Thursday 14 July 2022

অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০২২

 


এক বছর! মাত্র একটা বছরের মধ্যে আমূল বদলে গেল সবকিছু। বেশ তো গতানুগতিক ছন্দে চলছিল জীবন। বদলির অর্ডার তো বেরিয়েছিল আমার, চুঁচুড়া থেকে বিধাননগর। কারা যেন পরিহাসের ছলে মৃদু অনুযোগও করছিল তাই নিয়ে, ‘তোমায় তো পাড়ায় পোস্টিং দিল গো-।’ 


সেই মত, ক্যাশবুক গুলো শেষ করে, এক তাড়া গ্রাচুইটির কেসের অর্ডার লিখে, মহানগরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমি। এবার মুভমেন্ট অর্ডারটা বেরিয়ে গেলেই হয়। আমরা যারা বাইরে থেকে মহানগরে ঢুকতাম,রোজই কথাবার্তা - মেসেজ চালাচালি হত, বেরোল? মুভমেন্ট অর্ডার কি বেরোল? করোণা ভীতি ঝেড়ে ফেলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল জীবন। গত বছর ১লা জুলাই ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার দিনটা ছুটি নিলে, টানা চারদিন ছুটি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে তুত্তুরী সহ রওণা দিয়েছিলাম হাওড়া। 


দোসরা জুলাই, সন্ধ্যে বেলা, উদ্দাম আড্ডা বসেছে বাবার একতলার বৈঠকখানায়। এমন শোরগোল করছি আমরা, যে  ঠাকুমা থাকলে নির্ঘাত বলত, আমাদের চিৎকারের  ঠেলায়, ‘বাড়িতে কাক উড়ছে, চিল পড়ছে।’ হবে নাই বা কেন? আড্ডাবাজদের সংখ্যা কি কম? বাবারা দুই ভাইবোন, আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, তুত্তুরীরা তুই মামাতো পিসতুতো ভাইবোন, সর্বোপরি দুই কুলবধূ, মা আর চৈতি। 


আড্ডার ফাঁকে শৌভিকের ফোন। দুই ভাই কি সব ফাজিল মন্তব্যও করল তার জন্য। হট্টোগোল থেকে দূরে সরে গিয়ে, ফোনটা কানে ধরতেই, ওপাশ থেকে শৌভিকের চূড়ান্ত আবেগবিহীন কেজো কণ্ঠস্বর। ‘কপাল পুড়েছে-’। মানে? মানেটা শৌভিক বলার আগেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল,‘ এসডিও অর্ডার বেরিয়েছে?’ এটাকেই বোধহয় মহিলাদের ইনট্যুশন বলে। আমি বলি ভাইবস্। বেশ কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছিলাম, বলছিলামও শৌভিককে, ‘তুই বাপু বাঁচবি না। এসডিও তোকে হতেই হবে-।’ 


এরপরের প্রশ্ন অবধারিত ভাবেই, কোথায় হল? জবাব এল তমলুক। এরপরের প্রশ্ন, জানলি কি করে? জবাব এল ‘এষা।’ প্রশ্নটা না করলেও পারতাম, কারণ ততোক্ষণে আমার ফোনে এষার কল ওয়েটিং আসা শুরু হয়ে গেছে। কি প্রবল উৎসাহ নিয়ে খবরটা শুনিয়েছিল এষা, সেই উত্তাপের সিকি ভাগও ফেরৎ দিতে পারিনি আমরা। সেটা নিয়ে মৃদু অনুযোগও করল পাগলি মেয়েটা। ‘দেখ না দিদি, দাদা বলছে,দাদা নাকি জানত না। তা তোমরা আমাদের পার্টি দিচ্ছ কবে-’। জানতাম না তো কেউই, কবে যে ফাইল উঠল, কবে যে সই হল, ধুৎ জীবন কেন যে এত অঘটনঘটনপটিয়ী। 


অতঃপর খবর দেওয়া আর অভিনন্দন গ্রহণ করার পালা। গভীর রাতে,নিদ্রিত তুত্তুরী আর তন্দ্রাচ্ছন্নভাব মায়ের পাশে শুয়ে ফিসফিসে বার্তালাপ। ‘ কত লোক আমাদের অর্ডার বেরোনোর খবর রাখে রে-’, দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলে শৌভিক। এমন দিনে একসাথে না থাকতে পারার অস্বস্তিতে ভুগছি দুজনেই। শৌভিক জানায়, কে যেন ওকে অভিনন্দন জানিয়ে ফোন করে বলেছে, অমুক মন্ত্রী সম্পর্কে তার মামা আর তমুক অফিসার পিসেমশাই হয়। খামোখা চমকে যে লোকজনের কি লাভ হয়। তবে উভয়ের বন্ধুবান্ধবরাই খুব উচ্ছ্বসিত। অর্জুন তো শ্রীমান কুট্টুসের ছবি সম্বলিত একটা কার্ডই বানিয়ে পাঠিয়েছে, ‘কি আনন্দ, মামা এসডিও হয়েছে, ভৌ উউউ’। খুশি আমার চুঁচুড়ার সহকর্মীরাও। খুশির লহর কেবল অনুপস্থিত উভয়ের পরিবারে। কারোরই বাবা-মা যেন খুশি নয়। তমলুক চলে যাবে শৌভিক। প্রতি সপ্তাহে ফিরতেও পারবে না, এটা যেন কিছুতেই হজম হচ্ছে না কারো। শ্বশুরমশাই তো যেন কাকে বলেই ফেলেছেন,‘জ্যেষ্ঠ পুত্রের বাইরে চলে যাওয়ায়, আমি বেশ বিপন্ন বোধ করছি।’ 


অন্যায় তো কিছু বলেননি, শৌভিকের চলে যাওয়ার সম্ভবনাতেই বিপন্ন বোধ করছি আমি। বড় পরিশ্রমী আমার বর। সকালে বিছানা ঝাড়া থেকে দোকানবাজার, জামাকাপড় কাচা (অবশ্যই মেসিনে), বাথরুম(মেঝেটা, ইয়েটা অবশ্য আমার জিম্মেদারি ) পরিষ্কার কতকাজ যে দায়িত্ব নিয়ে করে সংসারে, সেটা ভাবতে বসে পাগল পাগল লাগে। গোটা বাড়ির চালিকা শক্তি তো ওই। সবথেকে বড় কথা, কলকাতা উত্তরের নির্বাচনী দপ্তরে পোস্টিং হওয়ার দরুন আমার পরে বেরোয় এবং আমার আগে বাড়িতে ঢোকে শৌভিক। মেয়েটাও যে বড্ড বাপ সোহাগী।  


বললাম, আমিও তমলুকে বদলি হয়ে যাই বরং। প্রায় মারমূর্তি ধরল শৌভিক। কি দরকার? কোন পাগলে নিরাপদ নির্ঝঞ্ঝাট বিধাননগর ছেড়ে স্বেচ্ছায় ঝঞ্ঝাট চূড়ামণি পূব মেদিনীপুরে যায়? দেখতে দেখতে এসে গেল দিনটা।  ৯ই জুলাই, শুক্রবার একসাথেই বাড়ি থেকে বেরোলাম দুজনে। গ্রীলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তুত্তুরীর মুখে চোখে একটাই অনুনয়,‘ আজই ফিরে এসো কিন্তু বাবা।’ কিভাবে যেন আগেপিছেই রাখা ছিল দুজনের গাড়ি। শৌভিকের ক্রিম কালারের জাইলো। সিকিউরিটি মনোরঞ্জন বাবু নেমে স্যালুট করলেন, হাত থেকে ব্যাগটা নিতে গেলেন। ছেড়ে দিল দুজনের গাড়ি। নিবেদিতা সেতু পর্যন্ত বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম একে অপরকে। তারপর দিল্লী রোড ধরলাম আমরা আর শৌভিকের গাড়ি রওনা দিল বোম্বে রোড বরাবর। 


সেদিন রাতে অবশ্যি ফিরে এসেছিল শৌভিক। শনি-রবি আর রথ নিয়ে পরপর তিনদিন ছুটি। সেই সপ্তাহান্তটা শুধু গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম আমরা। মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনাচ্ছিল শৌভিক, ‘এত সুন্দর কালেক্টরেট কোথাও দেখিনি। সবকিছু নতুন আর ঝকঝকে। আর ডিএম সাহেবের চেম্বারটা যা বানিয়েছে, উফঃ-’।  জানতে চাইলাম, এসডিওর বাংলো নেই? নিজের প্রসঙ্গে হাই তোলে শৌভিক, কেজো সুরে জানায়, ‘একটা হয়েছে শুনছি, নিমতৌড়ির ওখানে। কে যাবে? ওটা তো ভুষুণ্ডির মাঠ।’ জানায় ওর আপিসের পিছনের আবাসনে একটা ফ্ল্যাটেই আপাততঃ মহকুমা শাসকের নিবাস। শৌভিকও ওখানেই থাকতে চায়। ঘোরতর রকম শহরের মধ্যে, দোকান বাজার, তমলুক স্টেশন সবকিছু পা বাড়ালেই। মহকুমা শাসকের গৃহস্থালির ভারপ্রাপ্ত  লোকজনও খুব একটা ঐ ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে যেতে উৎসুক নয়।


দেখতে দেখতে এসে গেল ১২ই জুলাই। কাল পাকাপাকি ভাবে তমলুক রওণা দেবে শৌভিক। তবে সে তো কালকের কথা, আজ যে রথ। ওপরের লফট থেকে নামানো হয় ভাইবোন সমেত জগু বাবুকে। নামানো হয়, খবরের কাগজের মোড়া তাঁর তিনতলা রথ।

বেলা বাড়ে, তুত্তুরীকে ছুটি দেয় না গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল। পড়ার ঘরে ল্যাপটপ চালিয়ে ঘাড় গোঁজ করে পড়তে বসে তুত্তুরী। ব্যাগ গোছাতে বসে শৌভিক। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, টুকটাক কত কিছু কেনা বাকি। পোশাক পরিচ্ছদেরও যা হাল। পাকাপাকি ভাবে থাকতে হলে গোটা কয়েক জামাকাপড় কেনা বাধ্যতামূলক।  চটজলদি বেরোনোর তোড়জোর করি আমরা। তুত্তুরীর ক্লাশ শেষ হবার আগেই ফিরে আসব, মাত্র ঘন্টা খানেকের ব্যাপার। স্নানাহার ফিরে এসেই না হয়- 


ঠিক এগারোটা পয়ত্রিশে বাবার ফোন, আজও ভাসছে কথা গুলো ইথার তরঙ্গে, ‘তুমি কি ব্যস্ত আছ, আসতে পারবে? মা যেন কেমন-’।  ঠিক এই ভয়টাই পাই আমি সবসময়। ঠিক এই কথাগুলোই দুঃস্বপ্নে শুনি আমি, অসময়ে বাড়ি থেকে ফোন এলেই ধড়াস করে ওঠে বুক। যদিও প্রতিবারই প্রমাণ হয়, অকারণ আশঙ্কা করি আমি, আর যেদিন সত্যিই হয়, সেদিন কেন যে বাজে না কোন বিপদঘন্টি।


অনির ডাইরি ২৮ শে জুন, ২০২২


 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 


অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের দুয়ারে সরকার নিয়ে আমাদের উত্তাপ ছিল বেশ কম, তার অন্যতম কারণ অবশ্যি প্রকৃতি। মে মাসের তীব্র দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছিল যেন চরাচর। এমন যে হবে তাতো জানাই ছিল, অন্যান্য কন্টিনজেন্সির সাথে তাই ওআরএসের প্যাকেটও দিয়েছিলাম আমরা। ক্যাম্প প্রতি তিনটে করে। যেদিন যে ক্যাম্পেই গেছি, সর্বাগ্রে জিজ্ঞাসা করেছি, ওআরএস খাচ্ছো তো? আগে প্রাণে বাঁচো, তারপর কাজ।


 বলেই দিয়েছিলাম, পারফর্ম করার ইঁদুর দৌড়ে আমরা, নেই এবার।  যেটুকু পারবে,সেটুকুই করবে, শুধু নিছক গতানুগতিক ভাবে করো না। কাজে যেন একটা প্রাণ থাকে, থাকুক না একটু চনমনে ভাব তবেই না কাজ করে আনন্দ। কাজ যা করবে, ছবি তুলবে তার চারগুণ।  আর কেউ দেখুক না দেখুক, আমি দেখব। আর কোথাও শেয়ার হোক বা না হোক আমি করব। করেওছি, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে জেলাশাসক মহোদয়ের জেলা গ্রুপ, এমন কি লেবার কমিশনার সাহেবের রাজ্যের গ্রুপ, সর্বত্র। সগর্বে জানিয়েছি,অমুখ পেশার অমুক চন্দ্র অমুক বা শ্রীমতী তমুক কে পরিষেবা দিতে পেরে আমরা যৎপরনাস্তি গর্বিত। 


ছবি তোলা নিয়েও যে হয়েছে কত রগড়। বাচ্ছা কোলে মিষ্টি কোন মায়ের ছবি দেখে যেই বললাম দারুণ তো, অমনি শুধু মহিলার ছবিতে ভরে উঠল আমাদের গ্রুপ। সেদিন আমাদের শান্তনু হাসতে হাসতে বলছিল,‘ম্যাডাম আপনাকে খুশি করার জন্য তো লোকজন পারলে ছবি তুলতে পরের বাচ্ছা উঠিয়ে আনে।’ কি সর্বনাশ! ওসব করিস না বাবা। 


যদিও বলেছিলাম তেমন চাপ নেবার দরকার নেই, কোন টার্গেট দিচ্ছি না, যা পারো করো। ঝামেলা বাঁধাল চণ্ডীপুর। ব্যাটারা শুরু থেকেই এমন চালিয়ে খেলতে লাগল, রোদ গরম উপেক্ষা করেই হুহু করে উঠতে লাগল ডিএস। শহীদ মাতঙ্গিনী গতবারেও প্রচুর ডিএস ফেলেছিল, তড়িঘড়ি মাঠে নেমে পড়ল তারাও। সে কি প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুপক্ষের। বিগত দুয়ারে সরকারে খুব খারাপ ফল করেছিল তমলুক পুরসভা। নতুন ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি সদ্য বদলি হয়ে এসেছিল আমাদের কাছে, আসতে না আসতেই তার ঘাড়ে চেপেছিল কোলাঘাট ব্লকের অতিরিক্ত দায়িত্ব। সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ হয়েছিল পৌরসভার কাজ। রোজ বকতাম ব্যাটাদের। ব্লকের মত কাজ কখনই পুরসভা তুলতে পারে না। তাই বলে সামান্য নড়াচড়াও করবে না তোমরা? কোলাঘাট, তমলুক বা পাঁশকুড়া ব্লক কি এমন অপরাধ করেছে, যে তোমাদের দায়িত্ব ওদের ঘাড়ে করে বইতে হবে? 


আমার জিভের খোঁচায় নাকি বেদজ্যোতির ঘাড় থেকে কোলাঘাট নামার সৌজন্যে কি না জানি না, এবার প্রথম ক্যাম্প থেকেই ছুটতে শুরু করেছিল তমলুক পুরসভার ঘোড়া। মাঝে তো এমন দাঁড়াল, কয়েকটা ব্লকের থেকেও বেশি ডিএস পড়ে গেল পুরসভায়।  টুকটাক ডিএস পড়ছিল ময়নাতে, পাঁশকুড়া ব্লক বরাবরই আমাদের নাইটওয়াচম্যান। মেরে রান করে না বটে ব্যাটারা তবে ধরে রাখে উইকেট। পরিচ্ছন্ন ছোট্ট ইনিংস খেলে আউট হয়ে গেল তমলুক ব্লক। গতবারে তৃতীয় হয়েছিল ব্যাটারা। এবারে যে কিছু হবে না সেটা বেশ বুঝলাম আমরা। ধীরে ধীরে রান বাড়াচ্ছিল ময়না। প্রথম চোটে উদ্দাম দৌড়ে ক্রমশঃ বেদম হয়ে পিছু হটছিল চণ্ডীপুর।


 গতবারের চ্যাম্পিয়ন কোলাঘাটের বোধহয় ব্যাড প্যাচ চলছিল, কিছুতেই রান উঠছিল না। ক্যাম্পে গিয়ে সেটা বলেও এলাম, ঝাঁকিয়ে এলাম খানিক। ওঠো বাবারা। একটু নড়।  একটু অন্তত রান করার চেষ্টা করো। কোলাঘাট খালি বলে, ‘দেখছেননি অন্যান্য ব্লকে দিনে দুটো করে ক্যাম্প ম্যাডাম। আমাদের একটা। আপনি গড়ে হিসেব করুন।’ বয়ে গেছে গড়ে হিসেব করতে। আমি শুধু ফলাফল দেখব। কাজের চিন্তা তোমরা কর গা। 


সবার অলক্ষ্যে কখন যে নন্দকুমার মাঠে নেমেছে,বাকি রথী মহারথীরা খেয়ালই করেনি। খেয়াল করেছি কি আমিও? ব্যাটারা নেমেই যখন দমাদ্দুম ব্যাট চালিয়ে চার ছয় বাগাতে থাকল, তখন সবার খেয়াল হল, রাস্তায় হাতি নেমেছে। ৬তারিখ মধ্যরাত্রে যখন বন্ধ হয়ে গেল সার্ভিস ডেলিভারি, ততোক্ষণে সব রথী মহারথীদের বহু পিছনে ফেলে তমলুক মহকুমায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে নন্দকুমার। দ্বিতীয় আর তৃতীয় কে হয়েছে তা অবশ্যি জানাই নি আমরা। থাকুক না একটু সাসপেন্স। ছটফট করুক না লোকজন,বেশি না, সামান্য একটু। মাত্র কটা দিন।


আজ সেই সাসপেন্সের পরিসমাপ্তি হল। প্রথম যে নন্দকুমার তা তো সবাই জানতই মোটামুটি। দ্বিতীয় স্থানে আমরা সবাই ভেবেছিলাম ময়না থাকবে বুঝি। শেষ মুহূর্তের স্কোর শিট মেলাতে গিয়ে দেখা গেল কি ভাবে যেন সেকেণ্ড পোজিশনটা দখল করে বসেছে কোলাঘাট। খরগোশ আর কচ্ছপের গপ্পের কচ্ছপের মত একদিকে নালিশ করে গেছে, দিনে একটা ক্যাম্প, নেট নেই, ডিএস ফেলতে দিচ্ছে নি, ভালো খেতে দিচ্ছেনি, কেবল ভাত আর বাঁধাকপি খাইয়েছে অমুক পঞ্চায়েত ইত্যাদি প্রভৃতি। অন্যদিকে তেমনি এগিয়েই গেছে ব্যাটারা, কখনও এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে, কখনও সিঙ্গলস্ নিয়ে। ময়নার দৌড় এবারের মত এসে থেমেছে তৃতীয় স্থানে। তা হোক, সেটাই অনেক। ভুলে যাবেননি ময়না আমার সবথেকে দূরের ব্লক। দীর্ঘদিন ধরে ময়নায় কোন ইন্সপেক্টর নেই। কোন সিকেসিও নেই। নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রঞ্জিৎ রাণা আপাততঃ অতিরিক্ত দায়িত্বে আছে।


