#অনিরডাইরি
অনেকদিন পর ফোন করেছিলাম মেয়েটাকে। কর্মসূত্রে আলাপ হলেও, এককালে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলাম একে অপরের। তারপর যা হয় আর কি, দীর্ঘ অদর্শনে ধুলো জমেছে সেই সব উষ্ণ স্মৃতির সরণীগুলোয়। কি যেন ঘটনা প্রসঙ্গে হঠাৎই মনে পড়ে গেল আজ।
পুরাণ নম্বরটা দেখলাম অবিকৃত আছে। ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল ওপাশের মুঠোফোন। ভেসে এল ক্লান্ত অথচ উষ্ণ আওয়াজ,"কেমন আছেন ম্যাডাম?" হেসে জবাব দিলাম, ভালো আছি। এবার আমার কুশল সংবাদ সংগ্রহের পালা, জিজ্ঞাসা করলাম তুমি/তোমরা কেমন আছ?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটি বলল," আমি একদম ভালো নেই ম্যাডাম। আমার সংসার, আমার জীবন সবকিছু বদলে গেছে বিগত এক বছরে।ওলটপালট হয়ে গেছে সবকিছু। রোজ ভাবতাম, আপনাকে ফোন করব। আপনি লেখেন তো-"।
কি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে মেয়েটা! কাঠবাঙাল, তাই বরাবরই সাংঘাতিক আবেগপ্রবণ এবং বেশ ছিঁচকাঁদুনে ছিল মেয়েটা। আপনজনদের কারো কিছু হলে আর দেখতে হত না। কেঁদে ভাসাত। তেমনি কিছু হয়েছে নিশ্চিত।কিন্তু তার সাথে আমার লেখালেখির কি সম্পর্ক? গলায় একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করি, কি হয়েছে?
মেয়েটা বলে," কাউকে বলিনি এতদিন ম্যাডাম, কি ব্যথা যে বুকে চেপে আছি। কাঁদতেও পারিনি। আপনি বলতেন না, আমি ছিঁচকাঁদুনে, গত এক বছরে এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলিনি, ফেলতে পারিনি ম্যাডাম। সব সময় উৎকণ্ঠায় থেকেছি। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে আমার বরকে পাশে না পেলেই মনে হত ওকে হারিয়ে ফেললাম বুঝি, চিরতরে।"
ধুমকে উঠি আমি, কি আজেবাজে কথা বলছ! মেয়েটা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, " হ্যাঁ ম্যাডাম। আপনাকে বলতে গিয়ে আজ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেবল মনে হত, ও সুইসাইড করল বুঝি।" নির্বাক আমি, মাথার উপর বনবন করে ঘোরে পাখাটা, দরজা খুলে মুখ বাড়ায় সৌম্য, " ম্যাডাম, ফাইনাল পেমেন্টগুলো নিয়ে আসি?" ইশারায় বলি ৫ মিনিট, তারপর তোমায় ডাকছি।
ঘর ফাঁকা হতে গলা ঝেড়ে আবার বলি, কি যাতা বলছ? মেয়েটা বলে, " যাতা নয় ম্যাডাম, একদম সত্যি। জানেন, আমার বরের নামে থানায় নালিশ করা হয়েছিল যে, ও, ওর এক মহিলা সহকর্মীকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে--।" ঘরে সেই মুহূর্তে বাজ পড়লেও বুঝি এত চমকাতাম না। হতভম্ব হয়ে বলি কি বলছ? তোমার বর-। কথা শেষ করতে দেয় না মেয়েটা, জোর গলায় বলে ওঠে " হ্যাঁ ম্যাডাম। গত পুজোর ঘটনা। এখন কোর্টে কেস চলছে। আমি ঠিক করেছিলাম, কেস মিটলেই আপনাকে ফোন করব।"
কি বলি বুঝতে না পেরে নীরব থাকি। ব্যাপারটা গলা দিয়ে নামতেই চায় না, মাথায় বসতেই চায় না। মেয়েটাও থমকে থাকে খানিকক্ষণ, হয়তো কিছুটা গুছিয়ে নেয় নিজেকে। তারপর বলে, " যে ভাষায় নালিশ করেছে ম্যাডাম, আমি আপনাকে বলতে পারব না। পড়তে গিয়ে গা গুলিয়ে বমি আসে। দৈহিক সৌষ্ঠবের এমন বাজারী বিবরণ দিয়েছে, রগরগে ভাষায় লিখেছে কিভাবে আমার বর আর ওর অন্য এক সহকর্মী মিলে ওকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে।"
"আসলে কি হয়েছে জানেন তো, বড় দাদা ধরে চাকরি পেয়েছে মেয়েটা। যখন খুশি অফিসে আসে যখন খুশি বেরিয়ে যায় একটা কাজ দিলে পারেও না, করেও না। যতক্ষণ অফিসে থাকে মোবাইলে গান শুনে আর না হলে এর-ওর টেবিলে আড্ডা মেরে বেড়ায়। ওকে বদলি করার একটা চেষ্টা কর্তৃপক্ষ চালাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। গত পুজোর আগে অর্ডারও এসে গেল অথচ মেয়েটা গেলই না। জাস্ট গেল না। এত বড় ধৃষ্টতা যে রিলিজ অর্ডারটাও নিল না। আগের মতোই নিজের ইচ্ছেয় আসত, যেত, অ্যাটেনডেন্স খাতায় সই করত।
