Saturday, 4 June 2022

অনির ডাইরি ২৪শে মে, ২০২২

 



বিয়েটা সপ্তাহান্তে করলেও, বিবাহবার্ষিকীটা কেন যে ঘুরে ফিরে সেই কাজের দিনেই পড়ে-। এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রথম বিবাহবার্ষিকীর উন্মাদনা ত্রয়োদশ বরষে থাকে না। আর আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীটাও যা কেটেছিল, আহাঃ-। স্বপাকে বানানো ডাল- ভাত, বেগুন ভাজা আর ডিমের ঝোল খেয়ে দিব্যি ক্ষুদিরাম হয়ে আপিস গিয়েছিলাম দোঁহে। বেলা আড়াইটে নাগাদ, শৌভিক ফোন করে বলেছিল, ‘ধুৎ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কোথাও ঘুরতে যাবি?’


 অতঃপর খড়্গপুর ২নং ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের সাদা অ্যাম্বাসাডরে চেপে, ধূধূ ফাঁকা রাস্তা বরাবর হারিয়ে যাওয়া। নামানো কাঁচের ফাঁক দিয়ে ছুটে আসছিল দম বন্ধ করা হুহু হাওয়া। দুপাশে যতদূর দুচোখ যায়, আঁকাবাঁকা লাল মোরাম বিছানো নিঃসঙ্গ পথ আর নয়ানজুলি, নিরিবিলি ঝাউ আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। মাঝে মাঝে উচ্চাবচ কালভার্টে ঝাঁকুনি খাচ্ছিল গাড়িটা। গন্তব্য ছিল গড়বেতা স্থিত তৎকালীন মেদিনীপুরের সবথেকে বড় এবং জনপ্রিয় পার্ক, নাম ঝিলমিল নাকি নির্মলকানন। জঙ্গলমহল তখন আক্ষরিক অর্থেই মুক্তাঞ্চল, তারই মধ্যে স্থানীয় কপোতকপোতীদের প্রিয়তম তথা রোমান্টিকতম ডেসটিনেশন। তাই বলে সেন্ট্রাল পার্ক সুলভ কিছু ভেবে টেবে বসবেননি আবার। আসলে ড্রাইভার শৈবালদাকে বলা হয়েছিল, নব দম্পতির বিবাহবার্ষিকী পালনের জন্য একটা জম্পেশ জায়গায় নিয়ে যেতে। উনিও তাই মাথা খাটিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ পৌঁছে আর কিছুতেই নামতে চায়নি  শৌভিক। বেচারা হতভম্ব শৈবাল দার মুখের অবস্থা ছিল দেখার মত। এমন সুন্দর পার্ক ও শেষে সাহেবের নাপসন্দ? এ ব্যাটারা চায় কি?  

 

নাঃ তেমন কিছুই চাই না আমরা, একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা, একটু বেশি উদরপূর্তি, কাছে পিঠে কোথাও ঘুরে আসা আর একরাশ স্মৃতি রোমন্থন,ব্যাস,এই তো -- "একটু খানি চাওয়া আর একটু খানি পাওয়া, এই আবেশেই হোক না মধুর আমার এ গান গাওয়া।’


  পিছন ফিরে তাকালে কম পথ তো হাঁটিনি মোরা এক সাথে-। সেই যে মাদপুরে আমাদের ছোট্ট সংসার। আপিস থেকে কোয়ার্টারে ফিরেই ফোন করতাম,‘ আমি কিন্তু এসে গেছি।’ অমনি ডাক ফাইল বগলে বাড়ি চলে আসত শৌভিক।কোয়ার্টারেই আনিয়ে নিত বাকি ফাইলপত্র। ডাইনিং টেবলে বসে ফাইল সই করত একজন, অপরজন কাটতে বসত সব্জিপাতি। একবার আমার পটল ভাজার তপ্ত কড়াইয়ে পড়ে ভাজা হয়ে গিয়েছিল একটা মথ। আমি তো ভয়ে ঘেন্নায় কেঁদেই আকুল। ফাইল ফেলে ঝাঁজরি হাতা দিয়ে তেলে ভাজা মথ তুলতে দৌড়েছিল শৌভিক। 