যাই বলুন আজ আমাদের রঞ্জিত রাণারই দিন। দুটো ব্লক থুড়ি এলডব্লুএফসির চার্জে আছে, যার একটা প্রথম আর একটা তৃতীয়। খোদ বড় সাহেবের হাত থেকে ট্রফি দেওয়া হল রঞ্জিতকে। এরপর না খাওয়ালে চলে মাইরি? ভুল বুঝলেন, আমরা খাওয়াব না, ফাস্ট বয় খাওয়াবে আমাদের।  যাই হোক বড়সাহেবের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, চূড়ান্ত ব্যস্ততার মাঝেও স্যার বেশ অনেকটা সময় আজ কাটালেন আমাদের সাথে।  আমাদের সবার সাথে। স্যারের জন্যই বাজেট ভাঁড়ে মা ভবাণী হওয়া সত্ত্বেও সান্ত্বনা পুরষ্কার চালু করেছিলাম আমরা। এবারের সান্ত্বনা পুরষ্কার ছিল গাছ। ফলের গাছ। সৌজন্য আমার চুঁচুড়া পোস্টিং কালে হাড় জ্বালানো জনৈক ছোকরা উকিল। ব্যাটা বলেছিল, ‘পাখি গুলো আর বেশী দিন বাঁচবে না ম্যাডাম। না খেতে পেয়ে মরে যাবে সব। পাখিদের বাঁচাতে হলে ফলের গাছ লাগাতে হবে বুঝলেন-।’ যত পাগল কি আমার কপালেই জোটে। তা সেই পাগলের নির্দেশ শিরোধার্য করেই পেয়ারা, জামরুল আর লেবু গাছ দিলাম আমরা সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে। আর একটু সবুজ হোক না ধরা, আরো কিছুদিন বেশি বাঁচুক না পাখিগুলো। বাকি রইল কাজ, ও তো আমার আগেও হত, আমার পরেও হবে। থেকে যাবে শুধু একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি।

অনির ডাইরি ৫ই জুন, ২০২২

 


আমার বাবার মতে আয়োজন ছিল যৎসামান্য। বেশি করে কাজু কিশমিশ দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি ঘি গন্ধী সাদামাটা বাঙালী বাসন্তী পোলাও, তেলতেলে ঝাল ঝাল কষা মাংস, কাজু বাটা আর কসুরি মেথি দিয়ে পনীর, কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে শুধু মাত্র টমেটো কোরা আর জিরে গুঁড়ো-লঙ্কা গুঁড়ো মিশিয়ে ফ্রিজের কাতলার পেটির লাল লাল ঝাল, পাতি টমেটো খেজুর আমসত্ত্বের চাটনি, আমাদের কদমতলা বাজারের দেশপ্রিয়র চাপ চাপ লাল দই আর পায়েস। জামাই ষষ্ঠীতে মায়ের জামাইয়ের সামনে এইটুকুই রেঁধে, বেড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমার বর সোনামুখ করে খেয়ে নিয়েছিল বটে, ব্যাপারটা একদমই পছন্দ হয়নি আমার বাবার। 


বিগত দুর্গোৎসবের সময় ভুল চিকিৎসায় প্রায় এক পক্ষ কাল হাসপাতাল বাস তথা কেবল স্যালাইন সেবনের ফলে বাবার স্বাস্থ্য ইদানিং বড়ই ভেঙে পড়েছে। পাড়ার দোকানে যেতেই হাপিয়ে পড়ে বাবা। হারিয়ে ফেলে পায়ের জোর। ফলতঃ বড় দুশ্চিন্তা ছিল মায়ের, কি ভাবে সম্পন্ন হবে এবছরের জামাইষষ্ঠীর বিধি। এখনও কানে ভাসছে মায়ের আকুতি, “ ৫ তারিখে তো জামাইষষ্ঠী, রবিবার পড়েছে, শৌভিক আসতে পারবে তো?”


 অন্যদিন আপিসে ঢুকেই ফোন করি, সেদিন বেশ বেলা হয়েছে ফোন করতে। রমরমিয়ে চলছে দুয়ারে সরকার। গমগমিয়ে ঘুরছি আমি আর উত্তমকুমার, আজ অমুক ব্লকের এই পঞ্চায়েত তো কাল তমুক পুরসভার এত নম্বর ওয়ার্ড। বেশ কিছু ফাইল জমেছিল,ভেবেছিলাম সই সাবুদ করে সাড়ে বারোটা নাগাদ দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে বেরোব। গুটি কয়েক দর্শনার্থীও বসেছিলেন, নানা দাবিদাওয়া আর নালিশ নিয়ে। হাতের কাজ সেরে যখন বাড়িতে ফোনটা করতে পারলাম, শুনলাম গভীর দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন আমার বাপ। 


বাবার অবসর জীবনের সবথেকে প্রিয় অংশ হল এই অসময়ের দিবানিদ্রাটুকু। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ প্রাতঃরাশ সেরে, গোটা দুই সিগারেট আর এককাপ চিনি ছাড়া হাকুচ তেতো চা খেয়ে মায়ের সাথে জম্পেশ করে একচোট কোন্দল সেরে, পাখা চালিয়ে, জানলার পর্দা টেনে বা না টেনে, খাটে বা সোফায় ছোট্ট করে একটা ঘুম দিয়ে নেয় বাবা। ঘুম ভেঙে আবার চা, সিগারেট,আরেক প্রস্থ দাম্পত্য মতানৈক্য সেরে  স্নানাহারের দিকে পা বাড়ায় বৃদ্ধ দম্পতি। এটাই মোটামুটি চাটুজ্জে বাড়ির মেজ তরফের নৈমিত্তিক রুটিন। 


বাবার অনুপস্থিতিতে নিছক কেজো বার্তালাপ হয় মায়ের সঙ্গে। বাবার মত মজার মজার কথা বলতে থোড়াই পারে মা। বাবার মত মেরুদণ্ড সোজা করে নিজের মত প্রকাশ করতে বা ক্ষেত্র বিশেষে গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করতেও পারে না মা। পারতপক্ষে পরচর্চা বা পরনিন্দা  করে না মা,কারো সমালোচনা করেও না, শুনতেও ভালোবাসে না মা। কারণ আমার জননী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে সমালোচনার ফল সাধারণতঃ  খারাপই হয়। সময় বড় নির্মম, আজ আপনি যাঁর তীব্র সমালোচনা করবেন, কাল সময় আপনাকে হাঁটতে বাধ্য করবে তার জুতো পায়ে, তারই হেঁটে যাওয়া পথ ধরে। তো যাই হোক, এরপর বলুন দিকি এহেন মহিলার সাথে রসাল তথা দীর্ঘ বার্তালাপ কি আদৌ সম্ভব?


মায়ের সাথে শুধু কেজো কথা হয়, যথা তুত্তুরী স্কুল গেছে কি না, ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে কি না, শৌভিক অফিস গেছে কিনা বা তার শরীর কেমন আছে ইত্যাদি প্রভৃতি। মা প্রায় রোজ জানতে চায়, কি খেয়ে অফিসে এসেছি,টিফিনে কি খাব, ঠিকঠাক জল খাচ্ছি কি না। মা বলে, ‘রোজ একটা করে ফল খাস’। আমি যথারীতি কোনদিনই খাই না। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। উপরি হিসেবে যুক্ত হয়েছে কেবল জামাইষষ্ঠীর কথাটা। 


রবিবার ৫ই জুন জামাইষষ্ঠীর কথাটা আগেই বলেছিল মা,সেই মোতাবেক জিজ্ঞাসাও করেছিলাম শৌভিককে। আজ মাকেও জানিয়েই দিলাম, শুধু শৌভিকই নয়, আমরা তিনজনেই যাব। ভিডিও কলে আসন্ন জামাই বরণের উল্লাস ছাপিয়ে মায়ের চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে এক অচেনা বিষণ্ণতা। সুরাঁধুনী হিসেবে এককালে বেশ খ্যাতি ছিল মায়ের। এমনকি প্রবল রাশভারি তথা ব্যক্তিত্বময়ী আমার ঠাকুমাও তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাঁধতে ভালোও বাসত বটে মা। সকালে এক দফা রান্না করে, বাবার, আমার, নিজের টিফিন গুছিয়ে আপিস যেত। এমনকি স্কুল বা কলেজ থেকে ফিরে কি খাব তাও সুন্দর করে সাজিয়ে চুপড়ি চাপা দিয়ে জলে বসিয়ে রেখে যেত মা। সন্ধ্যে বেলা আপিস থেকে ফিরে, চা খেয়ে ছোট্ট করে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার রাতের রান্না করতে বসত। জীবনেও এক তরকারি ভাত বা শুধু মাছের ঝোল ভাত খাওয়ায়নি মা। মাত্র এক দেড় ঘন্টার মধ্যে তেঁতো থেকে অম্বল কত কি যে রেঁধে ফেলতেন ভদ্রমহিলা তার ইয়ত্তা থাকত না। 


মধ্য সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে সেই মা আজ দুপদ রাঁধতে থতমত খায়। যত বলি শৌভিক মোটেই আমাদের মত ভোজন বিলাসী নয়। শাশুড়ি মা তাঁর পুত্রদের বড় সুশিক্ষা দিয়ে গঠন করেছেন। শৌভিক তাই সব খায়। একপদ-দুপদ-দশপদের কোন বেয়াড়া আব্দার কোনদিন করে না। এবেলার রান্না ওবেলা ছাড়ুন, আজকের রান্না ফ্রিজে রেখে কাল গরম করে দিলেও সোনামুখ করে খেয়ে নেয়। এমনকি বাসি রুটিও যদি সামান্য ভেজে বা গরম করে দেওয়া হয় তাও লক্ষ্মী ছেলের মত খেয়ে নেবে। বরং পদের সংখ্যা বেশি হলেই কিঞ্চিৎ  নার্ভাস হয়ে পড়ে আমার সোয়ামী। মাকে তা কইলামও, তাও মায়ের ভয় কাটে না। বিরক্তি চেপে বললাম, খাবার কিনে নিলেই তো হয়?


