Saturday, 19 August 2023

অনির ডাইরি ১৮ই এপ্রিল, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #গুরুচন্ডালী


অতঃপর অতসী দেবী ওরফে শাশুড়ী মাতা কহিলেন," না বাপু তোমরা যতই বলো। আমি আর লোক রাখব না।" অতসী দেবীর ভার্টিগো আছে, আছে কানের সমস্যা। কান টানিলে মাথা আসার মতই বধিরতার পিছু পিছু আসিছে  ভারসাম্যহীনতা। মাঝেমধ্যেই ভূপতিত হন, চোট পান হেথাহোথা। বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই একাকী চাগিয়ে তুলিতেও পারেন না সবসময়। ভদ্রমহিলার মানসিক জোর সাংঘাতিক। ভূপতিত অবস্থায় স্বয়ং চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, প্রয়োজনে কিছুটা হামাগুড়ি দিয়াও উঠে দাঁড়ান।‌ খানিক উপরওয়ালার মুণ্ডপাত করেন, দশ-বিশ-তিরিশ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে চল্লিশ বৎসর পূর্বেও কৃত কোন অপরাধের জন্য শ্বশুরমশাইকে সামান্য তিরস্কার করেন এবং পুনরায় ব্যাপৃত হন গৃহকর্মে।


ভদ্রমহিলা রূপ এবং গুণ, দুদিকেই মা লক্ষ্মী। এই মধ্যসত্তরেও গলানো মাখন এর মতন গায়ের রং, মসৃণ ত্বক বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে গ্ল্যামার। কোমর ছোঁয়া ঢেউ খেলানো কালো চুলের ঢল, যার ফাঁকেফাঁকে উঁকি মারা রূপোর তারের মতন পক্ক কেশ গুচ্ছ, ওনার সৌন্দর্য বাড়ায় বৈ কমায় না। দাঁতগুলিও মোটামুটি অক্ষুন্ন আছে দু একটি বাদে। আর অক্ষুন্ন আছে ওনার ব্যক্তিত্ব। দুই ছেলে না ডরালেও, শ্বশুরমশাই এবং আমরা দুই পুত্র বধূ যমের মতন ভয় পাই ওনাকে। অগোচরে আমরা ওনার নাম রেখেছি, "শ্বশুরমশাইয়ের সুন্দরী প্রেয়সী।"


তো এহেন "সুন্দরী প্রেয়সী"র কাছে একটু আগেই বকা খেয়েছি আমি। ওনাকে একটা ভালো শাড়ি পরতে বলার অপরাধে। নববর্ষের সন্ধ্যা। দীর্ঘ দেড় মাস বাদে বাড়ি ফিরেছি আমরা। কর্মসূত্রে শ্বশুর মশাইয়ের দুই পুত্র মহানগর থেকে বহুদূরের দুই জেলার বাসিন্দা। দীর্ঘ অদর্শনে জমে উঠেছে গল্পের পাহাড়। জমে উঠেছে নতুন বছরের প্রথম সন্ধ্যার আড্ডাটাও। অপূর্ণতা বলতে কেবল আমার দেওর- জা আর দেওর ঝির অনুপস্থিতি। 


দিন কয়েক আগে যে আছাড় খেয়েছিলেন শাশুড়ি মা, তার সৌজন্যে একটা পায়ের পাতা এখনও ফুলে আছে। নড়তে চড়তেও সমস্যা হচ্ছে সামান্য। যদিও রান্না করা এবং বাসন মাজার লোক আছে তবুও একজন সর্বক্ষণের সঙ্গী বড় প্রয়োজন। টুকটাক সংসারের কাজ কি কম।


সেই কথাটা বলেই কেলো করেছে আমার বর। এরকম একটি মেয়েকে রাখা হয়েছিল কিছুকাল আগে, তাকে নিয়ে শাশুড়ি মাতার অভিযোগের অন্ত নেই। সে নাকি গূড়াকু বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে দাঁত মাজত এবং দেওয়ালে আঙুল দিয়ে কালো কালো দাগ টানত। উনি নিজে প্রতিদিন স্নান করতে গিয়ে স্কচব্রাইট দিয়ে তা ঘষে ঘষে তুলতেন। 


পাত্তা না দিয়ে আমার বর বলল," তা মাজতেই পারে। তুমি ফিরোজাকে নিষেধ করলেই পারতে।" আরো চটে গেলেন শাশুড়ি মাতা। ওদিকে শ্বশুরমশাই ইশারায় আমায় বলেই চলেছেন, "আর একবার বলো না যদি শাড়িটা-"। 

সত্যি আমরা সকলেই হয় নতুন, নয়তো পুরানো হলেও বাইরে পরা যায় এমন পোশাক পরেছি। কেবল ওনার পরনেই একটা ঘরে পরার ন্যাতানো শাড়ি। তাতেও বোধহয় উনি আমাদের সবার থেকে বেশি সুন্দর। বৃদ্ধের মন রাখতে বলতে গিয়েও, গিলে ফেললাম কথাটা। থাক বাবা, যার প্রেয়সী তিনি বলুন। আমার ঘাড়ে মাথা একটাই। বন্দুক আমার কাঁধে না চালান করতে পেরে, শেষে বৃদ্ধ স্বয়ং বললেন, "হ্যাঁগো, শুনছ। শাড়িটা পাল্টে এসো না।"


শ্বশুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে, এক ঝলক অগ্নিবর্ষণ করে, ন্যাতা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ গলার ঘাম মুছে, সুন্দরী বললেন," পারবো না।" অতঃপর জ্যেষ্ঠ পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,"তুই জানিস না আর কি করেছে? ইয়ে করে ইয়ে করেনি জানিস।"

কিয়ে করে, কিয়ে করেনি, প্রশ্ন করতে গিয়ে দেখি শ্বশুরমশাই দুই আঙুলে নাক টিপছেন। শাশুড়ী মাতাকে তখন থামায় কে। "এই লোকটা। এই যে এই লোকটাই সব লোককে মাথায় তোলে।" 


আমার জায়ের নাম উমা। আমি আদর করে বলি উমারানী। যুগপৎ গরম এবং ছুটি না পাওয়ার জন্য দুর্গাপুর থেকে এবার আসতে পারেনি উমা। তাই সান্ধ্যকালীন আড্ডার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে শয়তানটা। সত্বর মেসেজ পাঠালাম," বাবা লোকজনকে মাথায় তুলছে। তাই মা ক্ষেপে ব্যোম।" ওপাশ থেকে তৎক্ষণাৎ জবাব এল, " কিঃ"। পোষাকপরিচ্ছদ, জুতো সমেত চল্লিশ কেজি ওজন হলে বর্তে যায় যে লোকটা, সে কাউকে চাগিয়ে মাথার উপর তুলবে, ব্যাপারটা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য।


আরো হয়তো কিছু বলত উমা, তার আগেই বললাম, "দাঁড়া, দাঁড়া।আরেকটু কাল্টিভেট করতে দে ব্যাপারটাকে। ফিরোজা যেন কি করে, কি করেনি।" উমা বলল, "এটা জানি।" পরপরই ঢুকল 💩 ইমোজি। মনে মনে কপাল চাপড়ালাম আমি, সর্বনাশ! অতসী দেবীর পরিচ্ছন্নতা বোধ প্রবাদপ্রতিম। বেতো হাঁটু আর টলটলে ভারসাম্য নিয়েই তকতকে রাখেন সারা বাড়ি। এই বাড়িতে কোথাও নূন্যতম নোংরা পাবেন না। সেই বাড়িতে ইয়ে করে ফ্ল্যাশ না করা, নিঃসন্দেহে ফাঁসির যোগ্য অপরাধ। 


শাশুড়ি মায়ের ক্রোধ তখনও অপ্রশমিত। "ফিরোজা আমাকে মানসিক ভাবে চুরমার করে দিয়েছে। আমাকে আর লোক রাখতে তোরা বলিস না। এত বড় মেয়ে, একে তো বড় কাজ করে ফ্ল্যাশ না করা,তারওপর আবার ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় আমার তিনটে বাটি চুরি করে পালানো। বলতে পারিস স্টিলের বাটি, কিন্তু ওগুলো সব তোর অন্নপ্রাশনে পাওয়া উপহার। এত বছর আমি নিজে হাতে মেজে, ধুয়ে, শুকনো করে মুছে ব্যবহার করেছি। ঝকঝক করত বাটি গুলো -।" 


ওনার গলা ধরে যায়, জ্যেষ্ঠ পুত্রের অন্নপ্রাশনে পাওয়া তিনটি বাটির শোকে। বসার ঘরে, সাময়িক ভাবে নেমে আসে স্তব্ধতা। মাথার ওপর কেবল ঘড়ঘড়ে পাখার আওয়াজ ছাড়া কোন শব্দ নেই। মেসেজ পাঠালাম, " শাশুড়ি মায়ের চোখ ছলছল।" ফোনের এপারে আমার কন্যা তুত্তুরী আর ওপারে সুদূর দুর্গাপুরে উমা, ব্যোমকে গেল দুজনেই। শ্বশুর মশাই অকারণেই কানের লতি ধরে টানলেন কয়েকবার,তারপর গলা খাঁকড়ে বললেন, " আহাঃ আজকের দিনে ওসব কথা থাক না।" অতঃপর, ঢোক গিলে বললেন, " শাড়িটা পাল্টে এলেই তো পারো।" " ধুর বাপু" বলে সোফা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন শাশুড়ী মাতা। আরোও হয়তো কিছু জুটত অমৃতবচন, যদি না সঠিক সময়ে বেজে উঠত ফোনটা।

