Monday 11 October 2021

অনির ডাইরি, ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১

 


ফোনটা যখন এল , তখন আমি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একাকী জলমগ্ন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। শাশুড়ি মা যথার্থই বলেন, মা গো, এমন কুচ্ছিৎ জায়গায় মানুষ থাকে? এক পশলা বৃষ্টি মানেই এক হাঁটু জল। মুঠো ফোন বলছে, সবে রাত সাতটা বাহান্ন, আমার পিছনে জলের তোড়কে উপেক্ষা করে দৌড়চ্ছে মহানগর, আর আমার সামনে অখণ্ড নিস্তব্ধতা আর ঘন কালো টলটলে জল। কে বলবে আজ সকালেও হেঁটে নয়, রীতিমত দৌড়ে পেরিয়েছি এই একফালি রাস্তা। আপাততঃ জনবিহীন। আমার সাথে যে কয়জন হতভাগ্য এপাড়ে এসেছিল, সকলে হাঁটুর ওপর প্যান্ট গুটিয়ে ঝপাং করে জলে নেমে রাস্তা পার হয়ে গেছেন। ভোম্বলের মত দাঁড়িয়ে আছি আমি একাই। পায়ে তিন/চার ইঞ্চি হিলের মহার্ঘ চপ্পল, আগের দিনের বৃষ্টি আর জমা জল কোতল করেছে আমার সাধের দুগ্ধফেননিভ স্নিকার জোড়াকে। এদের অপমৃত্যু প্রাণে ধরে সইতে পারব না। আর খালি পায়ে এই রাস্তায় এত জল ঠেলে হাঁটতেও পারব না। ভেসেই যাব নির্ঘাত। ডুবেও যেতে পারি। জনৈক রিক্সাওয়ালা আশ্বস্ত করে গেছেন, সোয়ারী নামিয়েই ফিরে আসবেন আমার তরে, তাঁরই প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গুনছিলাম আর কি। 


ফোনের ওপার থেকে পণ্ডিতের উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এল, ' এই আমাদের কেয়ারটেকারকে সাপে কামড়েছে-'। পণ্ডিতে পুরো নাম না হয় উহ্যই থাকুক, শুধু এইটুকু বলি যে কোন এক মান্ধাতার আমলে তিনি এই অধমের অপরূপা সহপাঠিনী ছিলেন। আপাততঃ দক্ষিণ কলকাতার বিরাট বনেদি বাড়ির জাঁদরেল গৃহকত্রী। কেয়ারটেকারকে সাপে কামড়ানোর খবরটা শুনে রীতিমত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললাম, 'হাসপাতালে নিয়ে যা। ইঞ্জেকশন দিতে হবে।' আমার জ্ঞানের পরিধি অতটুকুই। ওপাশ থেকে ভেসে এল, জাঁদরেল গিন্নীর মৃদু ধমক, 'হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। এবার বল সাপটাকে কি করব?' 


আমি জন্মসূত্রে চাটুজ্জে, কাশ্যপ গোত্র। নিজেকে কাশ্যপ মুনির বংশধর হিসেবে ধরলে, কদ্রু দেবীর পুত্রকন্যাগণ নির্ঘাত তুতো ভাইবোন, নিদেনপক্ষে খুড়োজেঠা তো হবেনই। তা সত্ত্বেও কেন যে ওণাদের প্রতি বিন্দুমাত্র আত্মীয়তা অনুভব করি না। বরং উগ্র বিরাগ আমার। 


অকপটে মনোভাব ব্যক্ত না করলেও, এমনি কিছু বলাতে, আরেক চোট ধমক খেলাম। সাপ না লুপ্তপ্রায় জীব। সংখ্যায় নগন্য। আর এই মহানগরে, বিশেষতঃ নিউআলিপুরের মত ধনাঢ্য এলাকায় সাপ তো রীতিমত দুর্লভ। অসহিষ্ণু কণ্ঠে ধমকায় পণ্ডিত, ‘ আরেঃ তুই কি সরকারী চাকরী করিস রে? শীঘ্রি বল, ফরেস্ট ডিপার্মেন্টের কোন হেল্পলাইন আছে কি না? কাকে ফোন করব? সাপটা বাথরুমের দরজা থেকে রীতিমত টারজানের মত ঝুলছে।’


অজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম,যে বনদপ্তরের কোন সহায়িকা নম্বর আছে কি না আমার বাপও জানে না। আমি তো কোন ছাড়? বনদপ্তরের সাথে আমার একটাই ক্ষীণ যোগাযোগ আছ, ওদের জনৈক আধিকারিকের গিন্নী আমার যাকে বলে বেস্ট ফেরেন্ড। চেনা বামনির পৈতে লাগে না,তাই তাঁর নামটাও না হয় উহ্যই থাকুক।  সবাই তারে এমনিতেই এক ডাকে চিনে- তাকে বলাই যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পাতলা দাস্ত সককথাই তো বলি আমরা একে অপরকে। মাঝে মাঝে তো আমাদের বাক্যালাপ শুনে চমকে ওঠে আমাদের বরেরাও-' আচ্ছা এটাও কি অমুককে বলার দরকার ছিল?' কি করব! আমরা ওমনিই। 


সমস্যা সেটা নয়,সমস্যা হল, এই যে মাত্র এক মাস আগেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কারো জন্য কারোকে বলব না। অন্য এক বন্ধুর জন্য ফোন করেছিলাম জনৈক আধিকারিককে। এমন কিছুই দাবী ছিল না, সামান্য দু মিনিট সময় চেয়েছিল প্রবাসী বন্ধুটি। টাটা কোম্পানিতে বড় চাকরি করে ছেলেটি, বিশেষ কোন লাইসেন্সের জন্য কিছু টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট জমা করেছিল টাটারা। কাজ মিটে যাবার পর টাকা ফেরৎ চেয়ে আবেদন করেন, তারপর কেটে গেছে সাত আটটা বছর। বন্ধু বলল, 'ও টাকা ফেরৎ না পেলেও কোন সমস্যা নেই। তবে বাড়ি ফিরছিই যখন, আমাকে বলা হয়েছে একবার তদারকি করে আসতে।তুমি তো চিনবেই ওই অফসরকে। একটু বলবে, আমি জাস্ট দুমিনিট নেব ওনার।' বেশ তো। এ আর এমন কি? জানতে চাইলাম কত টাকা? উত্তর যা পেলাম  শুনে চমকে উঠলাম।গরিব দপ্তরের পক্ষে এটা অনেক টাকা। ফেরৎ তো পাওয়াই উচিৎ। আশ্বস্ত করলাম, বর্তমানে ওই দপ্তরের আধিকারিক আমার পরিচিত। বললে নিশ্চয় উনি কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। 


আশ্বস্ত তো করলাম। নিজে আশ্বস্ত হলাম কি? ফোন করতেই এমন ভয়ানক তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব এল, যে মনে হল অনেক হয়েছে, আমার আর এগিয়ে দরকার নেই। কার টাকা কে ফেরৎ পায়, বা না পায় শুধু শুধু আমার অপমানিত হওয়া নিরর্থক। পরোপকারের পোকার কামড় এমনি, যে তা সত্ত্বেও রীতিমত করুণাভিক্ষার সুরে বললাম, ' দেখো ভাই আমার নিজের প্রয়োজনে তো বলছি না। আশ্বস্ত থাকো যে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমি কখনোই তোমাকে বলব না। কিন্তু বন্ধুবান্ধব অনুরোধ করলে-। আর ও শুধু দুটো মিনিট কথা বলতে চায়।' 


'আরে না, না এরকম বলছ কেন? তুমি পাঠাও না।দেখছি কি করতে পারি।' এই শুনে বন্ধুটিকে তো পাঠালাম। পরিণাম এটা হল যে তাকে বসিয়ে রাখা বেলা বারোটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটে অবধি। অবশেষে ঘর ফাঁকা দেখে যখন সাহস করে প্রবেশের সুযোগ পেল ছেলেটি, সাক্ষাতের মেয়াদ দাঁড়াল দুমিনিট এর জায়গায় মাত্র তিরিশ সেকেন্ডে। আর আমার নাম করতেই বলা হল, 'বাইরে যান।বাইরে গিয়ে বসে থাকুন।' পাঁচটার সময় আমিই ফোন করে একরাশ ক্ষমা চেয়ে বললাম, ভাই তুই বাড়ি ফিরে যা।  


ন্যাড়া বেলতলায় আর কবার যায়? জানি না, তবে রিক্সায় উঠে প্রিয় বান্ধবীকে ধরলাম। আর যাই হোক, এ অমন তাচ্ছিল্য দেখাবে না। এটা নিশ্চিত। পরের ধাপে দেখা যাবে। বন দপ্তরীয় আধিকারিকের গৃহিনী, বনজঙ্গল  তথা জীবজন্তু-সাপখোপের ওপর তাঁর কি অকাট্য প্রেম, সর্পনন্দন টারজানের মত ঝুলঝুল করে ঝুলছে শুনে প্রথম চোটে তার কি হাসি। অতঃপর যখন বললাম, যে বেচারী কেয়ারটেকার ইতিমধ্যে সর্পদ্রষ্ট এবং আমাদের পণ্ডিত  দু-বগলে  ছানা এবং পোনাকে আঁকড়ে ঠকঠক করে কাঁপছে (জানতে পারলে পণ্ডিত নির্ঘাত আমায় কোতল করবে। তবে কি না গল্পে রঙ চড়াতে ওসব বলতে হয়), বন্ধু ঘচ্ করে ফোন কেটে দৌড়ল। ফোনের এপার থেকে শুনতে পেলাম বন্ধুর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর, ‘ও গোওওওও শুনছোওওওও-----’।  


