#অনিরডাইরি
পিতৃ এবং মাতৃকুল মিলিয়ে বংশ ছাড়া মেয়ে ছিলাম আমি। মিশতেই পারতাম না কারো সাথে। তাই নিয়ে একদল আত্মীয়ের কোন মাথাব্যথা না থাকলেও (এতটাই অপাংক্তেয় ছিলাম আমি, যে এনারা আমার অস্তিত্ব সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না), আরেকদলের উদ্বেগ ছিল সাংঘাতিক। প্রায়ই শুনতে হত মা'কে, 'মেয়েকে একটু মিশতে শেখা/শেখাও।'
কিভাবে অমিশুক শিশু কন্যাকে সামাজিক বানাবে, ভেবে কত যে বিনিদ্র রজনী যাপন করেছে আমার জননী। কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না, আমি ঘোরতর মিশুক, বরং বেশ ধিঙ্গি প্রকৃতির বলতে পারেন। আমার পওওচুর বন্ধু। কিন্তু মুশকিল হল, তারা সবই কাল্পনিক চরিত্র। জ্ঞান হওয়া ইস্তক, এমন এক কাল্পনিক জগতের সাথে আলাপিত হয়েছিলাম, যে রক্তমাংসের বন্ধুর আমার প্রয়োজনই পড়ত না। সৌজন্য আমার বাবা।
বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়া ভোর গুলোয়, কালবৈশাখী মোড়া ঝোড়ো বিকালগুলোয়, বাবার বুকে মাথা রেখে শোয়া তারাদের সামিয়ানা টাঙানো লোডশেডিং এর নিকষ রাতগুলোয় পলকে হারিয়ে যেতাম দুজনে ইনকাদের রাজ্যে। হেঁটে বেড়াতাম এলডোরাডোর পথে পথে। খুঁজে বেড়াতাম কোথায় লুকানো আছে আটাহুআল্লার গুপ্তধন। কখনও বা নতমস্তকে শামিল হতাম, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের শেষ যাত্রায়। তীরে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করতাম কেমন করে বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় মীরণের নৌকায়। মাঝে মাঝে গল্প করতে আসত পাভেলের মা নিলোভনা ব্লাসভা। আসত ব্রতীর মা সুজাতাও। সন্তান হারা মায়ের বেদনায়, যাতনায় ঝাঁঝরা হয়ে যেত চরাচর। ধরণী কেন যে দ্বিধা হত না।
এত বন্ধু থাকতে আবার বাইরের বন্ধুর দরকার কি এটাই বুঝতে পারতাম না আমি। এরা তো কেউ সমালোচনা করেনা, জটিল প্রশ্ন করে না, খুঁচিয়ে গোপন তথ্য পেট থেকে বার করতে চায় না, পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছি জানতে চায় না। বাবার আর্থিক অবস্থা বা আমার চেহারা ইত্যাদি দিয়ে আমার বিচার করে না, তাহলে?
কাল্পনিক এই বন্ধুদের তালিকায় প্রথম জাগতিক নাম জুড়লো সঞ্চিতার। আমরা তখন চতুর্থ শ্রেণী। প্রথম আলাপে কোমর বেঁধে ঝগড়া করা মেয়েটা, বিনানুমতিতে ধড়াম করে ঢুকে পড়ল আমার নিভৃত জগতে। ব্যাপারটা তারপর আর বিশেষ নিভৃত রইল না বুঝলেন কিনা। প্রতিটা দিনই বেঁধে যেত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। যত ঝগড়া, তত ভাব ছিল আমাদের। দিনের শেষে বাড়ি ফিরে, " আমিই ঠিক, তুই ভুল রে ইয়েটা" বলে লম্বা লম্বা চিঠি লিখতাম আমরা একে অপরকে। পরের দিন সেই নিয়ে নতুন করে বেঁধে যেত পানিপথের যুদ্ধ। চিঠি গুলো জমিয়ে রেখেছিলাম বহু বহু বছর।
