আর পারছি না গুরু, সেই সকাল সাতটা থেকে শুরু। এত বছর তো নিজে পড়াশোনা করলাম। তারপর আবার চাকরীর জন্য পড়তে হল। চাকরী পেয়েও পড়তে বসলাম, আপদ ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য। নাহলে নাকি চাকরী পাকা হবে না। তারপর কয়েকটা বছর একটু শান্তিতে কাটল বটে, অতঃপর আবার শুরু করতে হল, ‘অ লেখ রে ভাই, দাগে, দাগে।’ আবার ভর্তি হতে হল স্কুলে। আবার পড়ে গেলাম সেই ষাণ্মাসিক আর বার্ষিক পরীক্ষার চক্করে। কেন, কেন এবং কেন আমাকে দুবার করে পড়তে হবে? আমি আর পড়তে বসতে রাজি নই। যাঁর উদ্দেশ্য করে বলা, তিনি অনন্তকাল ধরে এক কাপ আদা মধুর জল নিয়ে বসে আছেন। একটু আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন তিনি বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ গড়ে তুলবেন। ওণার দাবী, ‘যতই গ্রীষ্ম- বর্ষা-শীত-বসন্ত আসুক ক্লাস হোক কেবল অফ লাইন, আর পরীক্ষা হোক অনলাইন।’
মামার বাড়ির আব্দার মাইরি। শ্রীমতী তুত্তুরীর বক্তব্য হল, অফলাইন ক্লাশ হলে কেমন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, ভাবের আদানপ্রদান চলে। অনলাইন ক্লাশ হলে তো কেবল স্যার একাই বকে যান। এতই যদি অফলাইন ক্লাশ পছন্দ, তাহলে পরীক্ষা অনলাইনে চাইছিস কেন? ‘ অনেক দিন দিইনি। জানি না আর পারব কিনা’। উদাস দার্শনিক ভাবে জবাব দেয় তুত্তুরী। অতঃপর একখান রাম কানমলা এবং যাবতীয় বৈপ্লবিক চিন্তা ভাবনা জানলা গলে পগার পার।
সকাল সাড়ে সাতটা। সক্কাল সক্কাল আজকাল বাবাকে ফোনটা করেনি। সারাদিন আমি সকল কাজের পাই যে সময়, সময় হয় না শুধু বুড়ো নিঃসঙ্গ বাপটাকে ফোন করার। বাবা সেদিন দুঃখ করে বলেই ফেলল, ‘বুড়ো হয়েছি তো। একটু বেশি বকি। আর আমার তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই,যে আমার বকবক সহ্য করবে। তুত্তুরীটাও আজকাল কেমন যেন বড় হয়ে যাচ্ছে। ওর মতের বিরুদ্ধে কিছু বললেই, বলে, “আচ্ছা দাদু, এখন রাখছি। হোমওয়ার্ক করতে হবে।“’
তা বলে বটে, শ্রীমতী তুত্তুরীর মতের বিরুদ্ধে গেলেই তিনি আজকাল ভয়ানক বিরক্ত হন। বাবা তো শুধু ফোনে শুনে আহত হয়, আমি তো নিত্য দেখতে পাই, তাঁর অভিব্যক্তি গুলো। আমার সব কথাই তাঁর আজকাল করলার রস গেলার মত লাগে। তুত্তুরীর প্রিয়তম ব্যক্তি হলেন তাঁর বাবা। কারণ শ্রীমতী তুত্তুরী উচ্ছন্নে গেলেও তিনি কিছুই বলেন না। উল্টে বলেন,“সবাইকে যে মানুষই হতে হবে কোথায় লেখা আছে? দু চারটে তো গেছো বাঁদর হবেই।”