ফ্ল্যাটের বেল বাজাতে না বাজাতেই ঢং করে ঢুকল মেসেজ, দক্ষিণ ২৪ পরগণার বন দপ্তরের আধিকারিকের নাম আর নম্বর। তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলাম পণ্ডিতকে। সাথে সাথে বিধিবদ্ধ সতর্কবাণীও দিলাম, ভাই, নম্বর না হয় যোগান দেওয়া গেল, কিন্তু এত রাতে তিনি ফোন ধরবেন কি না বা আদৌ কোন ব্যবস্থা নিতে পারবেন কি না, দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারছি না। ছিমতী পণ্ডিত, যাকে আমাদের চৈ ওরফে চৈতালী এই সেদিন অবধি সুযোগ পেলেই, ‘শেয়াল পণ্ডিত’ বলে খ্যাপাত, বাস্তবিক পণ্ডিতের মতই বলল, ‘জানি রে। এত বৃষ্টি হচ্ছে ও বেচারাই বা কি করবে, আর বনদপ্তরই বা কি করবে? ভাব নিউ আলিপুরে সাপ বেরোচ্ছে, কি দিনকাল পড়ল বাপু।এবার বাঘটা বেরোলেই একেবারে ১৬ কলা পূর্ণ হবে। ’ 


আশার বাণী আমি শোনাতে না পারলেও, রাত নটা নাগাদ পণ্ডিত শোনাল বটে, ‘ফোন ধরেছেন রে। এবং জানিয়েছেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমি যেন ধৈর্য না হারাই।’ জানতে চাইলাম, তিনি কি এখনও ঝুলছেন? জবাব পেলাম, তিনি এখনও টারজান মোডেই বিদ্যমান। 


রাত গড়ায়। নানা নৈমিত্তিক কাজের ফাঁকে মন পড়ে থাকে শৈশবের বান্ধবীর কাছে। কি করছে তারা, কোন মেসেজও তো আসে না ছাই। অবশেষে রাত সোয়া দশটায় ঢুকল মেসেজ, ‘নিয়ে গেছে রে বাবু। থ্যাঙ্কু। তোর জন্য ছবিটা পাঠালাম।’ 


 ছবি দেখে ভদ্রলোককে চিনতে পারব, এত বড় সর্পবিশারদ আমি নই। চিনতে যে খুব একটা উৎসুক তাও নই। বিন্দুমাত্র আত্মীয়তা বোধ এখনও আমার মধ্যে জাগেনি। তবে বেচারা অবোলা জীব, নিছক গণঠ্যাঙানিতে প্রাণ না হারিয়ে, বনদপ্তরের তত্ত্বাবধানে থাকবে ব্যাপারখানা মন্দ নয়। আমাদের পণ্ডিত আর তার শিশুরা নিরাপদে আছে এটাই আমার কাছে একমাত্র স্বস্তির কারণ। তবে সবথেকে যেটা ভালো লাগল, প্রথম অভিজ্ঞতার সময় চেনা মানুষও বাড়িয়ে দেয়নি ন্যূনতম সহযোগিতার হাত, আর এখানে আলিপুরের বনদপ্তরীয় আধিকারিককে না আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, না আমার প্রিয়তমা বান্ধবী,  উনিও নির্ঘাত অজ্ঞাত আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে, এতদসত্ত্বেও এমন বর্ষণমুখর রাতে, যেখানে অর্ধেক কলকাতা জল অবরুদ্ধ, নিছক দূরভাষে ভেসে আসা এক অজ্ঞাত পরিচয় জননীর সামান্য অনুরোধের ভিত্তিতে তাঁর টিমকে পাঠালেন এবং তারাও যেভাবে দায়িত্ব সহকারে এসে নিজ কর্তব্য পালন করল কোন প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ট নয়। এদের  জন্যই মনে হয়, সত্যি সত্যিই বোধহয় মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।


অনির পুজোর ডাইরি ৬ই অক্টোবর, ২০২১

 অনির পুজোর ডাইরি ৬ই অক্টোবর, ২০২১

(পর্ব-২) 

যাই লিখি, খুঁটিয়ে পড়ে লোকটা। দেয় সুচিন্তিত মতামত। ছবিগুলোও দেখে, শুধু আমারই নয়, আমার স্কুলের বন্ধুদেরও। সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছে তো-। ফেসবুকে ওদের দেওয়া সব ঘটনাবলী, তথ্য নখদর্পনে থাকে লোকটার। সারাদিনে কত বার যে চা খায় লোকটা।  আর সিগারেট? উফঃ তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠে বাড়ির লোক। সবসময় বসার ঘরে ফ্লেক্সের কড়া গন্ধ। একবার প্রশ্ন করেছিলাম,গোল্ড ফ্লেক্স খাওয়া না কেন? ওটা নির্ঘাত আরো ভালো। লোকটা বলেছিল, ‘দামটা একটু বেশী। চিরকাল তো চারমিনার খেয়েই এসেছি।’ তারপর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকের সুরে বলেছিল, ‘কেন গরিব বাপ পাতি ফ্লেক্স খেলে কি তোমার সম্মানে লাগে?’ কি প্রশ্নের কি উত্তর মাইরি। 


দেরী হয়ে যাচ্ছে। পরপর তিনটে ওলা ক্যান্সেল হল। সম্ভবতঃ রক্তদান শিবির চলছে, শ্রীভূমির ওদিকে, তাই প্রচণ্ড জ্যাম রাস্তায়। ফোন করলেই, উল্টোদিকের ড্রাইভার জানতে চাইছে, ‘কোথায় যাবেন দিদি,’ যেই বলছি হাওড়া, অমনি ঘচ্ করে বুকিং ক্যান্সেলের মেসেজ ঢুকছে। এতো মহা জ্বালা। বাইক ধরব কি? এয়ারপোর্ট থেকে হাওড়া গাড়িতে যেখানে এই মুহূর্তে ৫৬৬টাকা, বাইকে মাত্র ১৯২। কিন্তু অনাত্মীয় ব্যক্তির বাইকে চড়া যে ভয়ানক অপছন্দ লোকটার। 


কি যে অসম্ভব মনের জোর লোকটার, বয়সের ভারে হয়তো এসেছে কিঞ্চিৎ নুব্জতা, স্বল্প স্থবিরতা। সেই ঘাটতি মিটিয়ে দেয় বিক্রম আর মনের জোর। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে আজও আমি অপেক্ষা করে থাকি,লোকটার অমোঘ বাণীর,‘ আরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘাবড়াস না। ’ লোকটার মুখের কথা খসার সাথে সাথেই, সত্যিই সব যে কি ভাবে ঠিক হয়ে যায়, তা আজও এক দুর্ভেদ্য রহস্য আমার কাছে। লোকটা প্রায়ই বলে, জন্মলগ্ন থেকেই নাকি আমি তার জীবনের সূর্য। আমাকে ঘিরেই নানা কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায় লোকটা। আমার সামান্য সময়, অল্প একটু মনোযোগের জন্য হ্যাংলার মত বসে থাকে লোকটা। জীবনেও আমার কোন দোষ,কোন খুঁত খুঁজে পায় না লোকটা। তাই না বড় সাধ করে আমার নাম রেখেছে, ‘অনিন্দিতা’। 


লোকটার আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাইকই ধরলাম। মাথায় ফেট্টি বাঁধা একটি অবাঙালি ছেলে আর তার ধুলো পড়া কেলে অ্যাভেঞ্জারই আপাততঃ আমার পরিত্রাতা। মাথায় একখান জব্বর হেলমেট চেপেছে, যার ভারে মাথা আমার নুইয়ে এসেছে। পরার ইচ্ছে ছিল না মোটেই, আমার সামনে হেলমেট উল্টে জল ঝাড়ছিল ছেলেটা, আমি ঘাবড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম নির্ঘাত আগের সোয়ারীর ঘাম হবে, যা গরম আজ। ছেলেটা মা-বাপ- আল্লার কিরে করে বলল, ‘ইটা জোল দিদি। জোল। পানি। বিষ্টির পানি। আমিও ভিগে গিছি দেখেন। ’ 


এহেন লোকটা, ঠিক পুজোর আগেই যে কি বাঁধিয়ে বসল-। এই প্রথম মহালয়ার চণ্ডীপাঠ ধ্বনিত হল না আমাদের বাড়ি। প্রতি বছর ভোর চারটেয় ঠিক আমাকে ফোন করে লোকটা, অথবা আমি করি, ‘ওঠো,ওঠো মহালয়া শুরু হয়ে যায়-’। মহালয়া শেষ হয়ে গেলে আবার ফোন করে লোকটা,শোনায় তার ছেলেবেলার আগমনী গপ্প। বিশাল সাবেকী রেডিওতে গমগমে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর। ভোর বেলা বাবলু পিসির শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনার মনকেমন করা গল্প। আগুনে পুড়ে মারা যায় বাবলু পিসি। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণী। 


ঠিকঠাক রাস্তা চেনো তো, ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি আমি। কি জোরে চালাচ্ছে রে বাবা ছেলেটা। বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়ে জুড়ে এক মানুষ গভীর গর্ত। ইতিউতি জমে আছে শারদীয়া বৃষ্টির জল। ছিটে এসে লাগছে প্যান্টে। আকাশের মুখ এই গোমড়া তো এই হাসিখুশি। আচমকা বৃষ্টি নামলে কি যে হবে-। দক্ষিণেশ্বর ব্রীজ পেরিয়ে, বালি হয়ে,বেলুড়মঠ, লিলুয়া পেরিয়ে শালকিয়া চৌরাস্তায় পড়তেই খপ করে ধরল পুলিশ। ‘এই ব্যাটা এটা না ওয়ানওয়ে,  নাম। লাইসেন্স দেখা। ’ প্রায় দশ মিনিট হল ছেলেটা লাইসেন্স দেখাতে আর চালান কাটতে গেছে, বোকার মত বাইকে বসে আছি আমি। পাশ দিয়ে হাওড়া-হাওড়া হেঁকে চলে যাচ্ছে অটো। 


পরশুরাতেই ধমকে ছিলাম তুত্তুরীকে, সারাদিনে একটি বার ফোনও করেনি বুড়োবুড়িকে? কি এমন রাজকার্য করেছে তাহলে? ধমক খেয়ে রাত এগারোটায় করা ফোনে প্রথম জানতে পারলাম সন্ধ্যে থেকে অসহ্য পেটের ব্যথায় কাহিল লোকটা। ফোনের ওপার থেকে চিঁচিঁ করে বলল, ‘ডিকলিক খেয়েছি। কমে যাবে। তোকে অকারণ আর বিরক্ত করিনি। ’ পরদিন কাক ভোরে বৃদ্ধার ফোন, সারা রাত যাতনায় ছটফটিয়ে নেতিয়ে পড়ছে বৃদ্ধ। বাড়ির ডাক্তারকে খবর দিয়ে, তাঁর পরামর্শ মত দেওয়া হয়েছে অ্যানিমা, ফোটানো হয়েছে একাধিক ইঞ্জেকশন। পরবর্তী পদক্ষেপ হল হাসপাতালে ভর্তি করা। 


ট্রাফিক পুলিশের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে ফিরে এল ছেলেটা। সরি দিদি। ‘আপনার জন্য কিছু বললাম না,না হলে দিখাতাম মজা। ’ কাতর স্বরে জানালাম,ভাই, আমার এমনিতেই মজার শেষ নেই, তাই আমায় দয়া করে হাসপাতালে সময় মত পৌঁছিয়ে দে। যেখানে আইসিইউ এর দরজার দিকে ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করছে এক বৃদ্ধ। শুধু আমার তরে, আমিই যে তার জীবনের সূর্য। আর সে আমার ধ্রুব তারা।  উৎসবও যে মাঝে মাঝে কেন এমন বেদনার হয়-  জলদি সেরে ওঠো বাবা।

অনির পুজোর ডাইরি ৮ই অক্টোবর, ২০২১

 

(পর্ব-৩) 

শুভ প্রতিপদ


কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙালো মা,‘দরজাটা একটু খুলে দিবি? তোর বাবা'ই তো দিত-’। সেন্টু দিতে কিছু জানে বটে আমার গর্ভধারিণী। দরজা,অর্থাৎ চাটুজ্জে বাড়ির সিংহ দরজা। যাকে আমরা তিন প্রজন্ম সোহাগ করে ডাকি, সদর দরজা বলে। কাক ডাকা ভোরে, ঘুম ভেঙে উঠেই বাবা ছুটত সদর দরজা খুলতে।  বাবা খুলত বলেই, আর কেউ অতটা গা করত না। বাবা হাসপাতালে ভর্তি হবার সাথে সাথেই, মায়ের প্রধান মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সদর দরজা খোলা। কাল রাত সাড়ে এগারোটায়, জবরদস্ত পারিবারিক আড্ডার মাঝেও মনে করিয়ে দিয়েছে আমার খুড়তুতো ভাই অয়নকে। ‘দরজাটা একটু মনে করে খুলে দিস বাবা। দুধ- কাগজ সব ফিরে যাবে নইলে। ’ 


 জমাটি আড্ডার ফাঁকে, অয়ন আশ্বস্তও করেছিল, ‘তুমি চিন্তা করছ কেন? ও চৈতি ঠিক খুলে দেবে। ’ চৈতি অর্থাৎ চাটুজ্জে বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের জ্যেষ্ঠ কুলবধূ। এবাড়িতে সব সমস্যার একজনই মুস্কিল আসান, শ্রীমতী চৈতি। প্রত্যহ প্রাতে বাবার পরই যদি এবাড়িতে কেউ শয্যা ত্যাগ করে তবে তিনি চৈতি। এহেন চৈতি দায়িত্ব নেওয়া মানে, সে কাজ হবেই।  


