রবিবার যে ফাদার্স ডে,সেটা মোটামুটি বুধবার দুপুর থেকেই টের পাচ্ছিলাম। গোছা গোছা নোটিফিকেশন আসছিল আমাজন, নায়িকা, মিন্ত্রার মত ই-কমার্স ওয়বসাইট থেকে। বক্তব্য একটাই, ‘স্পেশাল দিনে বাবাকে ইস্পেশাল কিছু কিনে দাও না-’। অনেক ভাবলাম বৃদ্ধকে একটা টিভি কিনে দিই বরং। বর্তমান টিভিটা আমিই কিনে দিয়েছিলাম, প্রায় জবরদস্তি করে, এলসিডি বটে, তবে বয়সে তুত্তুরীর থেকেও বড়। মাঝেমাঝেই গোলমাল পাকায়, কিছুদিন আগেই দুটো স্পিকার পাল্টাতে হয়েছে বাবাকে। আরও কি সব খোলনলচে বদলে বর্তমানে দিব্যি চলছে বটে, তবুও-। গ্রেট ইস্টার্ন থেকে কিসব অফার ওয়ালা মেলও এসেছিল, প্রায় কিনেই ফেলতাম, তার আগে ভাবলাম একবার জিজ্ঞাসা করেনি, যা বদমেজাজী বৃদ্ধ, না বলে কিনে দিলে হয়তো সটান ফেরৎ পাঠাবে।
বেলা চারটে নাগাদ ফোন করতেই খ্যাঁক করে উঠল বৃদ্ধ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাধের দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা ভঙ্গের জন্য একরাশ বিরক্তি তো ছিলই, তার থেকে বড় কথা হল, ‘আমার পুরাণ টিভিটার কি হবে-’? বললাম,ফেলে দাও। একযুগ পুরাণ টিভি, কেউ পাঁচশ টাকা দিয়েও কিনতে যাবে না। বলেই প্রমাদ গুণলাম। ধেয়ে এল বাবার শাণিত জিহ্বা,‘ তাহলে, তোমার মাকে নিয়ে কি করব? কাল তো বলবে, আমার বউটাও পুরাণ হয়ে গেছে, একেও ফেলে দিতে।’ বাবার কোলের কাছে গুটিসুটি হয়ে নিদ্রা দেবীর আরাধনা করা মা এটা শুনে কতটা খুশি হল জানি না, আমি হতোদ্যম হয়ে ফোন রেখে দিলাম।
পুরাণ জিনিসপত্রের প্রতি চাটুজ্জে বাড়ির দরদ প্রায় প্রবাদপ্রতিম। কিছুই ফেলা হয় না আমাদের বাড়িতে। চাকরী পাওয়া ইস্তক উপহার দেওয়া প্রতিটা শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবি,বিছানার চাদর মায় খারাপ হয়ে যাওয়া ইনভার্টারটাও বাবা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। শুধু কি আমি, কবে অবসর নেওয়া ছোটমাসি চাকরী পেয়ে প্রথম মাসের মাইনে থেকে একটা ১৮টাকার প্যান্ট উপহার দিয়েছিল বাবাকে সেটাও রাখা আছে নিঁভাজ পাট করে। বাবার জামাকাপড়ের বেহাল দশা দেখে কবে সদ্য বিবাহিত মা কার থেকে যেন কিছু টাকা ধার করে কিনে দিয়েছিল তিনটে শার্ট। আজও গোছানো আছে তা। সেজ-ছোট মাসির বুনে দেওয়া সেই আশি নব্বইয়ের দশকের ফুটো হয়ে যাওয়া সোয়েটার, আছে তাও। বাবা কিছু ফেলে না। মাও না। শুধু আমি কিছু দিতে গেলেই হাড় জ্বলে যায় ওদের। যাই দিতে চাই, তাই নাকি অপ্রয়োজনীয় এবং বাহুল্য বিশেষ। বাড়িতে রাখার জায়গা নেই। স্বাভাবিক, পুরাণ দ্রব্যাদি গুদামজাত করে রাখলে, নতুন জিনিসপত্র রাখবে কোথায়-
বাড়ি ফিরে চায়ের কাপে সেই গল্পই শোনাচ্ছিলাম তুত্তুরীকে। ‘কিন্তু ওরা যখন চাইছেই না, তুমি অকারণ জোর করছ কেন?’ দাদুর ওপর চটে গিয়ে বিরক্ত স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। জবাব একটাই, আমার বাবাটা যে পৃথিবীর সেরা বাবা, তাই না চাইতেই সবকিছু দিতে চাই বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ সেটা শুনলে বা বুঝলে তো।
