুন, পদ্ম, গোলাপ, গাঁদা জবার মত হাতে গোনা কয়েকটা ফুল বাদে বাকিদের নামই জানি না। দূর থেকে এক গোছা হলুদ ফুল দেখে বলেই ফেললাম, “ও গুলো ঠিক কুমড়ো ফুলের মত দেখতে, দেখলেই বড়া খেতে ইচ্ছে করে।” দেবু পাশ থেকে সবজান্তার মত বলল, “ও গুলো গ্ল্যাডিওলা।” আমি কিছু বলার আগেই অন্বেষা ঝাঁজিয়ে উঠল, “দেবু কিচ্ছু চেনে না। ও গুলো লিলি। হলুদ লিলি। আর ঐ লাল রঙের ফুল গুলো হল স্যাল্ভিয়া, কমলা রঙের বড় বড় ফুল গুলো ক্যানা।” কত যে ফুল চিনলাম এক দিনে, স্যাল্ভিয়া, ক্যানা ছাড়াও হলুদ লিলি, সাদা লিলি, গেজেনিয়া আরও কত কি। সবথেকে চিত্রাকর্ষক ছিল এক ধরণের ছোট ছোট ঘাস ফুলের মত ফুল, যাদের রঙ কোথাও পার্পল, কোথাও বা ধপধপে সাদা যাদের নাম আমার দিদিমণি ও জানতেন না। আর ছিল প্রচুর গাঁদা আর গোলাপের মত দেখতে ক্যাকটাস। সব মিলিয়ে বাইরে থেকে হোটেল কম, পুষ্প উদ্যান বেশি মনে হচ্ছিল।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment