Thursday, 14 July 2022

অনির ডাইরি ৫ই জুন, ২০২২

 


আমার বাবার মতে আয়োজন ছিল যৎসামান্য। বেশি করে কাজু কিশমিশ দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি ঘি গন্ধী সাদামাটা বাঙালী বাসন্তী পোলাও, তেলতেলে ঝাল ঝাল কষা মাংস, কাজু বাটা আর কসুরি মেথি দিয়ে পনীর, কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে শুধু মাত্র টমেটো কোরা আর জিরে গুঁড়ো-লঙ্কা গুঁড়ো মিশিয়ে ফ্রিজের কাতলার পেটির লাল লাল ঝাল, পাতি টমেটো খেজুর আমসত্ত্বের চাটনি, আমাদের কদমতলা বাজারের দেশপ্রিয়র চাপ চাপ লাল দই আর পায়েস। জামাই ষষ্ঠীতে মায়ের জামাইয়ের সামনে এইটুকুই রেঁধে, বেড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমার বর সোনামুখ করে খেয়ে নিয়েছিল বটে, ব্যাপারটা একদমই পছন্দ হয়নি আমার বাবার। 


বিগত দুর্গোৎসবের সময় ভুল চিকিৎসায় প্রায় এক পক্ষ কাল হাসপাতাল বাস তথা কেবল স্যালাইন সেবনের ফলে বাবার স্বাস্থ্য ইদানিং বড়ই ভেঙে পড়েছে। পাড়ার দোকানে যেতেই হাপিয়ে পড়ে বাবা। হারিয়ে ফেলে পায়ের জোর। ফলতঃ বড় দুশ্চিন্তা ছিল মায়ের, কি ভাবে সম্পন্ন হবে এবছরের জামাইষষ্ঠীর বিধি। এখনও কানে ভাসছে মায়ের আকুতি, “ ৫ তারিখে তো জামাইষষ্ঠী, রবিবার পড়েছে, শৌভিক আসতে পারবে তো?”


 অন্যদিন আপিসে ঢুকেই ফোন করি, সেদিন বেশ বেলা হয়েছে ফোন করতে। রমরমিয়ে চলছে দুয়ারে সরকার। গমগমিয়ে ঘুরছি আমি আর উত্তমকুমার, আজ অমুক ব্লকের এই পঞ্চায়েত তো কাল তমুক পুরসভার এত নম্বর ওয়ার্ড। বেশ কিছু ফাইল জমেছিল,ভেবেছিলাম সই সাবুদ করে সাড়ে বারোটা নাগাদ দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে বেরোব। গুটি কয়েক দর্শনার্থীও বসেছিলেন, নানা দাবিদাওয়া আর নালিশ নিয়ে। হাতের কাজ সেরে যখন বাড়িতে ফোনটা করতে পারলাম, শুনলাম গভীর দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন আমার বাপ। 


বাবার অবসর জীবনের সবথেকে প্রিয় অংশ হল এই অসময়ের দিবানিদ্রাটুকু। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ প্রাতঃরাশ সেরে, গোটা দুই সিগারেট আর এককাপ চিনি ছাড়া হাকুচ তেতো চা খেয়ে মায়ের সাথে জম্পেশ করে একচোট কোন্দল সেরে, পাখা চালিয়ে, জানলার পর্দা টেনে বা না টেনে, খাটে বা সোফায় ছোট্ট করে একটা ঘুম দিয়ে নেয় বাবা। ঘুম ভেঙে আবার চা, সিগারেট,আরেক প্রস্থ দাম্পত্য মতানৈক্য সেরে  স্নানাহারের দিকে পা বাড়ায় বৃদ্ধ দম্পতি। এটাই মোটামুটি চাটুজ্জে বাড়ির মেজ তরফের নৈমিত্তিক রুটিন। 


বাবার অনুপস্থিতিতে নিছক কেজো বার্তালাপ হয় মায়ের সঙ্গে। বাবার মত মজার মজার কথা বলতে থোড়াই পারে মা। বাবার মত মেরুদণ্ড সোজা করে নিজের মত প্রকাশ করতে বা ক্ষেত্র বিশেষে গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করতেও পারে না মা। পারতপক্ষে পরচর্চা বা পরনিন্দা  করে না মা,কারো সমালোচনা করেও না, শুনতেও ভালোবাসে না মা। কারণ আমার জননী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে সমালোচনার ফল সাধারণতঃ  খারাপই হয়। সময় বড় নির্মম, আজ আপনি যাঁর তীব্র সমালোচনা করবেন, কাল সময় আপনাকে হাঁটতে বাধ্য করবে তার জুতো পায়ে, তারই হেঁটে যাওয়া পথ ধরে। তো যাই হোক, এরপর বলুন দিকি এহেন মহিলার সাথে রসাল তথা দীর্ঘ বার্তালাপ কি আদৌ সম্ভব?