তবুও ঘুম চোখে, বাসি মুখে অন্ধকার দালান টপকে,  দরজার খিল খুলে, লাল রোয়াক পেরিয়ে, তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে, সাবেকী উঠোনের পড়ে থাকা ভগ্নাংশকে আড়াআড়ি পেরিয়ে দিলাম দরজা খুলে। পূব আকাশে তখন এক মুঠো আবির ছড়িয়েছে কে যেন।বইছে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। মনে পড়ে গেল বৃদ্ধ এরপর-পরই পাম্প চালাতে যেত। দিলাম পাম্পটা চালিয়ে-। নিঝুম বাড়িতে গুনগুন করে চলা জলের পাম্পের আওয়াজ বড় ঘুম পাড়ানিয়া, হাই তুলে চালিয়ে দিলাম রেডিও- রফি সাহাবের মধু ঢালা কণ্ঠ পলকে গুঞ্জরিত হল সমগ্র বৈঠক খানা জুড়ে, "ওয়াক্ত ইন্সান পে এয়সা ভি কভি আতা হ্যায়- রাহ মে ছোড়কে সায়া ভি চলা যাতা হ্যায়। দিন ভি নিকলে গা কভি, রাত কে আনে পে না যা, মেরি নজরো কে তরফ দেখ, জমানে ফে না যা।" আমরা বাপ-মেয়ে দোঁহে রফি সাহেবের বড় অনুরাগী। শৌভিক আবার টিম কিশোর কুমার। মা মুকেশ আর শ্রীমতী তুত্তুরী অরিজিৎ সিং।  


জল উঠতে, উঠতে নেলপালিশ লাগিয়ে নিলাম হাতে-পায়ে। সময় বড়ই মূল্যবান আমার জীবনে, নিছক অবকাশ পেলেই টুকটাক কাজ সেরে নি আমি। 


আপিস ঢুকতে সামান্য বেলা হল, একদল লোক অপেক্ষা করে বসেছিল শুধু আমারই তরে। সকাল বেলাই ফোন করেছিল পালের গোদা থুড়ি নেতা, ‘ম্যাডাম আপনার বাবা কেমন আছেন? সেরকম হলে দুদিন না হয় পিছিয়ে দিন মিটিংটা-। পুজোর আগেই মিটে গেলে ভালো হয়,তবে আপনার অসুবিধা থাকলে পুজোর পরই বসব আমরা।' আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলাম, আজ আসব তো বটেই, তবে হয়তো বড়জোর আর এক বা দুদিনই যাব চুঁচুড়া, বদলী হয়ে গেছি আমি। এবার সিদ্ধান্ত আপনাদের, যদি আসতে চান, আমার সাথেই বসে মিটিয়ে নিতে চান আপনাদের দাবীসনদ, তো সুস্বাগতম, না হলে আমার  সুযোগ্য উত্তরাধিকারী তো রইলেনই। তা সত্ত্বেও এসেছে ব্যাটারা। মালিক এবং শ্রমিক উভয়পক্ষই। 


বেলা তিনটে পর্যন্ত ধস্তাধস্তি করে,কখনও প্রবল হুমকি, কখনও সেন্টু, কখনও নিছক দর কষাকষি করে নোটশিটে নামল সেটেলমেন্ট। শেষ দিনে এসে সই করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উভয়পক্ষকে বিদায় জানিয়ে, পড়ে থাকা ফাইলপত্রে সইসাবুদ করে, বেঁচে থাকা বিল ভাউচার ছেড়ে যখন গাড়িতে উঠলাম, ভিজিটিং আওয়ার শুরু হতে বাকি মাত্র সোয়া একটি ঘন্টা। একঘন্টায় কি পৌঁছাতে পারব চুঁচুড়া থেকে হাওড়া? আপদ নার্সিংহোম, ইনটেনসিভ কেয়ারের রুগীকে দেখার সময় নির্দিষ্ট করেছে মাত্রই আধটা ঘন্টা। কালও দেরী হয়েছে মিনিট সাতেক, আজ যে কি হবে- 


ও রঞ্জিৎ, একটু জোরে চালাও বাপু। কেন যে আজই এত জ্যাম, দিল্লী রোড জুড়ে। সোয়া পাঁচটা নাগাদ ঝড়ের মত ঢুকলাম ইন্টেনসিভ কেয়ারে। নিদ্রিত বাবার হাতটা ধরতে গিয়ে মনে পড়ল, স্যানিটাইজ করা হয়নি তো। ভিজে হাতে হাতটা ধরতেই চোখ খুলল বাবা, সুপ্তোত্থিত পিতার মুখমণ্ডলে কেন জানি না, নিজের শিশুকন্যার মুখাবয়ব প্রত্যক্ষ করলাম আমি। ঠিক এই ভাবেই ঘুম ভাঙলে আড়ামোড়া ভাঙে তুত্তুরী। মুখটা ঠিক এই রকমই রক্তিম বর্ণ ধারণ করে পলকের তরে। 