নববর্ষের শুভেচ্ছাজ্ঞাপক ফোন। যিনি করেছেন, তিনি শাশুড়ীমাকেও চাইলেন। " এই ফোনটায় ভালো শুনতে পাই না," বলতে বলতে ফোন ধরেন শাশুড়ী মাতা। ফোনের ওপাশের ব্যক্তি বোধহয় প্রণাম জানান। প্রাণ খুলে আশির্বাদ করেন অতসী দেবী। "ভালো থেকো। সুখে থেকো" ইত্যাদি, প্রভৃতি। থমথমে মেঘলা ছিল যে আকাশ, রৌদ্র স্নান করে পলকে। 


দরজার ঘন্টি বাজিয়ে খাবার দিয়ে যায় জ্যোমাটোওয়ালা। " কি দিয়ে গেল, ও দিদিভাই" বলতে বলতে লাফায় উমা। মেন্যু শুনে মন খারাপ করে উমা, " আমাকে বাদ দিয়ে খাবে? ইশ। কেমন খেতে গো মাছের প্রিপারেশনটা......"। 


আবহাওয়া "কখনও মেঘে ঢাকা, কখনও আলো মাখা" র মধ্যেই একসাথে নৈশ ভোজ সারি সবাই। শ্বশুর মশাই বিড়বিড় করেন, " এ সব হোটেল রেস্তোরাঁর থেকে বাড়ির মাছের ঝোল ভাত অনেক ভালো।" তর্ক জোড়ে ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্র, " তুমি কি বলতে চাইছ? তোমাদের সাকিনা (রান্নার দিদি) এর থেকেও ভালো মাছ রাঁধে? এটা ভূতেও বিশ্বাস করবে?"  রাত গড়ায়। নিশি পোহালেই মহানগর ছাড়তে হবে আমাদের, ফিরতে হবে সুদূর কাঁথি নগরীতে।  ঘুমাতে যাবার আগে বেলা শেষের গোছগাছে মন দিই আমরা। আচমকা চটক ভাঙে শ্বশুর মশাইয়ের চিৎকারে। আবার পড়ে গেছেন শাশুড়ী মা। এবার একেবারে চিৎপটাং। 


আমার বর দৌড়ে গিয়ে তুলে, ধরে ধরে সোফায় বসায়। মাথার পিছনটা পলকে ফুলে আবের মত হয়ে যায়। আতঙ্কে নড়তে পারি না আমি আর তুত্তুরী। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন শ্বশুরমশাই। অকুতোভয় কেবল অতসী দেবী। সামান্য লজ্জিত এই যা। তীব্র বেদনার মধ্যেও সংকুচিত হয়ে বললেন, " তোরা চিন্তা করিস না। পেন কিলার খেলেই সেরে যাবে।"


কি আতঙ্কে যে কাটল নতুন বছরের প্রথম রাতটা। কে জানে কি সন্দেশ বহন করে আনে ২রা বৈশাখের সকাল। সকাল হতেই ফিট অতসী দেবী। সেই শ্বশুর মশাইকে ভর্ৎসনা, সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রের সাথে দ্বন্দ্ব, দিনরাতের লোক উনি কিছুতেই রাখবেন না।সে যদি আবার ওই ফিরোজার মত গুণধরী হয়।তখন কে সামলাবে? 


সকাল গড়ায় দুপুরের দিকে, দুপুর গড়িয়ে নামে সন্ধ্যা। আমাদের প্রত্যাবর্তনের সময় সমাগত। প্রতিবারের মত আশ্বাস দিই, আমরা কেবল একটা ফোনের ওপারে। সমস্ত খুঁটিনাটি যেন রিপোর্ট করা হয় আমাদের। সামান্যতম অসুবিধা হলেও যেন জানাতে দ্বিধা না করেন বৃদ্ধ। শ্বশুরমশাই আশ্বস্ত করেন, সমস্যা দেখা দিলেই জানাবেন। আপাতত পশ্চিম সীমান্তে বিরাজমান অখণ্ড নীরবতা। আর অতসী দেবী কইলেন, " ওরে আমি ঠিক আছি,তোরা নিশ্চিন্তে যা। মাথার ফোলাটাও অনেক কমেছে। পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পাবার থেকে মাথায় চোট পাওয়া অনেক ভালো বুঝলি। কাজ করতে কোন সমস্যা হয় না।" 


এহেন অতসী দেবী ওরফে শ্বশুরমশাইয়ের সুন্দরী প্রেয়সী ওরফে শাশুড়ী মাতার ৭৫ তম জন্মদিন ছিল কাল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, খুব খুব ভালো থাকুন শাশুড়ি মাতা। সুস্থ থাকুন আর এমনিই থাকুন শ্বশুরমশাইয়ের প্রিয়তমা আর আমাদের মধ্যমণি হয়ে আরো বহু বহু বছর।

No comments:

Post a Comment