Sunday 26 June 2022

অনির ডাইরি ১৯শে জুন, ২০২২

 



রবিবার যে ফাদার্স ডে,সেটা মোটামুটি বুধবার দুপুর থেকেই টের পাচ্ছিলাম। গোছা গোছা নোটিফিকেশন আসছিল আমাজন, নায়িকা, মিন্ত্রার মত ই-কমার্স ওয়বসাইট থেকে। বক্তব্য একটাই, ‘স্পেশাল দিনে বাবাকে ইস্পেশাল কিছু কিনে দাও না-’। অনেক  ভাবলাম বৃদ্ধকে একটা টিভি কিনে দিই বরং। বর্তমান টিভিটা আমিই  কিনে দিয়েছিলাম, প্রায় জবরদস্তি করে, এলসিডি বটে, তবে বয়সে তুত্তুরীর থেকেও বড়। মাঝেমাঝেই গোলমাল পাকায়, কিছুদিন আগেই দুটো স্পিকার পাল্টাতে হয়েছে বাবাকে। আরও কি সব খোলনলচে বদলে বর্তমানে দিব্যি চলছে বটে, তবুও-। গ্রেট ইস্টার্ন থেকে কিসব অফার ওয়ালা মেলও এসেছিল, প্রায় কিনেই ফেলতাম, তার আগে ভাবলাম একবার জিজ্ঞাসা করেনি, যা বদমেজাজী বৃদ্ধ, না বলে কিনে দিলে হয়তো সটান ফেরৎ পাঠাবে। 


বেলা চারটে নাগাদ ফোন করতেই খ্যাঁক করে উঠল বৃদ্ধ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাধের দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা ভঙ্গের জন্য একরাশ বিরক্তি তো ছিলই, তার থেকে বড় কথা হল, ‘আমার পুরাণ টিভিটার কি হবে-’? বললাম,ফেলে দাও। একযুগ পুরাণ টিভি, কেউ পাঁচশ টাকা দিয়েও কিনতে যাবে না। বলেই প্রমাদ গুণলাম। ধেয়ে এল বাবার শাণিত জিহ্বা,‘ তাহলে, তোমার মাকে নিয়ে কি করব? কাল তো বলবে, আমার বউটাও পুরাণ হয়ে গেছে, একেও ফেলে দিতে।’ বাবার কোলের কাছে গুটিসুটি হয়ে নিদ্রা দেবীর আরাধনা করা মা এটা শুনে কতটা খুশি হল জানি না, আমি হতোদ্যম হয়ে ফোন রেখে দিলাম। 

পুরাণ জিনিসপত্রের প্রতি চাটুজ্জে বাড়ির  দরদ প্রায় প্রবাদপ্রতিম। কিছুই ফেলা হয় না আমাদের বাড়িতে। চাকরী পাওয়া ইস্তক উপহার দেওয়া প্রতিটা শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবি,বিছানার চাদর মায় খারাপ হয়ে যাওয়া ইনভার্টারটাও বাবা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। শুধু কি আমি, কবে অবসর নেওয়া ছোটমাসি চাকরী পেয়ে প্রথম মাসের মাইনে থেকে একটা ১৮টাকার প্যান্ট উপহার দিয়েছিল বাবাকে সেটাও রাখা আছে নিঁভাজ পাট করে। বাবার জামাকাপড়ের বেহাল দশা দেখে কবে সদ্য বিবাহিত মা কার থেকে যেন কিছু টাকা ধার করে কিনে দিয়েছিল তিনটে শার্ট। আজও গোছানো আছে তা। সেজ-ছোট মাসির বুনে দেওয়া সেই আশি নব্বইয়ের দশকের ফুটো হয়ে যাওয়া সোয়েটার, আছে তাও। বাবা কিছু ফেলে না। মাও না। শুধু আমি কিছু দিতে গেলেই হাড় জ্বলে যায় ওদের। যাই দিতে চাই, তাই নাকি অপ্রয়োজনীয় এবং বাহুল্য বিশেষ। বাড়িতে রাখার জায়গা নেই। স্বাভাবিক, পুরাণ দ্রব্যাদি গুদামজাত করে রাখলে, নতুন জিনিসপত্র রাখবে কোথায়-


বাড়ি ফিরে চায়ের কাপে সেই গল্পই শোনাচ্ছিলাম তুত্তুরীকে। ‘কিন্তু ওরা যখন চাইছেই না, তুমি অকারণ জোর করছ কেন?’ দাদুর ওপর চটে গিয়ে বিরক্ত স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। জবাব একটাই, আমার বাবাটা যে পৃথিবীর সেরা বাবা, তাই না চাইতেই সবকিছু দিতে চাই বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ সেটা শুনলে বা বুঝলে তো। 


স্বাভাবিক ভাবেই তুত্তুরীর কাছে তার বাবাটা সেরা, আমার বাবাটাও সেরা বটে, নিঃসন্দেহে সেরা। তবে দাদু হিসেবে। কার বাপটা বেশি ভালো এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই কোঁদল করি আমরা মা-মেয়েতে। এবারের কোঁন্দলটা যদিও তেমন জমল না। তর্ক যুদ্ধের মাঝপথে হঠাৎ অস্ত্র ত্যাগ করল তুত্তুরী । অতঃপর চিন্তিত স্বরে,‘ এই মা, ফাদার্স ডে তে আমি কি দেব আমার বাবাকে?’ বললাম কিছু কিনে দিই। তুত্তুরীর বাবাকে নিয়ে তো কোন চিন্তা নেই,পুরাতন জামাকাপড়  জমিয়ে রাখার বদভ্যাসটা তারও ঘোরতর আছে বটে, তবে নতুন কিছু দিলে আপত্তি খুব একটা করে না। বড়জোর মৃদু স্বরে বলে ওসব ‘উস্টুমধুস্টুম’ উপহার না দিয়ে, মূল্য ধরে দিলে বেশী খুশি হত। এই আর কি। 


প্রস্তাবটা পছন্দ হয় না শ্রীমতী তুত্তুরীর। ‘তুমি কিনে দিলে,সেটা তো তোমার দেওয়া হবে।’ যুক্তি অকাট্য। তাহলে? দীর্ঘ মস্তিষ্ক প্রক্ষালন তথা দুধের কাপে ঝড় তুলে অবশেষে উপায় বার করে তুত্তুরী, কোন সিনেমা বা ভিডিওতে দেখা রণবীর কাপুরের মত সারপ্রাইজ স্পেশাল ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়াবে বাবাকে। সাথে থাকবে একটা ছোট্ট বার্তা, ফাদার্স ডে স্পেশাল। 


ব্যাপারটা ভাবা যতটা সহজ, বাস্তব রূপায়ন ততোটাই দুরূহ। লুচি পরোটার মত শৌভিকের প্রিয় প্রাতরাশ বানানো তুত্তুরীর পক্ষে অসম্ভব। তার ওপরে এখানকার গ্যাসের টেবিলটা যা উঁচু। কড়া বসালে রীতিমত লেঙচে দেখতে হবে শ্রীমতী তুত্তুরীকে।  কাজেই ওসব বাদ। তাহলে কি ম্যাগি? শনিবার সকালে ফিল্ড ভিজিটে বেরানোর সময় আমার হাতের স্পেশ্যাল চিলি গার্লিক ম্যাগি খেয়ে বেরিয়েছে শৌভিক। কাজেই ম্যাগিও বাতিল। তাহলে? সারাদিন ধরে ইউটিউবে ফাদার্স ডে স্পেশাল ব্রেকফাস্টের রেসিপি ঘাঁটে শ্রীমতী তুত্তুরী। এমন কিছু যা মূলতঃ মাইক্রোওয়েভেই বানানো যাবে। শুধু তাই নয়, যা ঝটপট বানানো যাবে এবং যার সমস্ত উপকরণ মজুত আছে বাড়িতেই। 


সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে, স্নান সেরে কাচা তথা ভালো জামা পরে  যখন আমার ঘুম ভাঙাল তুত্তুরী ঘড়ি বলছে সবে সকাল সাতটা। ‘ও এত সকাল সকাল তোকে ডাকছে কেন?’ পাশ থেকে নিদ্রালু স্বরে জানতে চায় শৌভিক। কি বলি, ফেলুদা আর শার্লক গুলে খাওয়া এই লোকটার থেকে কোন কিছু গোপন রাখা বেশ দুষ্কর। তবুও বলি,ও কিছু না। তুত্তুরীর কিছু কাজ করে দিতে আমায়, তাই ডাকছে। সকালের কফি তৈরি হবার আগেই তৈরি হয়ে যায় আমাদের কেক মিক্স, এবার শুধু ফেটানোটাই যা বাকি। শৌভিক কফি খেতে নামে, রোজকার মত গোবেচারা মুখে দুধ আর চায়ের কাপ নিয়ে বসে আমরাও। আলোচনা করি উল্টোপাল্টা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে। দিব্যি কফি খেয়ে, খবরের কাগজের পাতা উল্টে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখে শৌভিক, আচমকা শ্রীমতী তুত্তুরী ঘাবড়ে গিয়ে বলে বসে,‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। যাও যাও। আমরা কিচ্ছু করছি না।’ পটাং করে পিছন দিকে ঘুরে যায় শৌভক, সার্চলাইট ফেলার মত করে নজরদারি চালায় মা মেয়ের ওপর। অতঃপর, ‘হুঃ। তারমানে কিছু একটা অপাট করছিস তোরা দুটোতে মিলে-’।  