‘অফিস যাসনি?’  প্রশ্ন করে বৃদ্ধ। জবাবে জানাই, আপিস ফেরতাই তো এসেছি। তাই না পরণে শাড়ি, উন্মুক্ত কেশদাম। চোখের পাতায় কাজলের হাল্কা ছোঁয়া। লিপস্টিক অবশ্যি খেয়ে নিয়েছি অনেক আগেই, মিটিং এর ফাঁকেফোকরে। অপলক দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধ, তারপর বলে, ‘বাইরে নিশ্চয়ই খুব ভিড়, নারে? আমার জন্যই তোদের পুজোটা ঘেঁটে গেল নারে?’ হাসি চেপে জবাব দিই, পাগল নাকি, বছর ঘুরে মা আসছে, আর বৃদ্ধের কন্যার মনে পুলক জাগবে না তা আবার হয় নাকি? যতই প্রতিকূল হোক পরিস্থিতি, ঠিক ফাঁকফোকর খুঁজে আনন্দ করে নেব আমি।  আর এসব কথা উঠছেই বা কেন, এটা যদি উল্টো হত, আমি শুয়ে থাকতাম ঐ দুধসাদা বিছানায়, আর এপারে দাঁড়িয়ে থাকত বৃদ্ধ, তাহলে সে কি একটি বারও ভাবত যে নষ্ট হয়ে গেল তার পুজো? আমি হয়তো অতটা মহান নই, প্রাথমিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম খানিকটা, ঘেঁটে গিয়েছিলাম পুরোপুরি, তারপর তো দিব্যি সামলে নিয়েছি নিজেকে। সামলাতে তো হতোই। সবাই সামলে নেয়। বৃদ্ধের সাথে দেখা করে,রিশেপসনে গিয়ে বসে থাকব এবার, ডাক্তার আসতে আরো ঘন্টা দেড়েক। তাঁর সাথে কথা বলে, ‘ছেড়ে দিন না ডাক্তারবাবু’র বৃথা অনুরোধ করর রোজকার মত। অতঃপর ডাক্তারের অনুমতি সাপেক্ষে ভিডিও কলে সংযুক্ত করব বৃদ্ধ আর তাঁর পক্ককেশ প্রেয়সীকে। ফাঁক দিয়ে দু একটা কথা বলে নেবে পিসিও। কথা বলতে বিবর্ণ শাড়ির আঁচলে মুছবে ভিজে চোখ। পিছন থেকে নানা মুখ ভঙ্গী করবেন ছিমতী তুত্তুরী। 


তারপর যাব বাজার। আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে লম্বা ফর্দ পাঠিয়েছেন শ্রীমতী তু্ত্তুরী। সারাদিন ধরে আমার মা যা যা বলেছে,আমার কন্যা তাই বাংলায় লিখে এবং স্ক্যান করে পাঠিয়েছে আমায়। ফেরার পথে ভাবছি একবার ঢুঁ মারব সুবল স্মৃতির মণ্ডপেও। তুলে  নিয়ে যাব আনন্দময়ীর ছবি, গৃহবন্দী জননী আর কন্যার জন্য। আমাদের যে ভালো থাকতেই হবে। আমরা ভালো না থাকলে বাবা ভালো থাকবে কি করে? আর ভালো হবেই বা কি করে?

অনির পুজোর ডাইরি ১০ই অক্টোবর, ২০২১

 অনির পুজোর ডাইরি ১০ই অক্টোবর, ২০২১

শুভ পঞ্চমী


'মা, মা একটা খেলা খেলবে?' দিন দুয়েক ধরে বলে যাচ্ছে তুত্তুরী। একাধিক চরিত্রে নাম ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হতে, কোথাও যেন সবথেকে বেশী অবহেলিত থেকে যায়, মায়ের ভূমিকাটাই। এই উৎসবের দিনেও শুকনো মুখে ঘরে বসে রয়েছে মেয়েটা। কাল সন্ধ্যে থেকে সামান্য জ্বর জ্বর ভাব। মধ্যরাতে ঘুমের আশ্লেষে একে অপরকে জড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলি আমরা, ‘বাবু, তুই যেন আমায় আর বিপদে ফেলিস না।’ ‘কাল ঠিক, ঠিক হয়ে যাব। তুমি দেখো। ’ ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে তুত্তরী। 


