#অনিরডাইরি
সদ্য অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি, মুখ হাতটা ও ভালো করে ধুইনি, এক মুঠো খুচরো পয়সা, দু চারটে ভাঁজ করা ময়লার নোট আমার সামনে ফেলল তুত্তুরী। "মা এতে ১১৩ টাকা আছে, তুমি খুচরো গুলো নিয়ে আমাকে গোটা নোট দিতে পারবে?" সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন রে? আর তুই এত টাকা পেলি কোথা থেকে?" সামান্য নার্ভাস হয়ে বার কয়েক নাক চুলকে তিনি জবাব দিলেন," ওই যে তোমরা মাঝেমধ্যে টাকা দাও না, স্কুলে যদি কোন দরকার পড়ে বা কিছু কিনে খেতে ইচ্ছে করে-সেটাই জমিয়ে রেখেছিলাম। রথের দিনও কিছু টাকা পেয়েছিলাম।"
আবার প্রশ্ন করি, "তুই এই টাকাটা নিয়ে করবি কি?" জবাব আসে, স্কুলে কোন এনজিও থেকে এসে বলেছে কিছু চাঁদা তুলে দিতে, দাতব্য বৃদ্ধাবাস বানানো হবে। যারা ১০০ বা তার বেশি তুলবে তাদের কোন ফুটবলারের অটোগ্রাফ দেওয়া হবে যেন। চোখের সামনে থেকে সরে যায় না জানি কতগুলো বছর, ভেসে ওঠে সাদাকালো কিছু দৃশ্য। এমনই একটা এনজিও এসেছিল আমাদের স্কুলেও। এমনি মাত্রা ধার্য হয়েছিল চাঁদার। মাত্রা ছাড়াতে পারলে জুটত তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অটোগ্রাফ। পেয়েও ছিলাম আমি, লম্বা সাদা কাগজে পাশাপাশি দুটো কলামে বারো জন ক্রিকেটারের নাম আর স্বাক্ষরের সস্তা ফটোকপি। আজও রাখা আছে কাগজটা, যত্ন করে হাওড়ার বাড়িতে।
খানিক কথা বলেই বুঝলাম, “আবার সে এসেছে ফিরিয়া”। বললাম, বৃদ্ধাবাসের জন্য চাঁদা তোলা তো খুব ভালো কথা, তো চাদা তুললেই তো পারিস। জমানো ব্যাঙের আধুলি খরচা করছিস কেন? "কার থেকে চাঁদা চাইব মা? কিভাবে চাঁদা চাইব মা?" কাতর স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। বাইরের ঘরে বসে সকালের বাসি সংবাদ পত্রখানা রিভিশন দিচ্ছিলেন শ্বশুরমশাই, ইশারাতে বললাম, "ধর দাদুকে।"
সঠিক পথ দেখিয়েছি, অচীরেই বুঝতে পারলাম। পিতামহ শুধু নিজে দিলেন তাই না, পিতমহীর নামেও দিলেন। সেই খবর মুঠোফোনে যখন হাওড়া পৌঁছালো, তুত্তুরীর মাতামহ জানতে চাইল, "দাদু কত দিয়েছে? আচ্ছা, ওর ডবল তুমি আমার নামে লেখো। আচ্ছা, ঠাম্মার নামেও দিয়েছে! তুমি আমার পাশাপাশি মামমাম (দিদা), দিদি (পিসি), আর লক্ষ্মীর (আয়া দিদি) নামও লেখো।" নাম লেখা তো হল, টাকাটা হাওড়া থেকে আসবে কি করে? দাদু উদার স্বরে বলল, " তোমার মাকে দিয়ে দিতে বল। হাওড়া এলে আমি দিয়ে দেব। এমনি দেবে না, আমার মেয়েটা যা কিপটে, বলো তোমারটাও দাদু দিয়ে দেবে বলেছে।"
