Thursday 14 July 2022

অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০২২

 


এক বছর! মাত্র একটা বছরের মধ্যে আমূল বদলে গেল সবকিছু। বেশ তো গতানুগতিক ছন্দে চলছিল জীবন। বদলির অর্ডার তো বেরিয়েছিল আমার, চুঁচুড়া থেকে বিধাননগর। কারা যেন পরিহাসের ছলে মৃদু অনুযোগও করছিল তাই নিয়ে, ‘তোমায় তো পাড়ায় পোস্টিং দিল গো-।’ 


সেই মত, ক্যাশবুক গুলো শেষ করে, এক তাড়া গ্রাচুইটির কেসের অর্ডার লিখে, মহানগরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমি। এবার মুভমেন্ট অর্ডারটা বেরিয়ে গেলেই হয়। আমরা যারা বাইরে থেকে মহানগরে ঢুকতাম,রোজই কথাবার্তা - মেসেজ চালাচালি হত, বেরোল? মুভমেন্ট অর্ডার কি বেরোল? করোণা ভীতি ঝেড়ে ফেলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল জীবন। গত বছর ১লা জুলাই ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার দিনটা ছুটি নিলে, টানা চারদিন ছুটি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে তুত্তুরী সহ রওণা দিয়েছিলাম হাওড়া। 


দোসরা জুলাই, সন্ধ্যে বেলা, উদ্দাম আড্ডা বসেছে বাবার একতলার বৈঠকখানায়। এমন শোরগোল করছি আমরা, যে  ঠাকুমা থাকলে নির্ঘাত বলত, আমাদের চিৎকারের  ঠেলায়, ‘বাড়িতে কাক উড়ছে, চিল পড়ছে।’ হবে নাই বা কেন? আড্ডাবাজদের সংখ্যা কি কম? বাবারা দুই ভাইবোন, আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, তুত্তুরীরা তুই মামাতো পিসতুতো ভাইবোন, সর্বোপরি দুই কুলবধূ, মা আর চৈতি। 


আড্ডার ফাঁকে শৌভিকের ফোন। দুই ভাই কি সব ফাজিল মন্তব্যও করল তার জন্য। হট্টোগোল থেকে দূরে সরে গিয়ে, ফোনটা কানে ধরতেই, ওপাশ থেকে শৌভিকের চূড়ান্ত আবেগবিহীন কেজো কণ্ঠস্বর। ‘কপাল পুড়েছে-’। মানে? মানেটা শৌভিক বলার আগেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল,‘ এসডিও অর্ডার বেরিয়েছে?’ এটাকেই বোধহয় মহিলাদের ইনট্যুশন বলে। আমি বলি ভাইবস্। বেশ কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছিলাম, বলছিলামও শৌভিককে, ‘তুই বাপু বাঁচবি না। এসডিও তোকে হতেই হবে-।’ 


এরপরের প্রশ্ন অবধারিত ভাবেই, কোথায় হল? জবাব এল তমলুক। এরপরের প্রশ্ন, জানলি কি করে? জবাব এল ‘এষা।’ প্রশ্নটা না করলেও পারতাম, কারণ ততোক্ষণে আমার ফোনে এষার কল ওয়েটিং আসা শুরু হয়ে গেছে। কি প্রবল উৎসাহ নিয়ে খবরটা শুনিয়েছিল এষা, সেই উত্তাপের সিকি ভাগও ফেরৎ দিতে পারিনি আমরা। সেটা নিয়ে মৃদু অনুযোগও করল পাগলি মেয়েটা। ‘দেখ না দিদি, দাদা বলছে,দাদা নাকি জানত না। তা তোমরা আমাদের পার্টি দিচ্ছ কবে-’। জানতাম না তো কেউই, কবে যে ফাইল উঠল, কবে যে সই হল, ধুৎ জীবন কেন যে এত অঘটনঘটনপটিয়ী। 


অতঃপর খবর দেওয়া আর অভিনন্দন গ্রহণ করার পালা। গভীর রাতে,নিদ্রিত তুত্তুরী আর তন্দ্রাচ্ছন্নভাব মায়ের পাশে শুয়ে ফিসফিসে বার্তালাপ। ‘ কত লোক আমাদের অর্ডার বেরোনোর খবর রাখে রে-’, দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলে শৌভিক। এমন দিনে একসাথে না থাকতে পারার অস্বস্তিতে ভুগছি দুজনেই। শৌভিক জানায়, কে যেন ওকে অভিনন্দন জানিয়ে ফোন করে বলেছে, অমুক মন্ত্রী সম্পর্কে তার মামা আর তমুক অফিসার পিসেমশাই হয়। খামোখা চমকে যে লোকজনের কি লাভ হয়। তবে উভয়ের বন্ধুবান্ধবরাই খুব উচ্ছ্বসিত। অর্জুন তো শ্রীমান কুট্টুসের ছবি সম্বলিত একটা কার্ডই বানিয়ে পাঠিয়েছে, ‘কি আনন্দ, মামা এসডিও হয়েছে, ভৌ উউউ’। খুশি আমার চুঁচুড়ার সহকর্মীরাও। খুশির লহর কেবল অনুপস্থিত উভয়ের পরিবারে। কারোরই বাবা-মা যেন খুশি নয়। তমলুক চলে যাবে শৌভিক। প্রতি সপ্তাহে ফিরতেও পারবে না, এটা যেন কিছুতেই হজম হচ্ছে না কারো। শ্বশুরমশাই তো যেন কাকে বলেই ফেলেছেন,‘জ্যেষ্ঠ পুত্রের বাইরে চলে যাওয়ায়, আমি বেশ বিপন্ন বোধ করছি।’ 


