Tuesday, 10 May 2022

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 

দরিদ্র, অপাংক্তেয় শ্রম দপ্তরের অগোছলো সেকশনের এক কোণে, হঠাৎই একদিন এসে বসলেন তিনি। কি যেন একটা তুফানে কেঁপে ওঠার কথা পূর্ব মেদিনীপুর। আকাশের মুখ ঘোর কৃষ্ণ, মাঝেমাঝেই ছুটে আসছে মাতাল হাওয়া, এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে সাধের তুরস্ক নীলরঙা পর্দা গুলোকে। উড়ে বেড়াচ্ছে যত কুচো আর বাতিল কাগজ। দূরের লোকজনকে আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ছুটির ঘন্টা বাজতে তখনও বেশ খানিক বাকি, ঘন্টা বাজলেই গুটি গুটি রওণা দেব আমরাও। এমন আবহাওয়ায় রুদ্ধ চেম্বারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতে পারি না আমি, ভালো লাগে ঘুরে বেড়াতে, প্রতিটা জানলায় দাঁড়িয়ে দেখতে, কতটা অন্যরকম লাগে মেঘলা আকাশ, বিদ্যুতের ঝলক আর দামাল হাওয়াকে। 


তেমনি পায়চারির ফাঁকে আচমকাই তাঁর সাথে দৃষ্টি বিনিময়। উড়ন্ত অবাধ্য কেশগুচ্ছকে দ্রুত শাসন করে উল্লাস না চাপতে পারা চপল স্বরে জানতে চাইলাম, এণাকে কোথায় পেলে? চঞ্চল,শান্তনু আর শুভাশিস ততোধিক উল্লসিত স্বরে জানাল, ‘ছিলেন তো ম্যাডাম। আমাদের পুরাণ অফিসেও শোভা পেতেন।এখানেও এসেছিলেন, আমাদের সাথে, তারপর কোথায় যে বস্তাবন্দি হয়ে লুকিয়ে বসেছিলেন। অতি কষ্টে, অনেক ধুলো ঘেঁটে খুঁজে বার করা হয়েছে, বৃদ্ধকে।’ 


সেই থেকে আমাদের অকিঞ্চিৎকর সেকশনের মাঝেই আসন পাতা তাঁর। নীরবে প্রত্যক্ষ করেন আমাদের কার্যকলাপ। দুরন্ত হাওয়ায় মাঝেমধ্যে হেলে দুলে যান বটে,  দুয়েক দিন ছাড়া,ছাড়াই সাফ ডাস্টার দিয়ে সাফ সুতরো করে দেওয়া হয় তাঁকে। দিন দিন আরো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন আমাদের ঘরের রবি। 


সপ্তাহ পেরোলেই 'আমাদের ঘরের রবি'র জন্মদিন। তো এ হেন রবি বাবুকে কি আমরা একটা মালাও পরাব না? 


শুক্রবার এমনিতেই ভিড় বেশি হয় এই অফিসে, পাশবই রিনিউ করতে, পেনশনের আবেদন নিবেদন করতে জমায়েত হন, একরাশ পরিবহন শ্রমিক, আসেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতারাও। সকলের ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। সদ্য কাজে যোগ দেওয়া বেবি ইন্সপেক্টর দ্বয়কে আজ বসানো হয়েছে জনতার দরবারে। ক্ষণিকের জন্য সবাইকে ডেকে প্রস্তাব রাখলাম, ঘরের রবির জন্মদিন পালনের। আর কিছু না পারি, সামান্য একটা পুষ্প হার, দুয়েক কলি তাঁর গান বা কবিতা, শুভদীপ্তর কন্যার একটা নাচ, আর সবার শেষে জনগণমন, এই আর কি। বাহুল্য নয়, শুধুখানিক আন্তরিকতা আর অনেকটা ভালোবাসা। 


মুস্কিল হল, এই তাপপ্রবাহ দীর্ণ খর দুপুরে এই আপিস পাড়ায় মালা কোথায় পাব? পৌনে চারটে নাগাদ স্কুল ছুটি হয় তুত্তুরীর, ভাবলাম ওকে নিয়ে ফেরার পথে কিনে আনব খন। শুভাশিস বলল, ‘ আপনারা যে রাস্তা দিয়ে ফেরেন, ঐ রাস্তায় পাবেননি ম্যাডাম। আপনাকে বর্গভীমা মন্দিরের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতে হবে।’ বর্গভীমা মন্দিরের সমনের রাস্তাটা বড়ই সঙ্কীর্ণ আর তেমনি যানবাহনপূর্ণ। ওদিকে যেতে হবে বললেই গজগজ করে আমাদের উত্তমকুমার। ‘সকাল থেকে বলতে পারলনি শুভাশিস দা। এখন মালা কোথায় পাবেন?’ এতবড় শহর, একছড়া মালা পাব না? ‘আহাঃ পাবেননি কেন,কিন্তু এই গরমে কোন ফুলওয়ালা আপনার জন্য বসে থাকবে বলুন দিকি।’ তাও বটে, তবুও কপাল ঠুকে রওণা দিলাম আমরা। দুই বেবি ইন্সপেক্টরকে বলে গেলাম, সবার নাম টুকতে। হয় গান গাইতে হবে, নয়তো আবৃত্তি করতে হবে। কিছুতো করতেই হবে,মুখ খুলতেই হবে ঘরের রবির খাতিরে। 


ভারি ব্যাগ সমেত তুত্তুরীকে গাড়িতে তুলে প্রায় অর্ধেক শহর পরিক্রমা করে ফেললাম আমরা, মনের মত মালা কোথায় পাই? মন্দিরের সামনে ঝোলানো আধশুকনো জবার মালাগুলো দেখে গাড়ি থামালই না উত্তম। শেষে এক কাঠের পোলের পাশে অর্ধেক ঝাঁপ বন্ধ দোকান থেকে দেড় গুণ মূল্যে পাওয়া গেল তাঁর মালা। প্রবল কাশির দমকে অস্থির, ক্লান্ত তুত্তুরীকে বাড়িতে নামিয়ে যখন আপিসে পৌঁছালাম, ততোক্ষণে নতুন করে পাতা হয়েছে 'আমাদের ঘরের রবি'র আসন। হাতল ছাড়া চেয়ারের ওপর তকতকে সাদা তোয়ালে পেতে বসেছেন তিনি। আপিসের সব থেকে সেরা গাছ গুলো দিয়ে ঘিরে রচিত হয়েছে তাঁর নিজস্ব শান্তিনিকেতন। কাগজের কাপে মাটি দিয়ে পোঁতা হয়েছে গোছা গোছা ধুপ। 


আপিস জুড়ে বইছে তপ্ত আবেগের  বাতাস। গান আবৃত্তি নয়, ছোট্ট করে বক্তব্য রাখবে শান্তনু আর শুভাশিস, কবিতা পড়বে চঞ্চল, পেনশন আর রিনিউয়ালে ফাইল গুছোতে গুছোতে গুণ গুণ করে আবৃত্তি অভ্যেস করছে নন্দন বাবু।  মোবাইল থেকে গুগল খুলে, কি সব গান টুকছেন জহর বাবু। নিজের চেম্বারে সেঁদিয়ে যেতে যেতে বললাম, ' আজ কিন্তু এ আমার গুরু দক্ষিণা গাইবেন না কেমন?' জিভ কেটে জহর বাবু দেখিয়ে গেলেন, উনি 'একলা চলো রে' টুকছিলেন। 


 জানলার বাইরে ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যে, একে একে জ্বলে উঠছে নিমতৌড়ির হলদেটে নিয়ন আলো গুলো। সপ্তাহান্তিক  ছুটির মেজাজে খালি হয়ে যাচ্ছে অন্যান্য আপিস গুলো, আর আমরা তৈরি হচ্ছি ঘরের রবির জন্মদিন পালনে। ফাইল পত্র গুটিয়ে, কম্পিউটার গুলো বন্ধ করে জড় হচ্ছি তাঁকে ঘিরে। ভিজে রজনীগন্ধার মালা থেকে বেরোচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি ফুলেল সৌরভ। শান্তনু বলল,‘ম্যাডাম আপনি পরিয়ে দিন।’ ভেবেছিলাম তুত্তুরী বা তিথির হাত দিয়ে মালা পরাব তাঁকে, একজন জ্বরগ্রস্ত, আরেকজন তখনও এসে পৌঁছায়নি। বড্ড ছোট যে, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে,মুখ হাত ধুয়ে তবে না নাচতে আসবে। এই প্রবল দাবদাহে তিনি যে আদৌ আসতে রাজি হয়ছেন, তাতেই ধন্য আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, তাম্রলিপ্ত। 


অগত্যা শান্তনুকে বললাম, তুমিই পরাও। থোড়াই পদ মর্যাদা দেখবেন রবি বাবু, রবির আলোকে তো সবাই সমান, ‘হে মহান, নেমে এসে তুমি যারে করেছ গ্রহণ,সৌন্দর্যের অর্ঘ্য তার তোমা-পানে করুক বহন।’ 


নতুন ইন্সপেক্টর দ্বয়ের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল,সবাইকে দিয়ে গান আর আবৃত্তি করানো। দেখলাম লম্বা তালিকা প্রস্তুত। প্রাথমিক জড়তা, কাটিয়ে, দপ্তরী পদমর্যাদা তথা সংকোচ ভুলে সবাই খোলা মনে উজাড় করে দিল, শ্রদ্ধার ডালি নিয়ে। নিজেদের মধ্যে যে এত প্রতিভা লুকিয়ে আছে কেউ কি জানত, সবই যে তাঁর মহিমা। বাঙালির প্রাণের ঠাকুর কি সাধে কয়।


No comments:

Post a Comment