Friday 17 May 2024

অনির ডাইরি মে, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৭শে মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় বেজে উঠল পাশে অনাদরে পড়ে থাকা মুঠো ফোনটা। কোন মতে হাত বাড়িয়ে কানে ঠেকাতেই, ওপাশ থেকে ভেসে এল চেনা, ছদ্ম কন্ঠস্বর, " দরজা খুলতে কি শ্বশুরমশাইকে ফোন করব?" অষ্টপ্রহর আমার বুড়ো বাপটাকে ধরে টানাটানি করে লোকটা। বিরক্ত হয়ে কিছুদিন আগেও বলতাম, " কেন? তোর ও তো একটা বাবা আছে, মাঝে মধ্যে তাকে ধরেও তো টানতে পারিস।" শ্বশুরমশাই চলে যাবার পর থেকে কথাটা আর বলতে পারি না। সেই সুযোগে লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে শয়তানটা। 


গজগজ করতে করতে উঠে দিয়ে দরজা খুলে দিই। সাড়ে তিনটে অবধি তো জেগে ছিলাম আমিও। মাঝে মাঝেই চলছিল টুকরোটাকরা বার্তা বিনিময়। এটা আমার আজকের নয়, বিগত ১৬ বছরের অভ্যাস। শৌভিক রাত জাগলেই রাত জাগি আমি। মাঝে,মাঝেই ফোন- মেসেজ করে জানাই, একা নও, আমিও "জেগে আছি"। 


আগে একাকীই জাগতাম, ইদানিং অনেক রাত পর্যন্ত সঙ্গ দেয় তুত্তুরী। গতকালও রাত দেড়টা অবধি জেগেছে মেয়েটা। আরো হয়তো জাগত খানিকক্ষণ, আমার দোষেই রাগ করে নিজের ঘরে চলে গেল। আসলে হয়েছে কি,রাত দেড়টা অবধি আসন্ন অলিম্পিক, খেলার জগৎ, খেলা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির ওপর এন্তার বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দেওয়ার পর, তাঁর মনে হয়েছে, মাকে একটা ধাঁধা ধরা যাক। সেটা যে ধাঁধা, সেই ঘোষণা ব্যতিরেকেই তিনি আমায় শুধালেন, " বলো তো মা, Bay of Bengal কোন state?" 


আমার সাদা মনে কোন কাদা নেই মাইরি, আমি বললাম, "বঙ্গোপসাগর কোন একটা স্টেটে কেন থাকবে? ভারতের গোটা পূর্ব উপকূল জুড়েই তো -"। তিনি সবজান্তা হাসি হেসে বললেন, " পারলে না তো? Bay of Bengal is in liquid state, এটা তো সবাই জানে।" কেমন রাগটা ধরে। শাণিত জিহ্বাকে শাসন করে, বললাম, " এবার আমি একটা প্রশ্ন শুধাচ্ছি,জবাব দে দেখি, বঙ্গোপসাগর ভারতের কোন কোন রাজ্যের সীমানা স্পর্শ করে -"। তিনি চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে শুরু করলেন, " বাংলা - উড়িষ্যা -"। তারপর অখণ্ড নীরবতা, তিনি ভাবছেন। ভেবে টেবে বললেন, " আসাম"। শায়িত অবস্থা থেকে উঠে বসলাম আমি। বললাম, " আসামের ধারে পাশে কোন সমুদ্র নেই।" ভড়কে গেলেন তিনি, ঢোঁক গিলে বললেন, " ঝাড়খণ্ড?" বললাম "land locked state।" এরপর একের পর এক উড়ে এল, " মহারাষ্ট্র এবং কেরালা।"


হাসতে হাসতে বিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। মোটামুটি তুত্তুরীর বয়সেই আমার এক প্রিয় বান্ধবী ডিব্রুগড় তৈল খনির ম্যাপ পয়েন্টিং করেছিল অধুনা ছত্রিশ গড়ে। এখন অবশ্য তিনি জাঁদরেল দিদিমণি। ছাত্রছাত্রীদের কান ধরে ভূগোল পড়ান। সেটাই বললাম তুত্তুরীকে। বললাম, কাল সকালে ভারতের মানচিত্র মুখস্ত করবি। তাতে তিনি রেগে গরগর করতে করতে চলে গেলেন, যাবার সময় বলে গেলেন, " নিজে ভূগোলে ভালো বলে কি অহংকার।"


সেটাও সবিস্তারে লিখেছিলাম শৌভিককে। রাত সাড়ে তিনটে অবধি রেমালের গতিপ্রকৃতি নিয়ে মিনিটে মিনিটে windy দেখছি আমি। আর আকুল প্রার্থনা করছি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে, একে তো ভোট নিয়ে জেরবার এই বঙ্গ, এরওপর তুফানের অভিঘাত যে বড় সাংঘাতিক হয়ে যাবে। অন্তত আমার বরের কাছে। জীবনের কঠিনতম অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলছে লোকটা। এমন ত্রহ্যস্পর্শ যোগ সচরাচর দেখা যায় না। একে তো নির্বাচনী গুঁতো, তারওপর নির্বাচনের ঠিক এগারো দিন পূর্বে আকস্মিক পিতৃবিয়োগ। তারও ওপর রেমাল বাবুর আগমনী। এবারেরটা প্লিজ তুমি নিয়ে নাও। পরের বারেরটা পাক্কা আমরা নিয়ে নেব। 


তারপরই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে আর কতটুকুই বা, ঘরের লোক ঘরে ফিরে এসেছে,এবার আরাম করে ঘুমাব। সে গুড়ে বালি, জ্বর নিয়ে ফিরেছেন তিনি। প্যারাসিটামল দিয়ে গরম কালো কফি খেয়ে, মাত্র কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার যখন বেরোল শৌভিক,বলে গেল, " অপেক্ষা না করে খেয়ে নিস। কাঁথির কাজ গুটিয়ে, আমায় একবার দীঘা যেতে হবে।" 


আকাশের মুখ ভার, বইছে জোরালো বাতাস। সাথে ক্রমশই বাঁধন হারা হচ্ছে বৃষ্টি। জলভরা বাতাসের দাপটে ছিটকে পড়ছে বাগানের টব গুলো। "এমন দিনে তারে বলা যায়", বলাই যায়। বললামও, "আমাকে নিয়ে যাবে? প্লিজ?" জীবনের নানা ওঠাপড়ার মাঝে কবে যে আমাদের বিয়ের দিনটা এসে চলে গেছে,মনে রাখিনি কেউই। দেশ জোড়া গর্বের পর্বের মধ্যে, তা রাখার কথাও নয়। কিন্তু আজ তো আর সেই চাপ নেই, আজকের দিনটা তো একসাথে থাকাই যায়। 


জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে শৌভিক বলল, " কে বলল নেই? চাপের বাবা, কাকা, মেসোশ্বশুর সবাই আছে। গিয়ে যদি চুপ করে বসে থাকতে আপত্তি। না থাকে তো চল। আমাকে কিন্তু বিরক্ত করা চলবে না। আমাকে আমার কাজ করতে দিতে হবে। রাজি?" তাই সই, মামা না থাকার থেকে কানা মামাই ভালো বাপু। পরিস্থিতি অনুকূল হোক বা প্রতিকূল একসাথে থাকতে পারাটাই আসল। বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।


অনির ডাইরি ২৩শে মে, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 



বেশ কিছুদিন আগের কথা, অফিস থেকে ফিরে শ্রীমতী তুত্তুরীকে পড়তে বসিয়েছি, হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুঠোফোনটা। অচেনা নম্বর হলেও চিনতে পারলাম, আজ সকালেই বোধহয় ফোন এসেছিল এই নম্বরটা থেকে। তখন ধরতে পারিনি। এখন ধরলাম, ওপাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ বলল, " ম্যাডাম আমি অঞ্জন।" কোন অঞ্জন, এই নামে একাধিক ব্যক্তিকে চিনি। জবাব এল,ম্যাডাম আমি SLO অঞ্জন, তমলুক ব্লক। 


চিনতে আর কোন সমস্যা হল না। আমার সাথে চেহারা গত সাদৃশ্যের জন্য, অঞ্জনকে আমি আলাদা করে গোবলু SLO বলে ডাকি। অঞ্জনের ফোন পেয়ে প্রমাদ গুনলাম। আমার এই গোবলু SLO টি মাঝে মধ্যেই আমাকে রচনাসম মেসেজ পাঠায়। মেসেজ গুলো শুরু হয়, " ম্যাডাম আপনি কত ভালো" দিয়ে এবং শেষ হয়, " আমার সাথে কেন এমন হয়েছে? আমার খুব দুঃখ হয়েছে" এবং "মার্জনা করবেন ম্যাডাম, আমি আপনার নির্দেশ পালনে অপারগ।" 


শতাধিক সদস্য নিয়ে গঠিত আমার তাম্রলিপ্ত পরিবার। সবাই আমার কাছে সমান গুরুত্বপুর্ণ, সমান স্নেহের পাত্র, সবাইকে সমান ভালোবাসি। কিন্তু বিভিন্ন রোগের যেমন বিভিন্ন দাওয়াই হয়, তেমনি বিভিন্ন সহকর্মীকে ও বিভিন্ন ভাবে সামলাতে হয়। কাউকে বেপোট ধমকাতে হয়, "কেটেই ফেলব" না বললে জাস্ট সে নড়ে না, আবার কাউকে বকলেই কেলো। তাদের সোনা,বাবা, বাছা না বললে সে নড়ে না। অঞ্জন দ্বিতীয় পর্যায় ভুক্ত। অঞ্জনের সব অভিযোগ যে সব সময় আমি মেটাতে পারি, তা নয়। যাদের নামে দুদিন আগে আমার কাছে নালিশ করে, দুদিন পর তারাই এসে পান চিবাতে চিবাতে বলে যায়, "ম্যাডাম আজ ব্লকে অঞ্জন দা খাওয়াল। কি ভালো মুর্গীর ঝোলটা যে হয়েছিল। আর তরকারিটা ম্যাডাম, উফ কি বলব আপনাকে -"। মনে হয় ব্যাটাদের কান ধরে ঘর থেকেই বার করে দি। আর অঞ্জনটাকে দিই ব্লক করে। 


তেমনি কিছু আসতে চলেছে ভেবে বললাম, "বলো"। অঞ্জন বলল, " কাল অফিসে থাকবেন ম্যাডাম? আমি একটু যাব নিমন্ত্রণ করতে।" কিসের নিমন্ত্রণ রে, বিয়ে করছ নাকি? তাই সবাইকে মুরগির ঝোল আর তরকারি খাইয়েছ? অঞ্জন এক গলা জিভ কেটে বলে, "না না ম্যাডাম। বিয়ে তো অনেকদিন আগেই করেছি। আসলে আমার মেয়ের জন্মদিন। বর্গভীমা মন্দিরে ওই দিন ভোগ দেব। আপনাদের সকলের নিমন্ত্রণ। প্লিজ আসবেন।"


বললাম সে তো আসবই, কিন্তু তোমাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে নি। আমি বলে দিলেই সবাই চলে যাবে। তাও কথা শুনল না অঞ্জন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি, গোটা রাজ্য পুড়ছে অকস্মাৎ তাপ প্রবাহে, তারই মধ্যে ঘোর দ্বিপ্রহরে এসে হাজির হল অঞ্জন। জনে জনে নিমন্ত্রণ করল আলাদা করে। আমায় তো সপরিবারে। "ম্যাডাম স্যারকে অবশ্যই আনবেন। আর তুত্তুরীকেও।" বলেই দিলাম,ওসব পারব না বাপু। একজনের স্কুল আর এক জনের নির্বাচন, কাউকে পাবে নি। আমি একা অবশ্যই যাব।


বললাম তো যাব, কিন্তু এদিকে যে উত্তরোত্তর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে বুড়ো তপন। গোটা পূব মেদিনীপুর জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। শান্তনু বলল, "খাবার না হয় লিয়ে চলে আসব ম্যাডাম। ঠাণ্ডা ঘরে বসে খেয়ে নিবেন।" ব্যাপারটা আমার যতটা পছন্দ হল, অঞ্জনের তার তিলমাত্রও হল না। " এলে অনেক ভালো হত ম্যাডাম। মেয়েটা খুব খুশি হত - "। এরপর আর কোন কথা চলে না। 


চলে না বললেও, আতঙ্ক তো যায় না। কি গরম বাপ রে! বর্গভীমা মন্দিরের নীচে জুতো খুলে ওই খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পা পুড়ে আংরা না হয়ে যায়। অফিসে শুভাশিষ, শান্তনু, নন্দন যদিও বারবার বলতে লাগল, " কিচ্ছু চিন্তা নেই ম্যাডাম। পিছন দিক দিয়ে সুন্দর রাস্তা আছে, ছায়ায় ঢাকা, দোতলায় উঠে জুতো খুলতে হয়।" হক বাবু বললেন, " দেখবেন ম্যাডাম, দেবস্থানে গরম লাগবে নি।" 


তাই সই। তারপর ও আসতে থাকে না না চিন্তা। মন্দিরে ভোগ, নির্ঘাত মাটিতে বসে খেতে হবে। শাড়ি পরে গেলে সুবিধা না সালোয়ার পরি? শান্তনু বলল, "দাঁড়ান ম্যাডাম সব খবর লিয়ে লিচ্ছি।"মিনিট দশেক পরেই ফোন, "ম্যাডাম মাটিতে বসে খাওয়ার পাশাপাশি চেয়ার টেবিলও থাকবে। অঞ্জনদা নিজে বাজার করে দিচ্ছে, মন্দিরের ভোগ ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকছে ম্যাডাম।" 


সে তো আগেই শুনেছি, নন্দন আজ সকালেই বলেছে, "তিন রকম মাছ থাকছে ম্যাডাম। বাটা, রুই আর শোল।" দেবী বর্গভীমার নিত্য ভোগ শৌভিক তমলুকের এসডিও থাকাকালীন বেশ কয়েকবার খেয়েছি। সাদা ভাত, শুক্তো, মুগ ডাল, পোস্ত ছড়ানো চৌকো করে কাটা, খোসা সমেত গুঁড়ি গুঁড়ি আলু ভাজা, শাক পাতা-কুমড়ো দিয়ে একটা তেলতেলে ঘ্যাঁট, রুই মাছের ঝাল, শোল মাছের টক আর পায়েস। সব কটি পদই অনবদ্য, অনুপম খেতে। আমরা চাটুজ্জে, আমাদের বংশে শোল মাছ ভক্ষণ নিষিদ্ধ। ভাগ্যে বিয়ে করে গোত্রান্তর হয়েছিল, নাহলে দেবীর এই অনুপম প্রাসাদ থেকে বঞ্চিত হতাম। শোল মাছের টকের কথা লিখতে বসে এখনও রসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে আমার রসনা। ঠিক করলাম, বাটা রুই নয়, ওটাই খাব কেবল, আশ মিটিয়ে। 


নির্দিষ্ট দিনে, টিফিন টাইমে গিয়ে হাজির হলাম বর্গভীমা মন্দিরের কাছে। মেয়েকে নিয়ে অঞ্জন স্বয়ং এল খিড়কি দুয়ারের পথ দেখাতে। মেয়েটি যেন হুবহু বাপের ফটো কপি। শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম, তোমার বাবাকে কিন্তু আমি অন্য নামে ডাকি। মেয়েটি এক গাল হেসে বলল, "জানি তো। তুমি বাবার নাম দিয়েছ গোবলু SLO, বাড়িতে আমিও তাই বলে ডাকি। থুড়ি রাগাই বাবাকে।" এই পুঁচকে বয়সেই নিরুপম বাচিক শিল্পী মেয়েটি। দারুণ আবৃত্তি করে, নানা জায়গা থেকে মেডেল জিতে আনে। সামান্য অনুরোধেই গোটা তিনেক শোনাল আমাদের। 


মন্দিরের ভিতরে আলো ছায়ার আজব কারিকুরি। যেখানে রোদ পড়ছে,সেখানে পা রাখা যায় না। ছায়াময় অংশটি আবার বেশ শীতল। এক্কা দোক্কা খেলার মত করে মন্দির চত্বর পার হয়ে গেলাম।মাঝখানে রাজরাণীর মত বসে আছেন দেবী বর্গভীমা। প্রচুর বিয়ে হয় এখানে। এই প্রখর রৌদ্রেও বেশ কয়েক জোড়া বর বধূ সেজেগুজে প্রস্তুত। তাদের পাশ কাটিয়ে বাম দিকে খাবার জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম আমরা। আজ গোটাটাই আমাদের জন্য সংরক্ষিত। তেমনই ব্যবস্থা করেছে অঞ্জন। 


এবার ভোজনের পালা। আমাদের জন্যই সবাই প্রতীক্ষা করছিল এতক্ষণ। একটা ছোট টেবিলে আমি, ALC নভোনীল বাবু,ইন্সপেক্টর মুকুল আর একজন অপরিচিত ব্যক্তি বসলাম,বাকিরা দলবদ্ধ ভাবে মাটিতে লম্বা করে পেতে রাখা আসনে বসে পড়ল। অঞ্জন স্বয়ং পরিবেশন করতে নামল। প্রায় দেড় মাস আগের কথা, তাও যতটুকু মনে পড়ে, প্রথমেই এল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, সাথে স্যাল্যাড, অসম্ভব ভালো শুক্তো, মুগ ডাল, ঘন্ট, পোস্ত ছড়ানো খোলা শুদ্ধ গুড়ি আলু ভাজা। প্রতিবারই ভাবি, এটা আর একটু নেব। চাইবার আগেই পরের আইটেম এসে যায় পাতে। কোনটা ফেলে কোনটা যে খাই। 


ভাবতে ভাবতেই এত্ত বড় বাটা মাছ স্বহস্তে পাতে তুলে দিল অঞ্জন। নিষেধ করার অবকাশ পেলাম না। বাটা আমার ঘোরতর অপছন্দের মাছ। এত কাঁটাওয়ালা মাছ আবার মানুষে খায়। ভেবেই এসেছিলাম, ওটা খাব না। না জিজ্ঞাসা করেই দিয়ে দিল যখন, অপচয় তো আর করতে পারি না। মুখে দিয়েই বুঝলাম, না খেলে পস্তাতাম। বাটাও এত সুস্বাদু হয়? ভাবলাম, অন্তত দুপিস টক শোল খাব। অসভ্য উদর জায়গা দিলে তো। আরো অনেক কিছু ছিল যে, চাটনি, পরমান্ন, ক্ষীরের মত দই,রসগোল্লা----। 


রাতে বাড়ি ফিরে দেখি অঞ্জন মেসেজ করেছে, "Mam আজ আপনি এসেছেন। আমার মেয়ে কে আশির্বাদ করলেন, আমি, আমার মেয়ে ও স্ত্রী খুব খুশি হয়েছি। আমরা সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি। আমার খুব ভালো লেগেছে। Mam আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে প্রনাম জানাচ্ছি।" ভালো করে পড়লাম বার কয়েক, নাহ আজ আর কোন নালিশ করেনি অঞ্জন তার ম্যাডামের কাছে।


অনির ডাইরি ১৪ই মে , ২০২৪

#অনিরডাইরি 



ঢং করে বেল বাজতেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম।ঘড়ি বলছে, রাত সাড়ে তিন-পৌনে চার। এই একটা আওয়াজের জন্যই এতক্ষণ সোফায় বসে আছি। জেগে বসে আছি লিখতে পারলাম না, কারণ বেশ বুঝতে পারছি আমার চোখ জুড়ে গিয়েছিল। 


দুঃসংবাদ আসার আধ ঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছি আমরা কাঁথি থেকে। দুটো পিট্টু ব্যাগের মধ্যে কোন মতে ভরে নিয়েছি কিছু জামাকাপড়। কি নিয়েছি, কি নিইনি জানি না। মাথাই চলছিল না। শূন্যতা বুঝি একেই বলে। গাড়ি সময়মত এসে গেলেও, কিঞ্চিৎ বিলম্ব করছিল শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষক।  উত্তেজিত হয়ে বার বার ফোন করতে করতে বাইরের বাগানে পায়চারি করছিলেন ড্রাইভার নূপুর বাবু। মাঝে মাঝে বলছিলেন, " স্যার, জানেন তো, অমুক ভট্টাচার্য সাহেব যখন এসডিও ছিলেন, ঠিক এমনি হয়েছিল। সেবারও নির্বাচন চলছিল, তারই মধ্যে ওনাকে নিয়েও এমনি মাঝ রাতে ছুটতে হয়েছিল।"


কথার সুর টেনে শৌভিক বলে, " অমুক সাহেব যখন ডায়মন্ড হারবারের এসডিও ছিলেন, নমিনেশন চলাকালীন ওনার পিতৃবয়োগ হয়। উনিও অমনি গিয়ে, দাহ করে, কাছা নিয়ে পরের দিন নমিনেশন নিয়েছিলেন।" জিজ্ঞাসা করি, "তুই কাছা নিবি না তো?" দৃঢ় ভাবে মাথা নাড়ে শৌভিক। "নিয়ম কানুন কিছু মানবি?" একই ভাবে মাথা নাড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে। জানতাম এটাই বলবে। শ্বশুর মশাই নিজে চূড়ান্ত নাস্তিক ছিলেন, দাদা শ্বশুর বা দিদি শাশুড়ি মারা যেতে মানেননি কোন নিয়ম। তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, অন্য কিছু করবে, এটা দুরাশা। 


জানাই, আমি কিন্তু মানব।  শৌভিকের নাস্তিকতা নিয়ে যতটা গর্বিত ছিলেন শ্বশুর মশাই, আমার আস্তিকতা, পুজো,উপোস ইত্যাদি নিয়ে অখুশি তো ছিলেন না। বরং ভোর বেলা টাটকা ফুল তুলে পুজো করতে দেখে এক অদ্ভুত খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ত বৃদ্ধের চোখেমুখে। 


 "বাবার বন্ধুদেরও খবর দিতে হবে -" মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে শৌভিক। " সবার নম্বর তো নেই। দীনু কাকুকে বলি, যাকে পারবে খবরটা দিয়ে দেয় যেন।" প্রায় মিনিট পনেরো পর, বাংলোর সামনে এসে দাঁড়ায় এক দ্বিচক্র যান, পিছনের আসন থেকে নেমে দৌড়ে আসে শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। কোন মতে উর্দিটা গলিয়েছেন, হাতে একটা প্লাস্টিকের ঝোলা। " সরি স্যার, আপনি ছুটি দেবার পর দিদির বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। খবর পেয়েই ছুটে আসছি।" শৌভিক প্রশ্ন করে, " খেয়ে এসেছ তো?" 


অন্ধকার হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলে গাড়ি। হৃদয়ে অদ্ভুত এক দোদুল্যমানতা, হয়তো আয়া দিদি ভুল দেখেছে। হয়তো এখুনি ফোন আসবে, " অ বড়দা, কাকু আবার জেগে উঠিছেন।" সেই ফোন আর আসে না। অন্য ফোন আসতে থাকে এক গাদা, কাকারা, পিসি, পিসেমশাই পইপই করে বলতে থাকে, " সাবধানে আয়। আমরা তো আছি।" ছোট ভাইকে ফোন করে একই কথা শোনায় শৌভিক। আজ দুর্গাপুর-আসানসোল এলাকায় ভোট ছিল,গাড়ি ঘোড়া কিছুই সহজলভ্য নয়। তারওপর সঙ্গে অত ছোট বাচ্ছা, এত রাতে কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত নেবার কোন দরকার নেই। 


নাচিন্দা মন্দিরের সামনে আলোর মালা, অক্ষয় তৃতীয়া উপলক্ষে মেলা বসেছে। এই তো মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই অফিস থেকে ফিরলাম এই পথ দিয়ে। তখন ভাবছিলাম শ্রীমতী তুত্তুরীকে যদি একবার দেখাতে পারতাম এই আলোকমালা। পাশে শুকনো মুখে বসে আছে তুত্তুরী, মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলছে, " আমার খুব ভয় করছে মা। দাদু কি সত্যিই চলে গেছে? ফুলঝুরি যে বড্ড ছোট, ওর কি দাদুর কথা আদৌ কিছু মনে থাকবে?"


রাত সোয়া একটা, ঘুমন্ত শহরের বুক চিরে গাড়ি এসে থামল চেনা বাড়িটার সামনে। আপাতদৃষ্টিতে সব একই আছে, অথচ কিছুই আর এক নেই। এত ক্ষণ মনে হচ্ছিল সময় যেন কাটছেই না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই পথ না শেষ হলেই বোধহয় ভালো ছিল। ফ্ল্যাটের বাইরে ছেড়ে রাখা এত গুলো জুতোই বলে দিচ্ছে এই বাড়িতে আজ কোন কিছুই স্বাভাবিক নেই।  চার ভাই, দুই ভাই বউ, বোন, ভগ্নিপতি, ভাইপো, ভাগ্নে, ভাগ্নে বউ ঘিরে আছে আমার মজলিশি শ্বশুরটাকে। আড্ডা দিতে বড় ভালোবাসতেন ভদ্রলোক। স্টাডি রুমের সিঙ্গেল খাটটাতে আজ একাই শুয়ে আছেন ভদ্রলোক। একটা চোখ যেন আধ বোজা, মুখটা সামান্য খোলা, ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। একটা ইঞ্চি পাড় সাদা কাপড় বুক অবধি চাপা দেওয়া। পাখার হাওয়ায় সেটা এমন থিরথির করে কাঁপছে যেন মৃদু মন্দ শ্বাস নিচ্ছেন উনি। " ক্যাথেটার নিয়ে পাজামা পরতে অসুবিধা হচ্ছিল বলাতে, আমাজন থেকে একজোড়া ধুতি অর্ডার করেছিলাম বাবার জন্য। শেষে এই কাজে লাগল ধুতিটা -!"  মৃদু অথচ হালকা সুরে কাকে যেন বলে ওঠে শৌভিক।


রাত দুটো নাগাদ একে একে বাড়ি পাঠানো হল কাকা পিসিদের। সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ, কেউই সম্পূর্ণ সুস্থ তো নয়, রাতটা একটু না জিরোলে শরীর দেবে কি করে। আবাসিক সমবায়ের জনৈক কর্তাব্যক্তি আগেই ডেকে এনেছিলেন ডাক্তার, তিনি দেখে গেছেন শ্বশুরমশাইকে। কথা দিয়ে গেছেন ভোর পাঁচটার সময় এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবেন। শববাহী গাড়ি ইত্যাদির জন্যও শৌভিককে চিন্তা করতে নিষেধ করে গেছেন। সকাল সাতটা-আটটার মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কাকা - পিসিরাও ততোক্ষণে এসে হাজির হবে সবাই। আপাতত অনন্ত প্রতীক্ষা। প্রাথমিক প্রতীক্ষা উমাদের জন্য। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ কোন মতে একটা গাড়ি যোগাড় করে দুর্গাপুর থেকে রওনা দিয়েছে উমারা। 


শ্বশুর মশাইয়ের কাছেই বসে রইল শৌভিক। ছোট ভাই বলেছে ফোনে, "বাবাকে যেন একা ছাড়িস না, দাদা। " খানিকক্ষণ আমিও বসলাম, তারপর জায়গা ছেড়ে দিলাম তুত্তুরীকে। জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখল মেয়েটা। ব্যাপারটা এখনও অনুধাবন করতে অসুবিধা হচ্ছে ওর। টেবিলের ওপর এখনও রাখা আছে শ্বশুর মশাইয়ের শেষ না করা বই, ডাইরিতে ওনার হাতে লেখা আজ পর্যন্ত কি কি ওষুধ খেয়েছেন, ঢাকা দেওয়া গ্লাসে অর্ধেক জল - সবকিছুই বাবার সাথে ভাগ করে নিতে চায় তুত্তুরী। মেয়ের মুখে সব খুঁটিনাটি শুনতে চায় শৌভিক। 