অন্যায় তো কিছু বলেননি, শৌভিকের চলে যাওয়ার সম্ভবনাতেই বিপন্ন বোধ করছি আমি। বড় পরিশ্রমী আমার বর। সকালে বিছানা ঝাড়া থেকে দোকানবাজার, জামাকাপড় কাচা (অবশ্যই মেসিনে), বাথরুম(মেঝেটা, ইয়েটা অবশ্য আমার জিম্মেদারি ) পরিষ্কার কতকাজ যে দায়িত্ব নিয়ে করে সংসারে, সেটা ভাবতে বসে পাগল পাগল লাগে। গোটা বাড়ির চালিকা শক্তি তো ওই। সবথেকে বড় কথা, কলকাতা উত্তরের নির্বাচনী দপ্তরে পোস্টিং হওয়ার দরুন আমার পরে বেরোয় এবং আমার আগে বাড়িতে ঢোকে শৌভিক। মেয়েটাও যে বড্ড বাপ সোহাগী।  


বললাম, আমিও তমলুকে বদলি হয়ে যাই বরং। প্রায় মারমূর্তি ধরল শৌভিক। কি দরকার? কোন পাগলে নিরাপদ নির্ঝঞ্ঝাট বিধাননগর ছেড়ে স্বেচ্ছায় ঝঞ্ঝাট চূড়ামণি পূব মেদিনীপুরে যায়? দেখতে দেখতে এসে গেল দিনটা।  ৯ই জুলাই, শুক্রবার একসাথেই বাড়ি থেকে বেরোলাম দুজনে। গ্রীলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তুত্তুরীর মুখে চোখে একটাই অনুনয়,‘ আজই ফিরে এসো কিন্তু বাবা।’ কিভাবে যেন আগেপিছেই রাখা ছিল দুজনের গাড়ি। শৌভিকের ক্রিম কালারের জাইলো। সিকিউরিটি মনোরঞ্জন বাবু নেমে স্যালুট করলেন, হাত থেকে ব্যাগটা নিতে গেলেন। ছেড়ে দিল দুজনের গাড়ি। নিবেদিতা সেতু পর্যন্ত বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম একে অপরকে। তারপর দিল্লী রোড ধরলাম আমরা আর শৌভিকের গাড়ি রওনা দিল বোম্বে রোড বরাবর। 


সেদিন রাতে অবশ্যি ফিরে এসেছিল শৌভিক। শনি-রবি আর রথ নিয়ে পরপর তিনদিন ছুটি। সেই সপ্তাহান্তটা শুধু গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম আমরা। মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনাচ্ছিল শৌভিক, ‘এত সুন্দর কালেক্টরেট কোথাও দেখিনি। সবকিছু নতুন আর ঝকঝকে। আর ডিএম সাহেবের চেম্বারটা যা বানিয়েছে, উফঃ-’।  জানতে চাইলাম, এসডিওর বাংলো নেই? নিজের প্রসঙ্গে হাই তোলে শৌভিক, কেজো সুরে জানায়, ‘একটা হয়েছে শুনছি, নিমতৌড়ির ওখানে। কে যাবে? ওটা তো ভুষুণ্ডির মাঠ।’ জানায় ওর আপিসের পিছনের আবাসনে একটা ফ্ল্যাটেই আপাততঃ মহকুমা শাসকের নিবাস। শৌভিকও ওখানেই থাকতে চায়। ঘোরতর রকম শহরের মধ্যে, দোকান বাজার, তমলুক স্টেশন সবকিছু পা বাড়ালেই। মহকুমা শাসকের গৃহস্থালির ভারপ্রাপ্ত  লোকজনও খুব একটা ঐ ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে যেতে উৎসুক নয়।


দেখতে দেখতে এসে গেল ১২ই জুলাই। কাল পাকাপাকি ভাবে তমলুক রওণা দেবে শৌভিক। তবে সে তো কালকের কথা, আজ যে রথ। ওপরের লফট থেকে নামানো হয় ভাইবোন সমেত জগু বাবুকে। নামানো হয়, খবরের কাগজের মোড়া তাঁর তিনতলা রথ।

বেলা বাড়ে, তুত্তুরীকে ছুটি দেয় না গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল। পড়ার ঘরে ল্যাপটপ চালিয়ে ঘাড় গোঁজ করে পড়তে বসে তুত্তুরী। ব্যাগ গোছাতে বসে শৌভিক। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, টুকটাক কত কিছু কেনা বাকি। পোশাক পরিচ্ছদেরও যা হাল। পাকাপাকি ভাবে থাকতে হলে গোটা কয়েক জামাকাপড় কেনা বাধ্যতামূলক।  চটজলদি বেরোনোর তোড়জোর করি আমরা। তুত্তুরীর ক্লাশ শেষ হবার আগেই ফিরে আসব, মাত্র ঘন্টা খানেকের ব্যাপার। স্নানাহার ফিরে এসেই না হয়- 


ঠিক এগারোটা পয়ত্রিশে বাবার ফোন, আজও ভাসছে কথা গুলো ইথার তরঙ্গে, ‘তুমি কি ব্যস্ত আছ, আসতে পারবে? মা যেন কেমন-’।  ঠিক এই ভয়টাই পাই আমি সবসময়। ঠিক এই কথাগুলোই দুঃস্বপ্নে শুনি আমি, অসময়ে বাড়ি থেকে ফোন এলেই ধড়াস করে ওঠে বুক। যদিও প্রতিবারই প্রমাণ হয়, অকারণ আশঙ্কা করি আমি, আর যেদিন সত্যিই হয়, সেদিন কেন যে বাজে না কোন বিপদঘন্টি।


No comments:

Post a Comment