সেযাত্রা বাবা বাছা বলে দোতলায় পাঠাতে পারলেও, চাদর কাচতে দেবার অছিলায় আবার নেমে আসে শৌভিক এবং এবার একেবারে আমাদের অজ্ঞাতসারে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কেকের ব্যাটার ফেটাতে শেখাচ্ছিলাম মেয়েকে, আচমকা,‘তার মানে আজ কেক বানানো হচ্ছে। যেটা বড়টা বানাবে আর ছোটটা দাবী করবে যে  ও বানিয়েছে।’ পলকে ফুলে ওঠে তুত্তুরীর ঠোঁট। হ্যাঁ আমি দেখিয়ে দিয়েছি বটে, প্রয়োজনে ডিমও ফাটিয়ে দিয়েছি, মিক্সির কন্টেনারটা ঠিক করে বসিয়ে দিয়েছি যাতে বিপদ না বাঁধায়,স্যান্ডউইচের পেঁয়াজ-শসা- গাজর কেটে দিয়েছি ইত্যাদি প্রভৃতি কিন্তু আসল মেহনত তো শ্রীমতী তুত্তুরীই।


সেসব বলতে, বোঝাতে গেলে এখন ধরা পড়ে যাবে পুরো পরিকল্পনাটাই। তাই লাস্যময়ী হয়ে বললাম,‘ঠিক ধরেছ। শোন না কেক হলে আমরা ডাকব বরং, তুমি এখন ওপরেই থাকো। বড্ড বিরক্ত করছ।’ 


ফেটানো কেকের ব্যাটার ঢালা হয় চায়ের কাপে, কাপ ঢোকে মাইক্রোওভেনে। তুত্তুরী দৌড়য় বাবার জন্য একগোছা ফুল তুলতে। রণবীর কাপুরের মত করে ট্রেটা সাজাতে হবে তো। কদিন আগেই বাগানে আবিষ্কৃত হয়েছে গর্ত সমেত সাপ। তিনি আবার এত দুঃসাহসী যে আমরাও যেমন তাঁকে দেখতে দৌড়েছিলাম, তিনিও তেমনি গর্ত থেকে মুখ বার করে দেখছিলেন আমাদের। তাঁর ভয়েই বোধহয় তুত্তুরীর পিছন পিছন দৌড়য় বাগানে কাজ করতে আসা মাসি আর সিকিউরিটি ছেলেটা। 


মস্ত ট্রে তে গরম গরম চকোলেট কাপকেক আর সদ্য তুলে আনা সূর্যমুখী ফুল রেখে সবে স্যান্ডউইচ বানানোতে হাত লাগিয়েছে তুত্তুরী , এমন সময় সিঁড়ির রেলিং এর ফাঁক থেকে ভেসে আসে শৌভিক বাণী, ‘আচ্ছা, কেকটাকে আবার সাজানোও হচ্ছে দেখি। পাঁউরুটি দিয়েও কিসব বানানো হচ্ছে-’। এইভাবে সারপ্রাইজ ব্রেকফাস্ট হয় মাইরি? 


 শেষ পর্যন্ত তুত্তুরী যা বানাতে পেরেছিল ,নীচে রইল তার ছবি। হাবেভাবে প্রকাশ না করলেও ভয়ানক খুশি হয়েছে শৌভিক বেশ বুঝতে পারলাম আমি, কারণ এতকিছুর মধ্যে তুত্তুরীর বার্তা থেকে কেবল একটা গ্রামাটিক্যাল এরর ধরেছে শৌভিক, আর একবার শুধু বলেছে ‘ফুলটা কিন্তু আমি খাব না।’ ওটুকু প্রত্যাশিত।  এমনি ভাবেই ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বাবারা, এমনি হাসিখুশি আর ভালোবাসায় জবজবে থাকুক সব সম্পর্ক, বছরের সবকটা দিন। এমনিতেও প্রতিটা মেয়ের সারা জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে একছত্র রাজত্ব চালায় যে লোকটা, তার জন্য কি মাত্র একটা দিনে পোষায়। অন্তত আমার আর তুত্তুরীর জন্য,  রোজই তো বাবা দিবস

অনির ডাইরি১লা জুন, ২০২২


 


মাঝে মাঝে মনে হয়, যে আমরা নিজেরা যতটা নিজেদের আহত করি, ততোটা আঘাত বোধহয় আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই সেই দিনটাকে, নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ,খবরের কাগজ জোড়া পেজারের বিজ্ঞাপন থাকলেও মুঠোফোন ছিল কেবল মাত্র সাইন্স মিউজিয়ামে দেখানো এক কল্পবিজ্ঞান মাত্র। মধ্যবিত্তের যোগাযোগের মাধ্যম বলতে হয় চিঠি নয়তো চাকা ঘোরানো ল্যাণ্ডফোন। তাই বা কটা বাড়িতে ছিল? একটা ফোন করতে হলে হেঁটে যেত হত পাড়ার স্যাকরার দোকানে বা বড় রাস্তা পেরিয়ে উল্টোফুটের পিসিওতে। তিন মিনিট, তিনটি টাকা। তিন মিনিটের পর এক সেকেণ্ড হলেও গুণতে হত পাক্কা ছ-ছটাকার গুণাগার। 


কি যেন দরকারে মেজদাকে ফোন করেছিলাম সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে বসেছিল, স্যাকরার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, অগত্যা গলির মোড়ের পিসিও। কাঁচের ঘরের মধ্যে রাখা বোতাম টেপা ফোন, প্রাইভেসি একটু বেশী বলে পাড়ার উঠতি কপোত-কপোতীদের প্রিয় ফোন করার জায়গা। প্রথম বুথে তেমনি ঢুকেছিল কেউ, দ্বিতীয় বুথ থেকে মেজদার সঙ্গে কেজো কথা সেরে ফোন রাখতে যাচ্ছি, ওপাশ থেকে ভেসে এল মেজদার তরল কণ্ঠ,‘ দাঁড়া ছাড়িস না। তোর সাথে কথা বলবে বলে দিদা ছুটে আসছে -’। 


যুগপৎ দাদুর অকাল মৃত্যু এবং চাকরির সন্ধানে মা ও মাসিদের গ্রাম ছেড়ে মহানগরে চলে আসার পর দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা এক অজ গাঁয়ে একাই থাকত দিদা। আমাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল হাতে লেখা চিঠি। পত্রলেখা বড় দীর্ঘসুত্রী, মেয়ে- জামাই- নাতি- নাতনীকে এক ঝলক দেখা বা সামান্য দুটো কথা বলার জন্য তৃষিতের মত অপেক্ষা করে থাকত দিদা। তাই বোধহয় দূরভাষ যন্ত্রটা এত প্রিয় ছিল বৃদ্ধার। ফোনের ঘন্টা বাজলে শিশু সুলভ উচ্ছ্বাসে উথলে উঠত দিদা। শিশুদের মতই ঘুরঘুর করত ফোনের আসেপাশে দুটো কথা বলা বা শোনার লোভে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি,আদরের ঝুমির সাথে দুটো কথা বলার জন্য ছুটে আসছিল দিদা, কিন্তু পিসিওর ঘড়ি যে বলছিল তিন মিনিট হতে আর কটাই সেকেণ্ড বাকি। তাই তড়িঘড়ি ফোন রেখে দিলাম আমি, বললাম, যাবই তো বাবা মায়ের সঙ্গে সপ্তাহান্তে,  আর কদিন পরে, তখন কথা হবে দিদার সাথে। 


গিয়েওছিলাম, বাবা-মায়ের হাত ধরে। মাত্র এক বেলায় ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল আমাদের দুনিয়া। সারা দিন কিচ্ছু খায়নি মা, আইসিইউ এর কাঁচের জানলার এপাশ থেকে, ওপাশে সংজ্ঞাহীন দিদার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ। হাসপাতাল থেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাড়ি ফিরেছিল শুধু আমায় নিয়ে বড়মাসির বাড়ি যাবে বলে। বাড়ি ফিরতেই জোর করে কয়েক গাল ভাত খাইয়েছিল জ্যাঠাইমা, মায়ের অজ্ঞাতে আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল, ' মায়ের দিকে একটু নজর রাখিস।' ভাত মেখে মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও খেতে পারছিল না মা, কেঁদেই যাচ্ছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। 