গল্প এখানেই থামল না রোজ বাড়ি ফিরি আর দেখি উত্তরোত্তর বাড়ছে চাঁদা দেওয়া লোকের সংখ্যা। তুত্তুরী মুখ ফুটে না চাইতেই বাড়ছে, শাশুড়ি মায়ের জন্য যে আয়া দিদিকে রাখা হয়েছে, তিনি দিয়েছেন। বাংলায় রান্না করে যে ছেলেটি, সে আর তার চার দিদি দিয়েছে। তুত্তুরীর মাসি, তার দুই মেয়ে, জামাই, নাতি সবার নাম লেখা রয়েছে কাগজে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চাঁদার অঙ্ক। চওড়া হচ্ছে মেয়ের মুখের হাসি। বুঝতে পারি পাশ করে গেছি পরীক্ষায়।
দিন কয়েক পরের কথা, অফিস থেকে ফিরেছি, দেখি মেয়ের মুখ ভার। চোখ ছলছল। "তোমার কি একটু সময় হবে?" কান্না চেপে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। ১৫০ কিলোমিটারের দৈনন্দিন যাতায়াত, গুচ্ছের দপ্তরী ঝামেলা আর জটিলতায় জেরবার হয়ে বিকট তিতকুটে মুডে সদ্য বাড়িতে পা রেখেছি। কয়েক মুহূর্ত আগেও শারীরিক ক্লান্তি আর মানসিক তিক্ততায় ভেঙ্গে পড়তে চাইছিল শরীর, মেয়ের অবস্থা দেখে কোথায় যেন উবে গেল সব ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা। অফিসের ঘেমো পোশাক, নোংরা হাতপায়েই ধপ করে বসে পড়ি, "কি হয়েছে বাবু?" বিশদে শুনি, শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছে তুত্তুরীর ক্লাশ। তাতে আমন্ত্রণ জানানো হবে স্কুলের সব স্যার আর ম্যাডামদের। ছাত্রছাত্রীদের নাচ-গান-আবৃত্তি-শ্রুতিনাটকে ঠাসা জমজমাট অনুষ্ঠান। ইংরেজি-বাংলা দুটোই ভালো বলতে পারে বলে, ক্লাসের সর্বসম্মতিক্রমে এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা বর্তেছে তুত্তুরীর ওপর। কাজটা খুব পছন্দ ওর। আজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হঠাৎ তার অডিশন নিতে আসেন কোন স্যার। তিনি যখন আসেন, টিফিন খেয়ে হাত ধুতে গিয়েছিল তুত্তুরী। ক্লাস যে চার পাঁচজন ছেলেমেয়েকে সিলেক্ট করেছে, ও ছাড়া বাকিরা কপাল গুণে ক্লাসেই ছিল। তারা অডিশন দিয়েওছে, সব শেষে স্যার যখন জানতে চেয়েছেন, আর কেউ দেবে কি না, তখন কয়েকজন তুত্তুরীর নাম বলেছে, আর একজন বলেছে, "ওর অডিশন নেবার দরকার নেই স্যার, ও খুব একটা স্মার্ট নয় আর একটু তোতলায়।" সেই শুনে স্যার, আর অপেক্ষা করেননি, চলে গেছেন।
যে মেয়েটি বলেছে,আজ সকালেও তার গুণমুগ্ধ ছিল তুত্তুরী। তার মুখে এই কথা তুত্তুরীর কাছে চরম বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। " মা তুমি বলো, আমি কি তোতলাই? ও কেন এমন করল মা?" ক্রন্দসী কন্যাকে কি বলে সান্ত্বনা দিই খানিক মাথায় আসে না। বুঝতে পারি এবারের পরীক্ষা বেশ কঠিন। "ওকে তো আমি ভালো বন্ধু ভাবতাম মা। গত বছর নভেম্বরে যখন ভর্তি হলাম, ও আমাকে ওর সব খাতা দিয়েছিল। আমিও দিই। টিফিন ভাগ করে খাই আজও -"। বলতে ইচ্ছে করে, এই তো জীবন কালিদা। এটাই মানবচরিত্র। বলতে ইচ্ছে করে, জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতি পদে তুমি এমন মানুষ পাবে।