আর সেই সপ্তাহান্তে খড়্গপুরের সেই ঝিমুনি ধরা সন্ধ্যাগুলো যখন একলা অন্ধকার গাড়িতে বসে মশার কামড় খেতাম শুধুই তার প্রতীক্ষায়। অনেক অঙ্ক টঙ্ক কষে, ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঢুকতাম আমরা খড়্গপুরের মহকুমা শাসকের দপ্তরে। পরিকল্পনা থাকত যে দুটো আপাত গুরুগম্ভীর ফাইল নিয়ে শৌভিক ঢুকবে বড় সাহেবের চেম্বারে, চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকব আমি। তারপর সুযোগ বুঝে বাড়ি ফেরার কথাটা পাড়বে শৌভিক। ফিরিস্তি দেবে শেষ কবে বাড়ি ফিরেছিলাম দোঁহে। সামনাসামনি অনুরোধ করলে নির্ঘাত না বলতে পারবেন না বড় সাহেব। আর বললে, আবার ফিরে গিয়ে ভাত চাপাব আমরা। 


খড়গপুর থেকে হাওড়া, তাও গাড়ি করে আসার সাহস ছিল না আমাদের। গাড়ি যেত কেবল মাদপুর থেকে খড়্গপুর স্টেশন অবধি। তারপর ট্রেন, তারপর রিক্সা। 


তৃষিতের মত মহকুমা শাসকের চেম্বারের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তার প্রতীক্ষায়। গাড়িতে লাগানো ছিল একটা পুঁচকে ফ্যান, তবে তা চলত কেবল যখন গাড়ি দৌড়ত। গাড়ি বন্ধ তো তিনিও নিদ্রিত। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ত মশার পাল।  আজকের তুলনায় নেহাৎ সস্তার নোকিয়া ফোন, মাত্র এক জিবির মেমারি কার্ড। তাতে সম্বল বলতে সাকুল্যে গুটি বিশেক গান। অন্ধকারে মশা মারার ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফাঁকেফোকরে তাই বসে বসে শুনতাম, বার বার। 


সাড়ে ছটা নাগাদ হাসি মুখে বেরিয়ে আসত শৌভিক। অতঃপর ভিড়ে ঠাসা ইস্পাত বা ধৌলি। আরেকটু রাত হলে রূপসী বাংলা। ইস্পাত বা ধৌলিতে বসার জায়গা পাওয়া ছিল নিছক কষ্টকল্পনা। দরজার কাছে জড়সড় হয়ে দাঁড়াতাম দোঁহে। এই ভাবেই কবে যেন দুই থেকে আড়াই হয়ে গেলাম আমরা। 


খড়্গপুরের পর ট্রেন থামত সাঁতরাগাছি, আমরাও তো ওখানেই নামব, ফলে সিট পাবার প্রশ্ন উঠত না। ধেড়ে তুত্তুরীকে উদরে নিয়ে,একে অপরের হাত ধরে ভালোয় ভালোয় নামতে পারলেই বাঁচতাম দুজনে। তারপর সাঁতরাগাছি স্টেশনে মাটির ভাঁড়ে চা আর কেক খেয়ে পরের লোকাল ধরে দাশনগর। অতঃপর রিক্সা। ভাড়া এমনিতে কুড়ি হলেও, রাত বাড়লেই হয়ে যেত পঁচিশ।  