সবে আটটা বাজছে, এরই মধ্যে রোদে পুড়ে যাচ্ছে চরাচর। মুঠো ফোন বলছে বাইরের তাপমাত্রা ৩২ মাত্র, যদিও ‘রিয়েল ফিল’ ৩৮মত। এত রোদেও গাছে জল দিয়েই যাচ্ছে বাগানে কাজ করতে আসা মাসির দল। দিন কয়েক আগে অমনি তুত্তুরীকে স্কুল থেকে বাড়িতে নামাতে গিয়ে দেখি, বিকাল সোয়া চারটের তুখোড় রোদে চলছে গাছে জল দেওয়া। মাথার ওপর দেদীপ্যমান দিনমণি,মাটি থেকে উঠছে তাপ, প্রায় ফুটছে ট্যাঙ্কের জল, সেই জলে স্নান করানো হচ্ছে আমার সাধের জিনিয়া, কশমস আর নয়নতারাদের। এরপরই ঢ্যাঁড়স,ঝিঙে,শসা,কুমড়ো, টমেটো আর বেগুন গাছের পালা।
সিকিউরিটি ছেলেটা বিরস বদনে পর্যবেক্ষণ করছে, তাকে ডেকে বললাম,‘শিগ্গির নিষেধ করো রে বাবা।’ তিতকুটে স্বরে জবাব এল, ‘আর বলবেননি ম্যাডাম। বললেও শুনতেছে না। খালি বলতেছে, তুমি চুপ করছু। ম্যাডামকে বলা আছে। ম্যাডাম সব জানতেছেন।’ এতো মহাজ্বালা। কারো সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললেই, সে আমার নামে সব চালিয়ে দেয় হেথায়। আরেঃ আমি শহুরে ভূত হতে পারি, গাছপালা তেমন নাও চিনতে পারি, তাই বলে এটুকু তো জানি যে এই তুখোড় রোদে গাছে জল দিলে গাছ ধড়ফড় করে মরে যায়। সেযাত্রা আমার অনুরোধ আর সিকিউরিটি ছেলেটির হম্বিতম্বিতে দুপুর বেলা জল দেওয়া বন্ধ হলেও চালু হয়েছে সকাল বেলা। অগত্যা বলতেই হয়,‘ও দিদিরা আর জল দিবেননি গো। আপনাদেরই হাতে লাগানো গাছ, সব মরে যাবে এবার।’
সকাল সাড়ে আটটা, স্নান করতে যাবেন শ্রীমতী তুত্তুরী। তার আগে মাথায় তেল মাখবেন জবজবে করে। তবে সেই তেল মাখানোর গুরুদায়িত্বটি মোটেই মায়ের উপর ছাড়তে তিনি নারাজ। মা যে ঘোরতর নারকেল তেলের পন্থী। নারকেল তেলের শিশি হাতে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভীষণ মিস করি ১৭ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী এক বৃদ্ধাকে। নারকেল তেলের মর্ম যদি ঠাকুমা বেঁচে থাকতে থাকতে বুঝতে পারতাম-।
বেলা সাড়ে দশটা, ‘তুমি কিন্তু আজ বাড়িতে খেতে আসবে।’ যাকে উদ্দশ্য করে বলা তিনি নীচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছেন। ‘হ্যাঁ তা আসাই যায়।’ এটাই নৈমিত্তিক দায়সারা জবাব। তুত্তুরীর স্কুল থাকলে টিফিন নিয়েই যাই আমি, আর ছুটি থাকলে বেলা তিনটে নাগাদ খেতে আসি। শৌভিক কোনদিন আসে না। টিফিনে কি খায়? কোনদিন মুড়ি চিবোয়, কোনদিন বা গোলাপীর মাখন পাঁউরুটি আর ডিমের অমলেট। কে যেন কিছুদিন আগেই গল্প করছিল,গোলাপীর ঘুঘনিতে পোকা আর ডিমে আরশোলার বাচ্ছা পেয়েছে। সে গল্প বড় মুখ করে শৌভিকই শুনিয়েছে আমায়। তাও গোলাপী প্রীতি ছাড়তে পারে না। প্রসঙ্গতঃ গোলাপী নামটা মহিলাসুলভ হলেও, তিনি আদতে পুরুষ।
আরে ভাই,মুড়িই যদি খাবি,তো বাড়িতে এসে খা। মাখন পাঁউরুটিও কি বাড়িতে জোটে না তোর? সপরিবারে থাকিস, তাও খামোকা গোলাপের পাউরুটি চিবোস কেন? যাঁর উদ্দেশ্য বলা, ততোক্ষণে গড়িয়ে গেছে তাঁর গাড়ির চাকা। চিৎকার করে বলি,‘ আমি ফোন করব, পৌনে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বি অফিস থেকে।’
