Sunday 24 September 2023

অনির ডাইরি ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

সদ্য অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি, মুখ হাতটা ও ভালো করে ধুইনি, এক মুঠো খুচরো পয়সা, দু চারটে ভাঁজ করা ময়লার নোট আমার সামনে ফেলল তুত্তুরী। "মা এতে ১১৩ টাকা আছে, তুমি খুচরো গুলো নিয়ে আমাকে গোটা নোট দিতে পারবে?" সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন রে? আর তুই এত টাকা পেলি কোথা থেকে?" সামান্য নার্ভাস হয়ে বার কয়েক নাক চুলকে তিনি জবাব দিলেন," ওই যে তোমরা মাঝেমধ্যে টাকা দাও না, স্কুলে যদি কোন দরকার পড়ে বা কিছু কিনে খেতে ইচ্ছে করে-সেটাই জমিয়ে রেখেছিলাম। রথের দিনও কিছু টাকা পেয়েছিলাম।" 


আবার প্রশ্ন করি, "তুই এই টাকাটা নিয়ে করবি কি?" জবাব আসে, স্কুলে কোন এনজিও থেকে এসে বলেছে কিছু চাঁদা তুলে দিতে, দাতব্য বৃদ্ধাবাস বানানো হবে। যারা ১০০ বা তার বেশি তুলবে তাদের কোন ফুটবলারের অটোগ্রাফ দেওয়া হবে যেন। চোখের সামনে থেকে সরে যায় না জানি কতগুলো বছর, ভেসে ওঠে সাদাকালো কিছু দৃশ্য। এমনই একটা এনজিও এসেছিল আমাদের স্কুলেও। এমনি মাত্রা ধার্য হয়েছিল চাঁদার। মাত্রা ছাড়াতে পারলে জুটত তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অটোগ্রাফ। পেয়েও ছিলাম আমি, লম্বা সাদা কাগজে পাশাপাশি দুটো কলামে বারো জন ক্রিকেটারের নাম আর স্বাক্ষরের সস্তা ফটোকপি। আজও রাখা আছে কাগজটা, যত্ন করে হাওড়ার বাড়িতে।


খানিক কথা বলেই বুঝলাম, “আবার সে এসেছে ফিরিয়া”। বললাম, বৃদ্ধাবাসের জন্য চাঁদা তোলা তো খুব ভালো কথা, তো চাদা তুললেই তো পারিস। জমানো ব্যাঙের আধুলি খরচা করছিস কেন? "কার থেকে চাঁদা চাইব মা? কিভাবে চাঁদা চাইব মা?" কাতর স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। বাইরের ঘরে বসে সকালের বাসি সংবাদ পত্রখানা রিভিশন দিচ্ছিলেন শ্বশুরমশাই, ইশারাতে বললাম, "ধর দাদুকে।"


সঠিক পথ দেখিয়েছি, অচীরেই বুঝতে পারলাম। পিতামহ শুধু নিজে দিলেন তাই না, পিতমহীর নামেও দিলেন। সেই খবর মুঠোফোনে যখন হাওড়া পৌঁছালো, তুত্তুরীর মাতামহ জানতে চাইল, "দাদু কত দিয়েছে? আচ্ছা, ওর ডবল তুমি আমার নামে লেখো। আচ্ছা, ঠাম্মার নামেও দিয়েছে! তুমি আমার পাশাপাশি মামমাম (দিদা), দিদি (পিসি), আর লক্ষ্মীর (আয়া দিদি) নামও লেখো।" নাম লেখা তো হল, টাকাটা হাওড়া থেকে আসবে কি করে? দাদু উদার স্বরে বলল, " তোমার মাকে দিয়ে দিতে বল। হাওড়া এলে আমি দিয়ে দেব। এমনি দেবে না, আমার মেয়েটা যা কিপটে, বলো তোমারটাও দাদু দিয়ে দেবে বলেছে।" 


গল্প এখানেই থামল না রোজ বাড়ি ফিরি আর দেখি উত্তরোত্তর বাড়ছে চাঁদা দেওয়া লোকের সংখ্যা। তুত্তুরী মুখ ফুটে না চাইতেই বাড়ছে, শাশুড়ি মায়ের জন্য যে আয়া দিদিকে রাখা হয়েছে, তিনি দিয়েছেন। বাংলায় রান্না করে যে ছেলেটি, সে আর তার চার দিদি দিয়েছে। তুত্তুরীর মাসি, তার দুই মেয়ে, জামাই, নাতি সবার নাম লেখা রয়েছে কাগজে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চাঁদার অঙ্ক। চওড়া হচ্ছে মেয়ের মুখের হাসি। বুঝতে পারি পাশ করে গেছি পরীক্ষায়। 


দিন কয়েক পরের কথা, অফিস থেকে ফিরেছি, দেখি মেয়ের মুখ ভার। চোখ ছলছল। "তোমার কি একটু সময় হবে?" কান্না চেপে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। ১৫০ কিলোমিটারের দৈনন্দিন যাতায়াত, গুচ্ছের দপ্তরী ঝামেলা আর জটিলতায় জেরবার হয়ে বিকট তিতকুটে মুডে সদ্য বাড়িতে পা রেখেছি। কয়েক মুহূর্ত আগেও শারীরিক ক্লান্তি আর মানসিক তিক্ততায় ভেঙ্গে পড়তে চাইছিল শরীর, মেয়ের অবস্থা দেখে কোথায় যেন উবে গেল সব ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা। অফিসের ঘেমো পোশাক, নোংরা হাতপায়েই ধপ করে বসে পড়ি, "কি হয়েছে বাবু?" বিশদে শুনি, শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছে তুত্তুরীর ক্লাশ। তাতে আমন্ত্রণ জানানো হবে স্কুলের সব স্যার আর ম্যাডামদের। ছাত্রছাত্রীদের নাচ-গান-আবৃত্তি-শ্রুতিনাটকে ঠাসা জমজমাট অনুষ্ঠান। ইংরেজি-বাংলা দুটোই ভালো বলতে পারে বলে, ক্লাসের সর্বসম্মতিক্রমে এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা বর্তেছে তুত্তুরীর ওপর। কাজটা খুব পছন্দ ওর। আজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হঠাৎ তার অডিশন নিতে আসেন কোন স্যার। তিনি যখন আসেন, টিফিন খেয়ে হাত ধুতে গিয়েছিল তুত্তুরী। ক্লাস যে চার পাঁচজন ছেলেমেয়েকে সিলেক্ট করেছে, ও ছাড়া বাকিরা কপাল গুণে ক্লাসেই ছিল। তারা অডিশন দিয়েওছে, সব শেষে স্যার যখন জানতে চেয়েছেন, আর কেউ দেবে কি না, তখন কয়েকজন তুত্তুরীর নাম বলেছে, আর একজন বলেছে, "ওর অডিশন নেবার দরকার নেই স্যার, ও খুব একটা স্মার্ট নয় আর একটু তোতলায়।" সেই শুনে স্যার, আর অপেক্ষা করেননি, চলে গেছেন। 


যে মেয়েটি বলেছে,আজ সকালেও তার গুণমুগ্ধ ছিল তুত্তুরী। তার মুখে এই কথা তুত্তুরীর কাছে চরম বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। " মা তুমি বলো, আমি কি তোতলাই? ও কেন এমন করল মা?" ক্রন্দসী কন্যাকে কি বলে সান্ত্বনা দিই খানিক মাথায় আসে না। বুঝতে পারি এবারের পরীক্ষা বেশ কঠিন। "ওকে তো আমি ভালো বন্ধু ভাবতাম মা। গত বছর নভেম্বরে যখন ভর্তি হলাম, ও আমাকে ওর সব খাতা দিয়েছিল। আমিও দিই। টিফিন ভাগ করে খাই আজও -"। বলতে ইচ্ছে করে, এই তো জীবন কালিদা। এটাই মানবচরিত্র। বলতে ইচ্ছে করে, জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতি পদে তুমি এমন মানুষ পাবে। 


বলি না। কি দরকার, কয়েকটা পুঁচকে ছেলেমেয়ের ঝামেলায় নাক গলিয়ে, কি দরকার এত অল্প বয়সে মেয়ের মন বিষিয়ে দিয়ে। বরং স্বাবলম্বী হবার শিক্ষা দিই। ঢোঁক গিলে বলি, “ব্যাপারটা কি তোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ?” জোরে জোরে মাথা নাড়ে তুত্তুরী। তাহলে তো তোর জন্য, তোকেই লড়তে হবে। স্যারকে গিয়ে বলতে হবে, “আমাকে অডিশন দেবার একটা সুযোগ দিন।” তারপর উনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই মাথা নত করে মেনে নিতে হবে। ব্যাপারটা বেশ মনে ধরে তুত্তুরীর, সাময়িক ভাবে মনে হয় পাশ করে গেছি, ভুল ভাঙে, পরদিন প্রভাতে। 


ভোর বেলা ঢুলতে ঢুলতে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে যাচ্ছি, অন্যমনস্ক ভাবে তুত্তুরী বলল, “ধর মা, স্যার আমার অডিশন নিলেন, নিয়ে আমায় সিলেক্ট করলেন, তাহলে তো আমার জন্য আমার অন্য বন্ধুরা বাদ পড়ে যাবে, ওদের ও বিশ্বাসভঙ্গ হবে। তখন ওরাও তো ওদের মায়েদের কাছে আমার নামে একই কথা বলবে, তাই না?” ঘুমন্ত মস্তিষ্ককে কয়েক ঘা বেত্রাঘাত করে জাগিয়ে, সামান্য ভেবে বলি, সে সিদ্ধান্ত তো তোমাকেই নিতে হবে সোনা। যদি মনে করো, এটা তোমাকে পেতেই হবে, তাহলে লড়ো, আর যদি মনে করো, তোমার জন্য তোমার বন্ধুদের হৃদয় ভঙ্গ হবে, তাহলে লড়ো না। সমস্যাটা তোমার, তুমি যাই সিদ্ধান্ত নেবে, তাকেই আমি সম্মান করব। বিন্দুমাত্র ‘জাজ’ করব না। “থাঙ্কু মা” বলে এক গাল হেসে গাড়ি থেকে নেমে যায় তুত্তুরী। 


 দুপুর তিনটে নাগাদ সবে টিফিন বাক্সটা খুলেছি, মাসির মোবাইল থেকে উত্তেজিত তুত্তুরীর ফোন, “মা, মা আমি চান্স পেয়ে গেছি।” মেয়ের চিৎকারে বিষম খেয়ে খানিক কেশে বললাম, “আর বন্ধুরা?” তুত্তুরী বলল, “তুমি জানো, আমার জন্য ওরা কত বড় সাক্রিফাইজ করতে যাচ্ছিল, ওরা দল বেঁধে স্যারকে বলতে যাচ্ছিল, আমাদের চাই না, পুরোযাকে একটা সুযোগ দিন। যে বলেছিল আমি তোতলাই, সেও এসে ক্ষমা চাইল। আমি বললাম, ঠিক আছে, কাউকে কারো জন্য সাক্রিফাইজ করতে হবে না। চল সবাই মিলে গিয়ে স্যারকে বলি, মে দা বেস্ট ওয়ান উইন।” ফোন রেখে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই, না তুত্তুরী নির্বাচিত হয়েছে, তাই জন্য নয়, মা হিসেবে পাশ করেছি বলে। যেদিন থেকে মাতৃত্বের শিরোপা পরেছি, এটাই তো করে আসছি। কত রকম যে পরীক্ষা দিয়ে চলেছি, প্রতিটা মুহূর্তে, কখনও পাশ করছি, কখনও ডাহা ফেল। তিনি আমার সূর্য, তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলেছে আমার জীবন। প্রতিটা দিন, রাত, মুহূর্ত জুড়ে রাজত্ব করেন কেবল তিনি। আর আপনারা বলেন কেবল আজ নাকি কন্যা দিবস।

Saturday 19 August 2023

অনির ডাইরি ৬ই আগস্ট, ২০১৫

 


তখন আমি খুব ছোট, বাক্য রচনা করতে শিখেছি বটে, তবে কলম ব্যবহার করার অনুমতি পেতে আরো এক- দু বছর দেরি, বাবা  একটা মোটকা লাল ডায়েরি দিয়েছিল,  রোজনামচা লেখার জন্য।  বাবা দুঃখ পাবে বলে মাঝেসাঝে যে লিখতাম না তা নয়, তবে তাতে  ছিটেফোঁটাও মাধুর্য থাকত না।  শেষে হতাশা হয়ে বাবা ডাইরি লেখার হাত থেকে  আমায় অব্যাহতি দেয়।  হাঁপ  ছেড়ে বাঁচি।  আজ হঠাৎ  আবার নতুন করে লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে।  আসলে  “পরকীয়া” পড়ে আমার আণবিক পাঠককুলের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমি নিজেই খানিকটা  আন্দোলিত । চিন্তাসূত্র কিছুটা এলোমেলো ।  না না অনুগ্রহ করে ক্ষুব্ধ হবেন না।  শুধু আপনাদের সন্দেহ অবিশ্বাস নয়, সান্যাল বাবুর ও বিরাট অবদান রয়েছে এর পিছনে। আপনারা হলেন আমার পরম হৈতেষী পাঠক ।  আপনাদের মতামত শিরোধার্য। সুতরাং নির্দ্ধিধায় বলতে পারি  গল্পটা আধখেঁচড়া থেকে যাওয়ার জন্য দায়ী শুধুই সান্যাল বাবু। 


কিন্তু কে এই  সান্যাল বাবু ? উনি আমার সহযাত্রী ।  রোজ একই চার্টার্ড বাসে আমরা অফিস যাই।  সান্যাল বাবু বেশ মজলিসি লোক।  দরাজ গলায় প্রাণখোলা হাসি ওণার ইউ এস পি।  আমাদের বাসে নিত্যদিন ভোজ লেগেই থাকে।  এই আয়োজনের দায়িত্বে সবসময়ই থাকেন সান্যাল বাবু। আমরা শুধু টাকা দিয়েই খালাস।  খুঁজে খুঁজে কোথায় কালিকার চপ্ , পুিটরামের সিঙারা, বৃন্দবাদন গুঁই এর বোঁদে, আলিয়ার ফিরনি ইত্যাদি আনা এবং সরবরাহ করা কি মুখের কথা??  কিন্তু  সান্যাল বাবু সাগ্রহে এবং সানন্দে এই কাজটি করেন।


এ হেন সান্যাল বাবু কাল বাড়ি ফেরার সময় আমার পাশের সিটে বসেছিলেন।  সামান্য সময় ব্যাপী মুষলাধার বৃষ্টির ফলে কলকাতা প্রায়  অবরুদ্ধ  হয়ে পড়েছিল কাল।  এক ঘন্টার  পথ পেরোতে লেগে যাচ্ছিল আড়াই ঘন্টা ।  আমি দিব্যি মোবাইলে গল্প লিখছিলাম, কিন্তু  এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে সান্যাল সাহেবের বোধহয় বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।  খানিক উকিঝুঁকি মেরে বললেন,“বাঃ বাংলা টাইপ করছেন!”  হেসে মাথা নাড়িয়ে আবার লিখতে শুরু করলাম।  উনি উসখুস  করে বললেন,“ কি কাউকে টেক্সট্ করছেন নাকি?” সলজ্জ ভাবে মাথা নাড়লাম।  উনি চোখ গোলগোল করে চেঁচিয়ে উঠলেন,“গল্প লিখছেন?”  লজ্জায় বেগুনী  হয়ে সায় দিলাম।  উনি ফিস্ ফিস্ করে বললেন, “ জানেন আমিও লিখছি।  তবে আপনার মত অনুগল্প নয়।  ৬০০ পাতার উপন্যাস । ” এবার আমার চোখ গোলগোল করার পালা।  উনি সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করলেন,“কিসের  ওপর জানেন? ” কি করে জানব? উত্তর  উনিই দিলেন,“ নাৎসি হোলোকাস্ট নিয়ে।  ”


একজন বঙ্গসন্তান উপন্যাস লিখছে হলোকাস্ট নিয়ে, এককথায় অভাবনীয় ।  উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,“রিসার্চ করেছেন নিশ্চয়? ” 

“ অবশ্যই।  ছয় বছর ধরে রিসার্চ করেছি ম্যাডাম।  বহু বই পড়েছি।  নেট ঘেঁটেছি।  ৪০ টার ওপর সিনেমা দেখেছি। ”

 বললাম,  “ শ্লিনডার্স লিস্ট ?”

 উনি ফোঁৎ করে শব্দ করে বললেন,“ জঘন্যতম। একদম দেখবেন না। ” আমি দেখতে পারিনি।  ঐ বিভৎসতা  অসহনীয় বিশেষতঃ একজন মায়ের পক্ষে ।  উনি হাসলেন,“চোদ্দ  বছরের নিচের শিশুগুলোকে ওরা নেরে ফেলত ম্যাডাম।  সের্ফ মেরে ফেলত।  ১৪-৬০ বছরের নারী পুরুষ গায়ে গতরে খাটতে পারত বলে বাঁচিয়ে রাখা হত।  তাদের ও মারত তবে রয়ে সয়ে।  ” ওনার গল্পের প্লট উনি অনেকটাই বলেছেন, কিন্তু  তা আর শেয়ার করছি না।  ঈশ্বরেরদয়ায় ওনার প্রচেষটা সফল হোক।


জমা জল, গুমোট গরম, যান জট, নাগরিক কোলাহল  থেকে বহু দূরে কোথায়  যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম।  শুধু  কানে আসছিল ওনার জলদ গম্ভীর  স্বর,“ মাত্র সত্তর বছর আগে , ম্যাডাম, এত গুলো মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হল অথচ কতটুকুই বা আমরা জানি সেই নিশংসতার? আউৎসভিৎসে দৈনিক মানুষ মারার লক্ষমাত্রা ছিল কত জানেন?” একটু দম নিয়ে বললেন, “দশ হাজার”।  আঁতকে উঠলাম।  উনি বলেই চলেন, “ মারতে হত না।  ওরা নিজেরাই অনেক সময় লড়ে মরত।  দশ ঘন্টার  পাথর ভাঙা আর এক বাটি স্যুপ্। প্রাণ বাঁচাতে বা বলা যায় জঠরাগ্নি নেভাতে পুরুষ গুলো কুত্তার মত লড়ে মরত। আর মহিলারা কি করত জানেন, ওরা আপোসে ঠিক করেছিল ওরা শুধু রাতে খাবে। যাতে অন্তত ঘুমটা হয়।  আর দিনের বেলা ওরা শুধু খাবার গল্প করত।  কার বড়িতে কবে কে কি রান্না করেছে সেই গল্প করে পেট ভরাতো ওরা।” মুগ্ধতার মধ্যেই কখন আমার স্টপ এসে গেছে খেয়ালই করিনি, নামতে যাব, উনি বললেন,“ ম্যাডাম, এটা শুনে যান, একটা চোদ্দ   বছরের ছেলে গ্যাস চেম্বারে যাবার আগে কিছু কবিতা লিখে একটা কৌটো করে মাটিতে পুঁতে রেখে গিয়েছিল।  বহু বছর বাদে তা আবিষ্কৃত হয়।  তার দুটি   লাইন বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, 

 

‘আমাদের এখানে একটাও প্রজাপতি নেই।  

কি করেই বা থাকবে? সব ফুলগুলি যে আমরা উদরস্থ  করেছি—’। ”

অনির ডাইরি ১৮ই এপ্রিল, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #গুরুচন্ডালী


অতঃপর অতসী দেবী ওরফে শাশুড়ী মাতা কহিলেন," না বাপু তোমরা যতই বলো। আমি আর লোক রাখব না।" অতসী দেবীর ভার্টিগো আছে, আছে কানের সমস্যা। কান টানিলে মাথা আসার মতই বধিরতার পিছু পিছু আসিছে  ভারসাম্যহীনতা। মাঝেমধ্যেই ভূপতিত হন, চোট পান হেথাহোথা। বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই একাকী চাগিয়ে তুলিতেও পারেন না সবসময়। ভদ্রমহিলার মানসিক জোর সাংঘাতিক। ভূপতিত অবস্থায় স্বয়ং চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, প্রয়োজনে কিছুটা হামাগুড়ি দিয়াও উঠে দাঁড়ান।‌ খানিক উপরওয়ালার মুণ্ডপাত করেন, দশ-বিশ-তিরিশ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে চল্লিশ বৎসর পূর্বেও কৃত কোন অপরাধের জন্য শ্বশুরমশাইকে সামান্য তিরস্কার করেন এবং পুনরায় ব্যাপৃত হন গৃহকর্মে।


ভদ্রমহিলা রূপ এবং গুণ, দুদিকেই মা লক্ষ্মী। এই মধ্যসত্তরেও গলানো মাখন এর মতন গায়ের রং, মসৃণ ত্বক বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে গ্ল্যামার। কোমর ছোঁয়া ঢেউ খেলানো কালো চুলের ঢল, যার ফাঁকেফাঁকে উঁকি মারা রূপোর তারের মতন পক্ক কেশ গুচ্ছ, ওনার সৌন্দর্য বাড়ায় বৈ কমায় না। দাঁতগুলিও মোটামুটি অক্ষুন্ন আছে দু একটি বাদে। আর অক্ষুন্ন আছে ওনার ব্যক্তিত্ব। দুই ছেলে না ডরালেও, শ্বশুরমশাই এবং আমরা দুই পুত্র বধূ যমের মতন ভয় পাই ওনাকে। অগোচরে আমরা ওনার নাম রেখেছি, "শ্বশুরমশাইয়ের সুন্দরী প্রেয়সী।"


তো এহেন "সুন্দরী প্রেয়সী"র কাছে একটু আগেই বকা খেয়েছি আমি। ওনাকে একটা ভালো শাড়ি পরতে বলার অপরাধে। নববর্ষের সন্ধ্যা। দীর্ঘ দেড় মাস বাদে বাড়ি ফিরেছি আমরা। কর্মসূত্রে শ্বশুর মশাইয়ের দুই পুত্র মহানগর থেকে বহুদূরের দুই জেলার বাসিন্দা। দীর্ঘ অদর্শনে জমে উঠেছে গল্পের পাহাড়। জমে উঠেছে নতুন বছরের প্রথম সন্ধ্যার আড্ডাটাও। অপূর্ণতা বলতে কেবল আমার দেওর- জা আর দেওর ঝির অনুপস্থিতি। 


দিন কয়েক আগে যে আছাড় খেয়েছিলেন শাশুড়ি মা, তার সৌজন্যে একটা পায়ের পাতা এখনও ফুলে আছে। নড়তে চড়তেও সমস্যা হচ্ছে সামান্য। যদিও রান্না করা এবং বাসন মাজার লোক আছে তবুও একজন সর্বক্ষণের সঙ্গী বড় প্রয়োজন। টুকটাক সংসারের কাজ কি কম।


সেই কথাটা বলেই কেলো করেছে আমার বর। এরকম একটি মেয়েকে রাখা হয়েছিল কিছুকাল আগে, তাকে নিয়ে শাশুড়ি মাতার অভিযোগের অন্ত নেই। সে নাকি গূড়াকু বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে দাঁত মাজত এবং দেওয়ালে আঙুল দিয়ে কালো কালো দাগ টানত। উনি নিজে প্রতিদিন স্নান করতে গিয়ে স্কচব্রাইট দিয়ে তা ঘষে ঘষে তুলতেন। 


পাত্তা না দিয়ে আমার বর বলল," তা মাজতেই পারে। তুমি ফিরোজাকে নিষেধ করলেই পারতে।" আরো চটে গেলেন শাশুড়ি মাতা। ওদিকে শ্বশুরমশাই ইশারায় আমায় বলেই চলেছেন, "আর একবার বলো না যদি শাড়িটা-"। 

সত্যি আমরা সকলেই হয় নতুন, নয়তো পুরানো হলেও বাইরে পরা যায় এমন পোশাক পরেছি। কেবল ওনার পরনেই একটা ঘরে পরার ন্যাতানো শাড়ি। তাতেও বোধহয় উনি আমাদের সবার থেকে বেশি সুন্দর। বৃদ্ধের মন রাখতে বলতে গিয়েও, গিলে ফেললাম কথাটা। থাক বাবা, যার প্রেয়সী তিনি বলুন। আমার ঘাড়ে মাথা একটাই। বন্দুক আমার কাঁধে না চালান করতে পেরে, শেষে বৃদ্ধ স্বয়ং বললেন, "হ্যাঁগো, শুনছ। শাড়িটা পাল্টে এসো না।"


শ্বশুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে, এক ঝলক অগ্নিবর্ষণ করে, ন্যাতা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ গলার ঘাম মুছে, সুন্দরী বললেন," পারবো না।" অতঃপর জ্যেষ্ঠ পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,"তুই জানিস না আর কি করেছে? ইয়ে করে ইয়ে করেনি জানিস।"

কিয়ে করে, কিয়ে করেনি, প্রশ্ন করতে গিয়ে দেখি শ্বশুরমশাই দুই আঙুলে নাক টিপছেন। শাশুড়ী মাতাকে তখন থামায় কে। "এই লোকটা। এই যে এই লোকটাই সব লোককে মাথায় তোলে।" 


আমার জায়ের নাম উমা। আমি আদর করে বলি উমারানী। যুগপৎ গরম এবং ছুটি না পাওয়ার জন্য দুর্গাপুর থেকে এবার আসতে পারেনি উমা। তাই সান্ধ্যকালীন আড্ডার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে শয়তানটা। সত্বর মেসেজ পাঠালাম," বাবা লোকজনকে মাথায় তুলছে। তাই মা ক্ষেপে ব্যোম।" ওপাশ থেকে তৎক্ষণাৎ জবাব এল, " কিঃ"। পোষাকপরিচ্ছদ, জুতো সমেত চল্লিশ কেজি ওজন হলে বর্তে যায় যে লোকটা, সে কাউকে চাগিয়ে মাথার উপর তুলবে, ব্যাপারটা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য।


আরো হয়তো কিছু বলত উমা, তার আগেই বললাম, "দাঁড়া, দাঁড়া।আরেকটু কাল্টিভেট করতে দে ব্যাপারটাকে। ফিরোজা যেন কি করে, কি করেনি।" উমা বলল, "এটা জানি।" পরপরই ঢুকল 💩 ইমোজি। মনে মনে কপাল চাপড়ালাম আমি, সর্বনাশ! অতসী দেবীর পরিচ্ছন্নতা বোধ প্রবাদপ্রতিম। বেতো হাঁটু আর টলটলে ভারসাম্য নিয়েই তকতকে রাখেন সারা বাড়ি। এই বাড়িতে কোথাও নূন্যতম নোংরা পাবেন না। সেই বাড়িতে ইয়ে করে ফ্ল্যাশ না করা, নিঃসন্দেহে ফাঁসির যোগ্য অপরাধ। 


শাশুড়ি মায়ের ক্রোধ তখনও অপ্রশমিত। "ফিরোজা আমাকে মানসিক ভাবে চুরমার করে দিয়েছে। আমাকে আর লোক রাখতে তোরা বলিস না। এত বড় মেয়ে, একে তো বড় কাজ করে ফ্ল্যাশ না করা,তারওপর আবার ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় আমার তিনটে বাটি চুরি করে পালানো। বলতে পারিস স্টিলের বাটি, কিন্তু ওগুলো সব তোর অন্নপ্রাশনে পাওয়া উপহার। এত বছর আমি নিজে হাতে মেজে, ধুয়ে, শুকনো করে মুছে ব্যবহার করেছি। ঝকঝক করত বাটি গুলো -।" 


ওনার গলা ধরে যায়, জ্যেষ্ঠ পুত্রের অন্নপ্রাশনে পাওয়া তিনটি বাটির শোকে। বসার ঘরে, সাময়িক ভাবে নেমে আসে স্তব্ধতা। মাথার ওপর কেবল ঘড়ঘড়ে পাখার আওয়াজ ছাড়া কোন শব্দ নেই। মেসেজ পাঠালাম, " শাশুড়ি মায়ের চোখ ছলছল।" ফোনের এপারে আমার কন্যা তুত্তুরী আর ওপারে সুদূর দুর্গাপুরে উমা, ব্যোমকে গেল দুজনেই। শ্বশুর মশাই অকারণেই কানের লতি ধরে টানলেন কয়েকবার,তারপর গলা খাঁকড়ে বললেন, " আহাঃ আজকের দিনে ওসব কথা থাক না।" অতঃপর, ঢোক গিলে বললেন, " শাড়িটা পাল্টে এলেই তো পারো।" " ধুর বাপু" বলে সোফা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন শাশুড়ী মাতা। আরোও হয়তো কিছু জুটত অমৃতবচন, যদি না সঠিক সময়ে বেজে উঠত ফোনটা।

নববর্ষের শুভেচ্ছাজ্ঞাপক ফোন। যিনি করেছেন, তিনি শাশুড়ীমাকেও চাইলেন। " এই ফোনটায় ভালো শুনতে পাই না," বলতে বলতে ফোন ধরেন শাশুড়ী মাতা। ফোনের ওপাশের ব্যক্তি বোধহয় প্রণাম জানান। প্রাণ খুলে আশির্বাদ করেন অতসী দেবী। "ভালো থেকো। সুখে থেকো" ইত্যাদি, প্রভৃতি। থমথমে মেঘলা ছিল যে আকাশ, রৌদ্র স্নান করে পলকে। 


দরজার ঘন্টি বাজিয়ে খাবার দিয়ে যায় জ্যোমাটোওয়ালা। " কি দিয়ে গেল, ও দিদিভাই" বলতে বলতে লাফায় উমা। মেন্যু শুনে মন খারাপ করে উমা, " আমাকে বাদ দিয়ে খাবে? ইশ। কেমন খেতে গো মাছের প্রিপারেশনটা......"। 


আবহাওয়া "কখনও মেঘে ঢাকা, কখনও আলো মাখা" র মধ্যেই একসাথে নৈশ ভোজ সারি সবাই। শ্বশুর মশাই বিড়বিড় করেন, " এ সব হোটেল রেস্তোরাঁর থেকে বাড়ির মাছের ঝোল ভাত অনেক ভালো।" তর্ক জোড়ে ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্র, " তুমি কি বলতে চাইছ? তোমাদের সাকিনা (রান্নার দিদি) এর থেকেও ভালো মাছ রাঁধে? এটা ভূতেও বিশ্বাস করবে?"  রাত গড়ায়। নিশি পোহালেই মহানগর ছাড়তে হবে আমাদের, ফিরতে হবে সুদূর কাঁথি নগরীতে।  ঘুমাতে যাবার আগে বেলা শেষের গোছগাছে মন দিই আমরা। আচমকা চটক ভাঙে শ্বশুর মশাইয়ের চিৎকারে। আবার পড়ে গেছেন শাশুড়ী মা। এবার একেবারে চিৎপটাং। 


আমার বর দৌড়ে গিয়ে তুলে, ধরে ধরে সোফায় বসায়। মাথার পিছনটা পলকে ফুলে আবের মত হয়ে যায়। আতঙ্কে নড়তে পারি না আমি আর তুত্তুরী। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন শ্বশুরমশাই। অকুতোভয় কেবল অতসী দেবী। সামান্য লজ্জিত এই যা। তীব্র বেদনার মধ্যেও সংকুচিত হয়ে বললেন, " তোরা চিন্তা করিস না। পেন কিলার খেলেই সেরে যাবে।"


কি আতঙ্কে যে কাটল নতুন বছরের প্রথম রাতটা। কে জানে কি সন্দেশ বহন করে আনে ২রা বৈশাখের সকাল। সকাল হতেই ফিট অতসী দেবী। সেই শ্বশুর মশাইকে ভর্ৎসনা, সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রের সাথে দ্বন্দ্ব, দিনরাতের লোক উনি কিছুতেই রাখবেন না।সে যদি আবার ওই ফিরোজার মত গুণধরী হয়।তখন কে সামলাবে? 


সকাল গড়ায় দুপুরের দিকে, দুপুর গড়িয়ে নামে সন্ধ্যা। আমাদের প্রত্যাবর্তনের সময় সমাগত। প্রতিবারের মত আশ্বাস দিই, আমরা কেবল একটা ফোনের ওপারে। সমস্ত খুঁটিনাটি যেন রিপোর্ট করা হয় আমাদের। সামান্যতম অসুবিধা হলেও যেন জানাতে দ্বিধা না করেন বৃদ্ধ। শ্বশুরমশাই আশ্বস্ত করেন, সমস্যা দেখা দিলেই জানাবেন। আপাতত পশ্চিম সীমান্তে বিরাজমান অখণ্ড নীরবতা। আর অতসী দেবী কইলেন, " ওরে আমি ঠিক আছি,তোরা নিশ্চিন্তে যা। মাথার ফোলাটাও অনেক কমেছে। পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পাবার থেকে মাথায় চোট পাওয়া অনেক ভালো বুঝলি। কাজ করতে কোন সমস্যা হয় না।" 


এহেন অতসী দেবী ওরফে শ্বশুরমশাইয়ের সুন্দরী প্রেয়সী ওরফে শাশুড়ী মাতার ৭৫ তম জন্মদিন ছিল কাল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, খুব খুব ভালো থাকুন শাশুড়ি মাতা। সুস্থ থাকুন আর এমনিই থাকুন শ্বশুরমশাইয়ের প্রিয়তমা আর আমাদের মধ্যমণি হয়ে আরো বহু বহু বছর।

অনির ডাইরি ১৭ ই আগস্ট, ২০২৩

  

#অনিরডাইরি 


অনেকদিন পর ফোন করেছিলাম মেয়েটাকে। কর্মসূত্রে আলাপ হলেও, এককালে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলাম একে অপরের। তারপর যা হয় আর কি, দীর্ঘ অদর্শনে ধুলো জমেছে সেই সব উষ্ণ স্মৃতির সরণীগুলোয়। কি যেন ঘটনা প্রসঙ্গে হঠাৎই মনে পড়ে গেল আজ।


পুরাণ নম্বরটা দেখলাম অবিকৃত আছে। ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল ওপাশের মুঠোফোন। ভেসে এল ক্লান্ত অথচ উষ্ণ আওয়াজ,"কেমন আছেন ম্যাডাম?" হেসে জবাব দিলাম, ভালো আছি। এবার আমার কুশল সংবাদ সংগ্রহের পালা, জিজ্ঞাসা করলাম তুমি/তোমরা কেমন আছ?


দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটি বলল," আমি একদম ভালো নেই ম্যাডাম। আমার সংসার, আমার জীবন সবকিছু বদলে গেছে বিগত এক বছরে।ওলটপালট হয়ে গেছে সবকিছু। রোজ ভাবতাম, আপনাকে ফোন করব। আপনি লেখেন তো-"। 


কি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে মেয়েটা! কাঠবাঙাল, তাই বরাবরই সাংঘাতিক আবেগপ্রবণ এবং বেশ ছিঁচকাঁদুনে ছিল মেয়েটা। আপনজনদের কারো কিছু হলে আর দেখতে হত না। কেঁদে ভাসাত। তেমনি কিছু হয়েছে নিশ্চিত।কিন্তু তার সাথে আমার লেখালেখির কি সম্পর্ক? গলায় একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করি, কি হয়েছে?


মেয়েটা বলে," কাউকে বলিনি এতদিন ম্যাডাম, কি ব্যথা যে বুকে চেপে আছি। কাঁদতেও পারিনি। আপনি বলতেন না, আমি ছিঁচকাঁদুনে, গত এক বছরে এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলিনি, ফেলতে পারিনি ম্যাডাম। সব সময় উৎকণ্ঠায় থেকেছি। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে আমার বরকে পাশে না পেলেই মনে হত ওকে হারিয়ে ফেললাম বুঝি, চিরতরে।"


ধুমকে উঠি আমি, কি আজেবাজে কথা বলছ! মেয়েটা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, " হ্যাঁ ম্যাডাম। আপনাকে বলতে গিয়ে আজ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেবল মনে হত, ও সুইসাইড করল বুঝি।"  নির্বাক আমি, মাথার উপর বনবন করে ঘোরে পাখাটা, দরজা খুলে মুখ বাড়ায় সৌম্য, " ম্যাডাম, ফাইনাল পেমেন্টগুলো নিয়ে আসি?" ইশারায় বলি ৫ মিনিট, তারপর তোমায় ডাকছি।


ঘর ফাঁকা হতে গলা ঝেড়ে আবার বলি, কি যাতা বলছ? মেয়েটা বলে, " যাতা নয় ম্যাডাম, একদম সত্যি। জানেন, আমার বরের নামে থানায় নালিশ করা হয়েছিল যে, ও, ওর এক মহিলা সহকর্মীকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে--।" ঘরে সেই মুহূর্তে বাজ পড়লেও বুঝি এত চমকাতাম না। হতভম্ব হয়ে বলি কি বলছ? তোমার বর-।  কথা শেষ করতে দেয় না মেয়েটা, জোর গলায় বলে ওঠে " হ্যাঁ ম্যাডাম। গত পুজোর ঘটনা। এখন কোর্টে কেস চলছে। আমি ঠিক করেছিলাম, কেস মিটলেই আপনাকে ফোন করব।" 


কি বলি বুঝতে না পেরে নীরব থাকি। ব্যাপারটা গলা দিয়ে নামতেই চায় না,  মাথায় বসতেই চায় না। মেয়েটাও থমকে থাকে খানিকক্ষণ, হয়তো কিছুটা গুছিয়ে নেয় নিজেকে। তারপর বলে, " যে ভাষায় নালিশ করেছে ম্যাডাম, আমি আপনাকে বলতে পারব না। পড়তে গিয়ে গা গুলিয়ে বমি আসে। দৈহিক সৌষ্ঠবের এমন বাজারী বিবরণ দিয়েছে, রগরগে ভাষায় লিখেছে কিভাবে আমার বর আর ওর অন্য এক সহকর্মী মিলে ওকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে।"


"আসলে কি হয়েছে জানেন তো, বড় দাদা ধরে চাকরি পেয়েছে মেয়েটা। যখন খুশি অফিসে আসে যখন খুশি বেরিয়ে যায় একটা কাজ দিলে পারেও না, করেও না। যতক্ষণ অফিসে থাকে মোবাইলে গান শুনে আর না হলে এর-ওর টেবিলে আড্ডা মেরে বেড়ায়। ওকে বদলি করার একটা চেষ্টা কর্তৃপক্ষ চালাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। গত পুজোর আগে অর্ডারও এসে গেল অথচ মেয়েটা গেলই না। জাস্ট গেল না। এত বড় ধৃষ্টতা যে রিলিজ অর্ডারটাও নিল না। আগের মতোই নিজের ইচ্ছেয় আসত, যেত, অ্যাটেনডেন্স খাতায় সই করত। 

আমার বর একদিন রেগে গিয়ে করল কি, হাজিরার সময় উত্তীর্ণ হতেই, খাতাটা তুলে আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিল। মেয়েটা ওর সময় মতন এসে যখন দেখল সই করতে পারছে না, সোজা নিকটবর্তী আইন রক্ষকদের কাছে গিয়ে লিখিত নালিশ করে বসল। 


এই অবধি শুনেই থামিয়ে দিলাম আমি, " Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act, 2013" প্রায় কণ্ঠস্থ আমার এবং তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা বা নির্যাতন সংক্রান্ত নালিশ সর্বাগ্রে করতে হয় Internal Complaints Commttee বা ICCর কাছে। নিয়ম অনুসারে প্রতিটি অফিসে এমন একটি কমিটি গড়ার কথাও আইনেই বলা আছে। যদি না থাকে, বা যদি নালিশ খোদ নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধেই হয়, তবে তা করতে হবে জেলাশাসক কর্তৃক গঠিত Local Complaints Committeeর কাছে। তারাই সমগ্র কেসটা তদন্ত করে শাস্তি বিধান করবেন। প্রয়োজনে তাঁরাই আইন রক্ষকদের দ্বারস্থ হওয়ার  সুপারিশ করবেন। তাহলে সেই মেয়েটির নালিশ গ্রাহ্য হল কেন?


চিড়বিড়ে তিতো গলায় মেয়েটি বলল, "জানি না ম্যাডাম। হয়তো ওর দেশওয়ালি ভাই বন্ধু কেউ ছিল। সোজা কেস ঠুকে দিয়েছে।" পরক্ষণেই ভারী হয়ে আসা গলায় মেয়েটি বলে, " পুজোর আগে কার যে নজর লাগল আমার সংসারে। গোটা অফিস ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমিও। তাসত্ত্বেও এত ভেঙে পড়েছিল আমার বর কি বলব। রাতের পর রাত ঘুমাতো না, অফিস যেতে চাইত না, কুঁকড়ে বসে থাকত ঘরের এক কোণায় আর কেবল বলত, 'এই পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকারই নেই।' বলতো,' আমি মরি না কেন'। রাতের অন্ধকারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদত। কি দিন যে গেছে ম্যাডাম।"


আমি ব্যথিত। আমি নির্বাক। আমি বাকরুদ্ধ। আমি ক্রুদ্ধ। ভাঁওরি দেবী প্রকাশ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, নিজের দপ্তরী কাজটুকু করতে গিয়ে। বিচার পাননি কোথাও। ভবিষ্যতের ভাঁওরি দেবীদের নররাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১৩ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন আনে ভারত সরকার। তাও হয়তো আনত না। যদি না নতুন করে গণধর্ষিত হতো ২২ বছরের জ্যোতি সিং, যাকে তদানীন্তন ভারতবাসী আদর করে নাম দিয়েছিল নির্ভয়া। সেই আইনের অপব্যবহার মানে প্রতিটি ধর্ষিত, নির্যাতিত নারীকে পুনরায় নতুন করে, জনসমক্ষে বেআব্রু করে দেওয়া। কোন নিন্দা, কোন ধিক্কারই এর জন্য যথেষ্ট নয়।


মেয়েটি বলে, "জানেন ম্যাডাম,এখন ওই মেয়েটা চায় মিটমাট করে নিতে। আমাদের উকিলের কাছে লোক পাঠিয়ে বলেছে, ও রাগের মাথায় কাজটা করে ফেলেছে। এখন কেসটা তুলে নিতে চায়। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ব না। কিছুতেই না।একজন সমর্থ পুরুষ মানুষকে কাঁদতে দেখা যে কি মর্মান্তিক ম্যাডাম,বিশেষ করে সে যদি আপনার প্রিয়জন হয়। আমার বরের প্রতিটা ফোঁটা চোখের জল আমি ওর থেকে উসুল করব। চলুক মামলা।" 


আর আমি বলি, লড়ো। লড়ে যাও ভালোবাসার মানুষটির জন্য।  ছেড়ো না মেয়েটিকে। এই আইনের অবমাননা করার এত বড় ধৃষ্টতা হয় কি করে? এই কেস তো তোমরা জিতবেই, আমার পূর্ণ শুভেচ্ছা রইল। তারপরেও থেমে যেও না যেন। মানহানির মামলা অবশ্যই দায়েব করো। এমন নজির সৃষ্টি করো যে দ্বিতীয়বার এই আইনকে খেলো করার সাহস যেন কেউ না পায়। তারপর দেখা করো আমার সাথে।  সেদিন আর গোপন রাখবো না তোমাদের পরিচয়। নাম-ধাম-ছবিসহ ডায়েরি লিখব আমি। অনির নয়, তোমাদের ডাইরি। এক সারভাইভার দম্পতির ডাইরি। সেই দিনের অপেক্ষাতেই রইলাম।

অনির ডাইরি ১৬ই আগস্ট, ২০২৩

 

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


"Veni, vidi, vici" বোধহয় একেই বলে। পূব মেদিনীপুর জেলার নিয়ম হল ঘড়ি ধরে পাক্কা নটায় পতাকা উত্তোলন করেন মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পর পতাকা তোলেন মহকুমা শাসক এবং অন্যান্য আধিকারিক বৃন্দ। সেই মোতাবেক পতাকা উত্তোলিত হল, গাওয়া হল সম্মিলিত জাতীয় সঙ্গীত। এবার মহকুমা শাসক মহোদয়ের বক্তব্য রাখার পালা। তারপর শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 


বক্তব্য তো রাখবে কিন্তু মাইক কোথায়? খবর আসে মাইকওয়ালা দীর্ঘ ক্ষণ আটকে আছে ট্রাফিক জ্যামে। জ্যাম তো হবেই। আজ স্বাধীনতা দিবস আর এটা পূব মেদিনীপুর। দেশপ্রেম আর আবেগের বন্যায় নাকানিচোবানি খাচ্ছে প্রতিটি জনপদ। কাঁথি নগরীর প্রতিটি শিরা উপশিরা জুড়ে চলছে প্রভাত ফেরি। কুৎসিত ডিজে নয়, বাজছে বিউগল আর ড্রাম। পাঁজি মতে ভাদ্র মাস না পড়লেও, তাল পাকানো গরম। দরদর করে ঘামছে সবাই। তারমধ্যেই কচিকাঁচা গুলো গলা চিরে ফেলছে পথে পথে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে। এযেন আমার ফেলে আসা হাওড়া। আজ সকালেই মন খারাপী সুরে বাবা বলছিল, "আজকাল কেউ প্রভাত ফেরি করে না। আজকাল আর কারো তেমন আবেগ নেই আজকের দিনটাকে ঘিরে।" বৃদ্ধকে যদি একটি বার আনতে পারতাম - 


মোদ্দা কথা, মাইকয়ালা নেহি আয়া। তাহলে কি হবে? বক্তৃতা হবে নি? শৌভিক সেই বস্তাপচা কথাটা আবার বলল, ও এতটাই অমায়িক, যে ওর আর মাইক লাগবে না। খালি গলায় বলল, তাও বিন্দুমাত্র পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া। একটি বারও দম নিল না, থমকালো না, তোতলাল না, একটাও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলল না। একটি বারও টলমলাল না আত্মবিশ্বাস, বলল - 


"আজ থেকে ছিয়াত্তর বছর আগে, মধ্যরাত্রে ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু সদর্পে আধুনিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় এবং বিভিন্নভাবে এই স্বাধীনতার স্বরূপ এবং সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে, যে সত্যি সত্যি এই স্বাধীনতা আমাদের সাধারণ জনগণের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে। তারা কতটা মুক্ত হতে পেরেছেন, প্রান্তিক জনগণ এই স্বাধীনতার কতটা সুফল উপভোগ করেছে, সত্যি সত্যি তাদের জীবনধারায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা ইত্যাদি প্রভৃতি। এই ধরনের আলোচনা সবসময়ই স্বাগত। কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতার মানে, মাথা উঁচু করে, নিজের শর্তে দেশ শাসন এবং দেশ গঠনের অধিকার। 


আজকে এই স্বাধীনতার ৭৬ বছর উত্তীর্ণ, আমাদের দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের তিন চতুর্থাংশ বা তার থেকেও বেশি, স্বাধীন ভারতেই জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা পরাধীনতার গ্লানি জানেন না। অন্তত বিদেশী শাসনের নীচে থাকার যে গ্লানি, যে অপমান, তা তাদের সহ্য করতে হয়নি। ফলে স্বাধীনতা তাদের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা জিনিস। 


একটা প্রচলিত গান আছে , "স্বাধীন থাকা তোমার রোজের রুটিন, স্বাধীন থাকা আমার রোজের রুটিন"। তো সেই স্বাধীন থাকা আমাদের দেশের জনগণের কাছে আজকে একটা স্বাভাবিক রুটিন। যেটা খুব স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় তার গুরুত্ব আমরা অনেক সময়ই অনুধাবন করতে পারি না। এই যে আমরা বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন নিচ্ছি, তার জন্য প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিতে আমরা কখনওই দু'দণ্ড সময় দিই না। তেমনি স্বাধীনতাকে আমরা সেভাবে সচেতনভাবে উপলব্ধি কখনই করতে পারি না।


তদসত্ত্বেও আমরা এই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলি আনুষ্ঠানিকভাবেই পালন করি। এটা অনেকটা পুজোর উপাচারের মতো হয়ে গেছে। এখন এটা ঘটনা যে পুজোর সঙ্গে উপাচার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেক সময় দেখা যায় যে উপাচারটা পূজোর থেকেও বড় হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে সেরকম যেন না হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আজকে আমরা এমন একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে রাজনৈতিক ভাবে, সামাজিক, আর্থিক ভাবে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মুক্তচিন্তা লঙ্ঘিত হচ্ছে।