সুইগি জ্যোমাটোর ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই মায়ের। একবার বাবার জন্মদিনে অর্ডার করা খাবার না ডেলিভারি দিয়েই ফিরে গিয়েছিল সুইগির ডেলিভারি বয়। একটা ফোনও করেনি। তুত্তুরী আর বুল্লু বাবু পাশের মাঠে খেলছিল, ওরা দৌড়ে গিয়ে বলেওছিল,‘ কাকু ওটা আমাদের অর্ডার, আমাদের বাড়ি ঐ দিকে।’ তাও পাত্তা দেয়নি ছেলেটা। উল্টে সুইগি একটা মোটা টাকা ফাইন চাপিয়েছিল আমার ওপর, কেন ওদের খাবার অর্ডার দিয়েও নিইনি বলে-। সেযাত্রা টুইটারে পচুর হল্লা করে ফাইন মুকুব করেছিলাম বটে,তবে খাবার কিনতে আমাকে বেরোতে হয়েছিল টোটো চেপে। অনলাইন কোন কিছুকেই ভরসা করে না মা। 


 রান্না বাড়িতে করতে হলে বাজারও তো লাগবে সমানুপাতিক হারে। বাবার যা শারীরিক অবস্থা। সমস্যার কথা শুনতে শুনতে কখনও যে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, ‘এতই যখন সমস্যা তখন এবছর জামাইষষ্ঠীটা না করলেই তো হয়।’ বলেই প্রমাদ গুণলাম, মায়ের মুখে ঘনিয়ে এল শ্রাবণের কৃষ্ণ বাদল। তড়িঘড়ি ফোন রেখে তো দিলাম, কিন্তু মনের মধ্যে কি যেন বারবার ফুটতে লাগল। 


আজ আমরা কোলাঘাট ব্লক আর পাঁশকুড়া পুরসভায় ক্যাম্প  দেখতে যাব। যখন গাড়ির চাকা গড়াতে লাগল, তখনও বেশ রোদ, অচীরেই ঘনিয়ে এল মনখারাপী মেঘ এবং উপুর্যান্তে বৃষ্টি। গাড়িটাকে ঘিরে যেন জলের পর্দা, পর্দার আড়াল থেকে ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম মাকে, ফোনটা ধরলেও জবাব দিল না মা, ফ্যাঁচফ্যাঁচে কান্নার শব্দ আসতে লাগল শুধু একটানা। অনেক কষ্টে,অনেক অনুনয় বিনয়, উত্তম কুমারের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে সহস্রবার মার্জনা ভিক্ষার পর মুখ খুলল মা,‘আমার সমস্যা, আমার অসহায়তার কথা, তোকে না বললে কাকে বলব?’ 


সত্যিই তো। আমার আশি পেরোনো বাপ আর মধ্য সত্তরের জননী, তাদের সমস্যার কথা অকপটে আমাকে না বললে আর বলবে কাকে? মাকে আশ্বস্ত করলাম, দাঁড়াও, তোমায় কোন চিন্তা করতে হবে না। জামাইষষ্ঠীর দুদিন আগেই বাড়ি ফিরব আমি আর তুত্তুরী। অতঃপর দোকান-বাজার, রান্না মায় উভয়পক্ষের উপহার কেনা সব আমার দায়িত্ব। মা শুধু বসে বসে হুকুম করবে আর মাঝে মাঝে একটু চা যদি, অনুগ্রহ করে- মায়ের মত চা, আর কেন জানি না কেউ বানাতেই শিখল না। এমনকি আমিও না। 


শেষ পর্যন্ত অবশ্য দোকানবাজারের অনেকটাই  তুত্তুরীকে সঙ্গে নিয়ে বাবাই করেছিল। কুটনো কোটা, মশলাবাটা ইত্যাদিতে সাহায্য করেছিল মায়ের আয়া দিদি, লক্ষ্মী।  হ্যাঁ খুন্তি আমি নাড়িয়েছি বটে, বাবার অগোচরে বার চারেক শ্রীমতী তুত্তুরী আর বুল্লু বাবুকে দোকানও পাঠিয়েছি  টুকটাক জিনিসপত্র, যেমন ইয়ে পোলাও রাঁধতে গিয়ে কম পড়া গোবিন্দভোগ চাল আনতে। ষষ্ঠী বলে স্বয়ং আঁশ বা এঁটো কোন খাদ্য চেখে দেখতে পারছিলাম না, সে কাজেও যথোপযুক্ত  সহায়তা করেছে তুত্তুরী আর বুল্লু বাবু। সে যাই বলুন না কেন, খুন্তী তো আমিই চালিয়েছি নাকি? এখন এত কিছুর পর যদি শৌভিককে প্রদেয় আশির্বাদী টাকাটা ঝেঁপেই থাকি, তেমন কোন অন্যায় করেছি কি? দুবেলা পর্যায়ক্রমে জ্ঞান এবং খোঁটা দেবার মত কোন গর্হিত কাজ করিছি কিনা বলুন তো? সেটা আমার বাপ, মা এবং তাদের জামাইকে কে বোঝায় বলুন দিকি?

Sunday 26 June 2022

অনির ডাইরি ২৫শে জুন,২০২২




ঠিক নটায় বেরোই আমরা। যদিও রিপোর্টিং টাইম নটা চল্লিশ আর গাড়িতে যেতে সময় লাগে মাত্র বিশ মিনিট, তবুও একটু আগেভাগেই বেরোই আমরা। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা থাকে, মাত্র পাঁচ মিনিট দেরী হলেই প্রায় একসাথে হুড়মুড় করে এসে হাজির হয় গোটা বারো ইস্কুল বাস, একগাদা গাড়ি, কয়েকশ বাইক আর বোধহয় কয়েক হাজার টোটো। পরিণামে গাড়িওয়ালাদের উত্তপ্ত বাদানুবাদ ছাড়া সাময়িক ভাবে স্তব্ধ হয়ে যায় জীবন। তখন ভারী স্কুলের বস্তা সহ মেয়ের হাত ধরে দৌড়তে হয় প্রায় হাফ কিলোমিটার। 


তাই একটু আগেভাগেই বেরোই আমরা। গাড়ির চাকা বাড়ির সীমানা ছাড়ালেই মায়ের মুঠো ফোনের জন্য হাত বাড়ায় তুত্তুরী। ওদিকেও ঠিক নটা বাজলেই তুত্তুরীর ভিডিও কলের জন্য মুখিয়ে থাকে বাবা। প্রতিদিন কল কানেক্ট হলে একই দৃশ্য দেখি আমরা, একহাতে  জ্বলন্ত সিগারেট, অন্য হাতে আমার মায়ের মুঠো ফোনটা নিয়ে আয়েস করে সোফায় বসছে বাবা। এবং প্রথম সংলাপটাও রোজই মোটামুটি একই থাকে, ধোঁয়া ছেড়ে উদাত্ত কণ্ঠে জানতে চায় বাবা, ‘তুত্তুউউরী বেরিয়ে পড়েছ? সঙ্গে কে যাচ্ছে?’ মোবাইল ক্যামেরা ঘুরিয়ে আমায় দেখায় তুত্তুরী। ক্যামেরা আবার তুত্তুরীর দিকে ঘুরে যায়।  বাবা বলে,“ বাঃ! গাড়িতে যাচ্ছ। ‘গাড়ি চালায় বংশীবদন, সঙ্গে যে যায়  ভাগ্নে মদন-’।” ড্রাইভার পলাশ শুনতে পাবে ভেবে মৃদু ধমকায় তুত্তুরী। নাতনীর ধমক খেয়ে, সিগারেটে একটা লম্বা টান মারে বাবা, অতঃপর বলে, ‘আচ্ছা তুত্তুরী, তোমার যেমন একটা পলাশ কাকু আছে, তেমনি কোন শিমূল কাকু নেই?’ দাদুর উৎপটাং কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী। নিমতৌড়ির সরকারী আপিস আর আবাসনে ঘেরা এলাকা ছাড়িয়ে গাড়ির চাকা গড়ায় রেলগেটের দিকে। দুদিকে ছাড়া ছাড়া এক দুতলা বাড়ি আর তাদের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে পিছনের ঘন সবুজ ক্ষেত, পুঁচকে দীঘি, আল বরাবর তাল আর নারকেল গাছের সারি। এখানে এলেই ক্যামেরাটা জানলার দিকে ঘুরিয়ে দেয় তুত্তুরী। দাদুকে চেনাতে চেনাতে নিয়ে চলে পথঘাট। দাদু কিন্তু আটকে থাকে শিমূল আর পলাশের জঙ্গলে। ‘জানো তো তুত্তুরী, পলাশ কাঠের ধোঁয়ায় ভূত পালায়।’ ধ্যাৎ বলে হেসে ফেলে তুত্তুরী। দাদু গল্প শোনায়, কাদের বাড়িতে যেন ভয়ানক ভূতের উপদ্রব হয়েছিল, ওঝা বলেছিল ভূত তাড়াতে মস্ত হোম করতে হবে। তবে বেল কাঠ নয়, হোম হবে পলাশ কাঠে। বড় জেঠু তখন হাজারিবাগে পোস্টেড। কিভাবে যেন বড়জেঠুকে ধরে কয়েক কেজি পলাশকাঠ যোগাড় করে দিয়েছিল বাবা, সেই গল্প চলে। 