শাশুড়ি মা কিছুক্ষণ পরপরই জানতে চাইছেন, ছোট ছেলে কতদূর এল। দুঃখিত ভাবে মাথা নেড়ে বলছেন, "যে যাবার সে তো চলেই গেছে, ওরা এত রাতে অতটুকু বাচ্ছা নিয়ে এভাবে না এলেই ভালো করত।" কখনও বা বলছেন, " আচ্ছা অনিন্দিতা, তুমি গ্যাস বুক করতে পারো? আমি তো কিছুই জানি না। সব তোমার শ্বশুরমশাই করতেন।" সত্যিই শ্বশুর মশাই সব করতেন, টাকাপয়সা তোলা, গৃহ সহায়িকাদের বেতন দেওয়া, ফোনে দোকানবাজার, ওষুধ আনানো, বাড়ির প্রতিটা কোণে নজর রাখা - সব, সব করতেন অসুস্থ বৃদ্ধ একাই। বৃদ্ধা তো মোবাইলে ফোনটুকুও ধরতে স্বচ্ছন্দ নন। 


কাঁথি থেকে কলকাতা আসার পথে এই কথাটাই বলছিলাম আমরা,  এনাকে একা গৃহ সহায়িকা বা আয়া দিদির ভরসায় মহানগরে ছেড়ে যাওয়া অবাস্তব। তবে সে তো অনেক পরের কথা, এখনও তো শ্বশুরমশাই আছেন। ঘুমিয়ে আছেন স্টাডি রুমে। অপেক্ষা করছেন আদরের কনিষ্ঠ পুত্র আর পুত্রবধূর জন্য। চোখ রগড়ে, "আসছি" বলে হাঁক পেড়ে, দরজা খুলি আমি। আমার সামনেই সপরিবারে আমাদের উমারাণী। উমার কোলে সদ্য ফোটা ফুলের মত ঘুমন্ত ফুলঝুরি, মুখের মধ্যে দুটো আঙুল পুরে ঘুমাচ্ছে। দুহাত বাড়িয়ে কোলে নিই মেয়েটাকে, উমা কোন মতে জানতে চায়, " দিদিভাই, বাবা কোথায়?"

অনির ডাইরি ১৩ ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



কিছু কিছু রাত কেন যে আসে? আসবে একদিন এতো জানা কথাই, তাই বলে এমন অতর্কিতে কেন এসে হাজির হয়! দিব্য তো চলছিল দিনটা, গতানুগতিক ভাবে, সেই ভোরে ওঠা, তুত্তুরীকে স্কুলে পৌঁছানো, আমাদের অফিস, ফিরে এসে কফির কাপে দৈনিক চব্য, শ্রীমতী তুত্তুরীকে পড়তে বসানো, পড়া আধখেঁচড়া ফেলে ঝটপট চিকেন স্টু রান্না করা, সাড়ে নটায় নৈশভোজ - কোথাও এক বিন্দু বিচ্যুতি ছিল না দিনটার মধ্যে। 


রাত দশটা নাগাদ, মোবাইলটা নিয়ে বসলাম। একটা নতুন ওয়েব সিরিজ ধরেছি, সেটাই এবার দেখব যুৎ করে। পাঁচ মিনিট দেখেছি কি দেখিনি, দরজা খুলে ঢুকে এল শৌভিক। একদম সাধারণ ভাবে বলল, " বাবা মারা গেছে।" লিখতে বসে, এখনও হাত কাঁপছে, ধড়পড় করছে বুক।শুনে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, " যাঃ! কি যাতা বলছিস।" তারপর খুব রাগ হল, একি ধরণের অলক্ষুণে কথাবার্তা। 


শৌভিক একই রকম শান্ত ভাবে বলল, " হ্যাঁ রে, সত্যি। বাবা মারা গেছে।" কোন মতে বললাম কে বলল? জবাব এল, " সবিতা দি ফোন করেছিল। বলল, কাকু এই মাত্র চলে গেলেন।" সবিতা দি হল বাড়ির দিনরাতের সহায়িকা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার নড়বড়ে শারীরিক অবস্থার জন্য, দুই বউয়ের পরোক্ষ ইন্ধনে, প্রবল ধমকধামক দিয়ে যাকে রাখতে বাধ্য করেছিল দুই ছেলে। 


কথা বলতে বলতেই হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে শৌভিক, পরক্ষণেই ফোন করে সবিতা দিকে, " তুমি আমায় ফোন করার কতক্ষণ আগে ঘটেছে ঘটনাটা? দশ মিনিট? আচ্ছা, তার মানে ৯টা ৫০।" ফোন রেখে আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে শৌভিক, "চার ঘণ্টার আগে ডেথ সার্টফিকেট পাওয়া যাবে না। তার মানে রাত দুটো। শব বাহী গাড়িও যোগাড় করতে হবে।" 


আমি অঝোরে কাঁদছি, ঘড়ি থেকে আমার দিকে চোখ নামিয়ে ধমকে উঠল, " দাঁড়া এখন ঘ্যানঘ্যান করিস না। আত্মীয়স্বজনদের ফোন করতে হবে। পিসিকে ফোন করে দি, ওই বরং সবাইকে খবর দিয়ে দিক। আমি গাড়িকে খবর দি, ব্যাগ গুছাই। সিকিউরিটিকে কি নেব,না নেব না?"   


বেশ খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকি আমি, আমার বরটা কি যন্ত্র হয়ে গেল! বাবাকে ঘিরেই তো ঘুরত ওর জীবন। বাবার শিক্ষা, বাবার আদর্শ, বাবার জীবন দর্শন - থেকে বাবা বিচ্যুত হলেও, আমার বর হয় না। আর আজ যখন সেই বাবা চলে গেছে চিরতরে, ও এতটুকু ভেঙে পড়ছে না কেন? 


চোখ মুছে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি, কাকে যেন ফোন করছে শৌভিক, " গুড ইভনিং ম্যাম। আমি শৌভিক বলছি, এসডিও কন্টাই। এই মাত্র খবর এল, আমার বাবা মারা গেছেন। যদি অনুমতি দেন তো -"। বুঝতে পারলাম মাননীয়া জেলা শাসক মহোদয়াকে ফোন করছে, স্টেশন লিভের অনুমতি নিতে। কাঁথিতে আগামী ২৫ শে মে নির্বাচন, এই মুহূর্তে শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে পুরোদমে। আগামী কাল সকাল সাতটা থেকে শুরু হবে ইভিএম কমিশনিং এর কাজ। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সামনে, প্রতিটা ইভিএম মেশিন খুলে তাতে ব্যালট পেপার ভরে সিল করা। সেই কর্মযজ্ঞ চলবে কাল পরশু দুই দিন ধরে। 


"অনেক ধন্যবাদ ম্যাম" দিয়ে ফোন শেষ হল। বুঝলাম অনুমতি পেয়েছে। এবার ড্রাইভারকে ধরার পালা। সে বেচারী সবে খেতে বসেছিল। ব্যক্তিগত নম্বরে ততোক্ষণে একের পর এক ফোন এসেই চলেছে। কিছু শৌভিক ধরছে, কিছু আমি। তীব্র শোকের মধ্যেও পিসি দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে খবর দিয়ে দিয়েছে, আর যথারীতি কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। আমরাও কি পারছি? আমি তো পারছি না। বিগত ১৬ বছরে কোনদিন বৃদ্ধকে সুস্থ দেখিনি। দু বার কর্কট রোগ জরাজীর্ণ করে দিয়েছিল শরীরের সব অঙ্গ তন্ত্র। তারওপর ছিল মারাত্মক শ্বাসকষ্ট। দিনে একবার, কখনও দুবার নেবুলাইজ করতেন। অক্সিজেন ও রাখা থাকত, প্রয়োজন হলেই যাতে নিতে পারেন। ইদানিং দেখা দিয়েছিল প্রস্টেটের সমস্যা। 


কিছুদিন আগেই প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আধ বেলা ছুটি নিয়ে দৌড়ে এসেছিল শৌভিক। অথচ কিছুতেই ডাক্তারের কাছে গেলেন না বৃদ্ধ। যেন বড় ছেলেকে দেখার জন্যই ঘাপটি মেরে বসে ছিল যত ব্যাধি। ছেলে এল, ওমনি সব ঠিক। ফিরে যাবার সময় বারবার বলল শৌভিক, "কাঁথি চল"। তাও এলেন না। কেন যে এলেন না, কি জানি এলে হয়তো অন্য রকম হত সবকিছু। সেবার শৌভিক বলে এসেছিল," আগামী ২৬ শে মে পর্যন্ত কিন্তু আর আসতে পারব না। সাবধানে থেকো।"


 এই বলাটাই যেন কাল হয়ে গেল, বিগত দিন কয়েক ধরে এমন ছেলেমানুষী শুরু করলেন বৃদ্ধ। আজই তো সকালে ফোন করেছিল ছেলেটা, এই আবাসনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে রক্ত -মল-মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করে ছেলেটা। রাগত স্বরে বলল, " দিদি আর পারছি না। মেসোমশাইকে নিয়ে আমি জ্বলে পুড়ে মরলাম। একবার করে বলে," সুপ্রিয় এসে ক্যাথিটারটা লাগিয়ে দিয়ে যাও। দুদিন যেতে না যেতেই বলে, সুপ্রিয় খুলে দিয়ে যাও।" শুনুন দিদি,প্রতিবার ক্যাথিটার লাগাতে ২০০০ টাকা লাগে। সে ওনার টাকা, উনি জলে দিন। কিন্তু এই খোলা পরার চক্করে প্রতিবার রক্তক্ষরণ তো হচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে ঈশ্বর না করুন, প্রস্টেট ক্যান্সার না হয়ে যায়। পরশু লাগিয়েছি,আজ বলছে আমি ডাক্তারের কাছে যাব, খুলে দিয়ে যাও। আমি আর যাচ্ছি না।"


কি সর্বনাশ, কোন ডাক্তারের কাছে যাবে আবার? হেঁপো বৃদ্ধের তো একা একা বাড়ি থেকে বেরোনোই নিষেধ। সেসব পাত্তা না দিয়ে এই তো দুদিন আগে কোন হাসপাতালে যেন ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল একাকী। প্রস্টেট সংক্রান্ত ডাক্তার। দুর্গাপুর থেকে আমার দেওর পইপই করে নিষেধ করেছিল, বলেছিল," একটু দাঁড়িয়ে যাও, আমি আসছি।ঘন্টা চার- পাঁচের মধ্যে পৌঁছে যাব।" যথারীতি কথা শোনেনি বৃদ্ধ। তাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে নিরস্ত করে, একাই চলে গিয়েছিল। সাধে আমার দেওর গোঁসা করে, যে "বাবা কেবল দাদাকেই ভরসা করে।" 


এত যে জেদ করে ডাক্তারের কাছে গেল,তার কথাও তো পছন্দ হল না বাবার। ক্যাথেটার লাগানো নিয়ে কোন কথাই শোনেননি নাকি ডাক্তার। বলেছেন, "ওতে অভ্যস্ত হতে হবে। এই সমস্যা আপনার চলতেই থাকবে। এই বয়সে ভুলেও অস্ত্রোপচারের কথা ভাববেন না।" তাও কি সব টেস্ট করিয়ে প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরেছিলেন বৃদ্ধ। অতক্ষণ হাসপাতালের হাওয়ায় থাকার জন্য সেকেন্ডারি ইনফেকশন হতে পারে বলে, জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে তার জন্য প্রবল ধমকও খেয়েছেন। 


আবার সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই শরণাপন্ন হলাম আমি, "ওগো দেখো, বাবা কি করছে।" সকাল পৌনে দশটা নাগাদ বাবাকে ফোন করল শৌভিক, " আজ আবার কোন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছ?" জানা গেল, কোন্নগরের আহমেদ ডাক্তারের কাছে যাবে শ্বাসকষ্টের জন্য। তিনি তো হোমিওপ্যাথ। আজ প্রায় তিরিশ বছর ধরে শ্বাসকষ্টে ভোগেন শ্বশুর মশাই, দীর্ঘদিন ধরে যে অ্যালোপাথ ডাক্তারকে দেখাতেন, তাকে আজকাল বাতিল করেছেন। কারণ তাঁর কাছে গেলেই তিনি বলেন, "আমার কাছে ঠিক কেন এসেছেন? ওষুধ, পত্র, নেবুলাইজার, স্টেরয়েড, অক্সিজেন সবই তো বাড়িতে মজুত থাকে। শ্বাসকষ্টের আর তো কোন চিকিৎসা নেই।" যথারীতি বাবার তাঁকে আর পছন্দ হয় না। সম্প্রতি দুয়েক বছর অন্য এক ডাক্তারকে দেখাচ্ছিলেন, তিনি পরের বার ব্রংকিয়োস্কপি করে যেতে বলেছিলেন। সেটা করতেও বাবার আতঙ্ক, তা না করিয়ে এবার তিনি হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে চাইছেন।


মনে আছে শৌভিক বলেছিল, " তুমি আগে স্টেরয়েডটা তো চালু করো। ভাই আসছে -"। আমার দেওর সত্যিই আসছিল, কিন্তু কপাল গুণে আজ ১৩ ই মে, দুর্গাপুরে নির্বাচন। একটা বাস, গাড়ি কিছু পায়নি। ট্রেনে অমানুষিক ভিড়। খোঁজ নিয়ে জানাল, কাল বিকাল থেকে হয়তো কিছু বাস চলবে। প্রথম বাসেই এসে হাজির হবে কলকাতা। দরকার হলে আহমেদ ডাক্তারকে বলেও ওষুধ আনা যায়, তাই আনবে। শৌভিক বলল, " তুমি ক্যাথেটারটা লাগিয়েই রেখো। দু সপ্তাহ পর্যন্ত তো লাগানো যায়, তারমধ্যে আমার ভোট মিটে গেলেই আমি ২৬ শে রাতেই চলে যাব। তারপর তোমাদের কাঁথি নিয়ে চলে আসব। তার আগে আসতে চাইলেও কোন অসুবিধা নেই,অনিন্দিতা তো আছে।" মনে আছে বৃদ্ধ বলেছিল, " হ্যাঁ, সেই ভালো। এখন আমি এমনিতেই বেশ ভালো আছি।" 


তড়িঘড়ি খাটের নীচের বাক্স খুলে ব্যাগ বার করে শৌভিক, কি সব জামা কাপড় ভরে হড়বড় করে। মেশিনের মত করে যায় একের পর এক কাজ, ফোন ধরে চলে যন্ত্রের মত। দুর্গাপুর থেকে এক গলা কান্না নিয়ে ফোন করে আমার দেওর, " বৌদি, বাবা আর নেই না?" কি জবাব দিই? বলি, " কাঁদিস না বাবা। সবিতা দি কি দেখতে কি দেখেছে। আমরা এখনই বেরোচ্ছি, গিয়ে দেখি। নিজে না দেখলে আমি অন্তত বিশ্বাস করছি না -"। পাশ থেকে শৌভিক বলে চলে, "নেই। নেই। বাবা আর নেই।বাবা চলে গেছে-"।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


ঠিক করেছিলাম, হীরামাণ্ডী দেখব না। কিছুতেই দেখব না। স্বাধীনতা পূর্ব অখণ্ড ভারত, পতিতালয়, একজন জাঁদরেল মহিলা চরিত্র আর স্বাধীনতা সংগ্রাম - বড় চেনা ছক হে বাপু। একটা রাজকাহিনীই যথেষ্ট ভাই, থাক আর দেখে কাজ নেই। 


১ লা মে, সারা ভারত ভেসে গেল হীরামাণ্ডী ঝড়ে, আমি ডুবে রইলাম চাকরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, obsessive-compulsive disorder এ ভোগা এক সত্যান্বেষী সাধু সান্নিধ্যে। Mr. Monk, তাঁর জটিল জটিল সব কেস আর তাঁর হাজারো ফোবিয়া নিয়ে দিব্য রইলাম আমি। সিদ্ধান্তে অনড় আমি, হীরামাণ্ডী দেখছি না। দেখব না বিগত সোমবার সুকন্যা যখন লিখল, "দুদিন ধরে হীরামাণ্ডী দেখলাম। কি জঘন্য মেলোড্রামাটিক লাগল -"। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালাম। আমার বাপু Mr Monkই ভালো। 


তারপরই হল কেলো। আমার দেওয়ালে হঠাৎই একদিন এসে উদয় হলেন ফরিদা জালাল। তাঁর মুগ্ধ নয়ন জুড়ে এক তরুণ যুবক। বৃদ্ধার বিলাত ফেরৎ নাতি, তাজদার বালোচ। গোটা রিল জুড়েই তাজদার, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তাজদার। শুধু তাকানো, আর মধুর হাসি। তাতেই কাঁপন ধরিয়ে দেয় হৃদয়ে, যেমন দিতেন সাদা কালো যুগের নায়কেরা। কে এই তাজদার বালোচ? আগে কি দেখেছি কোথাও? মুগ্ধ হৃদয় কিছুই বলে উঠতে অক্ষম। গুগল বলল, দেখেছ তো। আলবৎ দেখেছ। "তাজ - ডিভাইডেড বাই ব্লাড" সিরিজে। আরে এই তো সেই রগচটা শাহজাদা মুরাদ। 


মাগো, তাতে তো একটুও ভালো লাগেনি এনাকে। চোখে পুরু সুর্মা, দুই চোখে রাজ্যের বিরক্তি আর ক্রোধ। দেখলেই কেমন যেন ক্ষ্যাপা বলির্বদ মনে হত। সিংহাসনের মত ওই সিরিজের সব গোলাপী আলোও একজনই চুরি করে নিয়েছিলেন - শাহজাদা সেলিম। মুরাদ ছিল নিছক বিরক্তি উদ্রেককারী এক আপদ। তাজদার একদমই তার উল্টো। সফিস্টিকেটেড, শান্ত, মৃদু ভাষী। গুগল বলল, ইন্টারনেটের লেটেস্ট ক্রাশ এখন তাজদার। আরও জানতে পারলাম, হীরামাণ্ডীতে তাজদারের পরিণতি মোটেই সুখকর নয়, বরং মর্মান্তিক। তাতে যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল চরিত্রটা। সুকন্যাকে সবার আগে জানালাম, দেখব ভাবছি সিরিজটা। শুধু তাজদারের জন্য। সু বলল, "আরে অদিতি রাও হায়দারিকেও দেখো। কি অসাধারণ সুন্দর।" 


দেখতে শুরু করে আর সময়ের হিসেব রইল না। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি? মণীষা কৈরালা তো একাই একশ। সোনাক্ষির বিষাক্ত নজর। অদিতির বিখ্যাত swan walk, হাঁটতে হাঁটতে কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে আঙুলে প্যাঁচানো, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো। উফ্। সবার ওপর উস্তাদ জী। কি অসামান্য অভিনয় ভদ্রলোকের। গল্প ইত্যাদি নিয়ে অবশ্য বলার কিছু নেই। বেশ সাদামাটা গল্প, তা হোক, আমরা তো এরকম কত বিলাতী শো দেখে গদগদ হয়ে যাই। আর এতো খাঁটি স্বদেশী। 


দেখতে শুরু করার আগে, শৌভিককে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুনিয়ে এলাম, আমি হড়কেছি। তাজদারের রিলটাও দেখলাম,আহা একই বলে "আঁখো কি গুস্তাকিয়া-"। আমার বর দিনান্তে বাড়ি এসে কফি খেতে বসেছিল, যথারীতি তাজদারকে পছন্দ হল না। আজ অবধি আমার কোন ক্রাশকেই বা আমার বরের পছন্দ হয়েছে? সবার মধ্যেই ও গুচ্ছের খুঁত খুঁজে বার করে এবং সুকুমার রায়ের কথা "না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল দিয়ে গোঁজাব" করে সে গুলো আমার মাথায় ঢোকায়। 


প্রথম আপত্তি তুলল তাজদারের গোঁফ নিয়ে। আরে গোঁফ তো তোরও আছে রে ভাই। যখন দেখল মাথা থেকে তাজদারকে কোনভাবেই বার করতে পারছে না, তখন অন্য পথ ধরল। " আজ একটা দারুণ ভূতের সিনেমা দেখব। মালায়ালাম সিনেমা। ব্লক বাস্টার শুধু নয়, খুব হাই ক্রিটিক রেটিং ও পাচ্ছে। দেখবি? মামুট্টি আছে।" মামুট্টি আমার বাবার প্রিয়তম নায়ক তথা অভিনেতা। খুঁজে খুঁজে ইউটিউব থেকে মামুট্টির সিনেমা বার করে দেখে বাবা। আমি বরাবরই বাবার মেয়ে, বাবার যাকে পছন্দ, আমারও তাকেই ভালো লাগে। তবে এ ক্ষেত্রে মামুট্টির থেকেও যাকে বেশি পছন্দ হল, সে হল ভূত। ভূত বা ভৌতিক সিনেমা আমার চিরকালীন দুর্বলতা। 


 জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম? জবাব এল ভ্রমযুগম। মুখে কি ভাব ফুটল জানি না, শৌভিক চোখ গোল গোল করে বলল, " ভ্রমযুগম মানে জানিস? Age of madness।" চটজলদি নৈশভোজের পাট চুকিয়ে, ঘর অন্ধকার করে একরাশ উৎসাহ নিয়ে যুগলে দেখতে বসলাম। শ্রীমতী তুত্তুরীকেও আহ্বান জানানো হয়েছিল, তিনি যখন শুনলেন প্রায় আড়াই ঘণ্টার ছায়াছবি, সটান পিঠটান দিলেন। "বাবা গো, এত বড় সিনেমা কে দেখবে -"। 


অগত্যা আমি আর তুমিই ভরসা। শুরু হল সিনেমা। সাদাকালো। শুনলাম গোটা সিনেমাটাই নাকি সাদাকালো। ষোড়শ শতকের কেরালা। দক্ষিণ মালাবার অঞ্চলে পর্তুগিজ আক্রমণে পর্যুদস্ত এক রাজার দুই কর্মচারী, কোন মতে দাস ব্যবসায়ীদের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এক গহীন জঙ্গলে। জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যায় খরস্রোতা নদী, নদী টপকাতে পারলেই নিরাপদ আশ্রয়। অন্ধকারে নদী না পেরিয়ে,জঙ্গলের মধ্যেই আশ্রয় নেয় দুজনে। রাতের বেলা এক সুন্দরী পেত্নী ( যক্ষী) আক্রমণে নিহত হয় একজন, অন্যজন পালাতে পালাতে গিয়ে উপস্থিত হয় ভগ্নপ্রায় এক বিশাল অট্টালিকায়। 


এত বড় হাভেলী, কিন্তু বাসিন্দা কেবল দুই জন। বৃদ্ধ কিছুটা ক্ষেপা গৃহকর্তা কদুমন পোট্টি আর এক পাচক তথা গৃহসেবক। গৃহকর্তার নিমন্ত্রণে একটা রাতের জন্য থেকে যেতে রাজি হয়ে লোকটি, এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে অভুক্ত। সামান্য দুমুঠো অন্নের জন্য থেকেই যায় লোকটি। এই থেকে যাওয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায় হতভাগ্য লোকটির জন্য। কেন এবং কিভাবে সেটাই নিয়েই গল্প। যদি প্রশ্ন করেন,ভালো লেগেছে কি না, তো আমি তো অন্তত বলব মোটামুটি। অভিনয় নিয়ে কোন কথা হবে না, মাত্র তিনজন চরিত্র নিয়ে গড়িয়েছে গল্পটা। কদুমন পোট্টি - পাচক আর আশ্রিত ব্যক্তি। তিনজনেই ফাটিয়ে অভিনয় করেছে, কাকে ফেলে, কার কথা বলি। গোটা ফিল্মটাই সাদাকালো, এই বর্ণহীনতা আলাদাই এক মাত্রা এনে দেয় ভৌতিক সিনেমায়। শুধু আর একটু ছোট হলে বড় ভালো হত।  


সেটাই বললাম শৌভিককে। আর বললাম, ভূতটা মোটেই ভয় দেখানো টাইপ লয়। ভয় টয় কিস্যু তেমন লাগল না বাপু। শৌভিক মানলে তো নাই, উল্টে রেগে আগুন হয়ে বলল, " আসলে তুই কিছু বুঝিসই নি। এই সব সিনেমা তোর জন্য না, তুই যা তো, যা, গিয়ে হীরামাণ্ডীই দেখ।" যেন না বললে আমি দেখতাম না 😤।

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



অফিসে বেরিয়ে, গাড়িতে উঠেই ফোনটা করলাম, " হ্যাপি বাড্ডে বাবা।" বিগত দিন কয়েক ধরেই, শ্বশুরমশাইয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, গলার জোরও এসে ঠেকেছে তলানিতে, সেই অবস্থাতেই কোন মতে বললেন, " সে তো কালকে ছিল।"


সে আবার কি কথা, গতকাল কি করে থাকতে পারে? আজই তো ২৬ শে এপ্রিল, বাংলায় ১২ই বৈশাখ। আজকের দিনেই তো ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন ভদ্রলোক। আজকের দিনটার জন্য কবে থেকে আঁচলে গিঁট বেঁধে রেখেছি আমি। ভেবেছিলাম, তুত্তুরীকে বগলদাবা করে, সটান গিয়ে হাজির হব মহানগরে। সঙ্গে নিয়ে যাব পায়েস, কেক আর ওনার প্রিয় দুয়েকটি পদ। বৃদ্ধের হঠাৎ অসুস্থতা দিলে সব কেঁচে গণ্ডুষ করে। এবার তাই শুকনো ফোনই সম্বল।


কিন্তু বৃদ্ধ মানলে তো। যতবার আমি বলি, আজই আপনার জন্মদিন, ততোবার বৃদ্ধ বলে, "মোটেই না, গতকাল ছিল -।" এতো মহাজ্বালা। ভ্রাইভারের কান বাঁচিয়ে, দুদিক থেকে হিসেব করতে বসলাম দুজনে - ১৪ই এপ্রিল ছিল পয়লা বৈশাখ, তাহলে ১৫ই এপ্রিল, ২রা------- করতে করতে দেখা গেল, সত্যিই ২৬ নয়, ২৫ শে এপ্রিলই ছিল ১২ই বৈশাখ। শ্বশুরমশাইয়ের ৭৮ তম জন্মদিন। 


এক অদ্ভুত বিষাদের মেঘ পলকে ঢেকে দিল আমায়। ইশ্ বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে, এত বড় ভুল কি করে করতে পারলাম? পিসি - বাবা - মা- শ্বশুর মশাই আর শাশুড়ি মাতা এই পাঁচ বয়োজ্যেষ্ঠকে কেন্দ্র করেই প্রতি মুহূর্তে আবর্তিত হয় আমাদের জীবন। আর এই পাঁচজনের মধ্যে, জন্মদিন নিয়ে আবেগ কেবল এই বৃদ্ধেরই আছে। বাকিদের ক্ষেত্রে জন্মদিনটা "ভূতের আবার জন্মবার" গোছের হলেও, শ্বশুরমশাই কিন্তু আশা করেন যে ওনার জন্মদিনে সবাই উপস্থিত থাকব, পায়েস বানানো হবে, কেক কাটা হবে। নাতনীরা শোরগোল করবে। সস্তাতম হলেও একটা নতুন জামা গায়ে গলাবেন উনি - একটা দিন, বছরে কেবল একটা দিনের জন্য উনিই হবেন সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। 