বলি না। কি দরকার, কয়েকটা পুঁচকে ছেলেমেয়ের ঝামেলায় নাক গলিয়ে, কি দরকার এত অল্প বয়সে মেয়ের মন বিষিয়ে দিয়ে। বরং স্বাবলম্বী হবার শিক্ষা দিই। ঢোঁক গিলে বলি, “ব্যাপারটা কি তোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ?” জোরে জোরে মাথা নাড়ে তুত্তুরী। তাহলে তো তোর জন্য, তোকেই লড়তে হবে। স্যারকে গিয়ে বলতে হবে, “আমাকে অডিশন দেবার একটা সুযোগ দিন।” তারপর উনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই মাথা নত করে মেনে নিতে হবে। ব্যাপারটা বেশ মনে ধরে তুত্তুরীর, সাময়িক ভাবে মনে হয় পাশ করে গেছি, ভুল ভাঙে, পরদিন প্রভাতে।
ভোর বেলা ঢুলতে ঢুলতে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে যাচ্ছি, অন্যমনস্ক ভাবে তুত্তুরী বলল, “ধর মা, স্যার আমার অডিশন নিলেন, নিয়ে আমায় সিলেক্ট করলেন, তাহলে তো আমার জন্য আমার অন্য বন্ধুরা বাদ পড়ে যাবে, ওদের ও বিশ্বাসভঙ্গ হবে। তখন ওরাও তো ওদের মায়েদের কাছে আমার নামে একই কথা বলবে, তাই না?” ঘুমন্ত মস্তিষ্ককে কয়েক ঘা বেত্রাঘাত করে জাগিয়ে, সামান্য ভেবে বলি, সে সিদ্ধান্ত তো তোমাকেই নিতে হবে সোনা। যদি মনে করো, এটা তোমাকে পেতেই হবে, তাহলে লড়ো, আর যদি মনে করো, তোমার জন্য তোমার বন্ধুদের হৃদয় ভঙ্গ হবে, তাহলে লড়ো না। সমস্যাটা তোমার, তুমি যাই সিদ্ধান্ত নেবে, তাকেই আমি সম্মান করব। বিন্দুমাত্র ‘জাজ’ করব না। “থাঙ্কু মা” বলে এক গাল হেসে গাড়ি থেকে নেমে যায় তুত্তুরী।
দুপুর তিনটে নাগাদ সবে টিফিন বাক্সটা খুলেছি, মাসির মোবাইল থেকে উত্তেজিত তুত্তুরীর ফোন, “মা, মা আমি চান্স পেয়ে গেছি।” মেয়ের চিৎকারে বিষম খেয়ে খানিক কেশে বললাম, “আর বন্ধুরা?” তুত্তুরী বলল, “তুমি জানো, আমার জন্য ওরা কত বড় সাক্রিফাইজ করতে যাচ্ছিল, ওরা দল বেঁধে স্যারকে বলতে যাচ্ছিল, আমাদের চাই না, পুরোযাকে একটা সুযোগ দিন। যে বলেছিল আমি তোতলাই, সেও এসে ক্ষমা চাইল। আমি বললাম, ঠিক আছে, কাউকে কারো জন্য সাক্রিফাইজ করতে হবে না। চল সবাই মিলে গিয়ে স্যারকে বলি, মে দা বেস্ট ওয়ান উইন।” ফোন রেখে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই, না তুত্তুরী নির্বাচিত হয়েছে, তাই জন্য নয়, মা হিসেবে পাশ করেছি বলে। যেদিন থেকে মাতৃত্বের শিরোপা পরেছি, এটাই তো করে আসছি। কত রকম যে পরীক্ষা দিয়ে চলেছি, প্রতিটা মুহূর্তে, কখনও পাশ করছি, কখনও ডাহা ফেল। তিনি আমার সূর্য, তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলেছে আমার জীবন। প্রতিটা দিন, রাত, মুহূর্ত জুড়ে রাজত্ব করেন কেবল তিনি। আর আপনারা বলেন কেবল আজ নাকি কন্যা দিবস।
No comments:
Post a Comment