রেল ক্রশিং এ আটকে পড়ি আমরা। ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর পিছনে দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে  বিরাট একটা ডাইনোসরাস। খামোখা স্বামীজীর পিছনে ডাইনো ছাড়ার কি মানে ভগবান জানে। রোজ এইটা নিয়ে এক প্রস্থ চর্চা করি আমরা বাপ-মেয়ে আর নাতনীতে। 


রেল ক্রশিং পেরিয়ে গাড়ি গড়ায় হসপিটাল মোড়ের দিকে। হসপিটাল মোড়ের ক্রশিংয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছেন শহীদ ক্ষুদিরাম। আমাদের তমলুকের হ্যামিলটন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। দাদু আর নাতনী আদর করে তাঁর নাম দিয়েছে,‘ছোকরা বা বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোকরা।’ রেল গেট পেরোলেই ছোকরাকে দেখার বায়না করে দাদু। আর তুত্তুরী বায়না করে গল্প শোনার। 


নাতনীর আব্দারে, সাতসকালে "দাদুর ঝুলি" খুলে বসে বাবা। ‘ তোমাদের তুলনায় আমাদের ছোটবেলাটা ছিল অনেক সাদামাটা, আড়ম্বর বিহীন। আমাদের ছেলেবেলায় বিনোদন বলতে ছিল বাঁদর নাচ,ভাল্লুক নাচ, জাদুর খেলা আর নররক্ষস"। বাঁদর নাচ- ভাল্লুক নাচের গল্প চলে কিয়ৎক্ষণ, অতঃপর জানতে চায় বাবা, " তুত্তুরী তুমি পিসি সরকারের নাম শুনেছ?’ শুনেছে তুত্তুরী। বিখ্যাত যাদুকর। ঘাড় নাড়ে দাদু, বলে, তাঁর ছোটবেলায় জাদুর দুনিয়া যিনি কাঁপাতেন তিনি হলেন পিসি সরকার সিনিয়র। বছরে আটমাসই তিনি বিদেশে শো করে বেড়াতেন আর দিশি কাগজে ফলাও করে বেরোত পিসি সরকার সিনিয়রের অলৌকিক সব কাণ্ড কারখানা। সাধারণ পাঠক পড়ত, আর তাদের মনে হত, তিনি নিছক সাধারণ মানুষ নন, তাঁর যাদু নিছক চোখের ধাঁধা নয়। ‘উইজার্ড ছিলেন নাকি?’ ফস্ করে বলে ওঠে তুত্তুরী। সামান্য বিরক্ত হয় দাদু। তারপর বলে, 'নাঃ তা ছিলেন না। তবে সেটা তাঁর জীবদ্দশায় কেউ বুঝতে পারেনি। উনি মারা যাবার বহু বছর পরে, তোমার মায়েদের ছোটবেলায় ওণার পুত্র, জুনিয়র পিসি সরকার তাঁর বাবাকে নিয়ে এক মর্মস্পর্শী লেখা লেখেন। তাতে সেই সময় প্রচলিত অনেক গুজবের আসল কারণ ব্যাখ্যা করেন।’ 


‘দাদু তোমার ছোকরা এসে গেছে’, বলে কাঁচ নামায় তুত্তুরী। ছোকরাকে ঘিরে গোল করে ঘুরে যাই আমরা। পরবর্তী গন্তব্য, ‘বৃদ্ধা বা ঝান্ডা কাঁধে বৃদ্ধা।’ বুঝতেই পারছেন, পূব মেদিনীপুরের ঘরের মেয়ে। গান্ধী বুড়ি। আবার কাঁচ তুলে দেয় তুত্তুরী। দাদু আরেকটা সিগারেট ধরায়, অতঃপর আবার দোঁহে ফিরে যায় দাদুর শৈশবে। সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে। উপর্যুপরি দেশ ভাগ এবং কয়েক বছর আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে ধুঁকছে বঙ্গদেশ। পিসি সরকার সিনিয়রের যাদু দেখার ক্ষমতা হাওড়া শহরের খুব কম লোকেরই ছিল। মধ্য হাওড়া বাসীদের জন্য ছিলেন স্থানীয় ছোট খাট যাদুকর তথা নররাক্ষস। “নররাক্ষস” শুনে নড়ে চড়ে বসে তুত্তুরী। 


দাদু বলে চলে,“হ্যাঁ। মধ্য হাওড়ার বিভিন্ন জমিদার বাড়িগুলোতে বসত যাদুকর আর নররাক্ষসের খেলা। আমাদের মামার বাড়ির বাগানেও একবার হয়েছিল। দাদুর অনুমতি নিয়ে পড়েছিল তাঁবু।  টিকিটের দাম একআনা। খেলার সাত দিন আগে থেকে যাদুকরের লোকজন রিক্সা চেপে মাইক নিয়ে প্রচার করত পাড়ায় পাড়ায়। মাইক মানে তোমাদের এখনকার মত না। নিছক টিনের চোঙা। তাই মুখে নিয়ে চিৎকার করত। আবার কখনও কখনও ঘোড়ায় টানা গাড়িতে ব্যাণ্ডপার্টি নিয়েও চলত যাদু খেলা আর নররাক্ষসের প্রচার। ব্যাণ্ডপার্টির গদাগুম গদাগুম বাজনা শুনে ছুটে যেতাম আমরা। তখন যাদুকরের অ্যাসিস্টান্ট কোচোয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে চোঙা নিয়ে চিৎকার করত। 


সাধারণতঃ রবিবার বা ছুটির দিনে খেলা হত। এক আনা পয়সা দিলে ছোট্ট এক টুকরো কাগজে রাবার স্ট্যাম্প মেরে দিয়ে দিত আমাদের। ওটাই টিকিট। সে যে কি উত্তেজনা তুত্তুরী। টিকিট কাটার পর থেকে উত্তেজনায় রাতে ঘুম আসত না আমাদের। 


আগে হত যাদুর খেলা। পিসি সরকারের মত নয়। ছোট খাট যাদু দেখাতেন যাদুকর। তাসের খেলা। কান মুলে পিছন দিয়ে আমেরিকান ডেলের বড়া বার করা-”। 


“কিঃ” বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী। হেসে ফেলি আমিও। অতি কষ্টে হাসি চাপে পলাশ। বাবা বলে,“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য বৃটিশ সরকার যে শুধু চাল গুদামজাত করেছিল তাই নয়, সেপাইদের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছিল ডালও। ফলে বাজারে সে কি হাহাকার। ডালের বদলে আমেরিকা থেকে রপ্তানি করা হয়েছিল কোন এক বিশেষ ধরণের সিরিয়াল। লোকে বলত,‘আমেরিকান ডেল’। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে থেকে এক জন ভলান্টিয়ার চাইত যাদুকর। যে ছেলেটা উঠে যেত, তার বুক পকেটে একটা আমেরিকান ডেলের বড়া রেখে, কি সব অং বং মন্ত্র পড়ত যাদুকর। অতঃপর দেখা যেত ছেলেটার বুক পকেট ফক্কা। কোথায় গেল আমেরিকান ডেলের বড়া। সেই ডেলের বড়া যাদুকর বার করত, ছেলেটার পিছন থেকে।


সবশেষ খেলা ছিল নররাক্ষস। বাগানে একটা কবরের মত গর্ত খোঁড়া থাকত। যাদুকর তাঁবুর ভিতর গিয়ে পোশাক বদলে এসে সেই গর্তে শুয়ে পড়ত। গর্তের মুখটা ঢেকে দেওয়া হত একটা মস্ত কাঠের পাটাতন দিয়ে। তারওপর আবার মাটি চাপা দেওয়া হত। এগুলো করত স্থানীয় ছেলেরা। যাদুকর মাটির তলায় কিভাবে শ্বাস নিত কে জানে? তারপর ক্ষণিক অপেক্ষা। সেকি উত্তেজনা। গোটা তাঁবু জুড়ে সবাই ভয়ে জড়সড়। একটা পিন পড়লেও যেন শব্দ হয়।”


গাড়ির ভিতরেও প্রায় পিন পড়ার শব্দ শোনা যায়, বাঁহাতের শটকার্ট রাস্তাটা ধরতে গিয়েও ধরে না পলাশ। দাদু-নাতনীর প্রিয় বৃদ্ধার মূর্তির দিকে গড়ায় গাড়ির চাকা। বেশ কয়েকবার সিগারেটে টান দিয়ে, গলা ঝেড়ে আবার গল্প শুরু করে বাবা,‘তারপর, বেশ অনেকক্ষণ কেটে যায়। উদ্যোক্তরা ছেলেরা, যারা অধিকাংশই দাদা মানে তোমার বড়দাদুর বন্ধু ছিল, মাটি খুঁড়ে,পাটাতন সরিয়ে যাদুকরকে বার করে আনে। সে ততোক্ষণে যাদুকর থেকে নররাক্ষসে পরিণত। তার তখন সে কি ভয়ানক রূপ। উস্কোখুস্কো চুল, লাল ভাঁটার মত চোখ। সে তখন উন্মাদের মত ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় সামনে উপস্থিত কচিকাচা দর্শকদের ওপর। নররাক্ষসের কোমরে মোটা করে দড়ি বেঁধে দুদিক থেকে দুতিন জনে মিলে ধরে রাখে, তাও পারে না। নররাক্ষস,‘হাউ মাউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ’ করতেই থাকে। শেষে কেউ একজন একটা জ্যান্ত মুর্গি ছুঁড়ে দেয় নররাক্ষসের দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই মুর্গিটাকে ধরে নেয় নররাক্ষস, তারপর সবার সামনে তার ঘাড় মটকে, পালক ছিঁড়ে, ছাল ছাড়িয়ে তাকে খেতে থাকে। সে কি ভয়ানক দৃশ্য তুত্তুরী। খেলা শেষ হয়ে যাবার বেশ কিছুদিন পরও আমাদের থেকে ছোট বাচ্ছা যারা ছিল, এই ধর তোমরা ছোটদাদুর বয়সী, তারা একা ঘুমাতে পারত না রাতে। মায়ের বুকের কাছে শুয়ে ভয়ে কাঁপত। মাংস খাওয়া শেষ হলে, নররাক্ষস আবার মানুষ হয়ে যেত। বুঝলে তুত্তুরী, তখন না বুঝলেও, বড় হয়ে বুঝেছিলাম, নিছক দুটো পয়সা রোজগারের ধান্ধায় জ্যান্ত মুরগি খেত লোকটা। পেটের দায়ে মানুষকে কি না করতে হয়।’ 