স্বাভাবিক ভাবেই তুত্তুরীর কাছে তার বাবাটা সেরা, আমার বাবাটাও সেরা বটে, নিঃসন্দেহে সেরা। তবে দাদু হিসেবে। কার বাপটা বেশি ভালো এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই কোঁদল করি আমরা মা-মেয়েতে। এবারের কোঁন্দলটা যদিও তেমন জমল না। তর্ক যুদ্ধের মাঝপথে হঠাৎ অস্ত্র ত্যাগ করল তুত্তুরী । অতঃপর চিন্তিত স্বরে,‘ এই মা, ফাদার্স ডে তে আমি কি দেব আমার বাবাকে?’ বললাম কিছু কিনে দিই। তুত্তুরীর বাবাকে নিয়ে তো কোন চিন্তা নেই,পুরাতন জামাকাপড় জমিয়ে রাখার বদভ্যাসটা তারও ঘোরতর আছে বটে, তবে নতুন কিছু দিলে আপত্তি খুব একটা করে না। বড়জোর মৃদু স্বরে বলে ওসব ‘উস্টুমধুস্টুম’ উপহার না দিয়ে, মূল্য ধরে দিলে বেশী খুশি হত। এই আর কি।
প্রস্তাবটা পছন্দ হয় না শ্রীমতী তুত্তুরীর। ‘তুমি কিনে দিলে,সেটা তো তোমার দেওয়া হবে।’ যুক্তি অকাট্য। তাহলে? দীর্ঘ মস্তিষ্ক প্রক্ষালন তথা দুধের কাপে ঝড় তুলে অবশেষে উপায় বার করে তুত্তুরী, কোন সিনেমা বা ভিডিওতে দেখা রণবীর কাপুরের মত সারপ্রাইজ স্পেশাল ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়াবে বাবাকে। সাথে থাকবে একটা ছোট্ট বার্তা, ফাদার্স ডে স্পেশাল।
ব্যাপারটা ভাবা যতটা সহজ, বাস্তব রূপায়ন ততোটাই দুরূহ। লুচি পরোটার মত শৌভিকের প্রিয় প্রাতরাশ বানানো তুত্তুরীর পক্ষে অসম্ভব। তার ওপরে এখানকার গ্যাসের টেবিলটা যা উঁচু। কড়া বসালে রীতিমত লেঙচে দেখতে হবে শ্রীমতী তুত্তুরীকে। কাজেই ওসব বাদ। তাহলে কি ম্যাগি? শনিবার সকালে ফিল্ড ভিজিটে বেরানোর সময় আমার হাতের স্পেশ্যাল চিলি গার্লিক ম্যাগি খেয়ে বেরিয়েছে শৌভিক। কাজেই ম্যাগিও বাতিল। তাহলে? সারাদিন ধরে ইউটিউবে ফাদার্স ডে স্পেশাল ব্রেকফাস্টের রেসিপি ঘাঁটে শ্রীমতী তুত্তুরী। এমন কিছু যা মূলতঃ মাইক্রোওয়েভেই বানানো যাবে। শুধু তাই নয়, যা ঝটপট বানানো যাবে এবং যার সমস্ত উপকরণ মজুত আছে বাড়িতেই।
সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে, স্নান সেরে কাচা তথা ভালো জামা পরে যখন আমার ঘুম ভাঙাল তুত্তুরী ঘড়ি বলছে সবে সকাল সাতটা। ‘ও এত সকাল সকাল তোকে ডাকছে কেন?’ পাশ থেকে নিদ্রালু স্বরে জানতে চায় শৌভিক। কি বলি, ফেলুদা আর শার্লক গুলে খাওয়া এই লোকটার থেকে কোন কিছু গোপন রাখা বেশ দুষ্কর। তবুও বলি,ও কিছু না। তুত্তুরীর কিছু কাজ করে দিতে আমায়, তাই ডাকছে। সকালের কফি তৈরি হবার আগেই তৈরি হয়ে যায় আমাদের কেক মিক্স, এবার শুধু ফেটানোটাই যা বাকি। শৌভিক কফি খেতে নামে, রোজকার মত গোবেচারা মুখে দুধ আর চায়ের কাপ নিয়ে বসে আমরাও। আলোচনা করি উল্টোপাল্টা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে। দিব্যি কফি খেয়ে, খবরের কাগজের পাতা উল্টে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখে শৌভিক, আচমকা শ্রীমতী তুত্তুরী ঘাবড়ে গিয়ে বলে বসে,‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। যাও যাও। আমরা কিচ্ছু করছি না।’ পটাং করে পিছন দিকে ঘুরে যায় শৌভক, সার্চলাইট ফেলার মত করে নজরদারি চালায় মা মেয়ের ওপর। অতঃপর, ‘হুঃ। তারমানে কিছু একটা অপাট করছিস তোরা দুটোতে মিলে-’।
সেযাত্রা বাবা বাছা বলে দোতলায় পাঠাতে পারলেও, চাদর কাচতে দেবার অছিলায় আবার নেমে আসে শৌভিক এবং এবার একেবারে আমাদের অজ্ঞাতসারে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কেকের ব্যাটার ফেটাতে শেখাচ্ছিলাম মেয়েকে, আচমকা,‘তার মানে আজ কেক বানানো হচ্ছে। যেটা বড়টা বানাবে আর ছোটটা দাবী করবে যে ও বানিয়েছে।’ পলকে ফুলে ওঠে তুত্তুরীর ঠোঁট। হ্যাঁ আমি দেখিয়ে দিয়েছি বটে, প্রয়োজনে ডিমও ফাটিয়ে দিয়েছি, মিক্সির কন্টেনারটা ঠিক করে বসিয়ে দিয়েছি যাতে বিপদ না বাঁধায়,স্যান্ডউইচের পেঁয়াজ-শসা- গাজর কেটে দিয়েছি ইত্যাদি প্রভৃতি কিন্তু আসল মেহনত তো শ্রীমতী তুত্তুরীই।
সেসব বলতে, বোঝাতে গেলে এখন ধরা পড়ে যাবে পুরো পরিকল্পনাটাই। তাই লাস্যময়ী হয়ে বললাম,‘ঠিক ধরেছ। শোন না কেক হলে আমরা ডাকব বরং, তুমি এখন ওপরেই থাকো। বড্ড বিরক্ত করছ।’
ফেটানো কেকের ব্যাটার ঢালা হয় চায়ের কাপে, কাপ ঢোকে মাইক্রোওভেনে। তুত্তুরী দৌড়য় বাবার জন্য একগোছা ফুল তুলতে। রণবীর কাপুরের মত করে ট্রেটা সাজাতে হবে তো। কদিন আগেই বাগানে আবিষ্কৃত হয়েছে গর্ত সমেত সাপ। তিনি আবার এত দুঃসাহসী যে আমরাও যেমন তাঁকে দেখতে দৌড়েছিলাম, তিনিও তেমনি গর্ত থেকে মুখ বার করে দেখছিলেন আমাদের। তাঁর ভয়েই বোধহয় তুত্তুরীর পিছন পিছন দৌড়য় বাগানে কাজ করতে আসা মাসি আর সিকিউরিটি ছেলেটা।
মস্ত ট্রে তে গরম গরম চকোলেট কাপকেক আর সদ্য তুলে আনা সূর্যমুখী ফুল রেখে সবে স্যান্ডউইচ বানানোতে হাত লাগিয়েছে তুত্তুরী , এমন সময় সিঁড়ির রেলিং এর ফাঁক থেকে ভেসে আসে শৌভিক বাণী, ‘আচ্ছা, কেকটাকে আবার সাজানোও হচ্ছে দেখি। পাঁউরুটি দিয়েও কিসব বানানো হচ্ছে-’। এইভাবে সারপ্রাইজ ব্রেকফাস্ট হয় মাইরি?
শেষ পর্যন্ত তুত্তুরী যা বানাতে পেরেছিল ,নীচে রইল তার ছবি। হাবেভাবে প্রকাশ না করলেও ভয়ানক খুশি হয়েছে শৌভিক বেশ বুঝতে পারলাম আমি, কারণ এতকিছুর মধ্যে তুত্তুরীর বার্তা থেকে কেবল একটা গ্রামাটিক্যাল এরর ধরেছে শৌভিক, আর একবার শুধু বলেছে ‘ফুলটা কিন্তু আমি খাব না।’ ওটুকু প্রত্যাশিত। এমনি ভাবেই ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বাবারা, এমনি হাসিখুশি আর ভালোবাসায় জবজবে থাকুক সব সম্পর্ক, বছরের সবকটা দিন। এমনিতেও প্রতিটা মেয়ের সারা জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে একছত্র রাজত্ব চালায় যে লোকটা, তার জন্য কি মাত্র একটা দিনে পোষায়। অন্তত আমার আর তুত্তুরীর জন্য, রোজই তো বাবা দিবস
No comments:
Post a Comment