 জন্মের পর, সারা দিন ঘুমাত, সারা রাত জাগত তুত্তুরী। সে যে কি অসহনীয় যাতনা। অন্য দিন গুলো একসাথেই রাত জাগতাম তুত্তুরী, মা আর আমি।  সপ্তাহান্তে একটা রাতের জন্য বাড়ি ফিরত শৌভিক, সেই রাত গুলোয় মাকে রেস্ট দিয়ে তিনজনে মিলে রাত জাগতাম আমরা। অরকুটে একটা ছবি ছিল, যার ক্যাপশনই ছিল, ‘উই থ্রি, অ্যাট থ্রি।’ রাত তিনটেয়, মোরা তিনজন। 


মাঝে মাঝে আর সহ্য হত না এই রাত জাগার অত্যাচার, প্রচণ্ড বকতাম ছোট্ট তুত্তুরীকে। ঠোঁট ফোলাত তার বাবা ,‘ ও কিন্তু খুব অসহায়। আমরা ছাড়া ওর কেউ নেই-’। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুলি ফুটল তুত্তুরীর, শৌভিক বাড়ি ফিরলেই, ভেসে আসত আধো আধো বুলি ‘বাবা এলি? একবার এলি, দুবার এলি? কফি খাবি?’ 


 কবে যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিল মেয়েটা, কবে যে আলাদা দল গড়ে ফেলল বাপ-মেয়েতে আমি বুঝতেই পারলাম না।  একজনকে বকলে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে আসে আরেকজন। গাড়িতে উঠলেই বমি করত তুত্তুরী এবং কাকতালীয় ভাবে প্রতিবারই বমি করত শৌভিকের গায়ে। গাড়িতে উঠেই দুহাত বাড়িয়ে বলত,‘ বাবা নেঃ।’ যেই শৌভিক কোলে নিত,অমনি ওয়াক। কয়েক হাজার বার শৌভিকের গায়ে বমি করেছে মেয়েটা, অথচ সেসব কথা কেউ তোলে না এ বাড়িতে। বমির প্রসঙ্গ উঠলেই কেবল দোষী সাব্যস্ত হই আমি। সেই যে সেবার দিল্লী থেকে সিমলা যাবার পথে বমি করেছিলাম আমি, আজও রসিয়ে রসিয়ে সেই চর্চা করে বাপ আর মেয়েতে। গোটা ভলভো বাসের সব বমির প্যাকেট নাকি আমি একাই শেষ করে দিয়েছিলাম। এরকম আরো যে কত অপবাদ দেওয়া হয় আমার নামে। আমার যাবতীয় ইচ্ছে-অনিচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিরুদ্ধাচারণ করাটাই এদের বাপ মেয়ের নৈমিত্তিক কর্তব্য। 


যেমন ধরুন, আজ আমাদের বিয়ের দিন, কোথায় একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠব, আজকেই নাকি গোটা বাড়ির সব বিছানার চাদর আর বালিশের ওয়াড় কাচতে হবে এদের। আজ দুপুরে দীঘায়  মিটিং আছে শৌভিকের, কখন ফিরবে কে জানে? বললাম একটু বেলা করে আপিস যা তাহলে,অথবা আজ আপিস না গেলেও তো হয়? অফিসে নাকি এত ফাইল জমে আছে, যে সময় মত না গেলেই নয়। ভেবেছিলাম ছুটি নেব আজ, সপ্তাহের মাঝে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যাবার আব্দার তো আর করতে পারি না, তাই বাড়িতেই রান্না করব কিছু টুকটাক। আচমকা ঠিক হওয়া দীঘার মিটিংটা দিল সব পণ্ড করে। আড়াইটে থেকে মিটিং, কে জানে কতক্ষণ চলবে। তারপর ফিরতেও আরও ঘন্টা দুই, জ্যামে পড়লে আড়াই-।  গেল এ বছরের বিবাহবার্ষিকী। 