শহীদ মাতঙ্গিনীর পাশ দিয়ে নীরবে বেঁকে যায় গাড়ি, অভাবী নররাক্ষসের জন্য গাড়িতে বিরাজ করে এক মনখারাপি নীরবতা। কখন যেন এসে পড়ে তুত্তুরীর স্কুল। ফোন কেটে দেয় তুত্তুরী। আজ সকালের উপাখ্যান শেষ হয় এখানেই। কাল আবার হবে নতুন কোন গল্প। যার সাক্ষী থাকবে বিবেকানন্দ-ডাইনো-ছোকরা আর বৃদ্ধা। কে জানে কাল কার পালা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরাধীন বা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসবে হয়তো আবার কোন অনামী চরিত্র, যারা নীরবে বেঁচে, নীরবেই ঝরে গেছে কালের লিখনে,  রেখে গেছে শুধু এক ঝাঁক স্মৃতি।


*বিধিসন্মত সতর্কীকরণ*- আমার সাদামাটা জীবনের সাদামাটা দিনপঞ্জি। 'মশা মারতে কামান দাগা' বা পাঠকের মূল্যবান সময় অপচয় করা কোনটাই অধমের অভিপ্রায় নয়। অজান্তে যদি করে থাকি নিজগুণে মার্জনা করবেন। আমার আপাতঃ সুখী সুখী দিনপঞ্জি যদি আপনার নিছক ন্যাকা লাগে,  বিবমিষা উদ্রেক থাকে তারজন্যও করজোড়ে মার্জনা ভিক্ষা করি। জোর করে অসুখী, আঁতেল মার্কা লেখা কি করে লিখি বলুন দিকি? দুঃখ যে বড় ব্যক্তিগত অনুভূতি, তাকে কি সবার সামনে বিবস্ত্র করা যায়? মুস্কিল হল আপনি যদি আমার সামান্য সুখের মুহূর্তটাকেই না হজম করতে পারেন, আমার দুঃখটা কি আদৌ আপনার গলা দিয়ে নামবে? সন্তান গরবে গরবিনী বলেও খোঁটা দিল সেদিন কেউ, কি করি বলুন তো, আমি যে নিজেও ঐ শিক্ষায়, ঐ প্রশ্রয়ে বড় হয়ে উঠেছি গো। যেদিন অপরিচিত ছিল শৌভিক, যেদিন পকেট ছিল গড়ের মাঠ, যেদিন চেহারা ছিল নিছক ভিড়ে মিশে থাকা অপাংক্তেয়, সেদিনও যে আমাকে নিয়ে আমার বাবার গরবে মাটিতে পা পড়ত না। আজও বৃদ্ধকে একবার জিজ্ঞাসা করুন দিকি, এই পৃথিবীর সেরা কন্যে কে?দেখবেন তুত্তুরীকেও দ্বিতীয় স্থানে রাখবে বৃদ্ধ। বাবা-মা হয়ে যদি সন্তানের যোগ্যতা আর সাফল্য দেখতে বসি,তাহলে সমাজ দেখবে কি?  আর রইল সময়ের কথা, আমার হাতে অঢেল সময়ের খোঁচা মাঝেমধ্যেই শুনতে হয় আমাকে, বিশ্বাস করুন আমার দিনও কিন্তু মাত্র ২৪ ঘন্টাতেই শেষ হয়ে যায়। তারই মধ্যে কি ভাবে নিজের জন্য তথা লেখালিখির জন্য  সময় বার করি? ওটাকে বলে টাইম ম্যানেজমেন্ট।

অনির ডাইরি ২১শে জুন, ২০২২


 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 


রোজই অফিসে ঢোকা-বেরানোর পথে দেখা হয় বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে। পরণে একই নীল সাদা বিবর্ণ টিশার্ট, আর জরাজীর্ণ প্যান্ট। দুহাতে দুটো মস্ত বাজার ব্যাগ নিয়ে চা বিক্রি করেন।একটায় থাকে ফ্লাস্ক ভর্তি চা, অপরটায় কাগজের কাপ, প্লাস্টিকের গ্লাস,প্লাস্টিকের বয়াম ভর্তি সস্তা অনামী ব্র্যান্ডের মারি, ক্রিম ক্রাকার, লোকাল বেকারির বিস্কুট ইত্যাদি। দেখা হলেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন, ‘ম্যাডাম, ভালো আছেন?’ প্রায় রোজই করেন। তাড়াহুড়োর সময় কুশল সংবাদ জানতে চাইলে যে ভাবে উত্তর দেয় মানুষ,সেভাবেই জবাব দিই আমি,‘হ্যাঁ ভালো আছি। আপনি ভালো তো?’ জবাবও আসে আশানুরূপ, উত্তর আসার আগেই কখনও বন্ধ হয়ে যায় আমার লিফটের দরজা, কখনও বা কেজো হুঁ বলে এগিয়ে যান উনি। আজ একটু বেশিই তাড়ায় ছিলাম, মিটিং এ লেট হয়ে গেছি। লিফটে ওঠার মুখে আবার ওণার সঙ্গে দেখা, আবার,‘ম্যাডাম ভালো আছেন-?’আজ কেন জানি না মনে হল আমার জবাবটা একটু ঘুরিয়ে দিই,  আমি দিব্যি আছি জানিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি কেমন আছেন?’ কেজো ব্যস্ত হুঁ আজ আর ফেরৎ এল না। ব্যাগ দুটো মাটিতে নামিয়ে, কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘ভালোই আছি ম্যাডাম। কদিন আগে একটু জ্বর এয়েছিল। বৃষ্টিতে ভিজতেছিলাম কি না তাই। এখনও গা ম্যাজম্যাজাইচ্ছে।’ এবার আমার পালা, কেজো আচ্ছা বলে বলে পাশ কাটিয়ে লিফটে ওঠার। বোতাম টিপতে যাব, উনি আবার বললেন,‘ও ম্যাডাম শোনেন না, আপনি আসছে রবিবার আসবেন?’ কোথায়, প্রশ্নটা বোধহয় আমার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল, উনি ব্যাগ দুটো আবার হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের গাঁয়ে নারান মন্দিরের হইতেছে কিনা, রবিবার তার শুভ উদ্বোধন।মন্দিরটাকে সুন্দর বানাতে অনেক খাটছি আমরা। সবাই চাঁদা তুলে বানাইছি তো। ঠাকুরটা আমি দিইছি। দুদিন ধরে নামগান হবে। সারা গাঁয়ের লোক খাবে। আপনিও আসবেন ম্যাডাম কেমন? খোকাকেও আনবেন, খুব ভালো লাগবে, -’। ওণার সনির্বন্ধ অনুরোধের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা। আমি না, অন্য কোন তলায় কেউ বোতাম টিপেছে নির্ঘাত। উনি তখনও বিড়বিড় করে ঠিকানাটা বলছিলেন, কোন গাঁ, কোন পুকুরের পাশ দিয়ে, কটা ল্যাম্পপোস্টকে ডাঁয়ে আর বাঁয়ে রেখে ইত্যাদি প্রভৃতি। ক্ষীণ হতে হতে এক সময় হারিয়ে গেল ওণার কণ্ঠ। বন্ধ লিফটের মধ্যে খুব হাসলাম একচোট একাকী। প্রথমতঃ শ্রীমতী তুত্তুরীকে খোকা বলার জন্য আর দ্বিতীয়তঃ ভদ্র ভাবে দুটো কথা বললেই আজও কেমন পলকে আপন হয়ে যায় অপরিচিত মানুষজন।

অনির ডাইরি ১৯শে জুন, ২০২২

 



রবিবার যে ফাদার্স ডে,সেটা মোটামুটি বুধবার দুপুর থেকেই টের পাচ্ছিলাম। গোছা গোছা নোটিফিকেশন আসছিল আমাজন, নায়িকা, মিন্ত্রার মত ই-কমার্স ওয়বসাইট থেকে। বক্তব্য একটাই, ‘স্পেশাল দিনে বাবাকে ইস্পেশাল কিছু কিনে দাও না-’। অনেক  ভাবলাম বৃদ্ধকে একটা টিভি কিনে দিই বরং। বর্তমান টিভিটা আমিই  কিনে দিয়েছিলাম, প্রায় জবরদস্তি করে, এলসিডি বটে, তবে বয়সে তুত্তুরীর থেকেও বড়। মাঝেমাঝেই গোলমাল পাকায়, কিছুদিন আগেই দুটো স্পিকার পাল্টাতে হয়েছে বাবাকে। আরও কি সব খোলনলচে বদলে বর্তমানে দিব্যি চলছে বটে, তবুও-। গ্রেট ইস্টার্ন থেকে কিসব অফার ওয়ালা মেলও এসেছিল, প্রায় কিনেই ফেলতাম, তার আগে ভাবলাম একবার জিজ্ঞাসা করেনি, যা বদমেজাজী বৃদ্ধ, না বলে কিনে দিলে হয়তো সটান ফেরৎ পাঠাবে। 


