অনির ডাইরি ১০ই জুলাই, ২০১৬
[৮ই জুলাই এর পর থেকে]
ফার্ন হিল হোটেল বাইরে থেকে যতটা সুন্দর, ভিতরটাও ততোধিক সুন্দর। ঘরে ঢুকে মন ভরে গেল, ঘরের একটা দিক শুধুই কাঁচের। আর সেই কাঁচের দেওয়ালের ওপারে একটা ছোট্ট ন্যাড়া ছাত। যাকে ইংরাজিতে বলে ওপেন টেরাস। ছাতে বেতের চেয়ার টেবল পাতা, আর ছাতের ওদিকে দিগন্ত রেখা পর্যন্ত শুধুই পাহাড়। ঝকঝকে, সদ্য বৃষ্টি স্নাত ঘন সবুজ পাহাড়। হিমালয়ের মত বিস্ময় জাগানো নয়, বরং বলা যায় খেলনা শিশু পাহাড়, যদিও বয়সে হয়তো হিমালয়ের ঠাকুরদাদা। পাহাড়ের গায়ে যথারীতি ধাপ চাষ করা হয়েছে। আর ধাপে ধাপে মাঝে মাঝেই এক একটা বিশাল গাছ, যথার্থই শালপ্রাংশু মহাভুজ। ঐ গাছের মাথায় মেঘগুলো যেন লুকোচুরি খেলছে। খেতে ছোট ছোট মাথা দেখা যাচ্ছিল, অর্থাৎ চাষের কাজ পুরোদমেই চলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওখানে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু বেতের চেয়ারের গা দিয়ে তখনও চুইয়ে চুইয়ে জল পড়ছে, অগত্যা আমরা দুঃখী মনে দ্বি-প্রাহরিক আহারে গেলাম।
ফার্ন হিলের ডাইনিং হলের তিনদিকই কাঁচের, বাইরে সুদৃশ্য ফুলের বাগান, সেখানেও চেয়ার-টেবল পাতা, আগুন জ্বালিয়ে বন ফায়ার বা বার-কি-কিউএর ও ব্যবস্থা আছে। ইচ্ছা হলে বাইরে হলুদ আর সাদা লিলিদের রাজ্যে বসে, পাহাড় দেখতে দেখতে খাদ্য বা পানীয়ের স্বাদ গ্রহণ করাই যায়, কিন্তু আমাদের মন্দ ভাগ্য যে এই বর্ষায় টা অসম্ভব। অগত্যা কাঁচের এপাশ থেকেই পাহাড়, বৃষ্টি আর লিলিদের আস্বাদ গ্রহণ করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। তখন প্রায় আড়াইটে বাজছে, অগত্যা লাঞ্চেও মুর্গ বিরিয়ানিই বলা হল। উটির বিরিয়ানি চেন্নাই এর থেকে খারাপ তো নয়ই বরং ভাল, তবে এখানে রায়তা আর পাঁপড় দিলেও গ্রেভিটা দেয়নি। রায়তাটাও কেমন যেন, মিষ্টি ঘন মেয়নিজের মত স্বাদ। সেদিন আর কোথাও যাওয়া হল না, দু দিন ট্রেন যাত্রার পর, সকলেই ক্লান্ত ছিল, অবশিষ্ট দুপুর টুকু ঘুমিয়ে আর বিকাল এবং সন্ধ্যাটা ছাতে ঘুরেই কেটে গেল। ঠিক হল পরদিন সকালে উটি দর্শনে বেরোনো হবে। সেই মত হোটেলের ট্রাভেল ডেস্ক এ কথা বলা হল। উটি এবং উটির আসে পাশের দর্শনীয় স্থানগুলি একদিনেও দেখা যায় তাতে হোটেলওয়ালা দের মতে সময় লাগে প্রায় আট ঘণ্টা। আবার চার ঘণ্টা করে, দুদিনেও দেখা যায়। যেহেতু আমাদের বাচ্ছা গুলো খুবই ছোটো, পুটপুটের তো এখনও তিন বছরও হয়নি, তাই আমাদের ট্যুরটাই এমন ভাবে প্ল্যান করা হয়, যে প্রত্যহই একবেলা বেড়ানো আর একবেলা রেস্ট নেওয়া যায়। তাই ঠিক হল, পরের দিন আমরা সকাল সাড়ে নটায় শুরু করব এবং লাঞ্চের আগেই ফিরে আসা হবে। বৃষ্টির ধরণ দেখে সকলেই একটু দুশ্চিন্তা গ্রস্ত ছিলাম, হোটেল থেকে বলা হল, ঐ নিয়ে চিন্তা না করতে, উটিতে এই সময় সূর্যের মুখ প্রায় দেখাই যায় না। তেমনি এখানে বৃষ্টিও দীর্ঘস্থায়ী হয় না, ফলত পর্যটকদের খুব একটা অসুবিধা হয় না।
পরদিন সকাল সাড়ে নটার বদলে বের হতে হতে প্রায় পৌনে দশটা বেজে গেল। শৌভিক আর দেবুর নির্দেশে আমরা প্রথম দিন উটি থেকে কিঞ্চিৎ দূরের দর্শনীয় স্থান গুলো দেখতে চললাম। প্রথম যেখানে এসে গাড়ি থামল, তাকে বলে ৬ মাইল শুটিং স্পট। একটা লম্বা প্রাকৃতিক লেক এঁকে বেঁকে চলে গেছে। নিরালা নিঃশব্দ প্রায় জনবিরল। লেকের শুরুর দিকে গোটা কয়েক ঘোড়া এবং সহিস দাঁড়িয়ে ছিল, যদি কোন পর্যটক ঘোড়ায় চাপে সেই আশায়, এছাড়া আমাদের মত গুটি কয়েক টুরিস্ট, যাদের কেউই বাঙালি নয়। শৌভিক এবং দেবু কিঞ্চিৎ হতাশ হয়ে বলেই ফেলল, “এ সব জায়গায় আজকাল আর শুটিং হয় না।” খানিকটা হাঁটাহাঁটি, দু চারটে ছবি তুলে আমরা ফিরে যেতে উদ্যত হলাম, ফেরার পথেই ঝাঁপিয়ে এল বৃষ্টি। ঝমঝমে বৃষ্টি নয়, ইলশেগুঁড়ি, তাতেই কোনমতে অর্ধেক ভিজে আবার গাড়িতে ওঠা।
পরবর্তী গন্তব্য চকলেট ফ্যাক্টরি। উটিতে প্রচুর চকলেট তৈরি হয়, প্রায় ঘরে ঘরেই হোমমেড চকলেটের বিজ্ঞাপন সাঁটানো। চকলেট ফ্যাক্টরিটা আসলে ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার। ছোট ছোট মডেল রাখা আছে, কোকো ফল কি রকম দেখতে হয়। দু ধরণের কোকো হয়, হলুদ(ছবিতে) অরগানিক কোকো অর্থাৎ কোন কেমিকাল সার বা কীটনাশক ছাড়া আর সবুজ (ছবিতে) সাধারণ কোকো। অনেকটা ছোট ঝুনো নারকোলের মত দেখতে, তার ভেতরে একটা জেলির মত পদার্থ থাকে আর থাকে কোকো বীজ। ফলকে চাপা দেওয়া ড্রামে ফারমেন্ট করিয়ে বীজ গুলো আলাদা করা হয়। অতঃপর সেই বীজকে রোদে শুকানো হয়। এই অবধি সব কাজ কৃষকরাই করেন। এরপর ঐ শুকনো কোকো বীজ, ঝাড়াই বাচাই করে ওনারা বেচতে আসেন ফ্যাক্টরিতে। সেখানে নাকি প্রতিটি কোকো বীজ হাতে করে দেখে বাছাই করা হয়। সেই বাছাইকৃত কোকো গুলিকে একটা মেশিনের মাধ্যমে পেসাই করা হয়, প্রথমে পাওয়া যায় কোকো বাটার, তারপর বিভিন্ন মানের কোকো পাউডার। কোকো বাটারের সাথে মিল্ক পাউডার মিশিয়ে তৈরি হয় সাদা চকলেট আর কোকোর সাথে প্রয়োজন মত গুঁড়ো দুধ আর চিনি মিশিয়ে তৈরি হয় মিল্ক চকলেট আর ডার্ক চকলেট।
দেখে শুনে, ফ্রি চকলেট খেয়ে পরবর্তী গন্তব্য ৯ মাইল শুটিং স্পট। এখানেই নাকি আমির খান আর করিশ্মা কাপুর অভিনীত রাজা হিন্দুস্তানী সিনেমার সেই বিখ্যাত গান, “ পরদেশী পরদেশী জানা নেই” র শুটিং হয়েছিল। ৬মাইলেই আমরা বেশ ভিজেছিলাম, তাই এখানে আর অন্বেষা কিছুতেই নামতে চাইল না। পুটপুটকে নিয়ে রয়ে গেল গারিতেই, আমরাও তুত্তুরিকে গাড়িতে রেখেই নেমে গেলাম। এখানে