সঞ্চিতার পর পম্পা। আমি তখন একাদশ শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি। পম্পাও তখন শাড়ি। স্কুল আলাদা হলেও বাংলা মিডিয়াম আমাদের, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শাড়ি পরাই ছিল দস্তুর। এক কোচিং এ পড়তাম দোঁহে। পড়ত আরো কত রথী মহারথী। এতজনের মধ্যে,নিঝুম নিটোল সরল মেয়েটার কি করে যে আমাকেই বন্ধু বলে প্রাণে ধরেছিল, তা আজও এক রহস্য বটে। হয়তো জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের মত, বন্ধুত্বটাও আমরা উপর থেকেই লিখিয়ে নিয়ে আসি।
তারপর তপন আর নীপা। কলেজের বন্ধু। তপনের সাথে আজও যোগাযোগ থাকলেও, নীপাটা যে কোথায় নিপাত্তা হয়ে গেল। আদি বাড়ি ময়না হলেও নীপারা থাকত আন্দুলে। চার বোন। নীপা ছিল মেজ। বড়দিকে একটু খাতির করলেও, পরের দুই বোনের সাথে ছিল আমার গলাগলি ভাব। বাবার ল্যান্ড ফোনের বিল বাড়িয়ে কত যে গল্প করতাম আমরা। বলতে পারেন কলেজের ফার্স্ট সেকেন্ড ইয়ারে, আন্দুলের মাইতি বাড়িই ছিল আমার লাইফ লাইন। অভিভাবক ছাড়া জীবনের প্রথম সিনেমা দেখা, এই নীপার সাথেই। মধ্য হাওড়ার পার্বতী সিনেমা হলে তখন চলছিল মীরা নায়ারের, " ফায়ার"। চিরকেলে ভোম্বল আমরা, একে তো সিনেমা দেখে কিছুই বুঝতে পারেনি, তারওপর বাড়ি এসে যে অভ্যর্থনা জুটে ছিল-
বিএসসি পাস কোর্সের ছাত্রী ছিল নীপা। তৎকালীন নিয়মে দু বছরে কোর্স শেষ। আমাদের তখনও বাকি এক বছরের কলেজ জীবন। ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল যোগাযোগ। দৃষ্টির আড়াল যে মনেরও আড়াল প্রথম অনুভব করেছিলাম নীপার সাথে বিচ্ছেদের পর।
কলেজ উত্তর বছরগুলো জুড়ে শুধুই অপর্ণাদি আর সন্দীপ। মায়ের গোমড়াথেরিয়াম মেয়েটা যে এত হাসতে পারে আগে জানতাম না। একসাথে পড়ে ফেরার পথে আমাদের হাসির দমকে, থমকে চমকে উঠতো বাস। পৃথিবীর তাবড় বিষয় হেসেই উড়িয়ে দিতাম আমরা। যাতায়াতের পথে সামান্য পয়সা বাঁচিয়ে, গ্লোব, নিউ এম্পায়ার, প্যারাডাইস এর সস্তাতম টিকিট কেটে হলিউডের সাথে আলাপ এই দুই বন্ধুর হাত ধরেই।
দুর্গা পুজো এলেই আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করত সন্দীপ। পুজোর দিনগুলোয় নাকি ছেলেদের পাড়া ছেড়ে নড়তে নেই। সক্কাল সক্কাল একটা চেয়ার বাগিয়ে,ভালো দেখে একটা কোনায় জম্পেশ করে বসে, অষ্টপ্রহর প্রজাপতি পর্যবেক্ষণ করাই নাকি এই সময় ছেলেদের কর্তব্য। সন্দীপকে ছাড়াই পুজো পরিক্রমার পরিকল্পনা করতাম আমরা। ষষ্ঠী আর সপ্তমী, একদিন উত্তর আর একদিন দক্ষিণ কলকাতা। বাজেট সাকুল্যে ৫০-১০০ টাকা। ১১ নম্বরই ছিল মূল বাহন। শরতের খর রৌদ্রে, এক কলসী ঘেমে, এক হাঁটু ধুলো মেখে তিলোত্তমার বক্ষ জুড়ে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দর্শন করতাম আমরা। মুষ্টিমেয়র হাতেই মুঠোফোন থাকত তখন, আসেনি অরকুট বা ফেসবুকও। তাই কেউ দেখতে পেত না। কেউ জানতে পারত না। কোন লাভ/ লাইক বা কমেন্ট পেতাম না আমরা। তবু ঘুরতাম, কারণ ঘুরতে ভালো লাগত খুব। কন্যা অমিশুক বলে ঘুম না আসা আমার মায়ের কপালে পড়ত গভীর ভাঁজ। মেয়েটা এমন ধিঙ্গী হয়ে গেল কবে?