বেলা চারটে নাগাদ ফোন করতেই খ্যাঁক করে উঠল বৃদ্ধ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাধের দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা ভঙ্গের জন্য একরাশ বিরক্তি তো ছিলই, তার থেকে বড় কথা হল, ‘আমার পুরাণ টিভিটার কি হবে-’? বললাম,ফেলে দাও। একযুগ পুরাণ টিভি, কেউ পাঁচশ টাকা দিয়েও কিনতে যাবে না। বলেই প্রমাদ গুণলাম। ধেয়ে এল বাবার শাণিত জিহ্বা,‘ তাহলে, তোমার মাকে নিয়ে কি করব? কাল তো বলবে, আমার বউটাও পুরাণ হয়ে গেছে, একেও ফেলে দিতে।’ বাবার কোলের কাছে গুটিসুটি হয়ে নিদ্রা দেবীর আরাধনা করা মা এটা শুনে কতটা খুশি হল জানি না, আমি হতোদ্যম হয়ে ফোন রেখে দিলাম। 

পুরাণ জিনিসপত্রের প্রতি চাটুজ্জে বাড়ির  দরদ প্রায় প্রবাদপ্রতিম। কিছুই ফেলা হয় না আমাদের বাড়িতে। চাকরী পাওয়া ইস্তক উপহার দেওয়া প্রতিটা শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবি,বিছানার চাদর মায় খারাপ হয়ে যাওয়া ইনভার্টারটাও বাবা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। শুধু কি আমি, কবে অবসর নেওয়া ছোটমাসি চাকরী পেয়ে প্রথম মাসের মাইনে থেকে একটা ১৮টাকার প্যান্ট উপহার দিয়েছিল বাবাকে সেটাও রাখা আছে নিঁভাজ পাট করে। বাবার জামাকাপড়ের বেহাল দশা দেখে কবে সদ্য বিবাহিত মা কার থেকে যেন কিছু টাকা ধার করে কিনে দিয়েছিল তিনটে শার্ট। আজও গোছানো আছে তা। সেজ-ছোট মাসির বুনে দেওয়া সেই আশি নব্বইয়ের দশকের ফুটো হয়ে যাওয়া সোয়েটার, আছে তাও। বাবা কিছু ফেলে না। মাও না। শুধু আমি কিছু দিতে গেলেই হাড় জ্বলে যায় ওদের। যাই দিতে চাই, তাই নাকি অপ্রয়োজনীয় এবং বাহুল্য বিশেষ। বাড়িতে রাখার জায়গা নেই। স্বাভাবিক, পুরাণ দ্রব্যাদি গুদামজাত করে রাখলে, নতুন জিনিসপত্র রাখবে কোথায়-


বাড়ি ফিরে চায়ের কাপে সেই গল্পই শোনাচ্ছিলাম তুত্তুরীকে। ‘কিন্তু ওরা যখন চাইছেই না, তুমি অকারণ জোর করছ কেন?’ দাদুর ওপর চটে গিয়ে বিরক্ত স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। জবাব একটাই, আমার বাবাটা যে পৃথিবীর সেরা বাবা, তাই না চাইতেই সবকিছু দিতে চাই বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ সেটা শুনলে বা বুঝলে তো। 


স্বাভাবিক ভাবেই তুত্তুরীর কাছে তার বাবাটা সেরা, আমার বাবাটাও সেরা বটে, নিঃসন্দেহে সেরা। তবে দাদু হিসেবে। কার বাপটা বেশি ভালো এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই কোঁদল করি আমরা মা-মেয়েতে। এবারের কোঁন্দলটা যদিও তেমন জমল না। তর্ক যুদ্ধের মাঝপথে হঠাৎ অস্ত্র ত্যাগ করল তুত্তুরী । অতঃপর চিন্তিত স্বরে,‘ এই মা, ফাদার্স ডে তে আমি কি দেব আমার বাবাকে?’ বললাম কিছু কিনে দিই। তুত্তুরীর বাবাকে নিয়ে তো কোন চিন্তা নেই,পুরাতন জামাকাপড়  জমিয়ে রাখার বদভ্যাসটা তারও ঘোরতর আছে বটে, তবে নতুন কিছু দিলে আপত্তি খুব একটা করে না। বড়জোর মৃদু স্বরে বলে ওসব ‘উস্টুমধুস্টুম’ উপহার না দিয়ে, মূল্য ধরে দিলে বেশী খুশি হত। এই আর কি। 


প্রস্তাবটা পছন্দ হয় না শ্রীমতী তুত্তুরীর। ‘তুমি কিনে দিলে,সেটা তো তোমার দেওয়া হবে।’ যুক্তি অকাট্য। তাহলে? দীর্ঘ মস্তিষ্ক প্রক্ষালন তথা দুধের কাপে ঝড় তুলে অবশেষে উপায় বার করে তুত্তুরী, কোন সিনেমা বা ভিডিওতে দেখা রণবীর কাপুরের মত সারপ্রাইজ স্পেশাল ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়াবে বাবাকে। সাথে থাকবে একটা ছোট্ট বার্তা, ফাদার্স ডে স্পেশাল। 


ব্যাপারটা ভাবা যতটা সহজ, বাস্তব রূপায়ন ততোটাই দুরূহ। লুচি পরোটার মত শৌভিকের প্রিয় প্রাতরাশ বানানো তুত্তুরীর পক্ষে অসম্ভব। তার ওপরে এখানকার গ্যাসের টেবিলটা যা উঁচু। কড়া বসালে রীতিমত লেঙচে দেখতে হবে শ্রীমতী তুত্তুরীকে।  কাজেই ওসব বাদ। তাহলে কি ম্যাগি? শনিবার সকালে ফিল্ড ভিজিটে বেরানোর সময় আমার হাতের স্পেশ্যাল চিলি গার্লিক ম্যাগি খেয়ে বেরিয়েছে শৌভিক। কাজেই ম্যাগিও বাতিল। তাহলে? সারাদিন ধরে ইউটিউবে ফাদার্স ডে স্পেশাল ব্রেকফাস্টের রেসিপি ঘাঁটে শ্রীমতী তুত্তুরী। এমন কিছু যা মূলতঃ মাইক্রোওয়েভেই বানানো যাবে। শুধু তাই নয়, যা ঝটপট বানানো যাবে এবং যার সমস্ত উপকরণ মজুত আছে বাড়িতেই। 


সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে, স্নান সেরে কাচা তথা ভালো জামা পরে  যখন আমার ঘুম ভাঙাল তুত্তুরী ঘড়ি বলছে সবে সকাল সাতটা। ‘ও এত সকাল সকাল তোকে ডাকছে কেন?’ পাশ থেকে নিদ্রালু স্বরে জানতে চায় শৌভিক। কি বলি, ফেলুদা আর শার্লক গুলে খাওয়া এই লোকটার থেকে কোন কিছু গোপন রাখা বেশ দুষ্কর। তবুও বলি,ও কিছু না। তুত্তুরীর কিছু কাজ করে দিতে আমায়, তাই ডাকছে। সকালের কফি তৈরি হবার আগেই তৈরি হয়ে যায় আমাদের কেক মিক্স, এবার শুধু ফেটানোটাই যা বাকি। শৌভিক কফি খেতে নামে, রোজকার মত গোবেচারা মুখে দুধ আর চায়ের কাপ নিয়ে বসে আমরাও। আলোচনা করি উল্টোপাল্টা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে। দিব্যি কফি খেয়ে, খবরের কাগজের পাতা উল্টে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখে শৌভিক, আচমকা শ্রীমতী তুত্তুরী ঘাবড়ে গিয়ে বলে বসে,‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। যাও যাও। আমরা কিচ্ছু করছি না।’ পটাং করে পিছন দিকে ঘুরে যায় শৌভক, সার্চলাইট ফেলার মত করে নজরদারি চালায় মা মেয়ের ওপর। অতঃপর, ‘হুঃ। তারমানে কিছু একটা অপাট করছিস তোরা দুটোতে মিলে-’।  


সেযাত্রা বাবা বাছা বলে দোতলায় পাঠাতে পারলেও, চাদর কাচতে দেবার অছিলায় আবার নেমে আসে শৌভিক এবং এবার একেবারে আমাদের অজ্ঞাতসারে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কেকের ব্যাটার ফেটাতে শেখাচ্ছিলাম মেয়েকে, আচমকা,‘তার মানে আজ কেক বানানো হচ্ছে। যেটা বড়টা বানাবে আর ছোটটা দাবী করবে যে  ও বানিয়েছে।’ পলকে ফুলে ওঠে তুত্তুরীর ঠোঁট। হ্যাঁ আমি দেখিয়ে দিয়েছি বটে, প্রয়োজনে ডিমও ফাটিয়ে দিয়েছি, মিক্সির কন্টেনারটা ঠিক করে বসিয়ে দিয়েছি যাতে বিপদ না বাঁধায়,স্যান্ডউইচের পেঁয়াজ-শসা- গাজর কেটে দিয়েছি ইত্যাদি প্রভৃতি কিন্তু আসল মেহনত তো শ্রীমতী তুত্তুরীই।


সেসব বলতে, বোঝাতে গেলে এখন ধরা পড়ে যাবে পুরো পরিকল্পনাটাই। তাই লাস্যময়ী হয়ে বললাম,‘ঠিক ধরেছ। শোন না কেক হলে আমরা ডাকব বরং, তুমি এখন ওপরেই থাকো। বড্ড বিরক্ত করছ।’ 


ফেটানো কেকের ব্যাটার ঢালা হয় চায়ের কাপে, কাপ ঢোকে মাইক্রোওভেনে। তুত্তুরী দৌড়য় বাবার জন্য একগোছা ফুল তুলতে। রণবীর কাপুরের মত করে ট্রেটা সাজাতে হবে তো। কদিন আগেই বাগানে আবিষ্কৃত হয়েছে গর্ত সমেত সাপ। তিনি আবার এত দুঃসাহসী যে আমরাও যেমন তাঁকে দেখতে দৌড়েছিলাম, তিনিও তেমনি গর্ত থেকে মুখ বার করে দেখছিলেন আমাদের। তাঁর ভয়েই বোধহয় তুত্তুরীর পিছন পিছন দৌড়য় বাগানে কাজ করতে আসা মাসি আর সিকিউরিটি ছেলেটা। 


মস্ত ট্রে তে গরম গরম চকোলেট কাপকেক আর সদ্য তুলে আনা সূর্যমুখী ফুল রেখে সবে স্যান্ডউইচ বানানোতে হাত লাগিয়েছে তুত্তুরী , এমন সময় সিঁড়ির রেলিং এর ফাঁক থেকে ভেসে আসে শৌভিক বাণী, ‘আচ্ছা, কেকটাকে আবার সাজানোও হচ্ছে দেখি। পাঁউরুটি দিয়েও কিসব বানানো হচ্ছে-’। এইভাবে সারপ্রাইজ ব্রেকফাস্ট হয় মাইরি? 


