#অনিরডাইরি
বকবক লগ্নে জন্ম আমার, জীব হোক বা জড়, সুখ হোক বা অসুখ কথা আমায় বলতেই হবে। মায়ের ওপর রাগ করে, প্রেশার কুকারটাকেই একচোট ধমকালাম এখুনি, "কখন থেকে গ্যাসপে বৈঠায়া, সিঁটি বাজায় গা, কে নেহি বাজায় গা।" মায়ের ওপর রাগ না ধরাটাই অস্বাভাবিক। এমনিতে ফোন করে মায়ের সাথে কথা না বললে মায়ের দুর্জ্ঞেয় অভিমান হয়। আবার কথা বলতে গেলেও তিন বা চারটির বেশি বাক্য ব্যয় করে না মা। তার সবটুকু জুড়ে থাকি কেবল আমরা। তুত্তুরী স্কুলে গেল কিনা,কাজের খুব টেনশন আছে কি না, আমরা ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছি কি না এবং তুত্তুরীর পড়াশোনা কেমন চলছে। এর বাইরে মায়ের আর কোন কথা নেই।
আরে ভাই, এগুলো তো রোজই শুধাও, এবেলা - ওবেলা শুধাও। অন্য কিছু তো বলো। তোমার খবর তো কিছু দাও। বললেই ভদ্রমহিলার এক কথা,"আমার আবার কি খবর? আমি ঠিকই আছি।" বুঝতে পারলাম পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা মেরেছি, হাল ছেড়ে জানতে চাইলাম, বাবা কোথায়? বাবার সাথে উল্টো কেস হয় সাধারণত, বাবার গল্পের ভাণ্ডার অফুরন্ত। প্রায় জোর করে ফোন কাটতে হয়।
অন্য দিন মায়ের হাত থেকে ফোনটা প্রায় ছিনতাই করে নেয় বাবা, আজ তিনি অনুপস্থিত কেন? জবাব পেলাম, বাবা নাকি ঘুমাচ্ছে। এই রবিবারের বারবেলায় ঘুমাচ্ছে? শঙ্কিত হয়ে জানতে চাই, শরীর ভালো আছে তো? দায়সারা উত্তর পাই, "ওই একটু জ্বরজ্বর ভাব, গা ম্যাজম্যাজ,অরুচি, কাশি। কাল রাতে কাশির দমকে ঘুমাতে পারেনি। কথা শোনে না। সিগারেটের পর সিগারেট টেনেই যায়।" এরপর গরম হলে মাথার কি আর দোষ থাকে? এইটা তো আগে বলবে নাকি। বললাম বাড়িতে প্যারাসিটামল আছে কিনা দেখো, সেরকম হলে যেন একটা খেয়ে নেয়। ডাক্তার না দেখিয়ে, ওষুধ না খেয়ে, আর একটু সয়ে দেখি বলে যেচে যাতনা ভোগ করাটা চাটুজ্জেদের মজ্জাগত। আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই।
আমার যাবতীয় উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে উল্টে মা বলল, " তোকে এত চিন্তা করতে হবে না। এখানে লক্ষ্মী (মায়ের care giver) আছে, তপন ( পাড়াতুতো ইন্দ্রনাথ বলতে পারেন। ফোন করলেই ছুটে আসে, ডাক্তারের সাথে appointment বুক করে দেয়, টোটো ঠিক করে বাড়ির সদর দরজায় পাঠিয়ে দেয়, স্যাম্পল কালেক্ট করে যাবতীয় ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে দেয়, দরকার হলে পরীক্ষার রিপোর্ট গুলো বগলদাবা করে ডাক্তারকে দেখিয়ে ও আসে) আছে, তোকে তিনশ মাইল দৌড়ে আসতে হবে না।" মাইল নয় কিলোমিটার, তিনশ নয়, যাতায়াত মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশ। তাহোক, বাবাটা তো আমার। অসুস্থ বৃদ্ধকে নিছক লক্ষ্মী - তপনের ভরসায় ছাড়তে পারি নাকি!