ওই যে গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলে গেছেন না, পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুবক, তাকে মান্যতা দিয়েই গতিপথ বদলায় জীবন। নতুন করে বন্ধু হয় কেউ, আবার পথের বাঁকে হারিয়ে যায় কেউ। চোখের আড়াল থেকে মনের আড়াল হয়ে যায় না জানি কতজন, রেখে যায় একরাশ সুখ স্মৃতি। অন্তরা, মন্দিরা, ছন্দম তোরা যে যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস। খুব ভালো থাকিস।
চাকরি পাই, মহাকরণে অবর বর্গীয় সহায়ক। জমা করতে হয় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড খানা। বদলে ধরিয়ে দেয় এক টুকরো কাগজ, যাতে লেখা, দপ্তরের নাম। শিল্প এবং বাণিজ্য। বলা হল, "যাও, গিয়ে সত্ত্বর জয়েন কর"। ১৯শে জুলাই ২০০৬, মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে মহানগর। বিরাট সেকশনের এক কোণে, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ললিতমোহন ব্যানার্জীর টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা জয়েন করতে আসা , মেয়েটার চোখেও সেদিন মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি।
চাকরি পাবার তীব্র আনন্দের মাঝেও কেন যে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে মন। হৃদয় খুঁড়ে কে যে জাগাচ্ছে এত্ত এত্ত বেদনা। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, প্রশংসা, স্তুতি কিছুই মনে পড়ছে না। কিচ্ছু না। হৃদয়ের মধ্যে অগ্নিশলাকা দিয়ে নতুন করে লেখা হচ্ছে যাবতীয় অপমান, কটু কথা, আশা- বিশ্বাসভঙ্গের রামায়ণ মহাভারত। একটা মন বলছে "মরুক গে"। আর একটা অন্য মনটা বলছে, "আমিই বা মরছি না কেন? আমি মরিনি কেন?"
ভাবতেই পারছি না, দেখতেই পাচ্ছি না যে একদিন ভরে যাবে সব ঘা। মুছে যাবে সব দাগ। নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠবে না জানি কতজন। যাদের কেউ পূর্ব পরিচিত, কেউবা লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বিভিন্ন পথের বাঁকে। যারা বলবে, "তোর সুখের দিনে আমাদের না ডাকলেও কিছু মনে করব না। দুঃখের দিনে খবর না দিলে কিন্তু হেব্বি দুঃখ পাব মাইরি।" যাদের সামনে নির্দ্বিধায় খুলে ফেলতে পারব যাবতীয় সফিস্টিকেশনের ঝুটো মুখোশ। খুলে দিতে পারব হৃদয়ের দ্বার।হতে পারব অকপট। যাদের ডাকা যাবে উল্লুক, বেল্লিক, কচ্ছপ, খরগোশ, টিকটিকি যা খুশি নামে। যারা যেচে খেতে চাইবে খিস্তি। যারা লড়াই করবে, আমার সাথে নয়, বরং আমার হয়ে, আমার জন্য। যাদের কাছে, "পেট খারাপ" হয়েছে বললেই তৎক্ষণাৎ জবাব আসবে, "আর আমার কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে"। যাদের কাছে নিরন্তর ঘ্যানঘ্যান করা যাবে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে, যেমন, " ব্লাডার ফেটে যাবে, আপদ মিটিং আর শেষই হয় না।" অথবা, "এতটা দৌড়ে এলাম, তাও ঠিক চোখের সামনে দিয়ে উঠে গেল লিফটটা।বেঁচে থেকে কোন লাভ কি আদৌ আছে?" যাদের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনা করা যাবে, পরিকল্পনা করা যাবে চাঁদ থেকে মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণের, হীরে থেকে জিরে কেনার। যারা থাকবে বলে মনে হবে, প্রতিটা দিনই বন্ধু দিবস। প্রতিটা মুহূর্তই বন্ধু মুহূর্ত। কারণ যে যাই বলুক বাপু, "বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না।"
পুনশ্চ - নাম না নিলেও আশা করি বুঝতে পারছেন, আপনি কোন জন 😉।
No comments:
Post a Comment