 শেষ পর্যন্ত তুত্তুরী যা বানাতে পেরেছিল ,নীচে রইল তার ছবি। হাবেভাবে প্রকাশ না করলেও ভয়ানক খুশি হয়েছে শৌভিক বেশ বুঝতে পারলাম আমি, কারণ এতকিছুর মধ্যে তুত্তুরীর বার্তা থেকে কেবল একটা গ্রামাটিক্যাল এরর ধরেছে শৌভিক, আর একবার শুধু বলেছে ‘ফুলটা কিন্তু আমি খাব না।’ ওটুকু প্রত্যাশিত।  এমনি ভাবেই ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বাবারা, এমনি হাসিখুশি আর ভালোবাসায় জবজবে থাকুক সব সম্পর্ক, বছরের সবকটা দিন। এমনিতেও প্রতিটা মেয়ের সারা জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে একছত্র রাজত্ব চালায় যে লোকটা, তার জন্য কি মাত্র একটা দিনে পোষায়। অন্তত আমার আর তুত্তুরীর জন্য,  রোজই তো বাবা দিবস

অনির ডাইরি১লা জুন, ২০২২


 


মাঝে মাঝে মনে হয়, যে আমরা নিজেরা যতটা নিজেদের আহত করি, ততোটা আঘাত বোধহয় আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই সেই দিনটাকে, নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ,খবরের কাগজ জোড়া পেজারের বিজ্ঞাপন থাকলেও মুঠোফোন ছিল কেবল মাত্র সাইন্স মিউজিয়ামে দেখানো এক কল্পবিজ্ঞান মাত্র। মধ্যবিত্তের যোগাযোগের মাধ্যম বলতে হয় চিঠি নয়তো চাকা ঘোরানো ল্যাণ্ডফোন। তাই বা কটা বাড়িতে ছিল? একটা ফোন করতে হলে হেঁটে যেত হত পাড়ার স্যাকরার দোকানে বা বড় রাস্তা পেরিয়ে উল্টোফুটের পিসিওতে। তিন মিনিট, তিনটি টাকা। তিন মিনিটের পর এক সেকেণ্ড হলেও গুণতে হত পাক্কা ছ-ছটাকার গুণাগার। 


কি যেন দরকারে মেজদাকে ফোন করেছিলাম সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে বসেছিল, স্যাকরার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, অগত্যা গলির মোড়ের পিসিও। কাঁচের ঘরের মধ্যে রাখা বোতাম টেপা ফোন, প্রাইভেসি একটু বেশী বলে পাড়ার উঠতি কপোত-কপোতীদের প্রিয় ফোন করার জায়গা। প্রথম বুথে তেমনি ঢুকেছিল কেউ, দ্বিতীয় বুথ থেকে মেজদার সঙ্গে কেজো কথা সেরে ফোন রাখতে যাচ্ছি, ওপাশ থেকে ভেসে এল মেজদার তরল কণ্ঠ,‘ দাঁড়া ছাড়িস না। তোর সাথে কথা বলবে বলে দিদা ছুটে আসছে -’। 


যুগপৎ দাদুর অকাল মৃত্যু এবং চাকরির সন্ধানে মা ও মাসিদের গ্রাম ছেড়ে মহানগরে চলে আসার পর দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা এক অজ গাঁয়ে একাই থাকত দিদা। আমাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল হাতে লেখা চিঠি। পত্রলেখা বড় দীর্ঘসুত্রী, মেয়ে- জামাই- নাতি- নাতনীকে এক ঝলক দেখা বা সামান্য দুটো কথা বলার জন্য তৃষিতের মত অপেক্ষা করে থাকত দিদা। তাই বোধহয় দূরভাষ যন্ত্রটা এত প্রিয় ছিল বৃদ্ধার। ফোনের ঘন্টা বাজলে শিশু সুলভ উচ্ছ্বাসে উথলে উঠত দিদা। শিশুদের মতই ঘুরঘুর করত ফোনের আসেপাশে দুটো কথা বলা বা শোনার লোভে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি,আদরের ঝুমির সাথে দুটো কথা বলার জন্য ছুটে আসছিল দিদা, কিন্তু পিসিওর ঘড়ি যে বলছিল তিন মিনিট হতে আর কটাই সেকেণ্ড বাকি। তাই তড়িঘড়ি ফোন রেখে দিলাম আমি, বললাম, যাবই তো বাবা মায়ের সঙ্গে সপ্তাহান্তে,  আর কদিন পরে, তখন কথা হবে দিদার সাথে। 


গিয়েওছিলাম, বাবা-মায়ের হাত ধরে। মাত্র এক বেলায় ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল আমাদের দুনিয়া। সারা দিন কিচ্ছু খায়নি মা, আইসিইউ এর কাঁচের জানলার এপাশ থেকে, ওপাশে সংজ্ঞাহীন দিদার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ। হাসপাতাল থেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাড়ি ফিরেছিল শুধু আমায় নিয়ে বড়মাসির বাড়ি যাবে বলে। বাড়ি ফিরতেই জোর করে কয়েক গাল ভাত খাইয়েছিল জ্যাঠাইমা, মায়ের অজ্ঞাতে আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল, ' মায়ের দিকে একটু নজর রাখিস।' ভাত মেখে মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও খেতে পারছিল না মা, কেঁদেই যাচ্ছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। 


বড়মাসির বাড়ি যখন পৌঁছালাম ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে আটটা। চারদাদার সৌজন্যে অন্যান্য দিন গমগম করত যে বাড়ি, সে বাড়িতে সেদিন শুধুই চাপচাপ মনখারাপ। কেউ কথা বলছিল না ভালো করে। বড়দা আর সেজদা সম্ভবতঃ হাসপাতালে ছিল, চির ফাজিল ছোটদাও যেন কেমন গুম মেরে গিয়েছিল সেদিন। পরিস্থিতি তরল করতে মেজদা কেবল বারেবারে সবাইকে আশ্বস্ত করছিল, ‘চিন্তার কোন কারণ নেই, ও বুড়ি ঠিক ফিরে আসবে।’ 


ফিরে এসেছিল তো দিদা। রাত তখন এগারোটা। বাইরের ঘরে লম্বা বিছানা করে সদ্য শুয়েছি মা, সেজ মাসি, ছোট মাসি আর আমি। ঘুম নেই কারো চোখে। হঠাৎ বেজে উঠল কলিং বেল। তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেখি শুকনো মুখে বড়দা দাঁড়িয়ে। ‘কি হয়েছে দাদা? দিদা সুস্থ হয়ে গেছে? তাই বোধহয় ফিরে এসেছ তুমি?’ বড়দা গলা ঝেড়ে বলল, ‘বাবাকে ডাক।’ বাবা মানে বড় মেসোমশাই। ততোক্ষণে পটপট জ্বলে গেছে সব আলো। মশারি খুলে গুটিয়ে ফেলা হয়েছে বিছানা। কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে জড় হয়ে গেছে চার দাদার অগণিত বন্ধু। তাদেরই কাঁধে চেপে এল দিদা। বন্ধ দুই চোখ,মুখে অসীম প্রশান্তি। ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে। 


বড়মাসির গাম্ভীর্যপুর্ণ নিয়ন্ত্রিত শোক, দিদার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে মায়ের গুমরে গুমরে কান্না, সেজ মাসির বুক ফাটানো বিলাপ, ছোট মাসির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না, দাদাদের ভিজে চোখ আর সবকিছু ঝাপিয়ে আমার চরম অপরাধবোধ,তিনটে টাকা, মাত্র তিনটে টাকার জন্য আমার সাথে কথা না বলেই চলে গেল দিদা। 


প্রায় সিকি শতাব্দী আগে চলে যাওয়া দিদা, যেতে যেতে এক অমোঘ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিল, টেলিফোনে কখনও কোন বার্তালাপ আধখেঁচড়া ছাড়ি না আমি। পারতপক্ষে দূরভাষে কোন মতান্তরে যাই না আমি, অবশ্য যদি উল্টো দিকের লোকটা আমার প্রিয় পাত্র হন। ক্ষণিকের উত্তজনায় কদাচিৎ যদি তাদের সাথে কোন উত্তপ্ত  বাক্য বিনিময় হয়েও যায়, মাথা ঠাণ্ডা হবার সাথে সাথেই তাকে ফোন করে মিটিয়ে নিই আমি। দেরী করে লাভ কি, কে জানে কি লুকিয়ে আছে কালের গহ্বরে। বিশ্বাস করুন অসমাপ্ত সংলাপ আর শেষ না হওয়া কথাগুলো বড় কশাঘাত করে, করতেই থাকে, অকারণেই ভিজিয়ে দেয় চোখের কোণ,যখন তখন, হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।