#তাম্রলিপ্তকড়চা
অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের দুয়ারে সরকার নিয়ে আমাদের উত্তাপ ছিল বেশ কম, তার অন্যতম কারণ অবশ্যি প্রকৃতি। মে মাসের তীব্র দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছিল যেন চরাচর। এমন যে হবে তাতো জানাই ছিল, অন্যান্য কন্টিনজেন্সির সাথে তাই ওআরএসের প্যাকেটও দিয়েছিলাম আমরা। ক্যাম্প প্রতি তিনটে করে। যেদিন যে ক্যাম্পেই গেছি, সর্বাগ্রে জিজ্ঞাসা করেছি, ওআরএস খাচ্ছো তো? আগে প্রাণে বাঁচো, তারপর কাজ।
বলেই দিয়েছিলাম, পারফর্ম করার ইঁদুর দৌড়ে আমরা, নেই এবার। যেটুকু পারবে,সেটুকুই করবে, শুধু নিছক গতানুগতিক ভাবে করো না। কাজে যেন একটা প্রাণ থাকে, থাকুক না একটু চনমনে ভাব তবেই না কাজ করে আনন্দ। কাজ যা করবে, ছবি তুলবে তার চারগুণ। আর কেউ দেখুক না দেখুক, আমি দেখব। আর কোথাও শেয়ার হোক বা না হোক আমি করব। করেওছি, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে জেলাশাসক মহোদয়ের জেলা গ্রুপ, এমন কি লেবার কমিশনার সাহেবের রাজ্যের গ্রুপ, সর্বত্র। সগর্বে জানিয়েছি,অমুখ পেশার অমুক চন্দ্র অমুক বা শ্রীমতী তমুক কে পরিষেবা দিতে পেরে আমরা যৎপরনাস্তি গর্বিত।
ছবি তোলা নিয়েও যে হয়েছে কত রগড়। বাচ্ছা কোলে মিষ্টি কোন মায়ের ছবি দেখে যেই বললাম দারুণ তো, অমনি শুধু মহিলার ছবিতে ভরে উঠল আমাদের গ্রুপ। সেদিন আমাদের শান্তনু হাসতে হাসতে বলছিল,‘ম্যাডাম আপনাকে খুশি করার জন্য তো লোকজন পারলে ছবি তুলতে পরের বাচ্ছা উঠিয়ে আনে।’ কি সর্বনাশ! ওসব করিস না বাবা।
যদিও বলেছিলাম তেমন চাপ নেবার দরকার নেই, কোন টার্গেট দিচ্ছি না, যা পারো করো। ঝামেলা বাঁধাল চণ্ডীপুর। ব্যাটারা শুরু থেকেই এমন চালিয়ে খেলতে লাগল, রোদ গরম উপেক্ষা করেই হুহু করে উঠতে লাগল ডিএস। শহীদ মাতঙ্গিনী গতবারেও প্রচুর ডিএস ফেলেছিল, তড়িঘড়ি মাঠে নেমে পড়ল তারাও। সে কি প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুপক্ষের। বিগত দুয়ারে সরকারে খুব খারাপ ফল করেছিল তমলুক পুরসভা। নতুন ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি সদ্য বদলি হয়ে এসেছিল আমাদের কাছে, আসতে না আসতেই তার ঘাড়ে চেপেছিল কোলাঘাট ব্লকের অতিরিক্ত দায়িত্ব। সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ হয়েছিল পৌরসভার কাজ। রোজ বকতাম ব্যাটাদের। ব্লকের মত কাজ কখনই পুরসভা তুলতে পারে না। তাই বলে সামান্য নড়াচড়াও করবে না তোমরা? কোলাঘাট, তমলুক বা পাঁশকুড়া ব্লক কি এমন অপরাধ করেছে, যে তোমাদের দায়িত্ব ওদের ঘাড়ে করে বইতে হবে?
