Saturday 19 August 2023

অনির ডাইরি ১৬ই আগস্ট, ২০২৩

 

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


"Veni, vidi, vici" বোধহয় একেই বলে। পূব মেদিনীপুর জেলার নিয়ম হল ঘড়ি ধরে পাক্কা নটায় পতাকা উত্তোলন করেন মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পর পতাকা তোলেন মহকুমা শাসক এবং অন্যান্য আধিকারিক বৃন্দ। সেই মোতাবেক পতাকা উত্তোলিত হল, গাওয়া হল সম্মিলিত জাতীয় সঙ্গীত। এবার মহকুমা শাসক মহোদয়ের বক্তব্য রাখার পালা। তারপর শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 


বক্তব্য তো রাখবে কিন্তু মাইক কোথায়? খবর আসে মাইকওয়ালা দীর্ঘ ক্ষণ আটকে আছে ট্রাফিক জ্যামে। জ্যাম তো হবেই। আজ স্বাধীনতা দিবস আর এটা পূব মেদিনীপুর। দেশপ্রেম আর আবেগের বন্যায় নাকানিচোবানি খাচ্ছে প্রতিটি জনপদ। কাঁথি নগরীর প্রতিটি শিরা উপশিরা জুড়ে চলছে প্রভাত ফেরি। কুৎসিত ডিজে নয়, বাজছে বিউগল আর ড্রাম। পাঁজি মতে ভাদ্র মাস না পড়লেও, তাল পাকানো গরম। দরদর করে ঘামছে সবাই। তারমধ্যেই কচিকাঁচা গুলো গলা চিরে ফেলছে পথে পথে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে। এযেন আমার ফেলে আসা হাওড়া। আজ সকালেই মন খারাপী সুরে বাবা বলছিল, "আজকাল কেউ প্রভাত ফেরি করে না। আজকাল আর কারো তেমন আবেগ নেই আজকের দিনটাকে ঘিরে।" বৃদ্ধকে যদি একটি বার আনতে পারতাম - 


মোদ্দা কথা, মাইকয়ালা নেহি আয়া। তাহলে কি হবে? বক্তৃতা হবে নি? শৌভিক সেই বস্তাপচা কথাটা আবার বলল, ও এতটাই অমায়িক, যে ওর আর মাইক লাগবে না। খালি গলায় বলল, তাও বিন্দুমাত্র পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া। একটি বারও দম নিল না, থমকালো না, তোতলাল না, একটাও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলল না। একটি বারও টলমলাল না আত্মবিশ্বাস, বলল - 


"আজ থেকে ছিয়াত্তর বছর আগে, মধ্যরাত্রে ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু সদর্পে আধুনিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় এবং বিভিন্নভাবে এই স্বাধীনতার স্বরূপ এবং সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে, যে সত্যি সত্যি এই স্বাধীনতা আমাদের সাধারণ জনগণের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে। তারা কতটা মুক্ত হতে পেরেছেন, প্রান্তিক জনগণ এই স্বাধীনতার কতটা সুফল উপভোগ করেছে, সত্যি সত্যি তাদের জীবনধারায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা ইত্যাদি প্রভৃতি। এই ধরনের আলোচনা সবসময়ই স্বাগত। কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতার মানে, মাথা উঁচু করে, নিজের শর্তে দেশ শাসন এবং দেশ গঠনের অধিকার। 


আজকে এই স্বাধীনতার ৭৬ বছর উত্তীর্ণ, আমাদের দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের তিন চতুর্থাংশ বা তার থেকেও বেশি, স্বাধীন ভারতেই জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা পরাধীনতার গ্লানি জানেন না। অন্তত বিদেশী শাসনের নীচে থাকার যে গ্লানি, যে অপমান, তা তাদের সহ্য করতে হয়নি। ফলে স্বাধীনতা তাদের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা জিনিস। 


একটা প্রচলিত গান আছে , "স্বাধীন থাকা তোমার রোজের রুটিন, স্বাধীন থাকা আমার রোজের রুটিন"। তো সেই স্বাধীন থাকা আমাদের দেশের জনগণের কাছে আজকে একটা স্বাভাবিক রুটিন। যেটা খুব স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় তার গুরুত্ব আমরা অনেক সময়ই অনুধাবন করতে পারি না। এই যে আমরা বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন নিচ্ছি, তার জন্য প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিতে আমরা কখনওই দু'দণ্ড সময় দিই না। তেমনি স্বাধীনতাকে আমরা সেভাবে সচেতনভাবে উপলব্ধি কখনই করতে পারি না।


তদসত্ত্বেও আমরা এই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলি আনুষ্ঠানিকভাবেই পালন করি। এটা অনেকটা পুজোর উপাচারের মতো হয়ে গেছে। এখন এটা ঘটনা যে পুজোর সঙ্গে উপাচার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেক সময় দেখা যায় যে উপাচারটা পূজোর থেকেও বড় হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে সেরকম যেন না হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আজকে আমরা এমন একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে রাজনৈতিক ভাবে, সামাজিক, আর্থিক ভাবে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মুক্তচিন্তা লঙ্ঘিত হচ্ছে।


 কাঁথিবাসীরা নিশ্চয়ই স্মরণ করবেন স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের অগ্রণী ভূমিকার কথা, তাঁরা নিশ্চিত ভাবে তাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন থাকবেন এবং মনে রাখবেন কি চরম আত্মবলিদান এর মাধ্যমে এখানকার অগ্রণী নেতারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তো আজ এই পুণ্য লগ্নে দাঁড়িয়ে আমি সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ রাখছি, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মবলিদান আমরা কিছুতেই বিফলে যেতে দেব না। এই কঠিন সময়ে তাঁদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে, তাঁদের দেখানো পথে আমরা মুক্তমনে মুক্ত চিন্তায় এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব।"


শুনতে শুনতে ভীষণ মিস করছিলাম, সুদূর মহানগরবাসী, দুবার কর্কট বিজয়ী এক হেঁপো বৃদ্ধকে। আহা শ্বশুর মশাই শুনতে পেলে কতই না খুশি হতেন। এই চেতনা থেকে শব্দ ভাণ্ডার, এই আত্মবিশ্বাস সবই তো ওনারই দান। উনিই তো আদর্শ আমার বরের। ওনার ছেড়ে যাওয়া পদচিহ্নই তো অনুসরণ করে আমার বর।

No comments:

Post a Comment