মায়ের সাথে শুধু কেজো কথা হয়, যথা তুত্তুরী স্কুল গেছে কি না, ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে কি না, শৌভিক অফিস গেছে কিনা বা তার শরীর কেমন আছে ইত্যাদি প্রভৃতি। মা প্রায় রোজ জানতে চায়, কি খেয়ে অফিসে এসেছি,টিফিনে কি খাব, ঠিকঠাক জল খাচ্ছি কি না। মা বলে, ‘রোজ একটা করে ফল খাস’। আমি যথারীতি কোনদিনই খাই না। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। উপরি হিসেবে যুক্ত হয়েছে কেবল জামাইষষ্ঠীর কথাটা। 


রবিবার ৫ই জুন জামাইষষ্ঠীর কথাটা আগেই বলেছিল মা,সেই মোতাবেক জিজ্ঞাসাও করেছিলাম শৌভিককে। আজ মাকেও জানিয়েই দিলাম, শুধু শৌভিকই নয়, আমরা তিনজনেই যাব। ভিডিও কলে আসন্ন জামাই বরণের উল্লাস ছাপিয়ে মায়ের চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে এক অচেনা বিষণ্ণতা। সুরাঁধুনী হিসেবে এককালে বেশ খ্যাতি ছিল মায়ের। এমনকি প্রবল রাশভারি তথা ব্যক্তিত্বময়ী আমার ঠাকুমাও তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাঁধতে ভালোও বাসত বটে মা। সকালে এক দফা রান্না করে, বাবার, আমার, নিজের টিফিন গুছিয়ে আপিস যেত। এমনকি স্কুল বা কলেজ থেকে ফিরে কি খাব তাও সুন্দর করে সাজিয়ে চুপড়ি চাপা দিয়ে জলে বসিয়ে রেখে যেত মা। সন্ধ্যে বেলা আপিস থেকে ফিরে, চা খেয়ে ছোট্ট করে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার রাতের রান্না করতে বসত। জীবনেও এক তরকারি ভাত বা শুধু মাছের ঝোল ভাত খাওয়ায়নি মা। মাত্র এক দেড় ঘন্টার মধ্যে তেঁতো থেকে অম্বল কত কি যে রেঁধে ফেলতেন ভদ্রমহিলা তার ইয়ত্তা থাকত না। 


মধ্য সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে সেই মা আজ দুপদ রাঁধতে থতমত খায়। যত বলি শৌভিক মোটেই আমাদের মত ভোজন বিলাসী নয়। শাশুড়ি মা তাঁর পুত্রদের বড় সুশিক্ষা দিয়ে গঠন করেছেন। শৌভিক তাই সব খায়। একপদ-দুপদ-দশপদের কোন বেয়াড়া আব্দার কোনদিন করে না। এবেলার রান্না ওবেলা ছাড়ুন, আজকের রান্না ফ্রিজে রেখে কাল গরম করে দিলেও সোনামুখ করে খেয়ে নেয়। এমনকি বাসি রুটিও যদি সামান্য ভেজে বা গরম করে দেওয়া হয় তাও লক্ষ্মী ছেলের মত খেয়ে নেবে। বরং পদের সংখ্যা বেশি হলেই কিঞ্চিৎ  নার্ভাস হয়ে পড়ে আমার সোয়ামী। মাকে তা কইলামও, তাও মায়ের ভয় কাটে না। বিরক্তি চেপে বললাম, খাবার কিনে নিলেই তো হয়?