বড়মাসির বাড়ি যখন পৌঁছালাম ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে আটটা। চারদাদার সৌজন্যে অন্যান্য দিন গমগম করত যে বাড়ি, সে বাড়িতে সেদিন শুধুই চাপচাপ মনখারাপ। কেউ কথা বলছিল না ভালো করে। বড়দা আর সেজদা সম্ভবতঃ হাসপাতালে ছিল, চির ফাজিল ছোটদাও যেন কেমন গুম মেরে গিয়েছিল সেদিন। পরিস্থিতি তরল করতে মেজদা কেবল বারেবারে সবাইকে আশ্বস্ত করছিল, ‘চিন্তার কোন কারণ নেই, ও বুড়ি ঠিক ফিরে আসবে।’ 


ফিরে এসেছিল তো দিদা। রাত তখন এগারোটা। বাইরের ঘরে লম্বা বিছানা করে সদ্য শুয়েছি মা, সেজ মাসি, ছোট মাসি আর আমি। ঘুম নেই কারো চোখে। হঠাৎ বেজে উঠল কলিং বেল। তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেখি শুকনো মুখে বড়দা দাঁড়িয়ে। ‘কি হয়েছে দাদা? দিদা সুস্থ হয়ে গেছে? তাই বোধহয় ফিরে এসেছ তুমি?’ বড়দা গলা ঝেড়ে বলল, ‘বাবাকে ডাক।’ বাবা মানে বড় মেসোমশাই। ততোক্ষণে পটপট জ্বলে গেছে সব আলো। মশারি খুলে গুটিয়ে ফেলা হয়েছে বিছানা। কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে জড় হয়ে গেছে চার দাদার অগণিত বন্ধু। তাদেরই কাঁধে চেপে এল দিদা। বন্ধ দুই চোখ,মুখে অসীম প্রশান্তি। ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে। 


বড়মাসির গাম্ভীর্যপুর্ণ নিয়ন্ত্রিত শোক, দিদার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে মায়ের গুমরে গুমরে কান্না, সেজ মাসির বুক ফাটানো বিলাপ, ছোট মাসির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না, দাদাদের ভিজে চোখ আর সবকিছু ঝাপিয়ে আমার চরম অপরাধবোধ,তিনটে টাকা, মাত্র তিনটে টাকার জন্য আমার সাথে কথা না বলেই চলে গেল দিদা। 


প্রায় সিকি শতাব্দী আগে চলে যাওয়া দিদা, যেতে যেতে এক অমোঘ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিল, টেলিফোনে কখনও কোন বার্তালাপ আধখেঁচড়া ছাড়ি না আমি। পারতপক্ষে দূরভাষে কোন মতান্তরে যাই না আমি, অবশ্য যদি উল্টো দিকের লোকটা আমার প্রিয় পাত্র হন। ক্ষণিকের উত্তজনায় কদাচিৎ যদি তাদের সাথে কোন উত্তপ্ত  বাক্য বিনিময় হয়েও যায়, মাথা ঠাণ্ডা হবার সাথে সাথেই তাকে ফোন করে মিটিয়ে নিই আমি। দেরী করে লাভ কি, কে জানে কি লুকিয়ে আছে কালের গহ্বরে। বিশ্বাস করুন অসমাপ্ত সংলাপ আর শেষ না হওয়া কথাগুলো বড় কশাঘাত করে, করতেই থাকে, অকারণেই ভিজিয়ে দেয় চোখের কোণ,যখন তখন, হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

Wednesday 8 June 2022

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, ৭ই জুন, ২০২২

 


👩🏻-ম্যাম এসে বসে আছেন তো, এতক্ষণ ধরে ওপরে কি করছ?

👧🏻- (বইয়েরওপর ঝুঁকে পড়ে, অন্যমনস্ক ভাবে) হুঁ। 


👩🏻-(সামান্য অধৈর্য হয়ে) এখন হোমওয়ার্ক করছ? সারাদিন কি করেছ? শুধু বম্ বম্ করে ঘুরে বেরিয়েছ?

👧🏻-(আশ্বস্ত করার ঢঙে) না, না, হোমওয়ার্ক হয়ে গেছে। একটা জিনিস লিখে ফেলেছিলাম সেটাই মুচছি। 

👩🏻-(তরল গলায়) কি লিখেছিলি, ‘আই লাভ শাহরুখ?’

👧🏻-(হেসে ফেলে) নাঃ। লিখেছিলাম,‘আই লাভ ভিকি।’

👩🏻- (হতভম্ব হয়ে) অ্যাঁ, এই ভিকিটা আবার কে?


👧🏻-(চোখ গোলগোল করে) উফ্ মা। ভিকি কৌশল?

👩🏻-(বোকা বনে) ও হো,তাও তো-। শোন বাবু যেখানে খুশি লেখ শুধু পড়ার বইতে লিখিস না, কেমন?

👧🏻-(হেসে ফেলে) লিখিনি। শুধু আই লাভ লিখে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তুমি আমাকে ভীষণ ভালো বোঝ মা। 

👩🏻-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হ্যাঁ। কারণ আমিও তো, ক্লাস সিক্সেই, প্রথমবার (ঢোঁক গিলে), ঘরের দেওয়াল পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলাম,‘ আই লাভ মাই রুম।’ সলমান খান লেখার সাহস হয়নি কি না।

Saturday 4 June 2022

অনির ডাইরি ২৪শে মে, ২০২২

 



বিয়েটা সপ্তাহান্তে করলেও, বিবাহবার্ষিকীটা কেন যে ঘুরে ফিরে সেই কাজের দিনেই পড়ে-। এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রথম বিবাহবার্ষিকীর উন্মাদনা ত্রয়োদশ বরষে থাকে না। আর আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীটাও যা কেটেছিল, আহাঃ-। স্বপাকে বানানো ডাল- ভাত, বেগুন ভাজা আর ডিমের ঝোল খেয়ে দিব্যি ক্ষুদিরাম হয়ে আপিস গিয়েছিলাম দোঁহে। বেলা আড়াইটে নাগাদ, শৌভিক ফোন করে বলেছিল, ‘ধুৎ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কোথাও ঘুরতে যাবি?’


 অতঃপর খড়্গপুর ২নং ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের সাদা অ্যাম্বাসাডরে চেপে, ধূধূ ফাঁকা রাস্তা বরাবর হারিয়ে যাওয়া। নামানো কাঁচের ফাঁক দিয়ে ছুটে আসছিল দম বন্ধ করা হুহু হাওয়া। দুপাশে যতদূর দুচোখ যায়, আঁকাবাঁকা লাল মোরাম বিছানো নিঃসঙ্গ পথ আর নয়ানজুলি, নিরিবিলি ঝাউ আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। মাঝে মাঝে উচ্চাবচ কালভার্টে ঝাঁকুনি খাচ্ছিল গাড়িটা। গন্তব্য ছিল গড়বেতা স্থিত তৎকালীন মেদিনীপুরের সবথেকে বড় এবং জনপ্রিয় পার্ক, নাম ঝিলমিল নাকি নির্মলকানন। জঙ্গলমহল তখন আক্ষরিক অর্থেই মুক্তাঞ্চল, তারই মধ্যে স্থানীয় কপোতকপোতীদের প্রিয়তম তথা রোমান্টিকতম ডেসটিনেশন। তাই বলে সেন্ট্রাল পার্ক সুলভ কিছু ভেবে টেবে বসবেননি আবার। আসলে ড্রাইভার শৈবালদাকে বলা হয়েছিল, নব দম্পতির বিবাহবার্ষিকী পালনের জন্য একটা জম্পেশ জায়গায় নিয়ে যেতে। উনিও তাই মাথা খাটিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ পৌঁছে আর কিছুতেই নামতে চায়নি  শৌভিক। বেচারা হতভম্ব শৈবাল দার মুখের অবস্থা ছিল দেখার মত। এমন সুন্দর পার্ক ও শেষে সাহেবের নাপসন্দ? এ ব্যাটারা চায় কি?  