২০২১ সাল অবধি তাই তো হত। তখন যে একসাথে থাকতাম সবাই। পেশার টানে ইদানিং ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছি আমরা। গেল বার যখন কাঁথি আসেন, কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলেন শ্বশুরমশাই। " আমার জন্মদিনটা কারো মনে থাকে না।" অভিমানটুকু যদিও ছিল শাশুড়ি মাতার প্রতি। তিনি যে সত্যিই ভুলে যান। ভুলে না গেলেও, তাঁর নিজেরই যা শারীরিক অবস্থা কতটুকুই বা করতে পারতেন তিনি। 


দুর্বল অস্থিচর্মসার বৃদ্ধের অভিমানী কথা গুলো বড়ই মর্মন্তুদ লেগেছিল আমার। তখনই ঠিক করেছিলাম শৌভিক না পারলেও, সবৎসা আমি ঠিক গিয়ে হাজির হব ওনার জন্মদিনে। এমনই ভাগ্যের পরিহাস যে জন্মদিনের ঠিক তিনদিন আগে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ। এমনিতেই দু-দুবার কর্কট রোগাক্রান্ত, তারওপর আছে তীব্র শ্বাসকষ্ট। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে আবার প্রস্টেট সংক্রান্ত জটিলতা। ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছে, অপারেশনের প্রশ্নই ওঠে না। ওনার যা শারীরিক অবস্থা, ওই ধকল উনি নিতে পারবেন না। 


সেই সংক্রান্ত জটিলতায় হঠাৎ এমন কাবু হয়ে পড়েন, যে নির্বাচনী ব্যস্ততার মধ্যেও একদিনের ছুটি নিয়ে দৌড়াতে হয় শৌভিককে। ফলে বাতিল করতে হয়েছে আমাদের অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা। ভাবলাম শুকনো একটু শুভেচ্ছাই জানাই, তাও একটু ভালো লাগবে বৃদ্ধের। জানাতে গিয়ে দেখি, তাতেও কেলো করেছি। বিলম্বিত শুভেচ্ছা জানালাম, বৃদ্ধ ধন্যবাদ দিল বটে, ছিটেফোঁটাও যে খুশি হল না, তা আমি এই পৌনে দুশ কিলোমিটার দূর থেকেও দিব্য অনুভব করলাম। মদ্যাভাবে গুড়ং দদাৎ কেস হল আর কি।


নাঃ, এত দূর থেকে এই অভিমানী বৃদ্ধের জন্মদিন পালন,যা দেখছি আমার একার দ্বারা সম্ভব নয়। কেন যে ইংরেজি মতের জন্মদিনটা পালন করেন না ভদ্রলোক, কে জানে বাবা। ফোনটা রেখে, উমাকে ধরলাম। বাড়ির ছোট বউ শুধু নয়,উমা হল বৃদ্ধের আদরের কন্যা। আমার মত অপদার্থ নয়,ও নির্ঘাত ঠিক টাইমে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ওকেই বলি,ভাই রে পরের বার থেকে সঠিক তিথিটা আমাকেও একটু মনে করিয়ে দিস তো। 


হরি ! হরি! ফোন ধরে তিনি কইলেন, " না দিদিভাই, বাবার জন্মদিন তো ২৮ শে এপ্রিল। এই দেখো না, আমি রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছি, ফোন করব বলে।" নিজেদের গুণপনায় নিজেরাই মুগ্ধ হলাম, হাসলাম গলা ফাটিয়ে। তারপর প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হলাম, সামনের বছর থেকে এপ্রিল পড়লেই মনে করিয়ে দেব একে অপরকে। তারপর যে প্রান্তেই থাকি না, বরগুলো যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, ছানাগুলোকে ট্যাঁকে নিয়ে আমরা দুজনে ঠিক গিয়ে হাজির হব মহানগরের এক প্রান্তে বুড়োবুড়ির সংসারে। একজন পায়েস আনব, অন্যজন কেক। 


কিন্তু সেতো আসছে বছরের কথা, এবছর কি হবে? সময় যে বড় নির্মম, নিমেষে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সব হিসেব।সময় বড় চঞ্চলও, মুঠোর ফাঁক গলে কেবলই হারিয়ে যেতে চায়। তাই বলে আমরা ছাড়ব নাকি? দুজনেরই টুকটাক কাজ ছিল মহানগরে, জুটিয়ে বাটিয়ে, নানা অজুহাত দেখিয়ে সব একই সঙ্গে ফেললাম আমরা। যাতে ওই সুযোগে মেলে মহানগর যাওয়ার অনুমতি। তারপর? তারপর আর কি! শ্বশুরমশাইয়ের দুই পুত্রবধূর সম্মিলিত উদ্যোগে কেক ও হল,পায়েসও হল, নাতনীদের হুল্লোড়ও হল।মাত্র এক সপ্তাহ দেরী হল এই যা। পাট ভাঙ্গা পাঞ্জাবি পড়লেন শ্বশুর মশাই, পরিপাটি করে আঁচড়ালেন মাথার চার গাছি চুল, তারপর জমিয়ে এসে বসলেন গিন্নীর পাশে। আলগোছে বললেন, "তুমিও একটা ভালো শাড়ি পরলেই তো পারতে।" আমরা ততক্ষণে চিৎকার জুড়েছি, ফুঁ দাও, ফুঁ দাও। যতটা অভিমান জমিয়েছিলে, ততো জোরে ফুঁ দাও তো দেখি।


চিত্র সৌজন্য - শ্রীমতী তুত্তুরী

অনির ডাইরি ৬ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


অফিসে ঢোকার ঠিক মুখেই ফোনটা বাজল। আজ ICSE আর ISC এর রেজাল্ট বেরিয়েছে, অনেকেই ফোন করে তাঁদের সন্তানদের রেজাল্টের খবর দিচ্ছেন। যখনই কেউ ফোন করছে, অভিনন্দন জানানো দূর আমি আকাশ থেকে পড়ছি, " কি বলছেন গো? আপনার ছেলে/মেয়ে? ICSE/ISC পাশ করেছে? কি করে সম্ভব? ওই পুঁচকে মেয়ে/ছেলেটাকে তো সেদিনই দেখলাম, নাক দিয়ে ইয়ে গড়াচ্ছে/ লুকিয়ে নাক খুঁটছে। সে কোন যাদু মন্ত্রে এত ধেড়ে হয়ে গেল রাতারাতি?" সময় এত দ্রুত কেন ছোটে, কে জানে। 


ভাবলাম তেমনই কেউ করছে বুঝি। আমার যে বয়সের গাছ পাথর রইল না, সেই অনুভূতি নতুন করে জাগাতে। ফোন খুলে দেখি আমার বর। তার আবার কি হল? এই তো ঘন্টা খানেক আগেই দেখা হল। "বেরো - বেরো- বেরো- বেরো" করে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ভাগাল বাড়ি থেকে। রোজই তাই করে, নাহলে আমি নাকি আরো দেরী করব, অফিস বেরোতে। 


অসময়ে বাড়ির ফোন এলে একটু ভয় ভয়ই লাগে। ফোন ধরে তাই বললাম, "কি আবার হল? সব ঠিক -"। কথা শেষ করতে না দিয়ে ওদিক থেকে গম্ভীর গলায় শৌভিক বলল, " আমার জুতোয় একটা ব্যাঙ ঢুকে বসেছিল।" প্রথমে মনে হল, এটা বলতে এই নির্বাচনী ব্যস্ততার মাঝে আমায় ফোন করেছে?  পরক্ষণেই অনুধাবন করলাম, জুতোয় ব্যাঙ ঢোকা মোটেই ভালো ব্যাপার লয়। বললাম, " ঝেড়ে পরেছিলি তো?" 


উল্টো দিক থেকে কাঁদো কাঁদো সুরে শৌভিক বলল, " না তো।" মানে কি? অ্যাঁ? ব্যাঙ একটা বড়সড় জিনিস, কিন্তু আরশোলা-মাকড়সা -টিকটিকি তো ঢুকে থাকতেই পারে। হরবখত ঢোকে, তাই তুত্তুররীকে ছোট থেকে জুতো ঝেড়ে পরতে শিখিয়েছি। অথচ তার বাপ সেটা শেখেনি?


 বলাতে শোভিক বলল, "আরে রোজই তো পরি। আজ তাড়া ছিল, তারওপর একটা ফোন ও এসেছিল। তাই কথা বলতে বলতে সটান দিয়েছি পা গলিয়ে। একটা পা দিব্য গলে গেল, অন্যটা আর গলেই না। জোর করে ঢোকাতে গেলাম, পায়ের আঙুলে কেমন যেন কুড়কুড় করল।" 


 উফ ভগবান। এমন আপদ, যে  বোঝেওনি যে ভিতরে একটা আস্ত জীব ঢুকে বসে আছে। তারওপর দিয়ে চেপে পা ঢোকাতে গেছে আবার। কে জানে,ব্যাঙটা আছে, না থেঁতলে গেছে? শৌভিক আশ্বস্ত করার ঢঙে বলে, " আছে, আছে। পা কেন ঢুকছে না দেখার জন্য আমি যখন জুতোর ভিতরে হাত গলালাম, হাত বার করে দেখি, হাতের ওপর বসে একটা হোৎকা ব্যাঙ গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমার হাত থেকে সটান এক লাফ মেরে বাগানে পালিয়ে গেল।" 


নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। বলি, " তুই আবার জুতোর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ব্যাঙটাকে টেনে বারও করেছিস? এত বুদ্ধি রাখিস কোথায় রে?" ফোনের ওপাশে হিহি করে হাসতে থাকে শৌভিক।ছোটবেলায় ঠাকুমা বলত, ব্যাঙের গায়ে গরল থাকে, হাত দিলেই হাতে ঘা হয়। কে জানে, কোন হাত ঢুকিয়েছিল। কে জানে, কি হবে লোকটার হাতে। তবু ব্যাঙ অবধি ঠিক আছে, কিন্তু ব্যাঙ যার খাদক তিনি যদি ওমন ঘাপটি মেরে বসে থাকেন, কি হবে? তাকেও কি ওমন ন্যাজ ধরে টেনে বার করে সোহাগী ফোন করবে?  হে ঈশ্বর, কার পাল্লায় পড়েছি? আর হ্যাঁ, হে ঈশ্বর এটাও বলো দিকি বাপু, এটা বাড়ি না চিড়িয়াখানা?


অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



আমার বাবা আর মায়ের প্রেম তথা বিবাহের গল্প আগেও বহুবার লিখেছি। কখনও ইনিয়েবিনিয়ে, কখনও বা সোজাসাপ্টা। আসলে আমি জন্ম রোমান্টিক, আর শরৎ বাবু বা শরদ্বিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর দুয়েকটি হাতে গোনা গল্প বাদে, এটাই আমার প্রিয়তম প্রেমের গল্প। 


গ্রাম রামনগর, ব্লক বেলডাঙ্গা ২, জিলা মুর্শিদাবাদ, এটাই ছিল আমার মায়ের আদি ঠিকানা। মাতামহ যখন মারা যান, মা তখন নবম শ্রেণী, মা সদ্য শাড়ি। মাত্র দুটো শাড়ি ছিল মায়ের। একটা কাচত, একটা পরতো। তারই একটা হঠাৎ চুরি হয়ে গেল একদিন। নিরূপায় হয়ে দিদার সাদা থান পরেই কাটাতে হল মাকে বেশ কিছুদিন। খবর পেয়েই  এক জোড়া নতুন শাড়ি কিনে পাঠিয়ে দিল বড় মেসোমশাই। 


 মাতামহের অকাল মৃত্যুর পর নিঃসহায় এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দিদার হাত ধরে আশ্বাস দিয়েছিলেন বড় মেসোমশাই, " কেউ না থাকুক, আমি আছি। জামাতা নয়, আজ থেকে আমাকে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র বলেই মনে করবেন।" আমৃত্যু সেই প্রতিশ্রুতি পালন করে গেছেন মায়েদের "জাম্বু"। এহেন জাম্বুর নির্দেশেই একদিন রামনগরের লক্ষণ রেখা পেরিয়ে মহানগরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল মা। লক্ষ্য একটা চাকরী। 


পড়ন্ত বিকালে ঢলে পড়া সূর্যের আলোয় স্নাত হয়ে, লালগোলা প্যাসেঞ্জার থেকে শিয়ালদা স্টেশনে যখন নামল মা, বাংলা তখন জ্বলছে আগুনের সত্তরের দহনে। আপাততঃ ঠিকানা বড় মাসির বাড়ি। বড় মেসোমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্বাবলম্বী হতেই হবে। তার জন্য কাজ চাই, একটা চাকরী। কিন্তু চাকরী পাওয়া কি এতই সহজ? 


বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে, স্থানীয় পোস্ট অফিসে ছোটখাট কাজ জুটল। এমন কিছু না, খাম পোস্টকার্ড লিখে দেওয়া, ফিক্সড ডিপোজিটের ফর্ম ভরে দেওয়ার মামুলী কাজ। ভ্যাক্যান্সি থাকলে দুয়েক দিনের এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল কর্মীর কাজ। তাতেও চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। রোজ যে কাজ জোটে তা নয়,কোনদিন বেশ কয়েক টাকা জুটল,কোনদিন ঠনঠন গোপাল।বড় মেসোমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, লেগে থাকো। অধ্যাবসায় না থাকলে কিস্যু হয় না। 


 কর্মসূত্রেই আলাপ শান্তি মাসির সাথে। মহিলা সদ্য বিধবা, এক কন্যা সন্তান নিয়ে বড় বিপদে আছেন। অনেকদিন বাচ্ছার দুধের টাকাও জোটে না। মৃত স্বামীর বন্ধুদের কাছে হাত পাতেন। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে দুই নিঃসহায় রমণীর। খুলতে থাকে লুকিয়ে রাখা বেদনার ঝাঁপি। মা জানতে পারে, শান্তি মাসির স্বামী আদতে মৃত নয়, নিখোঁজ। প্রতিপক্ষ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর আর তার কোন খোঁজ মেলেনি। শোনা যায় পিটিয়ে মেরে লাশ গুম করে দেওয়া হয়েছে। শান্তি মাসির মাধ্যমেই মা পরিচিত হয় তাঁর মৃত স্বামীর বন্ধু থুড়ি কমরেডদের সাথে। কমরেডদের মধ্যমণি, এক  ভয়ানক আঁতেল নকশাল নেতা। গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা কৃষ্ণাঙ্গী মেয়েটাকে মোটেই পাত্তা দেয় না সে। কিন্তু মেয়েটির যে  ওণাকে বড় ভালো লাগে। সাম্য- বিপ্লব-যৌথ খামার মার্কা বুলি মেয়েটির স্বঘোষিত মোটা মাথায় একবিন্দু ঢোকে না। তবুও নেতাবাবুর অনুগামিনী হয়ে পড়ে সে। সময় পেলেই পিছনের সারিতে বসে শুনতে থাকে দিন বদলের বৈপ্লবিক স্বপ্নের ইতিকথা।  


একজনের নীরব প্রেম আর একজনের খেয়াল না করার গল্প গড়ায় বেশ কিছুদিন। আচমকা পট পরিবর্তন ঘটে সাধের বঙ্গভূমিতে। কাশিপুর বরানগর ভেসে যায় রুধির ধারায়। বছর ঘুরে যায়, বদলায় না, পরিস্থিতি। উল্টে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। নেতামশাইয়ের পৈতৃক বাড়িতে হামলা হয় সিপিএম-পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর। লুটপাট ভাঙচুরের সাথে বেধড়ক মেরেধরে তুলে নিয়ে যায় নেতাকে। মরেই যেত হয়তো। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ছেলেটি। 


এরপর আর কি?জেলহাজত। জামিনে ছাড়াতে হল যে জরিমানা প্রদানের প্রয়োজন, তা ছেলেটির বৃদ্ধ পিতার সাধ্যাতীত। অনির্দিষ্ট কালের জন্য জেল হাজতে থাকার জন্য যখন ছেলেটি মানসিক ভাবে প্রস্তুত, হঠাৎ একদিন জানানো হল তার জামিন মঞ্জুর হয়েছে। জরিমানা কে দিল? বিক্রি করার মত আর কোন গহণাও ততোদিনে ছেলেটির মায়ের অবশিষ্ট নেই। অবশিষ্ট বলতে সাড়ে সাত বিঘার শরিকি পৈত্রিক বাড়ি শুধু। তবে কি বৃদ্ধ পিতা সেটাই করে বসল?


উদ্বিগ্ন হয়ে জেলের বাইরে বেরিয়ে রীতিমত চমকে গেল ছেলেটি, জেলের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই পিছনের সারিতে বসে থাকা কৃষ্ণাঙ্গী সরল গ্রাম্য মেয়েটি। দুজনেই নীরব, শেষে ছেলেটি জানতে চাইল, “টাকা জোটালে কি করে?” মেয়েটি মাটির দিকে তাকিয়ে জানালো, দেশে গিয়ে ধান বেচে টাকা আনতে একটু দেরী করে ফেলেছে। 


এরপরের গল্প শুধুই প্রেমের,রোদে বৃষ্টিতে হাত ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া। অবশেষে ১৯৭৪এর ১লা মে,শ্রমিক দিবসের দিন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় দুইজনে। সেদিন কোন শাঁখ বাজেনি, কেউ উলু দেয়নি, মানা হয়নি কোন লোকাচার, এমনকি বরবেশও পরেনি ছেলেটি। মেয়েটি অবশ্য সেজেছিল, সামান্য প্রসাধন, ছেলেটিরই কিনে দেওয়া তুঁতে রঙের বেনারসী আর ধার করে আনা দিদির বিয়ের গয়নায়। সামান্য রেজিস্ট্রি বিবাহ, কনের তরফে সই করেন মেয়েটির জামাইবাবু তথা আমার বড় মেসোমশাই স্বর্গীয় অজিত কুমার সিংহ মহাশয় আর ছেলেটির তরফে জনৈক অবসর প্রাপ্ত আইসিএস অফিসার এইচ এল বেরি সাহেব। বাংলার নকশাল আন্দোলন নিয়ে বেরি সাহেবের মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহই ওণাকে ছেলেটির ঘনিষ্ট তথা শুভানুধ্যায়ী বানিয়ে ছিল। 


ক্লেদাক্ত মহানগরের কোন এক নিভৃত কিনু গোয়ালার গলিতে লালনীল সংসার সাজায় এক হেরে যাওয়া নকশাল নেতা আর চাকরী সন্ধানে উন্মুখ এক নিপাট সরল মেয়ে। ফুল বিবর্জিত নিভৃত বাসরে ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দেয়, "আমার পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তবে তোমায় নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। আজ থেকে আমিই তোমার শিক্ষক, প্রস্তুত হও ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য।” 


সেদিনের সেই দামাল দম্পতির প্রেমবিবাহের আজ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল।

No comments:

Post a Comment