আমার বর একদিন রেগে গিয়ে করল কি, হাজিরার সময় উত্তীর্ণ হতেই, খাতাটা তুলে আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিল। মেয়েটা ওর সময় মতন এসে যখন দেখল সই করতে পারছে না, সোজা নিকটবর্তী আইন রক্ষকদের কাছে গিয়ে লিখিত নালিশ করে বসল।
এই অবধি শুনেই থামিয়ে দিলাম আমি, " Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act, 2013" প্রায় কণ্ঠস্থ আমার এবং তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা বা নির্যাতন সংক্রান্ত নালিশ সর্বাগ্রে করতে হয় Internal Complaints Commttee বা ICCর কাছে। নিয়ম অনুসারে প্রতিটি অফিসে এমন একটি কমিটি গড়ার কথাও আইনেই বলা আছে। যদি না থাকে, বা যদি নালিশ খোদ নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধেই হয়, তবে তা করতে হবে জেলাশাসক কর্তৃক গঠিত Local Complaints Committeeর কাছে। তারাই সমগ্র কেসটা তদন্ত করে শাস্তি বিধান করবেন। প্রয়োজনে তাঁরাই আইন রক্ষকদের দ্বারস্থ হওয়ার সুপারিশ করবেন। তাহলে সেই মেয়েটির নালিশ গ্রাহ্য হল কেন?
চিড়বিড়ে তিতো গলায় মেয়েটি বলল, "জানি না ম্যাডাম। হয়তো ওর দেশওয়ালি ভাই বন্ধু কেউ ছিল। সোজা কেস ঠুকে দিয়েছে।" পরক্ষণেই ভারী হয়ে আসা গলায় মেয়েটি বলে, " পুজোর আগে কার যে নজর লাগল আমার সংসারে। গোটা অফিস ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমিও। তাসত্ত্বেও এত ভেঙে পড়েছিল আমার বর কি বলব। রাতের পর রাত ঘুমাতো না, অফিস যেতে চাইত না, কুঁকড়ে বসে থাকত ঘরের এক কোণায় আর কেবল বলত, 'এই পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকারই নেই।' বলতো,' আমি মরি না কেন'। রাতের অন্ধকারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদত। কি দিন যে গেছে ম্যাডাম।"
আমি ব্যথিত। আমি নির্বাক। আমি বাকরুদ্ধ। আমি ক্রুদ্ধ। ভাঁওরি দেবী প্রকাশ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, নিজের দপ্তরী কাজটুকু করতে গিয়ে। বিচার পাননি কোথাও। ভবিষ্যতের ভাঁওরি দেবীদের নররাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১৩ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন আনে ভারত সরকার। তাও হয়তো আনত না। যদি না নতুন করে গণধর্ষিত হতো ২২ বছরের জ্যোতি সিং, যাকে তদানীন্তন ভারতবাসী আদর করে নাম দিয়েছিল নির্ভয়া। সেই আইনের অপব্যবহার মানে প্রতিটি ধর্ষিত, নির্যাতিত নারীকে পুনরায় নতুন করে, জনসমক্ষে বেআব্রু করে দেওয়া। কোন নিন্দা, কোন ধিক্কারই এর জন্য যথেষ্ট নয়।
মেয়েটি বলে, "জানেন ম্যাডাম,এখন ওই মেয়েটা চায় মিটমাট করে নিতে। আমাদের উকিলের কাছে লোক পাঠিয়ে বলেছে, ও রাগের মাথায় কাজটা করে ফেলেছে। এখন কেসটা তুলে নিতে চায়। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ব না। কিছুতেই না।একজন সমর্থ পুরুষ মানুষকে কাঁদতে দেখা যে কি মর্মান্তিক ম্যাডাম,বিশেষ করে সে যদি আপনার প্রিয়জন হয়। আমার বরের প্রতিটা ফোঁটা চোখের জল আমি ওর থেকে উসুল করব। চলুক মামলা।"
আর আমি বলি, লড়ো। লড়ে যাও ভালোবাসার মানুষটির জন্য। ছেড়ো না মেয়েটিকে। এই আইনের অবমাননা করার এত বড় ধৃষ্টতা হয় কি করে? এই কেস তো তোমরা জিতবেই, আমার পূর্ণ শুভেচ্ছা রইল। তারপরেও থেমে যেও না যেন। মানহানির মামলা অবশ্যই দায়েব করো। এমন নজির সৃষ্টি করো যে দ্বিতীয়বার এই আইনকে খেলো করার সাহস যেন কেউ না পায়। তারপর দেখা করো আমার সাথে। সেদিন আর গোপন রাখবো না তোমাদের পরিচয়। নাম-ধাম-ছবিসহ ডায়েরি লিখব আমি। অনির নয়, তোমাদের ডাইরি। এক সারভাইভার দম্পতির ডাইরি। সেই দিনের অপেক্ষাতেই রইলাম।
No comments:
Post a Comment