Sunday, 26 June 2022

অনির ডাইরি১লা জুন, ২০২২


 


মাঝে মাঝে মনে হয়, যে আমরা নিজেরা যতটা নিজেদের আহত করি, ততোটা আঘাত বোধহয় আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই সেই দিনটাকে, নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ,খবরের কাগজ জোড়া পেজারের বিজ্ঞাপন থাকলেও মুঠোফোন ছিল কেবল মাত্র সাইন্স মিউজিয়ামে দেখানো এক কল্পবিজ্ঞান মাত্র। মধ্যবিত্তের যোগাযোগের মাধ্যম বলতে হয় চিঠি নয়তো চাকা ঘোরানো ল্যাণ্ডফোন। তাই বা কটা বাড়িতে ছিল? একটা ফোন করতে হলে হেঁটে যেত হত পাড়ার স্যাকরার দোকানে বা বড় রাস্তা পেরিয়ে উল্টোফুটের পিসিওতে। তিন মিনিট, তিনটি টাকা। তিন মিনিটের পর এক সেকেণ্ড হলেও গুণতে হত পাক্কা ছ-ছটাকার গুণাগার। 


কি যেন দরকারে মেজদাকে ফোন করেছিলাম সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে বসেছিল, স্যাকরার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, অগত্যা গলির মোড়ের পিসিও। কাঁচের ঘরের মধ্যে রাখা বোতাম টেপা ফোন, প্রাইভেসি একটু বেশী বলে পাড়ার উঠতি কপোত-কপোতীদের প্রিয় ফোন করার জায়গা। প্রথম বুথে তেমনি ঢুকেছিল কেউ, দ্বিতীয় বুথ থেকে মেজদার সঙ্গে কেজো কথা সেরে ফোন রাখতে যাচ্ছি, ওপাশ থেকে ভেসে এল মেজদার তরল কণ্ঠ,‘ দাঁড়া ছাড়িস না। তোর সাথে কথা বলবে বলে দিদা ছুটে আসছে -’। 


যুগপৎ দাদুর অকাল মৃত্যু এবং চাকরির সন্ধানে মা ও মাসিদের গ্রাম ছেড়ে মহানগরে চলে আসার পর দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা এক অজ গাঁয়ে একাই থাকত দিদা। আমাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল হাতে লেখা চিঠি। পত্রলেখা বড় দীর্ঘসুত্রী, মেয়ে- জামাই- নাতি- নাতনীকে এক ঝলক দেখা বা সামান্য দুটো কথা বলার জন্য তৃষিতের মত অপেক্ষা করে থাকত দিদা। তাই বোধহয় দূরভাষ যন্ত্রটা এত প্রিয় ছিল বৃদ্ধার। ফোনের ঘন্টা বাজলে শিশু সুলভ উচ্ছ্বাসে উথলে উঠত দিদা। শিশুদের মতই ঘুরঘুর করত ফোনের আসেপাশে দুটো কথা বলা বা শোনার লোভে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি,আদরের ঝুমির সাথে দুটো কথা বলার জন্য ছুটে আসছিল দিদা, কিন্তু পিসিওর ঘড়ি যে বলছিল তিন মিনিট হতে আর কটাই সেকেণ্ড বাকি। তাই তড়িঘড়ি ফোন রেখে দিলাম আমি, বললাম, যাবই তো বাবা মায়ের সঙ্গে সপ্তাহান্তে,  আর কদিন পরে, তখন কথা হবে দিদার সাথে। 


গিয়েওছিলাম, বাবা-মায়ের হাত ধরে। মাত্র এক বেলায় ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল আমাদের দুনিয়া। সারা দিন কিচ্ছু খায়নি মা, আইসিইউ এর কাঁচের জানলার এপাশ থেকে, ওপাশে সংজ্ঞাহীন দিদার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ। হাসপাতাল থেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাড়ি ফিরেছিল শুধু আমায় নিয়ে বড়মাসির বাড়ি যাবে বলে। বাড়ি ফিরতেই জোর করে কয়েক গাল ভাত খাইয়েছিল জ্যাঠাইমা, মায়ের অজ্ঞাতে আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল, ' মায়ের দিকে একটু নজর রাখিস।' ভাত মেখে মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও খেতে পারছিল না মা, কেঁদেই যাচ্ছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। 


বড়মাসির বাড়ি যখন পৌঁছালাম ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে আটটা। চারদাদার সৌজন্যে অন্যান্য দিন গমগম করত যে বাড়ি, সে বাড়িতে সেদিন শুধুই চাপচাপ মনখারাপ। কেউ কথা বলছিল না ভালো করে। বড়দা আর সেজদা সম্ভবতঃ হাসপাতালে ছিল, চির ফাজিল ছোটদাও যেন কেমন গুম মেরে গিয়েছিল সেদিন। পরিস্থিতি তরল করতে মেজদা কেবল বারেবারে সবাইকে আশ্বস্ত করছিল, ‘চিন্তার কোন কারণ নেই, ও বুড়ি ঠিক ফিরে আসবে।’ 


ফিরে এসেছিল তো দিদা। রাত তখন এগারোটা। বাইরের ঘরে লম্বা বিছানা করে সদ্য শুয়েছি মা, সেজ মাসি, ছোট মাসি আর আমি। ঘুম নেই কারো চোখে। হঠাৎ বেজে উঠল কলিং বেল। তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেখি শুকনো মুখে বড়দা দাঁড়িয়ে। ‘কি হয়েছে দাদা? দিদা সুস্থ হয়ে গেছে? তাই বোধহয় ফিরে এসেছ তুমি?’ বড়দা গলা ঝেড়ে বলল, ‘বাবাকে ডাক।’ বাবা মানে বড় মেসোমশাই। ততোক্ষণে পটপট জ্বলে গেছে সব আলো। মশারি খুলে গুটিয়ে ফেলা হয়েছে বিছানা। কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে জড় হয়ে গেছে চার দাদার অগণিত বন্ধু। তাদেরই কাঁধে চেপে এল দিদা। বন্ধ দুই চোখ,মুখে অসীম প্রশান্তি। ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে। 


বড়মাসির গাম্ভীর্যপুর্ণ নিয়ন্ত্রিত শোক, দিদার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে মায়ের গুমরে গুমরে কান্না, সেজ মাসির বুক ফাটানো বিলাপ, ছোট মাসির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না, দাদাদের ভিজে চোখ আর সবকিছু ঝাপিয়ে আমার চরম অপরাধবোধ,তিনটে টাকা, মাত্র তিনটে টাকার জন্য আমার সাথে কথা না বলেই চলে গেল দিদা। 


প্রায় সিকি শতাব্দী আগে চলে যাওয়া দিদা, যেতে যেতে এক অমোঘ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিল, টেলিফোনে কখনও কোন বার্তালাপ আধখেঁচড়া ছাড়ি না আমি। পারতপক্ষে দূরভাষে কোন মতান্তরে যাই না আমি, অবশ্য যদি উল্টো দিকের লোকটা আমার প্রিয় পাত্র হন। ক্ষণিকের উত্তজনায় কদাচিৎ যদি তাদের সাথে কোন উত্তপ্ত  বাক্য বিনিময় হয়েও যায়, মাথা ঠাণ্ডা হবার সাথে সাথেই তাকে ফোন করে মিটিয়ে নিই আমি। দেরী করে লাভ কি, কে জানে কি লুকিয়ে আছে কালের গহ্বরে। বিশ্বাস করুন অসমাপ্ত সংলাপ আর শেষ না হওয়া কথাগুলো বড় কশাঘাত করে, করতেই থাকে, অকারণেই ভিজিয়ে দেয় চোখের কোণ,যখন তখন, হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

No comments:

Post a Comment