পৌনে এগারোটা, কে বলবে তুফান আসছে, কি বিকট গরম। গাড়ি থেকে নেমে লিফট অবধি পৌঁছাতেই ঘেমে গেলাম। লিফটের দরজা আটকে দুই মহিলা আর এক পুরুষ। কি করছে রে ভাই? উঠছেও না, উঠতে দিচ্ছেও না। গলায় একরাশ কেজো বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘সরুন। সরুন। অযথা গেট আটকে রাখবেন না।’
‘এই তো, এই দিদি যাচ্ছেন, এণার সাথে চলে যাও', বলে ওঠে ছেলেটা। দুই গ্রাম্য ভদ্রমহিলা, দম দেওয়া পুতুলের মত নড়তে নড়তে লিফটে উঠলেন। নিজের তলার বোতাম টিপে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, বললেন আমার ওপরের তলায় যাবেন। বোতাম টিপে দিলাম। দরজা বন্ধ হল, লিফট উঠতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ভদ্রমহিলা আমায় জড়িয়ে ধরলেন। হতবাক হয়ে জানতে চাইলাম,‘ কি হয়েছে?’ সরল, গ্রাম্য ভঙ্গিমায় বললেন,‘খুব ভয় করছে। আগে চড়ছি না তো।’ পাশের মহিলা দেখলাম ওণাকে চেপে ধরেছেন। তিনিও বেশ ভীত। আশ্বস্ত করলাম, ভয়ের কিছু নেই। তবু যুগলে বললেন,‘তোমায় একটা কথা বলব, আমাদের একটু নামিয়ে দিয়ে আসবে?’ এত সরল, অকপট অনুরোধ কি ফেলা যায়? চলুন আপনাদের জন্য একতলা বেশিই উঠি না হয় আজ।
বেলা দুটো, অফিসের রাবার গাছটা আজ মরে গেল। এই আপিসে কি আছে কে জানে, এত বড় বড় জানলা, এত রোদ আলো ঢোকে, তবু গাছ বাঁচে না। এই নিয়ে তিন চারটে গাছ মরে গেল। ফাঁকা টব গুলো পড়ে থাকে ভূতের মত। এখানেও যদি মাম্পির মত কেউ থাকত-। এত বকুনি খেত, তাও সুযোগ পেলেই একাধিক ব্যাগ ভর্তি করে নদীর পলি মাটি, বালি, শতেক রকমের গাছের চারা, মাটি কোপানোর খুরপি ইত্যাদি নিয়ে হাজির হত চুঁচুড়ার আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে। তমলুকেও একবার এসো না মাম্পি, প্লিজ। দূরত্ব অনেকটা মানছি, গরমটাও মাত্রা ছাড়া, বর্ষা নামলেই না হয় এসো, তোমার বাড়ির গাছ গুলো যত বাচ্ছা দেবে, সবকটা আমার চাই। পাগলি মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ে ফোনের ওপারে। ‘আমি সত্যিই যাব ম্যাডাম। সদ্য পক্স থেকে উঠিছি তো, একটু শরীরটা সারতে দিন, প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে চলে যাব। আপনার আপিস পুরো গাছে ভরে দেব আমরা।’ আকাশকুসুম পরিকল্পনা করি দুজনে। জানি বাস্তবায়ন অসম্ভব।
বেলা তিনটে, কি রে খেতে আসবি? ওপাশ থেকে ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাস। নাঃ তোরা খেয়ে নে। এভাবে কাজ ফেলে যেতে পারব না। ধুত্তোরি বলে ফোন রাখতে রাখতে থমকে দাঁড়াই, হয়তো আমাকে খুশি করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সনির্বন্ধ অনুরোধ, ‘আজ রাতে একটু চিকেন করবি?’ রাতেই তো করি, সকালে সময় পাই কোথা?