 কাঁথিবাসীরা নিশ্চয়ই স্মরণ করবেন স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের অগ্রণী ভূমিকার কথা, তাঁরা নিশ্চিত ভাবে তাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন থাকবেন এবং মনে রাখবেন কি চরম আত্মবলিদান এর মাধ্যমে এখানকার অগ্রণী নেতারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তো আজ এই পুণ্য লগ্নে দাঁড়িয়ে আমি সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ রাখছি, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মবলিদান আমরা কিছুতেই বিফলে যেতে দেব না। এই কঠিন সময়ে তাঁদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে, তাঁদের দেখানো পথে আমরা মুক্তমনে মুক্ত চিন্তায় এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব।"


শুনতে শুনতে ভীষণ মিস করছিলাম, সুদূর মহানগরবাসী, দুবার কর্কট বিজয়ী এক হেঁপো বৃদ্ধকে। আহা শ্বশুর মশাই শুনতে পেলে কতই না খুশি হতেন। এই চেতনা থেকে শব্দ ভাণ্ডার, এই আত্মবিশ্বাস সবই তো ওনারই দান। উনিই তো আদর্শ আমার বরের। ওনার ছেড়ে যাওয়া পদচিহ্নই তো অনুসরণ করে আমার বর।

অনির ডাইরি ৬ ই আগস্ট, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি


পিতৃ এবং মাতৃকুল মিলিয়ে বংশ ছাড়া মেয়ে ছিলাম আমি। মিশতেই পারতাম না কারো সাথে। তাই নিয়ে একদল আত্মীয়ের কোন মাথাব্যথা না থাকলেও (এতটাই অপাংক্তেয় ছিলাম আমি, যে এনারা আমার অস্তিত্ব সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না), আরেকদলের উদ্বেগ ছিল সাংঘাতিক। প্রায়ই শুনতে হত মা'কে, 'মেয়েকে একটু মিশতে শেখা/শেখাও।'


কিভাবে অমিশুক শিশু কন্যাকে সামাজিক বানাবে, ভেবে কত যে বিনিদ্র রজনী যাপন করেছে আমার জননী। কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না, আমি ঘোরতর মিশুক, বরং বেশ ধিঙ্গি প্রকৃতির বলতে পারেন। আমার পওওচুর বন্ধু। কিন্তু মুশকিল হল, তারা সবই কাল্পনিক চরিত্র। জ্ঞান হওয়া ইস্তক, এমন এক কাল্পনিক জগতের সাথে আলাপিত হয়েছিলাম, যে রক্তমাংসের বন্ধুর আমার প্রয়োজনই পড়ত না। সৌজন্য আমার বাবা। 


বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়া ভোর গুলোয়, কালবৈশাখী মোড়া ঝোড়ো বিকালগুলোয়, বাবার বুকে মাথা রেখে শোয়া তারাদের সামিয়ানা টাঙানো লোডশেডিং এর নিকষ রাতগুলোয় পলকে হারিয়ে যেতাম দুজনে ইনকাদের রাজ্যে। হেঁটে বেড়াতাম এলডোরাডোর পথে পথে। খুঁজে বেড়াতাম কোথায় লুকানো আছে আটাহুআল্লার গুপ্তধন। কখনও বা নতমস্তকে শামিল হতাম, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের শেষ যাত্রায়। তীরে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করতাম কেমন করে বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় মীরণের নৌকায়। মাঝে মাঝে গল্প করতে আসত পাভেলের মা নিলোভনা ব্লাসভা। আসত ব্রতীর মা সুজাতাও। সন্তান হারা মায়ের বেদনায়, যাতনায় ঝাঁঝরা হয়ে যেত চরাচর। ধরণী কেন যে দ্বিধা হত না।


এত বন্ধু থাকতে আবার বাইরের বন্ধুর দরকার কি এটাই বুঝতে পারতাম না আমি। এরা তো কেউ সমালোচনা করেনা, জটিল প্রশ্ন করে না, খুঁচিয়ে গোপন তথ্য পেট থেকে বার করতে চায় না, পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছি জানতে চায় না। বাবার আর্থিক অবস্থা বা আমার চেহারা ইত্যাদি দিয়ে আমার বিচার করে না, তাহলে? 


কাল্পনিক এই বন্ধুদের তালিকায় প্রথম জাগতিক নাম জুড়লো সঞ্চিতার। আমরা তখন চতুর্থ শ্রেণী। প্রথম আলাপে কোমর বেঁধে ঝগড়া করা মেয়েটা, বিনানুমতিতে ধড়াম করে ঢুকে পড়ল আমার নিভৃত জগতে। ব্যাপারটা তারপর আর বিশেষ নিভৃত রইল না বুঝলেন কিনা। প্রতিটা দিনই বেঁধে যেত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। যত ঝগড়া, তত ভাব ছিল আমাদের। দিনের শেষে বাড়ি ফিরে, " আমিই ঠিক, তুই ভুল রে ইয়েটা" বলে লম্বা লম্বা চিঠি লিখতাম আমরা একে অপরকে। পরের দিন সেই নিয়ে নতুন করে বেঁধে যেত পানিপথের যুদ্ধ। চিঠি গুলো জমিয়ে রেখেছিলাম বহু বহু বছর।


সঞ্চিতার পর পম্পা। আমি তখন একাদশ শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি। পম্পাও তখন শাড়ি। স্কুল আলাদা হলেও বাংলা মিডিয়াম আমাদের, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শাড়ি পরাই ছিল দস্তুর। এক কোচিং এ পড়তাম দোঁহে। পড়ত আরো কত রথী মহারথী। এতজনের মধ্যে,নিঝুম নিটোল সরল মেয়েটার কি করে যে আমাকেই বন্ধু বলে প্রাণে ধরেছিল, তা আজও এক রহস্য বটে। হয়তো জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের মত, বন্ধুত্বটাও আমরা উপর থেকেই লিখিয়ে নিয়ে আসি।


তারপর তপন আর নীপা। কলেজের বন্ধু। তপনের সাথে আজও যোগাযোগ থাকলেও, নীপাটা যে কোথায় নিপাত্তা হয়ে গেল। আদি বাড়ি ময়না হলেও নীপারা থাকত আন্দুলে। চার বোন। নীপা ছিল মেজ। বড়দিকে একটু খাতির করলেও, পরের দুই বোনের সাথে ছিল আমার গলাগলি ভাব। বাবার ল্যান্ড ফোনের বিল বাড়িয়ে কত যে গল্প করতাম আমরা। বলতে পারেন কলেজের ফার্স্ট সেকেন্ড ইয়ারে, আন্দুলের মাইতি বাড়িই ছিল আমার লাইফ লাইন। অভিভাবক ছাড়া জীবনের প্রথম সিনেমা দেখা, এই নীপার সাথেই। মধ্য হাওড়ার পার্বতী সিনেমা হলে তখন চলছিল মীরা নায়ারের, " ফায়ার"। চিরকেলে ভোম্বল আমরা, একে তো সিনেমা দেখে কিছুই বুঝতে পারেনি, তারওপর বাড়ি এসে যে অভ্যর্থনা জুটে ছিল-


বিএসসি পাস কোর্সের ছাত্রী ছিল নীপা। তৎকালীন নিয়মে দু বছরে কোর্স শেষ। আমাদের তখনও বাকি এক বছরের কলেজ জীবন। ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল যোগাযোগ। দৃষ্টির আড়াল যে মনেরও আড়াল প্রথম অনুভব করেছিলাম নীপার সাথে বিচ্ছেদের পর।


কলেজ উত্তর বছরগুলো জুড়ে শুধুই অপর্ণাদি আর সন্দীপ। মায়ের গোমড়াথেরিয়াম মেয়েটা যে এত হাসতে পারে আগে জানতাম না। একসাথে পড়ে ফেরার পথে আমাদের হাসির দমকে, থমকে চমকে উঠতো বাস। পৃথিবীর তাবড় বিষয় হেসেই উড়িয়ে দিতাম আমরা। যাতায়াতের পথে সামান্য পয়সা বাঁচিয়ে, গ্লোব, নিউ এম্পায়ার, প্যারাডাইস এর সস্তাতম টিকিট কেটে হলিউডের সাথে আলাপ এই দুই বন্ধুর হাত ধরেই।


দুর্গা পুজো এলেই আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করত সন্দীপ। পুজোর দিনগুলোয় নাকি ছেলেদের পাড়া ছেড়ে নড়তে নেই। সক্কাল সক্কাল একটা চেয়ার বাগিয়ে,ভালো দেখে একটা কোনায় জম্পেশ করে বসে, অষ্টপ্রহর প্রজাপতি পর্যবেক্ষণ করাই নাকি এই সময় ছেলেদের কর্তব্য। সন্দীপকে ছাড়াই পুজো পরিক্রমার পরিকল্পনা করতাম আমরা। ষষ্ঠী আর সপ্তমী, একদিন উত্তর আর একদিন দক্ষিণ কলকাতা। বাজেট সাকুল্যে ৫০-১০০ টাকা। ১১ নম্বরই ছিল মূল বাহন। শরতের খর রৌদ্রে, এক কলসী ঘেমে, এক হাঁটু ধুলো মেখে তিলোত্তমার বক্ষ জুড়ে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দর্শন করতাম আমরা। মুষ্টিমেয়র হাতেই মুঠোফোন থাকত তখন, আসেনি অরকুট বা ফেসবুকও। তাই কেউ দেখতে পেত না। কেউ জানতে পারত না। কোন লাভ/ লাইক বা কমেন্ট পেতাম না আমরা। তবু ঘুরতাম, কারণ ঘুরতে ভালো লাগত খুব। কন্যা অমিশুক বলে ঘুম না আসা আমার মায়ের কপালে পড়ত গভীর ভাঁজ। মেয়েটা এমন ধিঙ্গী হয়ে গেল কবে?