শৌভিক যদিও অনেক সান্ত্বনা দিয়ে গেল, কথা দিয়ে গেল সাড়ে চারটের মধ্যে পাক্কা বেরিয়ে পড়বে সমুদ্র সুন্দরীর গাঁটছড়া খুলে, ওসব নিছক কথার কথা।  মনখারাপ করে ঘুরে এলাম গোটা কয়েক দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প থেকে, আপিসে আজ আর ঢুকলাম না। অন্যান্য বার যাঁরা ফোন করে শুভেচ্ছা জানান, এ বার বোধহয় তাঁদেরও মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে দিনটার কথা। বললেই শৌভিক বলে,‘কেন করবে? কি এমন স্পেশাল আমরা।’ তা বটে, তবুও বিশেষ বিশেষ দিনে আপনজনদের কাছে এই অন্তঃসলিলা দাবীটা আমার থেকেই যায়, বিশেষতঃ যাঁরা এত ভালোবাসেন আমাদের। 


বিকাল সাড়ে চারটে নাগাদ ফোন করল জনৈক বন্ধু,নিছক কাজের ফোন। আগ বাড়িয়ে তাকেই বললাম,‘জানিস আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। এমন দিনে দীঘা  গেছে শৌভিক, আমাদের নিয়ে যায়নি।’ ভেবেছিলাম সমব্যথী হবে, দুটো সান্ত্বনার কথা বলবে। উল্টে সুহৃদ বলল,‘ভালো হয়েছে তোকে নিয়ে যায়নি। গেলেই শালা দুটো ছবি লাগাতিস, আর  আমার বউ আমার মাথা খারাপ করে দিত। তুই রবিবার ক্যাম্পে গিয়েছিলি, তাই নিয়েই আমায় চারটে কথা শোনাল, তুই গেছিস, আমি কেন যাইনি? বললাম অনিন্দিতাও যায়নি, পুরাণ ছবি পোস্ট করছে, তাই নিয়ে কি বাওয়াল।’  সাধে রাষ্ট্র ভাষায় বলে মাইরি, এমন বন্ধু থাকতে, শত্রুর কি প্রয়োজন? এই জন্যই অপদার্থ বন্ধুটির থেকে ওর বউকে আমি বেশি ভালোবাসি। 


বন্ধুর সাথে তরল বাক্য বিনিময়ের মাঝেই, শৌভিকের কল ওয়েটিং, তড়িঘড়ি ফোন কেটে ফোন করলাম। নির্ঘাত বলবে, রাতে খেয়েই ফিরবে আজ। ওদিক থেকে ভেসে এল, আবেগ মথিত বাক্যবাণ,‘হুঁ, বেরিয়ে পড়েছি। রান্না বসিয়েছিস তো?এক কাপ চা ছাড়া কিছুই খাইনি মিটিং এ।’ ঘড়িতে পৌনে পাঁচ। শৌভিকের জলদি বাড়ি ফেরার পুলক ছাপিয়ে উঠে এল একরাশ উৎকণ্ঠা। সর্বনাশ, মনের দুঃখে আমি যে রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট বানাতে বলেছি গো। 


পুনশ্চঃ শেষ পর্যন্ত শৌভিক বাড়ি ফিরেছিল সাড়ে সাতটা নাগাদ। তড়িঘড়ি যা বানাতে পেরেছিলাম -বাপমেয়ের ভয়ানক প্রিয় মেয়োনিজ সহ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কসুরি মেথি গন্ধী মালাই পনির, গোটা মশলা দেওয়া কষা মাংস,লাল-লাল চাপ চাপ পায়েস আর ইয়ে পরোটা। সত্যি বলতে কি, বানাতে তো গিয়েছিলাম লাচ্ছা পরোটা, দ্বিতীয় দফা বেলার পর আর ভাঁজ গুলো খুঁজে পেলাম না। ভয়ানক মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল মাইরি, শৌভিক যদিও বলল, এটাই বেশি ভালো হয়েছে। ও নাকি লাচ্ছা পরোটা দুচক্ষে দেখতে পারে না। সে তো ও আমার সব কিছুকেই ভালো দেখে, তাই ওর কথায় আর কে বিশ্বাস করে?

No comments:

Post a Comment