বিকাল সাড়ে পাঁচটা, অপিসের গাড়িটা সবে এসে থেমেছে গাড়ি বারন্দার নীচে, কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন শ্রীমতী তু্ত্তুরী, ‘এই মা,একটা কেলো হয়েছে।’ কি হল আবার? তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে যার দিকে তাকিয়ে আছি, তিনি ভয়ে নীরবতার আশ্রয় নিয়েছে। মাসি পাশ থেকে জানান, পায়ে পেরেক ফুটেছে শ্রীমতী তুত্তুরীর। কি ভাবে নিজের হাতে ফুটে যাওয়া নাছোড়বান্দা পেরেকটাকে টেনে বার করেছে তুত্তুরী সেই বীরগাথা শুনতে শুনতে তাকে টিটেনাস দিইয়ে আনি। আগামী এক ঘন্টা যে তিনি জনে জনে ফোন করে তাঁর বীরবত্তার গল্প শোনাবেন, তা বেশ বুঝতে পারি। উত্তম কুমার বলে, ' ম্যাডাম দুটো ব্যথার ট্যাবলেট কিনে নিলে পারতেন,ব্যথা হয় যদি।' হোক না, ব্যথা সইতেও তো শিখতে হবে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছটা, সাধারণ চিকেন রাঁধতে একদম ইচ্ছে করছে না। ভীষণ ভীষণ রেজালা রাঁধতে মুঞ্চায়। রাতে আর কি করেছ গো মাসি, ভাত না রুটি? জবাব আসে ভাত। ভাতের সাথে রেজালা, শুনে ঢোঁক গেলে শৌভিক। 'তার থেকে ঝোলই কর। বেশি করে আলু দিয়ে লম্বা ঝোল।কেমন?' রাঁধব তো আমি, তাও নিজের ইচ্ছে মত পারব না? কোন দিন এবাড়িতে যদি আমার মর্জিমাফিক কিছু হয়।
রাত সাড়ে সাতটা- আমার বাংলা পড়ানো শেষ। এবার ইংরেজি বইটা নিয়ে বাপের কাছে যা। করলা গেলা মুখ নিয়ে গেল বটে তুত্তুরী, ফিরে এল গাল ভরা হাসি নিয়ে। বাবা বলেছে, অত পড়তে হবে না। আজ তোর ছুটি। কিসের ছুটি রে? বাবা স্প্যানিশ থ্রিলার দেখবে, তাই নাকি মেয়ের ছুটি। ‘আমি সওওব পড়িয়ে দেব।’ জানি না আমার ভয়েই কিনা, মেয়ের পিছু পিছু দোতলা থেকে নেমে এসে আমাকে আশ্বস্ত করে যায় শৌভিক। কবে? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেক হিসেব টিসেব কষে, কান এঁটো করা হাসি সমেত জবাব আসে, ‘ কাল। না না কাল তো হবে না। তাহলে পরশু। বুঝলি তো বুজু, তুই আর আমি, পরশু সব পড়ে ফেলব-’।
রাত নটা, রান্না প্রায় শেষ, না তেরা না মেরা, মার্কা ঝোল করেছি চিকেনের। টক দই, মরিচ গুঁড়ো, আদা রসুন বাটা আর সাদা তেল দিয়ে ম্যারিনেট করা মাংসকে কষেছি পোস্ত আর কাজু বাদাম বাটা দিয়ে। গুটি কয়েক গোটা শুকনো লঙ্কা ও দিয়েছি ফোড়ন হিসেবে। দিয়েছি অল্প ঘি, গরম মশলা আর সামান্য একটু বেশি মিষ্টি। গোলাপ আর কেওড়ার জল আর মাখানা মেশালেই পুরো রেজালা হয়ে যেত মাইরি। এমনিতেই যা ভুরভুর করে গন্ধ বেরোচ্ছে। সামান্য বেশি কষার জন্য, একটা হালকা হলদেটে রং এসেছে যদিও। সত্যিই রেজালা তো নয়, অত নিখুঁত করার দরকারটাই বা কি?
পদ্ধতি এক হলেও হিসেব বহির্ভূত কেবল আলুটা। আলু না দিলে গোঁসা হয় যে এদের বাপ মেয়ের। এমনিতেই শ্রীমতী তুত্তুরী উপুড় করে রেখেছেন অনুযোগের ডালি। আমি কেন তার বাবাকে খোঁচালাম, তাই না বাবা বলল, তুত্তুরীকে নিয়ে সব পড়ে ফেলবে বাবা। মুস্কিল হচ্ছে, মোটেই সব পড়তে রাজি নয় তুত্তুরী। বোকা মা যে কেন বোঝে না, পড়াশোনা করতেই আগ্রহী নন তিনি। বিরক্ত হয়ে বলি, ‘লেখাপড়া না শিখলে বড় হয়ে ফুচকা বেচতে হবে যে-’। জবাব আসে, ‘ফুচকাওয়ালা হওয়া তো ভালো। বড় বড় লোকেরা আমার সামনে বাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে।’ হে ঈশ্বর, আমায় তুলে নাও প্রভু। অথবা হে ধরণী তুমি দ্বিধা হও, এই বাপ মেয়ের সংসারে, আমার যে বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই, আমি বেশ বুঝতে পারছি।
No comments:
Post a Comment