বসার ঘরে বসে বসে দাড়ি চুলকাচ্ছিল শৌভিক, বেচারী প্রেশার কুকারের ওপর করা হম্বিতম্বি শুনে দৌড়ে এল, "কেয়া হুয়া"? সুখ, দুঃখ থেকে দাম্পত্য আলাপ, দিদার ভাষাতেই জমে আমাদের। স্বর্গীয়া সুনীতিরাণী ঘোষ, ওরফে আমার দিদা দারুণ হিন্দি বলত। দিদার বলা কিছু কিছু হিন্দি বাক্য বলতে পারেন অমর হয়ে রয়ে গেছে আমাদের পরিবারে। হিন্দি কথনে লালমোহন বাবা ওরফে জটায়ুকে গুণে গুণে এগারোটা গোল দিতে পারত দিদা। দিদার বোধহয় ধারণা ছিল বাংলা বাক্যের সাথে হ্যায় লাগালেই তাহা রাষ্ট্র ভাষায় রূপান্তরিত হয়। যেমন ধরুন বড় মাসির বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে দেখল, গলির মুখ আটকে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত একটা ঠেলা গাড়ি। দিদা অমনি ঠেলাওয়ালাদের ধমকে দিল, " আই, তুম ইতনা ছোটো গলি মে, এত্ত বড় ঠেলা ঢুকিয়েছ কেন হ্যায়?"
মা - মাসি বা অন্য দাদারা দিদার হিন্দি অতটা খেয়াল না করলেও, দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ সমেত রেকর্ড করে নিত সেজদা। তারপর রবিবার সন্ধ্যা বেলা, বড় মাসির বাড়ির টিভির ঘরে, কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর আমতেল দিয়ে মাখা এক গামলা মুড়ি সহ জমে উঠত দিদার "হিন্দি পে চর্চা"। সেই যে রোটাং পাশ না কোথায় যাবার সময়, কোন হোটেলের কোন তরকারিতে যেন নুন কম হয়েছিল। সেই নিয়ে সেজদা মৃদু অনুযোগ করায়, ওয়েটারকে বেদম বকেছিল দিদা, "এই, তুম তরকারি মে নুন নেহি দিয়া? আমার ছেলেকো নুন কম লাগতা হ্যায় কাহে?" ছেলে অর্থাৎ বাচ্ছা।আমার মুর্শিদাবাদী মা-মাসি-দিদা সবাই বাচ্ছাদের ছেলে বলত। মা তো এখনও তুত্তুরীর সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ছেলে শব্দটা প্রয়োগ করে, " ছেলেকে দেখো। ছেলে যেন পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করে" ইত্যাদি প্রভৃতি।
১৯৯৮ সালে অমৃত লোকে পাড়ি দিয়েছে দিদা। ছোট্টখাট্টো, সাদা শাড়ি পরা, তামুক পাতা চিবানো চিনির পুঁটলিটা কোথায় যে হারিয়ে গেল। একমাত্র নাতনী বলে একটা ভয়ানক আদরের নাম ছিল আমার, দিদা চলে যাবার পর আর কেউ কখনও সেই নামে ডাকেনি। দিদা হয়তো নেই, দিদার হিন্দি গুলো আজও রয়ে গেছে আমার সাথে। আজও যখনই রেগে যাই, খুব খুশি হয়ে যাই, সোহাগে উথলে উঠি, "ষড়া অন্ধা অছি" র মত বিশুদ্ধ দিদার রাষ্ট্র ভাষাই বেরোয় আমার মুখ দিয়ে। বিগত সাড়ে চোদ্দ বছরে শৌভিক ও দেখি দিব্যি রপ্ত করে ফেলেছে আমার দিদার বুলি।