সুইগি জ্যোমাটোর ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই মায়ের। একবার বাবার জন্মদিনে অর্ডার করা খাবার না ডেলিভারি দিয়েই ফিরে গিয়েছিল সুইগির ডেলিভারি বয়। একটা ফোনও করেনি। তুত্তুরী আর বুল্লু বাবু পাশের মাঠে খেলছিল, ওরা দৌড়ে গিয়ে বলেওছিল,‘ কাকু ওটা আমাদের অর্ডার, আমাদের বাড়ি ঐ দিকে।’ তাও পাত্তা দেয়নি ছেলেটা। উল্টে সুইগি একটা মোটা টাকা ফাইন চাপিয়েছিল আমার ওপর, কেন ওদের খাবার অর্ডার দিয়েও নিইনি বলে-। সেযাত্রা টুইটারে পচুর হল্লা করে ফাইন মুকুব করেছিলাম বটে,তবে খাবার কিনতে আমাকে বেরোতে হয়েছিল টোটো চেপে। অনলাইন কোন কিছুকেই ভরসা করে না মা। 


 রান্না বাড়িতে করতে হলে বাজারও তো লাগবে সমানুপাতিক হারে। বাবার যা শারীরিক অবস্থা। সমস্যার কথা শুনতে শুনতে কখনও যে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, ‘এতই যখন সমস্যা তখন এবছর জামাইষষ্ঠীটা না করলেই তো হয়।’ বলেই প্রমাদ গুণলাম, মায়ের মুখে ঘনিয়ে এল শ্রাবণের কৃষ্ণ বাদল। তড়িঘড়ি ফোন রেখে তো দিলাম, কিন্তু মনের মধ্যে কি যেন বারবার ফুটতে লাগল। 


আজ আমরা কোলাঘাট ব্লক আর পাঁশকুড়া পুরসভায় ক্যাম্প  দেখতে যাব। যখন গাড়ির চাকা গড়াতে লাগল, তখনও বেশ রোদ, অচীরেই ঘনিয়ে এল মনখারাপী মেঘ এবং উপুর্যান্তে বৃষ্টি। গাড়িটাকে ঘিরে যেন জলের পর্দা, পর্দার আড়াল থেকে ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম মাকে, ফোনটা ধরলেও জবাব দিল না মা, ফ্যাঁচফ্যাঁচে কান্নার শব্দ আসতে লাগল শুধু একটানা। অনেক কষ্টে,অনেক অনুনয় বিনয়, উত্তম কুমারের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে সহস্রবার মার্জনা ভিক্ষার পর মুখ খুলল মা,‘আমার সমস্যা, আমার অসহায়তার কথা, তোকে না বললে কাকে বলব?’ 


সত্যিই তো। আমার আশি পেরোনো বাপ আর মধ্য সত্তরের জননী, তাদের সমস্যার কথা অকপটে আমাকে না বললে আর বলবে কাকে? মাকে আশ্বস্ত করলাম, দাঁড়াও, তোমায় কোন চিন্তা করতে হবে না। জামাইষষ্ঠীর দুদিন আগেই বাড়ি ফিরব আমি আর তুত্তুরী। অতঃপর দোকান-বাজার, রান্না মায় উভয়পক্ষের উপহার কেনা সব আমার দায়িত্ব। মা শুধু বসে বসে হুকুম করবে আর মাঝে মাঝে একটু চা যদি, অনুগ্রহ করে- মায়ের মত চা, আর কেন জানি না কেউ বানাতেই শিখল না। এমনকি আমিও না। 


শেষ পর্যন্ত অবশ্য দোকানবাজারের অনেকটাই  তুত্তুরীকে সঙ্গে নিয়ে বাবাই করেছিল। কুটনো কোটা, মশলাবাটা ইত্যাদিতে সাহায্য করেছিল মায়ের আয়া দিদি, লক্ষ্মী।  হ্যাঁ খুন্তি আমি নাড়িয়েছি বটে, বাবার অগোচরে বার চারেক শ্রীমতী তুত্তুরী আর বুল্লু বাবুকে দোকানও পাঠিয়েছি  টুকটাক জিনিসপত্র, যেমন ইয়ে পোলাও রাঁধতে গিয়ে কম পড়া গোবিন্দভোগ চাল আনতে। ষষ্ঠী বলে স্বয়ং আঁশ বা এঁটো কোন খাদ্য চেখে দেখতে পারছিলাম না, সে কাজেও যথোপযুক্ত  সহায়তা করেছে তুত্তুরী আর বুল্লু বাবু। সে যাই বলুন না কেন, খুন্তী তো আমিই চালিয়েছি নাকি? এখন এত কিছুর পর যদি শৌভিককে প্রদেয় আশির্বাদী টাকাটা ঝেঁপেই থাকি, তেমন কোন অন্যায় করেছি কি? দুবেলা পর্যায়ক্রমে জ্ঞান এবং খোঁটা দেবার মত কোন গর্হিত কাজ করিছি কিনা বলুন তো? সেটা আমার বাপ, মা এবং তাদের জামাইকে কে বোঝায় বলুন দিকি?

No comments:

Post a Comment