ওই যে গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলে গেছেন না, পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুবক, তাকে মান্যতা দিয়েই গতিপথ বদলায় জীবন। নতুন করে বন্ধু হয় কেউ, আবার পথের বাঁকে হারিয়ে যায় কেউ। চোখের আড়াল থেকে মনের আড়াল হয়ে যায় না জানি কতজন, রেখে যায় একরাশ সুখ স্মৃতি। অন্তরা, মন্দিরা, ছন্দম তোরা যে যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস। খুব ভালো থাকিস।


চাকরি পাই, মহাকরণে অবর বর্গীয় সহায়ক। জমা করতে হয় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড খানা। বদলে ধরিয়ে দেয় এক টুকরো কাগজ, যাতে লেখা, দপ্তরের নাম। শিল্প এবং বাণিজ্য। বলা হল, "যাও, গিয়ে সত্ত্বর জয়েন কর"। ১৯শে জুলাই ২০০৬, মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে মহানগর। বিরাট সেকশনের এক কোণে, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ললিতমোহন ব্যানার্জীর টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা জয়েন করতে আসা , মেয়েটার চোখেও সেদিন মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি। 


চাকরি পাবার তীব্র আনন্দের মাঝেও কেন যে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে মন। হৃদয় খুঁড়ে কে যে জাগাচ্ছে এত্ত এত্ত বেদনা। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, প্রশংসা, স্তুতি কিছুই মনে পড়ছে না। কিচ্ছু না। হৃদয়ের মধ্যে অগ্নিশলাকা দিয়ে নতুন করে লেখা হচ্ছে যাবতীয় অপমান, কটু কথা, আশা- বিশ্বাসভঙ্গের রামায়ণ মহাভারত। একটা মন বলছে "মরুক গে"। আর একটা অন্য মনটা বলছে, "আমিই বা মরছি না কেন? আমি মরিনি কেন?"  


ভাবতেই পারছি না, দেখতেই পাচ্ছি না যে একদিন ভরে যাবে সব ঘা। মুছে যাবে সব দাগ। নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠবে না জানি কতজন। যাদের কেউ পূর্ব পরিচিত, কেউবা লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বিভিন্ন পথের বাঁকে। যারা বলবে, "তোর সুখের দিনে আমাদের না ডাকলেও কিছু মনে করব না। দুঃখের দিনে খবর না দিলে কিন্তু হেব্বি দুঃখ পাব মাইরি।" যাদের সামনে নির্দ্বিধায় খুলে ফেলতে পারব যাবতীয় সফিস্টিকেশনের ঝুটো মুখোশ। খুলে দিতে পারব হৃদয়ের দ্বার।হতে পারব অকপট। যাদের ডাকা যাবে উল্লুক, বেল্লিক, কচ্ছপ, খরগোশ, টিকটিকি যা খুশি নামে। যারা যেচে খেতে চাইবে খিস্তি। যারা লড়াই করবে, আমার সাথে নয়, বরং আমার হয়ে, আমার জন্য। যাদের কাছে, "পেট খারাপ" হয়েছে বললেই তৎক্ষণাৎ জবাব আসবে, "আর আমার কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে"। যাদের কাছে নিরন্তর ঘ্যানঘ্যান করা যাবে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে, যেমন, " ব্লাডার ফেটে যাবে, আপদ মিটিং আর শেষই হয় না।" অথবা, "এতটা দৌড়ে এলাম, তাও ঠিক চোখের সামনে দিয়ে উঠে গেল লিফটটা।বেঁচে থেকে কোন লাভ কি আদৌ আছে?" যাদের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনা করা যাবে, পরিকল্পনা করা যাবে চাঁদ থেকে মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণের, হীরে থেকে জিরে কেনার। যারা থাকবে বলে মনে হবে, প্রতিটা দিনই বন্ধু দিবস। প্রতিটা মুহূর্তই বন্ধু মুহূর্ত। কারণ যে যাই বলুক বাপু, "বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না।"


পুনশ্চ - নাম না নিলেও আশা করি বুঝতে পারছেন, আপনি কোন জন 😉।

অনির ডাইরি ২৪শে জুলাই,২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


বকবক লগ্নে জন্ম আমার, জীব হোক বা জড়, সুখ হোক বা অসুখ কথা আমায় বলতেই হবে। মায়ের ওপর রাগ করে, প্রেশার কুকারটাকেই একচোট ধমকালাম এখুনি, "কখন থেকে গ্যাসপে বৈঠায়া, সিঁটি বাজায় গা, কে নেহি বাজায় গা।" মায়ের ওপর রাগ না ধরাটাই অস্বাভাবিক। এমনিতে ফোন করে মায়ের সাথে কথা না বললে মায়ের দুর্জ্ঞেয় অভিমান হয়। আবার কথা বলতে গেলেও তিন বা চারটির বেশি বাক্য ব্যয় করে না মা। তার সবটুকু জুড়ে থাকি কেবল আমরা। তুত্তুরী স্কুলে গেল কিনা,কাজের খুব টেনশন আছে কি না, আমরা ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছি কি না এবং তুত্তুরীর পড়াশোনা কেমন চলছে। এর বাইরে মায়ের আর কোন কথা নেই। 


আরে ভাই, এগুলো তো রোজই শুধাও, এবেলা - ওবেলা শুধাও। অন্য কিছু তো বলো। তোমার খবর তো কিছু দাও। বললেই ভদ্রমহিলার এক কথা,"আমার আবার কি খবর? আমি ঠিকই আছি।" বুঝতে পারলাম পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা মেরেছি, হাল ছেড়ে জানতে চাইলাম, বাবা কোথায়? বাবার সাথে উল্টো কেস হয় সাধারণত, বাবার গল্পের ভাণ্ডার অফুরন্ত। প্রায় জোর করে ফোন কাটতে হয়। 


অন্য দিন মায়ের হাত থেকে ফোনটা প্রায় ছিনতাই করে নেয় বাবা, আজ তিনি অনুপস্থিত কেন? জবাব পেলাম, বাবা নাকি ঘুমাচ্ছে। এই রবিবারের বারবেলায় ঘুমাচ্ছে? শঙ্কিত হয়ে জানতে চাই, শরীর ভালো আছে তো? দায়সারা উত্তর পাই, "ওই একটু জ্বরজ্বর ভাব, গা ম্যাজম্যাজ,অরুচি, কাশি। কাল রাতে কাশির দমকে ঘুমাতে পারেনি। কথা শোনে না। সিগারেটের পর সিগারেট টেনেই যায়।" এরপর গরম হলে মাথার কি আর দোষ থাকে? এইটা তো আগে বলবে নাকি। বললাম বাড়িতে প্যারাসিটামল আছে কিনা দেখো, সেরকম হলে যেন একটা খেয়ে নেয়। ডাক্তার না দেখিয়ে, ওষুধ না খেয়ে, আর একটু সয়ে দেখি বলে যেচে যাতনা ভোগ করাটা চাটুজ্জেদের মজ্জাগত। আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই। 


আমার যাবতীয় উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে উল্টে মা বলল, " তোকে এত চিন্তা করতে হবে না। এখানে লক্ষ্মী (মায়ের care giver) আছে, তপন ( পাড়াতুতো ইন্দ্রনাথ বলতে পারেন। ফোন করলেই ছুটে আসে, ডাক্তারের সাথে appointment বুক করে দেয়, টোটো ঠিক করে বাড়ির সদর দরজায় পাঠিয়ে দেয়, স্যাম্পল কালেক্ট করে যাবতীয় ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে দেয়, দরকার হলে পরীক্ষার রিপোর্ট গুলো বগলদাবা করে ডাক্তারকে দেখিয়ে ও আসে) আছে, তোকে তিনশ মাইল দৌড়ে আসতে হবে না।" মাইল নয় কিলোমিটার, তিনশ নয়, যাতায়াত মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশ। তাহোক, বাবাটা তো আমার। অসুস্থ বৃদ্ধকে নিছক লক্ষ্মী - তপনের ভরসায় ছাড়তে পারি নাকি!


বসার ঘরে বসে বসে দাড়ি চুলকাচ্ছিল শৌভিক, বেচারী প্রেশার কুকারের ওপর করা হম্বিতম্বি শুনে দৌড়ে এল, "কেয়া হুয়া"? সুখ, দুঃখ থেকে দাম্পত্য আলাপ, দিদার ভাষাতেই জমে আমাদের। স্বর্গীয়া সুনীতিরাণী ঘোষ, ওরফে আমার দিদা দারুণ হিন্দি বলত। দিদার বলা কিছু কিছু হিন্দি বাক্য বলতে পারেন অমর হয়ে রয়ে গেছে আমাদের পরিবারে। হিন্দি কথনে লালমোহন বাবা ওরফে জটায়ুকে গুণে গুণে এগারোটা গোল দিতে পারত দিদা। দিদার বোধহয় ধারণা ছিল বাংলা বাক্যের সাথে হ্যায় লাগালেই তাহা রাষ্ট্র ভাষায় রূপান্তরিত হয়। যেমন ধরুন বড় মাসির বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে দেখল, গলির মুখ আটকে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত একটা ঠেলা গাড়ি। দিদা অমনি ঠেলাওয়ালাদের ধমকে দিল, " আই, তুম ইতনা ছোটো গলি মে, এত্ত বড় ঠেলা ঢুকিয়েছ কেন হ্যায়?" 


