#তাম্রলিপ্তকড়চা
রোজই অফিসে ঢোকা-বেরানোর পথে দেখা হয় বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে। পরণে একই নীল সাদা বিবর্ণ টিশার্ট, আর জরাজীর্ণ প্যান্ট। দুহাতে দুটো মস্ত বাজার ব্যাগ নিয়ে চা বিক্রি করেন।একটায় থাকে ফ্লাস্ক ভর্তি চা, অপরটায় কাগজের কাপ, প্লাস্টিকের গ্লাস,প্লাস্টিকের বয়াম ভর্তি সস্তা অনামী ব্র্যান্ডের মারি, ক্রিম ক্রাকার, লোকাল বেকারির বিস্কুট ইত্যাদি। দেখা হলেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন, ‘ম্যাডাম, ভালো আছেন?’ প্রায় রোজই করেন। তাড়াহুড়োর সময় কুশল সংবাদ জানতে চাইলে যে ভাবে উত্তর দেয় মানুষ,সেভাবেই জবাব দিই আমি,‘হ্যাঁ ভালো আছি। আপনি ভালো তো?’ জবাবও আসে আশানুরূপ, উত্তর আসার আগেই কখনও বন্ধ হয়ে যায় আমার লিফটের দরজা, কখনও বা কেজো হুঁ বলে এগিয়ে যান উনি। আজ একটু বেশিই তাড়ায় ছিলাম, মিটিং এ লেট হয়ে গেছি। লিফটে ওঠার মুখে আবার ওণার সঙ্গে দেখা, আবার,‘ম্যাডাম ভালো আছেন-?’আজ কেন জানি না মনে হল আমার জবাবটা একটু ঘুরিয়ে দিই, আমি দিব্যি আছি জানিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি কেমন আছেন?’ কেজো ব্যস্ত হুঁ আজ আর ফেরৎ এল না। ব্যাগ দুটো মাটিতে নামিয়ে, কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘ভালোই আছি ম্যাডাম। কদিন আগে একটু জ্বর এয়েছিল। বৃষ্টিতে ভিজতেছিলাম কি না তাই। এখনও গা ম্যাজম্যাজাইচ্ছে।’ এবার আমার পালা, কেজো আচ্ছা বলে বলে পাশ কাটিয়ে লিফটে ওঠার। বোতাম টিপতে যাব, উনি আবার বললেন,‘ও ম্যাডাম শোনেন না, আপনি আসছে রবিবার আসবেন?’ কোথায়, প্রশ্নটা বোধহয় আমার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল, উনি ব্যাগ দুটো আবার হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের গাঁয়ে নারান মন্দিরের হইতেছে কিনা, রবিবার তার শুভ উদ্বোধন।মন্দিরটাকে সুন্দর বানাতে অনেক খাটছি আমরা। সবাই চাঁদা তুলে বানাইছি তো। ঠাকুরটা আমি দিইছি। দুদিন ধরে নামগান হবে। সারা গাঁয়ের লোক খাবে। আপনিও আসবেন ম্যাডাম কেমন? খোকাকেও আনবেন, খুব ভালো লাগবে, -’। ওণার সনির্বন্ধ অনুরোধের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা। আমি না, অন্য কোন তলায় কেউ বোতাম টিপেছে নির্ঘাত। উনি তখনও বিড়বিড় করে ঠিকানাটা বলছিলেন, কোন গাঁ, কোন পুকুরের পাশ দিয়ে, কটা ল্যাম্পপোস্টকে ডাঁয়ে আর বাঁয়ে রেখে ইত্যাদি প্রভৃতি। ক্ষীণ হতে হতে এক সময় হারিয়ে গেল ওণার কণ্ঠ। বন্ধ লিফটের মধ্যে খুব হাসলাম একচোট একাকী। প্রথমতঃ শ্রীমতী তুত্তুরীকে খোকা বলার জন্য আর দ্বিতীয়তঃ ভদ্র ভাবে দুটো কথা বললেই আজও কেমন পলকে আপন হয়ে যায় অপরিচিত মানুষজন।
No comments:
Post a Comment