বাবার অসময়ে ঘুম, মায়ের বেশি কথা না বলার পাশাপাশি অনুযোগ করলাম প্রেশার কুকারের নামেও। বলতে বলতে মনে পড়ে গেল সিদ্ধ ডিম গুলো ছাড়াতে হবে। এই কাজটা শৌভিক খুব ভালোবাসে, লাফাতে লাফাতে করতে আসে। তাই বললাম, " তুম সিদ্ধ ডিম ছাড়ায়েগা কে নেহি? কখন সে সেদ্ধ হোকে বৈঠা হ্যায়, দু দুটো ডিম।" শাশুড়ির ওপর ক্ষুণ্ন বউয়ের রুদ্র রূপ দেখে সুড়সুড় করে ডিম ছাড়াতে এল শৌভিক। হতভাগা সিঁটি আর ওঠে না। বিরক্ত হয়ে বরের কাছে অনুযোগ করলাম, " এ হতভাগা প্রেশার কুকার কো, লাগতা হ্যায় ম্যায় পছন্দই নেহি হ্যায়। মুঝ কো দেখকে সিঁটিই নেহি বাজাতা। বুজুকো( তুত্তুরী) বুলা কে দেখতা হুঁ। শায়দ ও পছন্দ হো যায়।"
শৌভিক এক মনে ডিম ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, "নেহি নেহি, ইয়ে না, সাত্ত্বিক প্রেশার কুকার হ্যায়।" কচু পোড়া হ্যায় বলে যেই বেরিয়ে এলাম, পি করে সিঁটি বেজে উঠল। হতভাগা প্রেশার কুকারের লাগতা হ্যায় ওরিয়েন্টেশন ম্যেই গণ্ডগোল হ্যায়। এবার থেকে শৌভিককেই রাঁধতে পাঠাব। যদি একটু তাড়াতাড়ি হয়।
আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গল ভয়ানক মন খারাপি খবরে, গতকাল রাতে মাতৃহারা হয়েছে জনৈকা বন্ধু। পাশাপাশি পাড়ায় বেড়ে উঠেছি আমরা। খবরটা পড়া ইস্তক, আশৈশব দেখে আসা কাকিমার মুখটা কেবলই ভাসছে চোখের সামনে। খুব ভাব ছিল মায়ের সাথে। রাস্তায় দেখা হয়ে গেলেই জমে উঠত আড্ডা। দুজনকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসা হত দায়। মায়ের কাছে প্রায় অনুযোগ করতেন কাকিমা, "দেখেছ ওরা কেমন আড্ডা মারে, আমাদেরও ওমন একটা হলে হত তো।" মা বলেও ছিল কথাটা আমাদের। লুফেও নিয়েছিলাম আমরা।বাবা - মায়েদের নিয়ে গেট্টু। তারপর যা হয় আরকি, আজ হবে, কাল হবে করে আর হয়ে ওঠেনি। হুড়মুড় করে চলে এসেছে অতিমারি, বদলে দিয়েছে জীবনের ধাঁচ-
আমার কেমন যেন ধারণা ছিল ছোটবেলায়, যে বড় হয়ে গেলে হয়তো বাবা মায়ের সাথে বিচ্ছেদটা আর অত কষ্টকর হবে না। বড়দের তেমন ভাবে কাঁদতে দেখিনি যে। আজ প্রতি পদে মনে হয় কি চরম বোকা ছিলাম আমি। বয়স যত বাড়ছে, প্রতিটা মুহূর্তে আরো আরো বেশি করে যেন আঁকড়ে ধরছি ওদের। বিচ্ছেদের কথা ভাবতেও বন্ধ হয়ে আসে দম। অন্ধকার হয়ে পড়ে চরাচর।
সেই কথাই বলছিলাম মাকে। কাল নীরবতার জন্য ধমক খেয়েছে বলে নাকি হঠাৎ চলে যাওয়া পাড়াতুতো সহেলীর প্রতি স্মৃতিমেদুরতার জন্য জানি না, আজ মনে হল মাকে কথায় পেয়েছে। প্রায় সাত আট মিনিট স্বর্গীয় কাকিমার কথাই বলে চলল। মুঠো ফোনে কারো এত বড় প্রশস্তি, মায়ের পক্ষে এটা বিশ্বরেকর্ড বটে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ হাওয়া মোরগের মত উল্টো দিকে ঘুরে গেল মা, " এই জানিস, আমাদের আজ সকাল থেকে কি দুর্বিপাক -"।
চলন্ত বাহনের জানলা গলে যেন পলকে ঢুকে এল একরাশ উৎকন্ঠার মেঘ, কি হল আবার? মাকে আজ যেন গপ্পে পেয়েছে, "শোন না, সে কি বিপদ! আমি তো আজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠেছি।" অধীর হয়ে বললাম, "আরে ইতিহাস পরে শুনব, আপাতত কি হয়েছে সেটা তো বলো -"। "এই বলছি শোন না। উঠে দেখি, বাইরের আবহাওয়া তেমন ভালো নয়। মেঘ করে আছে, টিপটিপ করে বৃষ্টিও পড়ছে। তারই মধ্যে গেলাম সদর দরজা খুলতে।"
আবার বললাম, এবার বেশ খানিকটা গলা তুলে, "আরে হয়েছেটা কি?" ফোনের ওপারে ব্যঙ্গ করে "হেহেঃ" হেসে উঠল একবার বাবা। মায়ের কোন হেলদোল নেই, " শোন না, তোর বাবার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না বলে, আজ আর উঠতে দিইনি, আমিও আর শুইনি। কাজের মেয়েটা আসবে বলে, একটা চেয়ার নিয়ে গিয়ে রোয়াকেই বসে রইলাম। ভাগ্যে বৃষ্টিটা থেমে ছিল। বসে বসে ঢুলচি -"।
আরে ধুৎ, আসল কথাটা তো বলো। বাবা আবার আওয়াজ দিল, "হোহো রাজা খাঃ"। এর মানে কি তার উত্তর কেবল আমার পিতৃদেবই জানেন। মায়ের অবস্থা সত্যি "ছুটলে কথা থামায় কে? আজকে ঠেকায় আমায় কে?" বলেই চলে, " তিনি আসলেন বেলা সাড়ে সাতটায়। এসে দুমিনিটে তার ঝাঁট দেওয়া, মোছা হয়ে গেল। দুমদাম করে বাসন মাজল, চলে যাচ্ছে যখন বললাম, একটু দোতলা টা ঝাঁট দিয়ে আয় না। আমায় মুখ বেঁকিয়ে বলল, ' আজ পারবুনি -'।" স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, " আচ্ছা এটাই তাহলে তোমার দুর্বিপাক।"
"নাঃ, নাঃ। শোন না।" উদ্বেগ মেশানো পান চিবানো আড্ডার মেজাজে বলে মা। " তারপর তোর বাবা উঠল,উঠেই এক কাপ চা চাইল। বাসি জামাকাপড় ছেড়ে, পুজো করলাম। চা বানালাম -"। গাড়ির কাঁচে ঠকঠক করে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বললাম, দোহাই মা, এবার তো বলো কি হয়েছে। আর উত্তেজনা সইতে পারছি না। আরো মিনিট খানেক এমন অনির্বচনীয় যাতনা দেবার পর, অবশেষে জানা গেল,যুগলে চা পান সমাপন করে, মেশিনে বাসি কাপড় কাচতে গিয়ে মা আবিষ্কার করেছে, ট্যাংকের সব জল কিভাবে যেন শেষ হয়ে গেছে।
সত্য যখন উদ্ঘাটিত হয়েছে, ততক্ষণে রীতিমত মাথা ঘুরছে, বাস্তবিক ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কোনমতে শুধু বললাম, ঘাট হয়েছে, বেশি কথা বলো না বলে কাল তোমায় বকার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছি। এবারের মত মার্জনা করে দাও মা জননী। ভুলে গিয়েছিলাম, বয়স যতই বাড়ুক, মা চিরকাল মা'ই থাকে। এক উচ্চতর জীব, যার পদাঙ্ক তো অনুসরণ করা যায়, কিন্তু যাকে কখনও ছাপিয়ে যাওয়া যায় না।
No comments:
Post a Comment