 

নাঃ তেমন কিছুই চাই না আমরা, একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা, একটু বেশি উদরপূর্তি, কাছে পিঠে কোথাও ঘুরে আসা আর একরাশ স্মৃতি রোমন্থন,ব্যাস,এই তো -- "একটু খানি চাওয়া আর একটু খানি পাওয়া, এই আবেশেই হোক না মধুর আমার এ গান গাওয়া।’


  পিছন ফিরে তাকালে কম পথ তো হাঁটিনি মোরা এক সাথে-। সেই যে মাদপুরে আমাদের ছোট্ট সংসার। আপিস থেকে কোয়ার্টারে ফিরেই ফোন করতাম,‘ আমি কিন্তু এসে গেছি।’ অমনি ডাক ফাইল বগলে বাড়ি চলে আসত শৌভিক।কোয়ার্টারেই আনিয়ে নিত বাকি ফাইলপত্র। ডাইনিং টেবলে বসে ফাইল সই করত একজন, অপরজন কাটতে বসত সব্জিপাতি। একবার আমার পটল ভাজার তপ্ত কড়াইয়ে পড়ে ভাজা হয়ে গিয়েছিল একটা মথ। আমি তো ভয়ে ঘেন্নায় কেঁদেই আকুল। ফাইল ফেলে ঝাঁজরি হাতা দিয়ে তেলে ভাজা মথ তুলতে দৌড়েছিল শৌভিক। 


আর সেই সপ্তাহান্তে খড়্গপুরের সেই ঝিমুনি ধরা সন্ধ্যাগুলো যখন একলা অন্ধকার গাড়িতে বসে মশার কামড় খেতাম শুধুই তার প্রতীক্ষায়। অনেক অঙ্ক টঙ্ক কষে, ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঢুকতাম আমরা খড়্গপুরের মহকুমা শাসকের দপ্তরে। পরিকল্পনা থাকত যে দুটো আপাত গুরুগম্ভীর ফাইল নিয়ে শৌভিক ঢুকবে বড় সাহেবের চেম্বারে, চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকব আমি। তারপর সুযোগ বুঝে বাড়ি ফেরার কথাটা পাড়বে শৌভিক। ফিরিস্তি দেবে শেষ কবে বাড়ি ফিরেছিলাম দোঁহে। সামনাসামনি অনুরোধ করলে নির্ঘাত না বলতে পারবেন না বড় সাহেব। আর বললে, আবার ফিরে গিয়ে ভাত চাপাব আমরা। 


খড়গপুর থেকে হাওড়া, তাও গাড়ি করে আসার সাহস ছিল না আমাদের। গাড়ি যেত কেবল মাদপুর থেকে খড়্গপুর স্টেশন অবধি। তারপর ট্রেন, তারপর রিক্সা। 


তৃষিতের মত মহকুমা শাসকের চেম্বারের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তার প্রতীক্ষায়। গাড়িতে লাগানো ছিল একটা পুঁচকে ফ্যান, তবে তা চলত কেবল যখন গাড়ি দৌড়ত। গাড়ি বন্ধ তো তিনিও নিদ্রিত। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ত মশার পাল।  আজকের তুলনায় নেহাৎ সস্তার নোকিয়া ফোন, মাত্র এক জিবির মেমারি কার্ড। তাতে সম্বল বলতে সাকুল্যে গুটি বিশেক গান। অন্ধকারে মশা মারার ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফাঁকেফোকরে তাই বসে বসে শুনতাম, বার বার। 


সাড়ে ছটা নাগাদ হাসি মুখে বেরিয়ে আসত শৌভিক। অতঃপর ভিড়ে ঠাসা ইস্পাত বা ধৌলি। আরেকটু রাত হলে রূপসী বাংলা। ইস্পাত বা ধৌলিতে বসার জায়গা পাওয়া ছিল নিছক কষ্টকল্পনা। দরজার কাছে জড়সড় হয়ে দাঁড়াতাম দোঁহে। এই ভাবেই কবে যেন দুই থেকে আড়াই হয়ে গেলাম আমরা। 


খড়্গপুরের পর ট্রেন থামত সাঁতরাগাছি, আমরাও তো ওখানেই নামব, ফলে সিট পাবার প্রশ্ন উঠত না। ধেড়ে তুত্তুরীকে উদরে নিয়ে,একে অপরের হাত ধরে ভালোয় ভালোয় নামতে পারলেই বাঁচতাম দুজনে। তারপর সাঁতরাগাছি স্টেশনে মাটির ভাঁড়ে চা আর কেক খেয়ে পরের লোকাল ধরে দাশনগর। অতঃপর রিক্সা। ভাড়া এমনিতে কুড়ি হলেও, রাত বাড়লেই হয়ে যেত পঁচিশ।  


 জন্মের পর, সারা দিন ঘুমাত, সারা রাত জাগত তুত্তুরী। সে যে কি অসহনীয় যাতনা। অন্য দিন গুলো একসাথেই রাত জাগতাম তুত্তুরী, মা আর আমি।  সপ্তাহান্তে একটা রাতের জন্য বাড়ি ফিরত শৌভিক, সেই রাত গুলোয় মাকে রেস্ট দিয়ে তিনজনে মিলে রাত জাগতাম আমরা। অরকুটে একটা ছবি ছিল, যার ক্যাপশনই ছিল, ‘উই থ্রি, অ্যাট থ্রি।’ রাত তিনটেয়, মোরা তিনজন। 


মাঝে মাঝে আর সহ্য হত না এই রাত জাগার অত্যাচার, প্রচণ্ড বকতাম ছোট্ট তুত্তুরীকে। ঠোঁট ফোলাত তার বাবা ,‘ ও কিন্তু খুব অসহায়। আমরা ছাড়া ওর কেউ নেই-’। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুলি ফুটল তুত্তুরীর, শৌভিক বাড়ি ফিরলেই, ভেসে আসত আধো আধো বুলি ‘বাবা এলি? একবার এলি, দুবার এলি? কফি খাবি?’ 


 কবে যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিল মেয়েটা, কবে যে আলাদা দল গড়ে ফেলল বাপ-মেয়েতে আমি বুঝতেই পারলাম না।  একজনকে বকলে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে আসে আরেকজন। গাড়িতে উঠলেই বমি করত তুত্তুরী এবং কাকতালীয় ভাবে প্রতিবারই বমি করত শৌভিকের গায়ে। গাড়িতে উঠেই দুহাত বাড়িয়ে বলত,‘ বাবা নেঃ।’ যেই শৌভিক কোলে নিত,অমনি ওয়াক। কয়েক হাজার বার শৌভিকের গায়ে বমি করেছে মেয়েটা, অথচ সেসব কথা কেউ তোলে না এ বাড়িতে। বমির প্রসঙ্গ উঠলেই কেবল দোষী সাব্যস্ত হই আমি। সেই যে সেবার দিল্লী থেকে সিমলা যাবার পথে বমি করেছিলাম আমি, আজও রসিয়ে রসিয়ে সেই চর্চা করে বাপ আর মেয়েতে। গোটা ভলভো বাসের সব বমির প্যাকেট নাকি আমি একাই শেষ করে দিয়েছিলাম। এরকম আরো যে কত অপবাদ দেওয়া হয় আমার নামে। আমার যাবতীয় ইচ্ছে-অনিচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিরুদ্ধাচারণ করাটাই এদের বাপ মেয়ের নৈমিত্তিক কর্তব্য। 


যেমন ধরুন, আজ আমাদের বিয়ের দিন, কোথায় একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠব, আজকেই নাকি গোটা বাড়ির সব বিছানার চাদর আর বালিশের ওয়াড় কাচতে হবে এদের। আজ দুপুরে দীঘায়  মিটিং আছে শৌভিকের, কখন ফিরবে কে জানে? বললাম একটু বেলা করে আপিস যা তাহলে,অথবা আজ আপিস না গেলেও তো হয়? অফিসে নাকি এত ফাইল জমে আছে, যে সময় মত না গেলেই নয়। ভেবেছিলাম ছুটি নেব আজ, সপ্তাহের মাঝে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যাবার আব্দার তো আর করতে পারি না, তাই বাড়িতেই রান্না করব কিছু টুকটাক। আচমকা ঠিক হওয়া দীঘার মিটিংটা দিল সব পণ্ড করে। আড়াইটে থেকে মিটিং, কে জানে কতক্ষণ চলবে। তারপর ফিরতেও আরও ঘন্টা দুই, জ্যামে পড়লে আড়াই-।  গেল এ বছরের বিবাহবার্ষিকী। 


শৌভিক যদিও অনেক সান্ত্বনা দিয়ে গেল, কথা দিয়ে গেল সাড়ে চারটের মধ্যে পাক্কা বেরিয়ে পড়বে সমুদ্র সুন্দরীর গাঁটছড়া খুলে, ওসব নিছক কথার কথা।  মনখারাপ করে ঘুরে এলাম গোটা কয়েক দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প থেকে, আপিসে আজ আর ঢুকলাম না। অন্যান্য বার যাঁরা ফোন করে শুভেচ্ছা জানান, এ বার বোধহয় তাঁদেরও মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে দিনটার কথা। বললেই শৌভিক বলে,‘কেন করবে? কি এমন স্পেশাল আমরা।’ তা বটে, তবুও বিশেষ বিশেষ দিনে আপনজনদের কাছে এই অন্তঃসলিলা দাবীটা আমার থেকেই যায়, বিশেষতঃ যাঁরা এত ভালোবাসেন আমাদের। 


বিকাল সাড়ে চারটে নাগাদ ফোন করল জনৈক বন্ধু,নিছক কাজের ফোন। আগ বাড়িয়ে তাকেই বললাম,‘জানিস আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। এমন দিনে দীঘা  গেছে শৌভিক, আমাদের নিয়ে যায়নি।’ ভেবেছিলাম সমব্যথী হবে, দুটো সান্ত্বনার কথা বলবে। উল্টে সুহৃদ বলল,‘ভালো হয়েছে তোকে নিয়ে যায়নি। গেলেই শালা দুটো ছবি লাগাতিস, আর  আমার বউ আমার মাথা খারাপ করে দিত। তুই রবিবার ক্যাম্পে গিয়েছিলি, তাই নিয়েই আমায় চারটে কথা শোনাল, তুই গেছিস, আমি কেন যাইনি? বললাম অনিন্দিতাও যায়নি, পুরাণ ছবি পোস্ট করছে, তাই নিয়ে কি বাওয়াল।’  সাধে রাষ্ট্র ভাষায় বলে মাইরি, এমন বন্ধু থাকতে, শত্রুর কি প্রয়োজন? এই জন্যই অপদার্থ বন্ধুটির থেকে ওর বউকে আমি বেশি ভালোবাসি। 


বন্ধুর সাথে তরল বাক্য বিনিময়ের মাঝেই, শৌভিকের কল ওয়েটিং, তড়িঘড়ি ফোন কেটে ফোন করলাম। নির্ঘাত বলবে, রাতে খেয়েই ফিরবে আজ। ওদিক থেকে ভেসে এল, আবেগ মথিত বাক্যবাণ,‘হুঁ, বেরিয়ে পড়েছি। রান্না বসিয়েছিস তো?এক কাপ চা ছাড়া কিছুই খাইনি মিটিং এ।’ ঘড়িতে পৌনে পাঁচ। শৌভিকের জলদি বাড়ি ফেরার পুলক ছাপিয়ে উঠে এল একরাশ উৎকণ্ঠা। সর্বনাশ, মনের দুঃখে আমি যে রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট বানাতে বলেছি গো। 


পুনশ্চঃ শেষ পর্যন্ত শৌভিক বাড়ি ফিরেছিল সাড়ে সাতটা নাগাদ। তড়িঘড়ি যা বানাতে পেরেছিলাম -বাপমেয়ের ভয়ানক প্রিয় মেয়োনিজ সহ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কসুরি মেথি গন্ধী মালাই পনির, গোটা মশলা দেওয়া কষা মাংস,লাল-লাল চাপ চাপ পায়েস আর ইয়ে পরোটা। সত্যি বলতে কি, বানাতে তো গিয়েছিলাম লাচ্ছা পরোটা, দ্বিতীয় দফা বেলার পর আর ভাঁজ গুলো খুঁজে পেলাম না। ভয়ানক মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল মাইরি, শৌভিক যদিও বলল, এটাই বেশি ভালো হয়েছে। ও নাকি লাচ্ছা পরোটা দুচক্ষে দেখতে পারে না। সে তো ও আমার সব কিছুকেই ভালো দেখে, তাই ওর কথায় আর কে বিশ্বাস করে?

Thursday 12 May 2022

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০১৮

 

“বললাম, গাড়ি করে যাই-” গজগজিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। দমদম থেকে ট্রেনে উঠেছেন সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দম্পতি, বৃদ্ধর বয়স সম্ভবতঃ আশির দোরগোড়ায়, বৃদ্ধাও সত্তরোত্তীর্ণা। একজনের গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম,অপরের টকটকে ফর্সা। বৃদ্ধা উঠেই হাপরের মত হাঁপাচ্ছেন, হাঁপাচ্ছেন বৃদ্ধও মুখে যদিও দুষ্টু হাসি। রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতে লাগলেন মুখ। 

হাঁপাতে হাঁপাতে বৃদ্ধা আবার শুরু করলেন,“বললাম, গাড়ি ভাড়া করো। ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যাই, তা নয় ট্রেনে চল।” বৃদ্ধ সহাস্যে বললেন,“গাড়ি ভাড়া করলে হাজার টাকার ধাক্কা, তারওপর ছ ঘন্টা কেটে গেলেই শালারা বারো পনেরো যা খুশি চায়। চলো না, ট্রেন চললেই হাওয়া আসবে। নেমে অটোয় চাপাব না, রিক্সা ধরে নেব। ” বৃদ্ধা মুখ ঝামটা দিলেন। বৃদ্ধ গদগদ সুরে বলতে লাগলেন,“আরে আগে তো ট্রেনেই যাতায়াত করেছি। তোমার বাবা কাকা দাদা যা ছিল সব একএকটা। নামি গুণ্ডা। তাদের ভয়ে ভিড় ট্রেনে চেপে কোন ফাঁকা স্টেশনে নেমে দেখা করতে হত। বাপসঃ। ” এবার সত্যিই কুরুক্ষেত্র লেগে গেল। আমার যদিও প্রচণ্ড মজা লাগছিল, ওণাদের ডেটিং এর গল্প শুনতে। 

বেশ খানিক ঝগড়ার পর নেতিয়ে পড়লেন বৃদ্ধা। এই গরমে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আঁচল প্রান্ত গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এই লাইনে অনেক মধ্যবয়সীই হিজাবের পরিবর্তে শাড়ির আঁচল জড়ান। বৃদ্ধ চটজলদি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে দিলেন।গায়ের চাপা খুলে দিতে অনুরোধ করলেন।  জল খেয়ে খানিক ধাতস্থ হয়ে আবার ঝগড়া। 

বৃদ্ধ রীতিমত গলার শির ফুলিয়ে বৃদ্ধাকে অভিযুক্ত  করতে লাগলেন, বৃদ্ধা নাকি  ঠিকঠাক ওষুধ খান না। বৃদ্ধাও সমান তেজী। বেশ খানিক তর্কের পর ওষুধের হিসেব নিতে বসলেন বৃদ্ধ। কোন ওষুধ কটা পড়ে আছে। গো হারান হেরে গেলেন বৃদ্ধা। 

সাময়িক শান্তি। তারপর বৃদ্ধ শুরু করলেন,“ওদের বাড়িতে যতই বলুক, বুঝলে পেট ভরে খাবো না। ফেরার পথে স্টেশন রোডের ফুচকা।” মহিলা বোধহয় ঝাল নিয়ে কিছু বললেন, বৃদ্ধ বললেন,“তুমি ঝাল ছাড়াই খেয়ো। তেমন হলে শুকনোই খেয়ো। একটা খেয়ো অন্তত। না হলে-”।  বলে এমন অভিমানী ভঙ্গীতে মাথা নত করে বাইরের দিকে তাকালেন, যে বোঝাই গেল গিন্নী ব্যতীত উনি ফুচকায় স্বাদ পাবেন না। বৃদ্ধা ফিসফিস করে কিছু আব্দার করলেন, বৃদ্ধ খুশি হয়ে বললেন,“বেশ। হবে। ফুচকাও হবে, আইসক্রীম ও হবে। তুমি গায়ের চাপাটা এবার খোলো। সিদ্ধ হয়ে মরবে।  কেউ কিচ্ছু বলবে না। আরেঃ আমি বলছি,”।  ট্রেন বেশ ফাঁকা, বৃদ্ধা এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ভীরে মাথা এবং গা থেকে আঁচল সরিয়ে জড়সড় হয়ে লাজুক নবোঢ়া বধূর মত স্বামীর গায়ে গা লাগিয়ে বসলেন। চমকে গেলাম, বৃদ্ধার মাথা ভর্তি চকচকে টাক। দুহাতে অজস্র সূঁচ ফোটানোর  কালো দাগ। কেমো চলছে অথবা কেমো হয়েছে। বৃদ্ধ মজা করে বলে চলেছেন,“আমার বউ টেকো হতে পারে তাই বলে কি কম সুন্দর নাকি-”। বৃদ্ধা মুখ বেঁকিয়ে বোধহয় বললেন মরণ। চোখের কোণটা এত কড়কড় করছে কি বলব, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। দিন কয়েক আগে বোধহয় আমিও ভাবছিলাম এ শহর বিস্মৃত হয়েছে প্রেম। আজ এদের দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই, ফুল ফুটুক না ফুটুক আমার শহরে বিরাজমান  চিরবসন্ত।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২২

 



আর পারছি না গুরু, সেই সকাল সাতটা থেকে শুরু। এত বছর তো নিজে পড়াশোনা করলাম। তারপর আবার চাকরীর জন্য পড়তে হল। চাকরী পেয়েও পড়তে বসলাম, আপদ ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য। নাহলে নাকি চাকরী পাকা হবে না। তারপর কয়েকটা বছর একটু শান্তিতে কাটল বটে, অতঃপর আবার শুরু করতে হল, ‘অ লেখ রে ভাই, দাগে, দাগে।’ আবার ভর্তি হতে হল স্কুলে। আবার পড়ে গেলাম সেই ষাণ্মাসিক আর বার্ষিক পরীক্ষার চক্করে।  কেন, কেন এবং কেন আমাকে দুবার করে পড়তে হবে? আমি আর পড়তে বসতে রাজি নই। যাঁর উদ্দেশ্য করে বলা, তিনি অনন্তকাল ধরে এক কাপ আদা মধুর জল নিয়ে বসে আছেন। একটু আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন তিনি বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ গড়ে তুলবেন। ওণার দাবী, ‘যতই গ্রীষ্ম- বর্ষা-শীত-বসন্ত আসুক ক্লাস হোক কেবল অফ লাইন, আর পরীক্ষা হোক অনলাইন।’ 


মামার বাড়ির আব্দার মাইরি। শ্রীমতী তুত্তুরীর বক্তব্য হল, অফলাইন ক্লাশ হলে কেমন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, ভাবের আদানপ্রদান চলে। অনলাইন ক্লাশ হলে তো কেবল স্যার একাই বকে যান। এতই যদি অফলাইন ক্লাশ পছন্দ, তাহলে পরীক্ষা অনলাইনে চাইছিস কেন? ‘ অনেক দিন দিইনি। জানি না আর পারব কিনা’। উদাস দার্শনিক ভাবে জবাব দেয় তুত্তুরী। অতঃপর একখান রাম কানমলা এবং যাবতীয় বৈপ্লবিক চিন্তা ভাবনা জানলা গলে পগার পার। 


 সকাল সাড়ে সাতটা। সক্কাল সক্কাল আজকাল বাবাকে ফোনটা করেনি। সারাদিন আমি সকল কাজের পাই যে সময়, সময় হয় না শুধু বুড়ো নিঃসঙ্গ বাপটাকে ফোন করার। বাবা সেদিন দুঃখ করে বলেই ফেলল, ‘বুড়ো হয়েছি তো। একটু বেশি বকি। আর আমার তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই,যে আমার বকবক সহ্য করবে। তুত্তুরীটাও আজকাল কেমন যেন বড় হয়ে যাচ্ছে। ওর মতের বিরুদ্ধে কিছু বললেই, বলে, “আচ্ছা দাদু, এখন রাখছি। হোমওয়ার্ক করতে হবে।“’ 


তা বলে বটে, শ্রীমতী তুত্তুরীর মতের বিরুদ্ধে গেলেই তিনি আজকাল ভয়ানক বিরক্ত হন। বাবা তো শুধু ফোনে শুনে আহত হয়, আমি তো নিত্য দেখতে পাই, তাঁর অভিব্যক্তি গুলো। আমার সব কথাই তাঁর আজকাল করলার রস গেলার মত লাগে। তুত্তুরীর প্রিয়তম ব্যক্তি হলেন তাঁর বাবা। কারণ শ্রীমতী তুত্তুরী উচ্ছন্নে গেলেও তিনি কিছুই বলেন না। উল্টে বলেন,“সবাইকে যে মানুষই হতে হবে কোথায় লেখা আছে? দু চারটে তো গেছো বাঁদর হবেই।” 


সবে আটটা বাজছে, এরই মধ্যে রোদে পুড়ে যাচ্ছে চরাচর। মুঠো ফোন বলছে বাইরের তাপমাত্রা ৩২ মাত্র, যদিও ‘রিয়েল ফিল’ ৩৮মত। এত রোদেও গাছে জল দিয়েই যাচ্ছে বাগানে কাজ করতে আসা মাসির দল। দিন কয়েক আগে অমনি তুত্তুরীকে স্কুল থেকে বাড়িতে নামাতে গিয়ে দেখি, বিকাল সোয়া চারটের তুখোড় রোদে চলছে গাছে জল দেওয়া। মাথার ওপর দেদীপ্যমান দিনমণি,মাটি থেকে উঠছে তাপ, প্রায় ফুটছে ট্যাঙ্কের জল, সেই জলে স্নান করানো হচ্ছে আমার সাধের জিনিয়া, কশমস আর নয়নতারাদের। এরপরই ঢ্যাঁড়স,ঝিঙে,শসা,কুমড়ো, টমেটো আর বেগুন গাছের পালা। 


সিকিউরিটি ছেলেটা বিরস বদনে পর্যবেক্ষণ করছে, তাকে ডেকে বললাম,‘শিগ্গির নিষেধ করো রে বাবা।’  তিতকুটে স্বরে জবাব এল, ‘আর বলবেননি ম্যাডাম। বললেও শুনতেছে না। খালি বলতেছে, তুমি চুপ করছু। ম্যাডামকে বলা আছে। ম্যাডাম সব জানতেছেন।’ এতো মহাজ্বালা। কারো সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললেই, সে আমার নামে সব চালিয়ে দেয় হেথায়। আরেঃ আমি শহুরে ভূত হতে পারি, গাছপালা তেমন নাও চিনতে পারি, তাই বলে এটুকু তো জানি যে এই তুখোড় রোদে গাছে জল দিলে গাছ ধড়ফড় করে মরে যায়। সেযাত্রা আমার অনুরোধ আর সিকিউরিটি ছেলেটির হম্বিতম্বিতে দুপুর বেলা জল দেওয়া বন্ধ হলেও চালু হয়েছে সকাল বেলা। অগত্যা বলতেই হয়,‘ও দিদিরা আর জল দিবেননি গো। আপনাদেরই হাতে লাগানো গাছ, সব মরে যাবে এবার।’ 


সকাল সাড়ে আটটা, স্নান করতে যাবেন শ্রীমতী তুত্তুরী। তার আগে মাথায় তেল মাখবেন জবজবে করে। তবে সেই তেল মাখানোর গুরুদায়িত্বটি মোটেই মায়ের উপর ছাড়তে তিনি নারাজ। মা যে ঘোরতর নারকেল তেলের পন্থী। নারকেল তেলের শিশি হাতে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভীষণ মিস করি ১৭ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী এক বৃদ্ধাকে। নারকেল তেলের মর্ম যদি ঠাকুমা বেঁচে থাকতে থাকতে বুঝতে পারতাম-। 


বেলা সাড়ে দশটা, ‘তুমি কিন্তু আজ বাড়িতে খেতে আসবে।’ যাকে উদ্দশ্য করে বলা তিনি নীচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছেন। ‘হ্যাঁ তা আসাই যায়।’ এটাই নৈমিত্তিক দায়সারা জবাব। তুত্তুরীর স্কুল থাকলে টিফিন নিয়েই যাই আমি, আর ছুটি থাকলে বেলা তিনটে নাগাদ খেতে আসি। শৌভিক কোনদিন আসে না। টিফিনে কি খায়? কোনদিন মুড়ি চিবোয়, কোনদিন বা গোলাপীর মাখন পাঁউরুটি আর ডিমের অমলেট। কে যেন কিছুদিন আগেই গল্প করছিল,গোলাপীর ঘুঘনিতে পোকা আর ডিমে আরশোলার বাচ্ছা পেয়েছে। সে গল্প বড় মুখ করে শৌভিকই শুনিয়েছে আমায়। তাও গোলাপী প্রীতি ছাড়তে পারে না। প্রসঙ্গতঃ গোলাপী নামটা মহিলাসুলভ হলেও, তিনি আদতে পুরুষ। 


আরে ভাই,মুড়িই যদি খাবি,তো বাড়িতে এসে খা। মাখন পাঁউরুটিও কি বাড়িতে জোটে না তোর? সপরিবারে থাকিস, তাও খামোকা গোলাপের পাউরুটি চিবোস কেন? যাঁর উদ্দেশ্য বলা, ততোক্ষণে গড়িয়ে গেছে তাঁর গাড়ির চাকা। চিৎকার করে বলি,‘ আমি ফোন করব, পৌনে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বি অফিস থেকে।’  


পৌনে এগারোটা, কে বলবে তুফান আসছে, কি বিকট গরম। গাড়ি থেকে নেমে লিফট অবধি পৌঁছাতেই ঘেমে গেলাম। লিফটের দরজা আটকে দুই মহিলা আর এক পুরুষ। কি করছে রে ভাই? উঠছেও না, উঠতে দিচ্ছেও না। গলায় একরাশ কেজো বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘সরুন। সরুন। অযথা গেট আটকে রাখবেন না।’


 ‘এই তো, এই দিদি  যাচ্ছেন, এণার সাথে চলে যাও', বলে ওঠে ছেলেটা। দুই গ্রাম্য ভদ্রমহিলা, দম দেওয়া পুতুলের মত নড়তে নড়তে লিফটে উঠলেন। নিজের তলার বোতাম টিপে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, বললেন আমার ওপরের তলায় যাবেন। বোতাম টিপে দিলাম। দরজা বন্ধ হল, লিফট উঠতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ভদ্রমহিলা আমায় জড়িয়ে ধরলেন। হতবাক হয়ে জানতে চাইলাম,‘ কি হয়েছে?’ সরল, গ্রাম্য ভঙ্গিমায় বললেন,‘খুব ভয় করছে। আগে চড়ছি না তো।’ পাশের মহিলা দেখলাম ওণাকে চেপে ধরেছেন। তিনিও বেশ ভীত। আশ্বস্ত করলাম, ভয়ের কিছু নেই। তবু যুগলে বললেন,‘তোমায় একটা কথা বলব, আমাদের একটু নামিয়ে দিয়ে আসবে?’ এত সরল, অকপট অনুরোধ কি ফেলা যায়? চলুন আপনাদের জন্য একতলা বেশিই উঠি না হয় আজ। 


বেলা দুটো, অফিসের রাবার গাছটা আজ মরে গেল। এই আপিসে কি আছে কে জানে, এত বড় বড় জানলা, এত রোদ আলো ঢোকে, তবু গাছ বাঁচে না। এই নিয়ে তিন চারটে গাছ মরে গেল। ফাঁকা টব গুলো পড়ে থাকে ভূতের মত। এখানেও যদি মাম্পির মত কেউ থাকত-। এত বকুনি খেত, তাও সুযোগ পেলেই একাধিক ব্যাগ ভর্তি করে নদীর পলি মাটি, বালি, শতেক রকমের গাছের চারা, মাটি কোপানোর খুরপি ইত্যাদি নিয়ে হাজির হত চুঁচুড়ার আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে। তমলুকেও একবার এসো না মাম্পি, প্লিজ। দূরত্ব অনেকটা মানছি, গরমটাও মাত্রা ছাড়া, বর্ষা নামলেই না হয় এসো, তোমার বাড়ির গাছ গুলো যত বাচ্ছা দেবে, সবকটা আমার চাই। পাগলি মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ে ফোনের ওপারে। ‘আমি সত্যিই যাব ম্যাডাম। সদ্য পক্স থেকে উঠিছি তো, একটু শরীরটা সারতে দিন, প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে চলে যাব। আপনার আপিস পুরো গাছে ভরে দেব আমরা।’ আকাশকুসুম পরিকল্পনা করি দুজনে। জানি বাস্তবায়ন অসম্ভব। 


বেলা তিনটে, কি রে খেতে আসবি? ওপাশ থেকে ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাস। নাঃ তোরা খেয়ে নে। এভাবে কাজ ফেলে যেতে পারব না। ধুত্তোরি বলে ফোন রাখতে রাখতে থমকে দাঁড়াই, হয়তো আমাকে খুশি করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সনির্বন্ধ অনুরোধ, ‘আজ রাতে একটু চিকেন করবি?’  রাতেই তো করি, সকালে সময় পাই কোথা? 


বিকাল সাড়ে পাঁচটা, অপিসের গাড়িটা সবে এসে থেমেছে গাড়ি বারন্দার নীচে, কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন শ্রীমতী তু্ত্তুরী, ‘এই মা,একটা কেলো হয়েছে।’ কি হল আবার? তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে যার দিকে তাকিয়ে আছি, তিনি ভয়ে নীরবতার আশ্রয় নিয়েছে। মাসি পাশ থেকে জানান, পায়ে পেরেক ফুটেছে শ্রীমতী তুত্তুরীর। কি ভাবে নিজের হাতে ফুটে যাওয়া নাছোড়বান্দা  পেরেকটাকে টেনে বার করেছে তুত্তুরী সেই বীরগাথা শুনতে শুনতে তাকে টিটেনাস দিইয়ে আনি। আগামী এক ঘন্টা যে তিনি জনে জনে ফোন করে তাঁর বীরবত্তার গল্প শোনাবেন, তা বেশ বুঝতে পারি। উত্তম কুমার বলে, ' ম্যাডাম দুটো ব্যথার ট্যাবলেট কিনে নিলে পারতেন,ব্যথা হয় যদি।' হোক না, ব্যথা সইতেও তো শিখতে হবে। 


সন্ধ্যা সাড়ে ছটা, সাধারণ চিকেন রাঁধতে একদম ইচ্ছে করছে না। ভীষণ ভীষণ রেজালা রাঁধতে মুঞ্চায়। রাতে আর কি করেছ গো মাসি, ভাত না রুটি? জবাব আসে ভাত। ভাতের সাথে রেজালা, শুনে ঢোঁক গেলে শৌভিক। 'তার থেকে ঝোলই কর। বেশি করে আলু দিয়ে লম্বা ঝোল।কেমন?' রাঁধব তো আমি, তাও নিজের ইচ্ছে মত পারব না?  কোন দিন এবাড়িতে যদি আমার মর্জিমাফিক কিছু হয়। 


রাত সাড়ে সাতটা- আমার বাংলা পড়ানো শেষ। এবার ইংরেজি বইটা নিয়ে বাপের কাছে যা। করলা গেলা মুখ নিয়ে গেল বটে তুত্তুরী, ফিরে এল গাল ভরা হাসি নিয়ে। বাবা বলেছে, অত পড়তে হবে না। আজ তোর ছুটি। কিসের ছুটি রে? বাবা স্প্যানিশ থ্রিলার দেখবে, তাই নাকি মেয়ের ছুটি। ‘আমি সওওব পড়িয়ে দেব।’ জানি না আমার ভয়েই কিনা, মেয়ের পিছু পিছু দোতলা থেকে নেমে এসে আমাকে আশ্বস্ত করে যায় শৌভিক। কবে? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেক হিসেব টিসেব কষে, কান এঁটো করা হাসি সমেত জবাব আসে, ‘ কাল। না না কাল তো হবে না। তাহলে পরশু। বুঝলি তো বুজু, তুই আর আমি, পরশু সব পড়ে ফেলব-’।


রাত নটা, রান্না প্রায় শেষ, না তেরা না মেরা, মার্কা ঝোল করেছি চিকেনের। টক দই, মরিচ গুঁড়ো, আদা রসুন বাটা আর সাদা তেল দিয়ে ম্যারিনেট করা মাংসকে কষেছি পোস্ত আর কাজু বাদাম বাটা দিয়ে। গুটি কয়েক গোটা শুকনো লঙ্কা ও দিয়েছি ফোড়ন হিসেবে। দিয়েছি অল্প ঘি, গরম মশলা আর সামান্য একটু বেশি মিষ্টি। গোলাপ আর কেওড়ার জল আর মাখানা মেশালেই পুরো রেজালা হয়ে যেত মাইরি। এমনিতেই যা ভুরভুর করে গন্ধ বেরোচ্ছে। সামান্য বেশি কষার জন্য, একটা হালকা হলদেটে রং এসেছে যদিও। সত্যিই রেজালা তো নয়, অত নিখুঁত করার দরকারটাই বা কি? 


পদ্ধতি এক হলেও হিসেব বহির্ভূত কেবল আলুটা। আলু না দিলে গোঁসা হয় যে এদের বাপ মেয়ের। এমনিতেই শ্রীমতী তুত্তুরী উপুড় করে রেখেছেন অনুযোগের ডালি। আমি কেন তার বাবাকে খোঁচালাম, তাই না বাবা বলল, তুত্তুরীকে নিয়ে সব পড়ে ফেলবে বাবা। মুস্কিল হচ্ছে, মোটেই সব পড়তে রাজি নয় তুত্তুরী। বোকা মা যে কেন বোঝে না, পড়াশোনা করতেই আগ্রহী নন তিনি। বিরক্ত হয়ে বলি, ‘লেখাপড়া না শিখলে বড় হয়ে ফুচকা বেচতে হবে যে-’। জবাব আসে, ‘ফুচকাওয়ালা হওয়া তো ভালো। বড় বড় লোকেরা আমার সামনে বাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে।’  হে ঈশ্বর, আমায় তুলে নাও প্রভু। অথবা হে ধরণী তুমি দ্বিধা হও, এই বাপ মেয়ের সংসারে, আমার যে বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই, আমি বেশ বুঝতে পারছি।

Tuesday 10 May 2022

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 

দরিদ্র, অপাংক্তেয় শ্রম দপ্তরের অগোছলো সেকশনের এক কোণে, হঠাৎই একদিন এসে বসলেন তিনি। কি যেন একটা তুফানে কেঁপে ওঠার কথা পূর্ব মেদিনীপুর। আকাশের মুখ ঘোর কৃষ্ণ, মাঝেমাঝেই ছুটে আসছে মাতাল হাওয়া, এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে সাধের তুরস্ক নীলরঙা পর্দা গুলোকে। উড়ে বেড়াচ্ছে যত কুচো আর বাতিল কাগজ। দূরের লোকজনকে আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ছুটির ঘন্টা বাজতে তখনও বেশ খানিক বাকি, ঘন্টা বাজলেই গুটি গুটি রওণা দেব আমরাও। এমন আবহাওয়ায় রুদ্ধ চেম্বারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতে পারি না আমি, ভালো লাগে ঘুরে বেড়াতে, প্রতিটা জানলায় দাঁড়িয়ে দেখতে, কতটা অন্যরকম লাগে মেঘলা আকাশ, বিদ্যুতের ঝলক আর দামাল হাওয়াকে। 