আমার জিভের খোঁচায় নাকি বেদজ্যোতির ঘাড় থেকে কোলাঘাট নামার সৌজন্যে কি না জানি না, এবার প্রথম ক্যাম্প থেকেই ছুটতে শুরু করেছিল তমলুক পুরসভার ঘোড়া। মাঝে তো এমন দাঁড়াল, কয়েকটা ব্লকের থেকেও বেশি ডিএস পড়ে গেল পুরসভায়। টুকটাক ডিএস পড়ছিল ময়নাতে, পাঁশকুড়া ব্লক বরাবরই আমাদের নাইটওয়াচম্যান। মেরে রান করে না বটে ব্যাটারা তবে ধরে রাখে উইকেট। পরিচ্ছন্ন ছোট্ট ইনিংস খেলে আউট হয়ে গেল তমলুক ব্লক। গতবারে তৃতীয় হয়েছিল ব্যাটারা। এবারে যে কিছু হবে না সেটা বেশ বুঝলাম আমরা। ধীরে ধীরে রান বাড়াচ্ছিল ময়না। প্রথম চোটে উদ্দাম দৌড়ে ক্রমশঃ বেদম হয়ে পিছু হটছিল চণ্ডীপুর।
গতবারের চ্যাম্পিয়ন কোলাঘাটের বোধহয় ব্যাড প্যাচ চলছিল, কিছুতেই রান উঠছিল না। ক্যাম্পে গিয়ে সেটা বলেও এলাম, ঝাঁকিয়ে এলাম খানিক। ওঠো বাবারা। একটু নড়। একটু অন্তত রান করার চেষ্টা করো। কোলাঘাট খালি বলে, ‘দেখছেননি অন্যান্য ব্লকে দিনে দুটো করে ক্যাম্প ম্যাডাম। আমাদের একটা। আপনি গড়ে হিসেব করুন।’ বয়ে গেছে গড়ে হিসেব করতে। আমি শুধু ফলাফল দেখব। কাজের চিন্তা তোমরা কর গা।
সবার অলক্ষ্যে কখন যে নন্দকুমার মাঠে নেমেছে,বাকি রথী মহারথীরা খেয়ালই করেনি। খেয়াল করেছি কি আমিও? ব্যাটারা নেমেই যখন দমাদ্দুম ব্যাট চালিয়ে চার ছয় বাগাতে থাকল, তখন সবার খেয়াল হল, রাস্তায় হাতি নেমেছে। ৬তারিখ মধ্যরাত্রে যখন বন্ধ হয়ে গেল সার্ভিস ডেলিভারি, ততোক্ষণে সব রথী মহারথীদের বহু পিছনে ফেলে তমলুক মহকুমায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে নন্দকুমার। দ্বিতীয় আর তৃতীয় কে হয়েছে তা অবশ্যি জানাই নি আমরা। থাকুক না একটু সাসপেন্স। ছটফট করুক না লোকজন,বেশি না, সামান্য একটু। মাত্র কটা দিন।
আজ সেই সাসপেন্সের পরিসমাপ্তি হল। প্রথম যে নন্দকুমার তা তো সবাই জানতই মোটামুটি। দ্বিতীয় স্থানে আমরা সবাই ভেবেছিলাম ময়না থাকবে বুঝি। শেষ মুহূর্তের স্কোর শিট মেলাতে গিয়ে দেখা গেল কি ভাবে যেন সেকেণ্ড পোজিশনটা দখল করে বসেছে কোলাঘাট। খরগোশ আর কচ্ছপের গপ্পের কচ্ছপের মত একদিকে নালিশ করে গেছে, দিনে একটা ক্যাম্প, নেট নেই, ডিএস ফেলতে দিচ্ছে নি, ভালো খেতে দিচ্ছেনি, কেবল ভাত আর বাঁধাকপি খাইয়েছে অমুক পঞ্চায়েত ইত্যাদি প্রভৃতি। অন্যদিকে তেমনি এগিয়েই গেছে ব্যাটারা, কখনও এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে, কখনও সিঙ্গলস্ নিয়ে। ময়নার দৌড় এবারের মত এসে থেমেছে তৃতীয় স্থানে। তা হোক, সেটাই অনেক। ভুলে যাবেননি ময়না আমার সবথেকে দূরের ব্লক। দীর্ঘদিন ধরে ময়নায় কোন ইন্সপেক্টর নেই। কোন সিকেসিও নেই। নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রঞ্জিৎ রাণা আপাততঃ অতিরিক্ত দায়িত্বে আছে।
যাই বলুন আজ আমাদের রঞ্জিত রাণারই দিন। দুটো ব্লক থুড়ি এলডব্লুএফসির চার্জে আছে, যার একটা প্রথম আর একটা তৃতীয়। খোদ বড় সাহেবের হাত থেকে ট্রফি দেওয়া হল রঞ্জিতকে। এরপর না খাওয়ালে চলে মাইরি? ভুল বুঝলেন, আমরা খাওয়াব না, ফাস্ট বয় খাওয়াবে আমাদের। যাই হোক বড়সাহেবের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, চূড়ান্ত ব্যস্ততার মাঝেও স্যার বেশ অনেকটা সময় আজ কাটালেন আমাদের সাথে। আমাদের সবার সাথে। স্যারের জন্যই বাজেট ভাঁড়ে মা ভবাণী হওয়া সত্ত্বেও সান্ত্বনা পুরষ্কার চালু করেছিলাম আমরা। এবারের সান্ত্বনা পুরষ্কার ছিল গাছ। ফলের গাছ। সৌজন্য আমার চুঁচুড়া পোস্টিং কালে হাড় জ্বালানো জনৈক ছোকরা উকিল। ব্যাটা বলেছিল, ‘পাখি গুলো আর বেশী দিন বাঁচবে না ম্যাডাম। না খেতে পেয়ে মরে যাবে সব। পাখিদের বাঁচাতে হলে ফলের গাছ লাগাতে হবে বুঝলেন-।’ যত পাগল কি আমার কপালেই জোটে। তা সেই পাগলের নির্দেশ শিরোধার্য করেই পেয়ারা, জামরুল আর লেবু গাছ দিলাম আমরা সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে। আর একটু সবুজ হোক না ধরা, আরো কিছুদিন বেশি বাঁচুক না পাখিগুলো। বাকি রইল কাজ, ও তো আমার আগেও হত, আমার পরেও হবে। থেকে যাবে শুধু একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি।
No comments:
Post a Comment