টিকিট কাটতে হয়, এবং ৬ মাইলের থেকে বেশ ভিড়, যদিও বাঙালি কেউই ছিলেন না। টিকিট কাউন্টারের সামনে কয়েকটা ধপধপে সাদা হাঁস প্যাঁকপ্যাঁক করে ঘুরছে, দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়েছিল, আকাশও কিঞ্চিৎ সাফ লাগছিল, অসহায় ভাবে শৌভিককে জিজ্ঞেস করলাম, তুত্তুরিকে নিয়ে আসব কি না? শৌভিক অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ। ও গাড়িতে কি করছে? ধরে নিয়ে আয় ওকে।” মহানন্দে মেয়ের হাত ধরে দৌড়লাম। একটা ঘন সবুজ ঘাসে ভরা ঢালু পাহাড়, একটা ভেজা পাথুরে রাস্তা দিয়ে উঠতে হয়, অনেককে অবশ্য পাশের ঘাসের ওপর দিয়েও উঠছিল। বেশ খাড়াই, তেমনি হাওয়া দিচ্ছিল, আবার শুরু হল টুপটাপ বৃষ্টি। ছাতা খুলব কি, শৌখিন থ্রি ফোল্ড ছাতা প্রায় ভেঙে যায় আর কি। খাড়াই ভেঙে যখন উঠলাম মন ভরে গেল। যতদূর দেখা যায়, গাড় সবুজ পাহাড় আর উপত্যকা। হাল্কা হাল্কা মেঘ ভেসে যাচ্ছে উপত্যকার ওপর দিয়ে। সেই নৈঃস্বর্গিক সৌন্দর্য ভাষায় অবর্ণনীয়। ইতিমধ্যে বৃষ্টিও ধরে গেছে। ছাতা গুলো মুড়ে মাটিতে রেখে সবে পাহাড়ের কিনারে ছবি তোলার জন্য পোজ দিতে যাব, আচমকা এক ধমকা হাওয়ায় মনে হল উড়ে যাব। আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা যে বাতাসের আদৌ থাকতে পারে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। হিংস্র ভাবে ধাক্কা মারছিল পাগল বাতাস, দৌড়ে পাহাড়ের মাঝামাঝি আসতে না আসতেই দমকা হাওয়া, আমাদের পিছু নিয়ে সেখানেও এসে হাজির হল, এক টানে উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল দু-দুটো মুড়ে রাখা ছাতা। তুত্তুরি মাঝখানে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল, ও দৌড়ে ছাতা দুটো ধরতে গেল তো ওকে সুদ্ধু উড়িয়ে নিয়ে যাবার তাল করল দুষ্টু হাওয়া। ভয়ে আমার কন্যা চিৎকার করতে লাগল, “মা আমি উড়ে যাচ্ছি-”। আমি বা শৌভিক ধরার আগেই হাওয়া ওকে ঠেলে দিল দেবুর দিকে, দেবু খপ করে ধরতে না ধরতেই আমরা দৌড়ে গিয়ে হাজির হলাম। ঐ মাতাল হাওয়াতেই এক চোট হাসাহাসির পর, দেবু বলল, “ওরে তোরা যে যার ছাতা ধর। নাহলে তিনটে ছাতা সমেত এ হাওয়া আমাকেই উড়িয়ে নিয়ে যাবে”। ঐ অবস্থায় শৌভিক টুপি আর চশমা সামলে গোটা কয়েক চটজলদি ছবি তুলতেই আমরা দৌড়লাম, পরিস্থিতি ক্রমশই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। আমাদের ধরার জন্য ওপর থেকে ধাওয়া করল ক্রুদ্ধ হাওয়া আর নীচে থেকে ঘন থকথকে মেঘ। ক্রমশ আমরা মেঘে ঢাকা পরে গেলাম, একহাতে তুত্তুরিকে আঁকড়ে ধরে অপর হাতে শৌভিকের হাত ধরে ঈশ্বরের নাম নিতে নিতে হুড়মুড়িয়ে নামতে লাগলাম।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment