Thursday 12 May 2022

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০১৮

 

“বললাম, গাড়ি করে যাই-” গজগজিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। দমদম থেকে ট্রেনে উঠেছেন সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দম্পতি, বৃদ্ধর বয়স সম্ভবতঃ আশির দোরগোড়ায়, বৃদ্ধাও সত্তরোত্তীর্ণা। একজনের গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম,অপরের টকটকে ফর্সা। বৃদ্ধা উঠেই হাপরের মত হাঁপাচ্ছেন, হাঁপাচ্ছেন বৃদ্ধও মুখে যদিও দুষ্টু হাসি। রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতে লাগলেন মুখ। 

হাঁপাতে হাঁপাতে বৃদ্ধা আবার শুরু করলেন,“বললাম, গাড়ি ভাড়া করো। ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যাই, তা নয় ট্রেনে চল।” বৃদ্ধ সহাস্যে বললেন,“গাড়ি ভাড়া করলে হাজার টাকার ধাক্কা, তারওপর ছ ঘন্টা কেটে গেলেই শালারা বারো পনেরো যা খুশি চায়। চলো না, ট্রেন চললেই হাওয়া আসবে। নেমে অটোয় চাপাব না, রিক্সা ধরে নেব। ” বৃদ্ধা মুখ ঝামটা দিলেন। বৃদ্ধ গদগদ সুরে বলতে লাগলেন,“আরে আগে তো ট্রেনেই যাতায়াত করেছি। তোমার বাবা কাকা দাদা যা ছিল সব একএকটা। নামি গুণ্ডা। তাদের ভয়ে ভিড় ট্রেনে চেপে কোন ফাঁকা স্টেশনে নেমে দেখা করতে হত। বাপসঃ। ” এবার সত্যিই কুরুক্ষেত্র লেগে গেল। আমার যদিও প্রচণ্ড মজা লাগছিল, ওণাদের ডেটিং এর গল্প শুনতে। 

বেশ খানিক ঝগড়ার পর নেতিয়ে পড়লেন বৃদ্ধা। এই গরমে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আঁচল প্রান্ত গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এই লাইনে অনেক মধ্যবয়সীই হিজাবের পরিবর্তে শাড়ির আঁচল জড়ান। বৃদ্ধ চটজলদি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে দিলেন।গায়ের চাপা খুলে দিতে অনুরোধ করলেন।  জল খেয়ে খানিক ধাতস্থ হয়ে আবার ঝগড়া। 

বৃদ্ধ রীতিমত গলার শির ফুলিয়ে বৃদ্ধাকে অভিযুক্ত  করতে লাগলেন, বৃদ্ধা নাকি  ঠিকঠাক ওষুধ খান না। বৃদ্ধাও সমান তেজী। বেশ খানিক তর্কের পর ওষুধের হিসেব নিতে বসলেন বৃদ্ধ। কোন ওষুধ কটা পড়ে আছে। গো হারান হেরে গেলেন বৃদ্ধা। 

সাময়িক শান্তি। তারপর বৃদ্ধ শুরু করলেন,“ওদের বাড়িতে যতই বলুক, বুঝলে পেট ভরে খাবো না। ফেরার পথে স্টেশন রোডের ফুচকা।” মহিলা বোধহয় ঝাল নিয়ে কিছু বললেন, বৃদ্ধ বললেন,“তুমি ঝাল ছাড়াই খেয়ো। তেমন হলে শুকনোই খেয়ো। একটা খেয়ো অন্তত। না হলে-”।  বলে এমন অভিমানী ভঙ্গীতে মাথা নত করে বাইরের দিকে তাকালেন, যে বোঝাই গেল গিন্নী ব্যতীত উনি ফুচকায় স্বাদ পাবেন না। বৃদ্ধা ফিসফিস করে কিছু আব্দার করলেন, বৃদ্ধ খুশি হয়ে বললেন,“বেশ। হবে। ফুচকাও হবে, আইসক্রীম ও হবে। তুমি গায়ের চাপাটা এবার খোলো। সিদ্ধ হয়ে মরবে।  কেউ কিচ্ছু বলবে না। আরেঃ আমি বলছি,”।  ট্রেন বেশ ফাঁকা, বৃদ্ধা এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ভীরে মাথা এবং গা থেকে আঁচল সরিয়ে জড়সড় হয়ে লাজুক নবোঢ়া বধূর মত স্বামীর গায়ে গা লাগিয়ে বসলেন। চমকে গেলাম, বৃদ্ধার মাথা ভর্তি চকচকে টাক। দুহাতে অজস্র সূঁচ ফোটানোর  কালো দাগ। কেমো চলছে অথবা কেমো হয়েছে। বৃদ্ধ মজা করে বলে চলেছেন,“আমার বউ টেকো হতে পারে তাই বলে কি কম সুন্দর নাকি-”। বৃদ্ধা মুখ বেঁকিয়ে বোধহয় বললেন মরণ। চোখের কোণটা এত কড়কড় করছে কি বলব, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। দিন কয়েক আগে বোধহয় আমিও ভাবছিলাম এ শহর বিস্মৃত হয়েছে প্রেম। আজ এদের দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই, ফুল ফুটুক না ফুটুক আমার শহরে বিরাজমান  চিরবসন্ত।

No comments:

Post a Comment