তেমনি পায়চারির ফাঁকে আচমকাই তাঁর সাথে দৃষ্টি বিনিময়। উড়ন্ত অবাধ্য কেশগুচ্ছকে দ্রুত শাসন করে উল্লাস না চাপতে পারা চপল স্বরে জানতে চাইলাম, এণাকে কোথায় পেলে? চঞ্চল,শান্তনু আর শুভাশিস ততোধিক উল্লসিত স্বরে জানাল, ‘ছিলেন তো ম্যাডাম। আমাদের পুরাণ অফিসেও শোভা পেতেন।এখানেও এসেছিলেন, আমাদের সাথে, তারপর কোথায় যে বস্তাবন্দি হয়ে লুকিয়ে বসেছিলেন। অতি কষ্টে, অনেক ধুলো ঘেঁটে খুঁজে বার করা হয়েছে, বৃদ্ধকে।’ 


সেই থেকে আমাদের অকিঞ্চিৎকর সেকশনের মাঝেই আসন পাতা তাঁর। নীরবে প্রত্যক্ষ করেন আমাদের কার্যকলাপ। দুরন্ত হাওয়ায় মাঝেমধ্যে হেলে দুলে যান বটে,  দুয়েক দিন ছাড়া,ছাড়াই সাফ ডাস্টার দিয়ে সাফ সুতরো করে দেওয়া হয় তাঁকে। দিন দিন আরো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন আমাদের ঘরের রবি। 


সপ্তাহ পেরোলেই 'আমাদের ঘরের রবি'র জন্মদিন। তো এ হেন রবি বাবুকে কি আমরা একটা মালাও পরাব না? 


শুক্রবার এমনিতেই ভিড় বেশি হয় এই অফিসে, পাশবই রিনিউ করতে, পেনশনের আবেদন নিবেদন করতে জমায়েত হন, একরাশ পরিবহন শ্রমিক, আসেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতারাও। সকলের ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। সদ্য কাজে যোগ দেওয়া বেবি ইন্সপেক্টর দ্বয়কে আজ বসানো হয়েছে জনতার দরবারে। ক্ষণিকের জন্য সবাইকে ডেকে প্রস্তাব রাখলাম, ঘরের রবির জন্মদিন পালনের। আর কিছু না পারি, সামান্য একটা পুষ্প হার, দুয়েক কলি তাঁর গান বা কবিতা, শুভদীপ্তর কন্যার একটা নাচ, আর সবার শেষে জনগণমন, এই আর কি। বাহুল্য নয়, শুধুখানিক আন্তরিকতা আর অনেকটা ভালোবাসা। 


মুস্কিল হল, এই তাপপ্রবাহ দীর্ণ খর দুপুরে এই আপিস পাড়ায় মালা কোথায় পাব? পৌনে চারটে নাগাদ স্কুল ছুটি হয় তুত্তুরীর, ভাবলাম ওকে নিয়ে ফেরার পথে কিনে আনব খন। শুভাশিস বলল, ‘ আপনারা যে রাস্তা দিয়ে ফেরেন, ঐ রাস্তায় পাবেননি ম্যাডাম। আপনাকে বর্গভীমা মন্দিরের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতে হবে।’ বর্গভীমা মন্দিরের সমনের রাস্তাটা বড়ই সঙ্কীর্ণ আর তেমনি যানবাহনপূর্ণ। ওদিকে যেতে হবে বললেই গজগজ করে আমাদের উত্তমকুমার। ‘সকাল থেকে বলতে পারলনি শুভাশিস দা। এখন মালা কোথায় পাবেন?’ এতবড় শহর, একছড়া মালা পাব না? ‘আহাঃ পাবেননি কেন,কিন্তু এই গরমে কোন ফুলওয়ালা আপনার জন্য বসে থাকবে বলুন দিকি।’ তাও বটে, তবুও কপাল ঠুকে রওণা দিলাম আমরা। দুই বেবি ইন্সপেক্টরকে বলে গেলাম, সবার নাম টুকতে। হয় গান গাইতে হবে, নয়তো আবৃত্তি করতে হবে। কিছুতো করতেই হবে,মুখ খুলতেই হবে ঘরের রবির খাতিরে। 


ভারি ব্যাগ সমেত তুত্তুরীকে গাড়িতে তুলে প্রায় অর্ধেক শহর পরিক্রমা করে ফেললাম আমরা, মনের মত মালা কোথায় পাই? মন্দিরের সামনে ঝোলানো আধশুকনো জবার মালাগুলো দেখে গাড়ি থামালই না উত্তম। শেষে এক কাঠের পোলের পাশে অর্ধেক ঝাঁপ বন্ধ দোকান থেকে দেড় গুণ মূল্যে পাওয়া গেল তাঁর মালা। প্রবল কাশির দমকে অস্থির, ক্লান্ত তুত্তুরীকে বাড়িতে নামিয়ে যখন আপিসে পৌঁছালাম, ততোক্ষণে নতুন করে পাতা হয়েছে 'আমাদের ঘরের রবি'র আসন। হাতল ছাড়া চেয়ারের ওপর তকতকে সাদা তোয়ালে পেতে বসেছেন তিনি। আপিসের সব থেকে সেরা গাছ গুলো দিয়ে ঘিরে রচিত হয়েছে তাঁর নিজস্ব শান্তিনিকেতন। কাগজের কাপে মাটি দিয়ে পোঁতা হয়েছে গোছা গোছা ধুপ। 


আপিস জুড়ে বইছে তপ্ত আবেগের  বাতাস। গান আবৃত্তি নয়, ছোট্ট করে বক্তব্য রাখবে শান্তনু আর শুভাশিস, কবিতা পড়বে চঞ্চল, পেনশন আর রিনিউয়ালে ফাইল গুছোতে গুছোতে গুণ গুণ করে আবৃত্তি অভ্যেস করছে নন্দন বাবু।  মোবাইল থেকে গুগল খুলে, কি সব গান টুকছেন জহর বাবু। নিজের চেম্বারে সেঁদিয়ে যেতে যেতে বললাম, ' আজ কিন্তু এ আমার গুরু দক্ষিণা গাইবেন না কেমন?' জিভ কেটে জহর বাবু দেখিয়ে গেলেন, উনি 'একলা চলো রে' টুকছিলেন। 


 জানলার বাইরে ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যে, একে একে জ্বলে উঠছে নিমতৌড়ির হলদেটে নিয়ন আলো গুলো। সপ্তাহান্তিক  ছুটির মেজাজে খালি হয়ে যাচ্ছে অন্যান্য আপিস গুলো, আর আমরা তৈরি হচ্ছি ঘরের রবির জন্মদিন পালনে। ফাইল পত্র গুটিয়ে, কম্পিউটার গুলো বন্ধ করে জড় হচ্ছি তাঁকে ঘিরে। ভিজে রজনীগন্ধার মালা থেকে বেরোচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি ফুলেল সৌরভ। শান্তনু বলল,‘ম্যাডাম আপনি পরিয়ে দিন।’ ভেবেছিলাম তুত্তুরী বা তিথির হাত দিয়ে মালা পরাব তাঁকে, একজন জ্বরগ্রস্ত, আরেকজন তখনও এসে পৌঁছায়নি। বড্ড ছোট যে, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে,মুখ হাত ধুয়ে তবে না নাচতে আসবে। এই প্রবল দাবদাহে তিনি যে আদৌ আসতে রাজি হয়ছেন, তাতেই ধন্য আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, তাম্রলিপ্ত। 


অগত্যা শান্তনুকে বললাম, তুমিই পরাও। থোড়াই পদ মর্যাদা দেখবেন রবি বাবু, রবির আলোকে তো সবাই সমান, ‘হে মহান, নেমে এসে তুমি যারে করেছ গ্রহণ,সৌন্দর্যের অর্ঘ্য তার তোমা-পানে করুক বহন।’ 


নতুন ইন্সপেক্টর দ্বয়ের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল,সবাইকে দিয়ে গান আর আবৃত্তি করানো। দেখলাম লম্বা তালিকা প্রস্তুত। প্রাথমিক জড়তা, কাটিয়ে, দপ্তরী পদমর্যাদা তথা সংকোচ ভুলে সবাই খোলা মনে উজাড় করে দিল, শ্রদ্ধার ডালি নিয়ে। নিজেদের মধ্যে যে এত প্রতিভা লুকিয়ে আছে কেউ কি জানত, সবই যে তাঁর মহিমা। বাঙালির প্রাণের ঠাকুর কি সাধে কয়।