মা - মাসি বা অন্য দাদারা দিদার হিন্দি অতটা খেয়াল না করলেও, দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ সমেত রেকর্ড করে নিত সেজদা। তারপর রবিবার সন্ধ্যা বেলা, বড় মাসির বাড়ির টিভির ঘরে, কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর আমতেল দিয়ে মাখা এক গামলা মুড়ি সহ জমে উঠত দিদার "হিন্দি পে চর্চা"। সেই যে রোটাং পাশ না কোথায় যাবার সময়, কোন হোটেলের কোন তরকারিতে যেন নুন কম হয়েছিল। সেই নিয়ে সেজদা মৃদু অনুযোগ করায়, ওয়েটারকে বেদম বকেছিল দিদা, "এই, তুম তরকারি মে নুন নেহি দিয়া? আমার ছেলেকো নুন কম লাগতা হ্যায় কাহে?" ছেলে অর্থাৎ বাচ্ছা।আমার মুর্শিদাবাদী মা-মাসি-দিদা সবাই বাচ্ছাদের ছেলে বলত। মা তো এখনও তুত্তুরীর সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ছেলে শব্দটা প্রয়োগ করে, " ছেলেকে দেখো। ছেলে যেন পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করে" ইত্যাদি প্রভৃতি।


১৯৯৮ সালে অমৃত লোকে পাড়ি দিয়েছে দিদা। ছোট্টখাট্টো, সাদা শাড়ি পরা, তামুক পাতা চিবানো চিনির পুঁটলিটা কোথায় যে হারিয়ে গেল। একমাত্র নাতনী বলে একটা ভয়ানক আদরের নাম ছিল আমার, দিদা চলে যাবার পর আর কেউ কখনও সেই নামে ডাকেনি। দিদা হয়তো নেই, দিদার হিন্দি গুলো আজও রয়ে গেছে আমার সাথে। আজও যখনই রেগে যাই, খুব খুশি হয়ে যাই, সোহাগে উথলে উঠি, "ষড়া অন্ধা অছি" র মত বিশুদ্ধ দিদার রাষ্ট্র ভাষাই বেরোয় আমার মুখ দিয়ে। বিগত সাড়ে চোদ্দ বছরে শৌভিক ও দেখি দিব্যি রপ্ত করে ফেলেছে আমার দিদার বুলি। 


 বাবার অসময়ে ঘুম, মায়ের বেশি কথা না বলার পাশাপাশি অনুযোগ করলাম প্রেশার কুকারের নামেও। বলতে বলতে মনে পড়ে গেল সিদ্ধ ডিম গুলো ছাড়াতে হবে। এই কাজটা শৌভিক খুব ভালোবাসে, লাফাতে লাফাতে করতে আসে। তাই বললাম, " তুম সিদ্ধ ডিম ছাড়ায়েগা কে নেহি? কখন সে সেদ্ধ হোকে বৈঠা হ্যায়, দু দুটো ডিম।" শাশুড়ির ওপর ক্ষুণ্ন বউয়ের রুদ্র রূপ দেখে সুড়সুড় করে ডিম ছাড়াতে এল শৌভিক। হতভাগা সিঁটি আর ওঠে না। বিরক্ত হয়ে বরের কাছে অনুযোগ করলাম, " এ হতভাগা প্রেশার কুকার কো, লাগতা হ্যায় ম্যায় পছন্দই নেহি হ্যায়। মুঝ কো দেখকে সিঁটিই নেহি বাজাতা। বুজুকো( তুত্তুরী) বুলা কে দেখতা হুঁ। শায়দ ও পছন্দ হো যায়।"


 শৌভিক এক মনে ডিম ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, "নেহি নেহি, ইয়ে না, সাত্ত্বিক প্রেশার কুকার হ্যায়।" কচু পোড়া হ্যায় বলে যেই বেরিয়ে এলাম, পি করে সিঁটি বেজে উঠল। হতভাগা প্রেশার কুকারের লাগতা হ্যায় ওরিয়েন্টেশন ম্যেই গণ্ডগোল হ্যায়। এবার থেকে শৌভিককেই রাঁধতে পাঠাব। যদি একটু তাড়াতাড়ি হয়। 


আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গল ভয়ানক মন খারাপি খবরে, গতকাল রাতে মাতৃহারা হয়েছে জনৈকা বন্ধু। পাশাপাশি পাড়ায় বেড়ে উঠেছি আমরা। খবরটা পড়া ইস্তক, আশৈশব দেখে আসা কাকিমার মুখটা কেবলই ভাসছে চোখের সামনে। খুব ভাব ছিল মায়ের সাথে। রাস্তায় দেখা হয়ে গেলেই জমে উঠত আড্ডা। দুজনকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসা হত দায়। মায়ের কাছে প্রায় অনুযোগ করতেন কাকিমা, "দেখেছ ওরা কেমন আড্ডা মারে, আমাদেরও ওমন একটা হলে হত তো।" মা বলেও ছিল কথাটা আমাদের। লুফেও নিয়েছিলাম আমরা।বাবা - মায়েদের নিয়ে গেট্টু। তারপর যা হয় আরকি, আজ হবে, কাল হবে করে আর হয়ে ওঠেনি। হুড়মুড় করে চলে এসেছে অতিমারি, বদলে দিয়েছে জীবনের ধাঁচ- 


আমার কেমন যেন ধারণা ছিল ছোটবেলায়, যে বড় হয়ে গেলে হয়তো বাবা মায়ের সাথে বিচ্ছেদটা আর অত কষ্টকর হবে না। বড়দের তেমন ভাবে কাঁদতে দেখিনি যে। আজ প্রতি পদে মনে হয় কি চরম বোকা ছিলাম আমি। বয়স যত বাড়ছে, প্রতিটা মুহূর্তে আরো আরো বেশি করে যেন আঁকড়ে ধরছি ওদের। বিচ্ছেদের কথা ভাবতেও বন্ধ হয়ে আসে দম। অন্ধকার হয়ে পড়ে চরাচর। 


সেই কথাই বলছিলাম মাকে। কাল নীরবতার জন্য ধমক খেয়েছে বলে নাকি হঠাৎ চলে যাওয়া পাড়াতুতো সহেলীর প্রতি স্মৃতিমেদুরতার জন্য জানি না, আজ মনে হল মাকে কথায় পেয়েছে। প্রায় সাত আট মিনিট স্বর্গীয় কাকিমার কথাই বলে চলল। মুঠো ফোনে কারো এত বড় প্রশস্তি, মায়ের পক্ষে এটা বিশ্বরেকর্ড বটে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ হাওয়া মোরগের মত উল্টো দিকে ঘুরে গেল মা, " এই জানিস, আমাদের আজ সকাল থেকে কি দুর্বিপাক -"। 


চলন্ত বাহনের জানলা গলে যেন পলকে ঢুকে এল একরাশ উৎকন্ঠার মেঘ, কি হল আবার? মাকে আজ যেন গপ্পে পেয়েছে, "শোন না, সে কি বিপদ! আমি তো আজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠেছি।" অধীর হয়ে বললাম, "আরে ইতিহাস পরে শুনব, আপাতত কি হয়েছে সেটা তো বলো -"। "এই বলছি শোন না। উঠে দেখি, বাইরের আবহাওয়া তেমন ভালো নয়। মেঘ করে আছে, টিপটিপ করে বৃষ্টিও পড়ছে। তারই মধ্যে গেলাম সদর দরজা খুলতে।"


 আবার বললাম, এবার বেশ খানিকটা গলা তুলে, "আরে হয়েছেটা কি?" ফোনের ওপারে ব্যঙ্গ করে "হেহেঃ" হেসে উঠল একবার বাবা। মায়ের কোন হেলদোল নেই, " শোন না, তোর বাবার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না বলে, আজ আর উঠতে দিইনি, আমিও আর শুইনি। কাজের মেয়েটা আসবে বলে, একটা চেয়ার নিয়ে গিয়ে রোয়াকেই বসে রইলাম। ভাগ্যে বৃষ্টিটা থেমে ছিল। বসে বসে ঢুলচি -"। 


আরে ধুৎ,  আসল কথাটা তো বলো। বাবা আবার আওয়াজ দিল, "হোহো রাজা খাঃ"। এর মানে কি তার উত্তর কেবল আমার পিতৃদেবই জানেন। মায়ের অবস্থা সত্যি "ছুট‌লে কথা থামায় কে? আজকে ঠেকায় আমায় কে?" বলেই চলে, " তিনি আসলেন বেলা সাড়ে সাতটায়। এসে দুমিনিটে তার ঝাঁট দেওয়া, মোছা হয়ে গেল। দুমদাম করে বাসন মাজল, চলে যাচ্ছে যখন বললাম, একটু দোতলা টা ঝাঁট দিয়ে আয় না। আমায় মুখ বেঁকিয়ে বলল, ' আজ পারবুনি -'।" স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, " আচ্ছা এটাই তাহলে তোমার দুর্বিপাক।" 


"নাঃ, নাঃ। শোন না।" উদ্বেগ মেশানো পান চিবানো আড্ডার মেজাজে বলে মা। " তারপর তোর বাবা উঠল,উঠেই এক কাপ চা চাইল। বাসি জামাকাপড় ছেড়ে, পুজো করলাম। চা বানালাম -"। গাড়ির কাঁচে ঠকঠক করে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বললাম, দোহাই মা, এবার তো বলো কি হয়েছে। আর উত্তেজনা সইতে পারছি না। আরো মিনিট খানেক এমন অনির্বচনীয় যাতনা দেবার পর, অবশেষে জানা গেল,যুগলে চা পান সমাপন করে, মেশিনে বাসি কাপড় কাচতে গিয়ে মা আবিষ্কার করেছে, ট্যাংকের সব জল কিভাবে যেন শেষ হয়ে গেছে। 


সত্য যখন উদ্ঘাটিত হয়েছে, ততক্ষণে রীতিমত মাথা ঘুরছে, বাস্তবিক ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কোনমতে শুধু বললাম, ঘাট হয়েছে, বেশি কথা বলো না বলে কাল তোমায় বকার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছি। এবারের মত মার্জনা করে দাও মা জননী। ভুলে গিয়েছিলাম, বয়স যতই বাড়ুক, মা চিরকাল মা'ই থাকে। এক উচ্চতর জীব, যার পদাঙ্ক তো অনুসরণ করা যায়, কিন্তু যাকে কখনও ছাপিয়ে যাওয়া যায় না।