বোধহয় দরজার বাইরে হলেও কান পেতে শোনেন আনন্দময়ী। আজ সকাল থেকে সত্যিই উধাও হয়ে যায় জ্বর। নাকটানা আর কাশি অবশ্য বিদ্যমান। তবে ও যৎসামান্য। প্যারাসিটামলের পাহাড় উপুড় করে দিয়েছে বড় মামা। কত খাবি খা। শুধু সুস্থ থাক পুতু। এবাড়ি আর কোন মনোবেদনা সহ্য করার মত অবস্থায় নেই এই মুহূর্তে।  


যাই হোক, এরপর তো তুত্তুরীর আবেদন অগ্রাহ্য করা যায় না। খেলতেই হয়। তবে খেলার শর্ত হচ্ছে, গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে খেলতে হবে। আতঙ্কে এসির রিমোট লুকিয়ে রেখেছে মামমাম(থুড়ি দিদা)। কমানো সব পাখার রেগুলেটর। খেলা বলতে একটি পাতায় লিস্ট বানাতে হবে গোটা পনেরো প্রিয় গানের। কেউ কারো লিস্ট দেখতে পারব না আমরা। তারপর যখন তৈরি হয়ে যাবে লিস্টি, তখন আমরা মিলিয়ে দেখব কতগুলি গান পছন্দ দোঁহের। তবে শর্ত একটাই যে এই খেলায় জড়ানো যাবে না দাড়ি বুড়োকে।  তাঁর লেখা গান যেহেতু দুজনেরই পরম প্রিয়। 


বেশ তো, তৈরী হল লিস্টি-

এই মুহূর্তে তুত্তুরীর সেরা -১৫

১। নোকঝোক(ছপাক)

২। টু লেট টু টার্ন ব্যাক নাউ

৩। কভিরা✔️

৪। রাধারাণী লাগে✔️

৫। ঘর মোরে পরদেশীয়াঁ ✔️

৬। কলঙ্ক (টাইটেল ট্রাক)

৭। কানহা শো যা যারা

৮। চিডিয়া

৯। লগনলাগি রে

১০। এয় ওয়াতন (মেল ভার্সন)✔️

১১। ভারত✔️

১২। ভারত কি বেটি

১৩। আশমাঁ দি পরী

১৪। রাঞঝা(শেরশাহ)✔️

১৫। মন ভরেয়া ২.০


এবার আমার পালা, লিখতে বসে যত গানের কলি মাথায় আসে সবই তো দাড়ি বুড়োর লেখা। ধুৎ তেরী, যাই হোক, তাঁকে বাদ দিয়ে যে কটি গানের কলি মাথায় এল,তাই লিপিবদ্ধ করলুম শেষে-


১। দিল কি আওয়াজ ভি শুন, মেরে ফ্যসানে পে না যা ( আহাঃ পরম পূজনীয় রফি সাহেব)✔️

২। ও মেহবুবা (রাজ কাপুর আর মুকেশ জী। পিওর লাভ)

৩। রাঞ্জনা হুয়া ম্যায় তেরা, কওন তেরে বিন মেরা (ধনুষ)✔️

৪। ফুলোঁ কে রঙ সে, দিল কি কলম সে✔️ (কিশোরকুমারকে ছাড়া আবার লিস্টি হয় নাকি?)

৫। আজিব দাস্তান হ্যায় ইয়ে, কাঁহা শুরু কাঁহা খতম( আহাঃ লতাজী)✔️

৬। কুছ না কহো ( রাহুল দেববর্মন আর কুমার শানু❤️)

৭। ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী✔️

৮। আজি এসেছি,আজি এসেছি নিয়ে এই হাসি- রূপ-গান✔️ (এই গানটি দেখে শ্রীমতী তু্ত্তুরী ভয়ানক রাগ করেছিলেন, ‘বলেছিলাম না তোমায়,রবীন্দ্র সঙ্গীত রাখবে না’। স্বর্গীয় ডি এল রায় সাহেব, অনুগ্রহ করে আমার গণ্ডমূর্খ কন্যাটিকে মার্জনা করিবেন) 


৯। প্যার হুয়া হ্যায় জব সে, মুঝকো নেহি চ্যায়ন আতা (শৌভিকের প্রিয় জুটি লতা জী আর কিশোরকুমার)

১০। ম্যায়নে প্যার কিয়া (এস পি বালাসুব্রহ্মমণিয়ামের কণ্ঠ আমার শৈশবের প্রেম) 

১১। তারে বলে দিও, সে যেন আসে না আমার দ্বারে✔️ (চিরন্তন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ❤️আর উত্তমকুমার ❤️)

১২। নিশিরাত বাঁকাচাঁদ আকাশে ✔️(গীতা দত্ত❤️)

১৩। এয় দিল মুঝে বতা দে, তু কিসপে আগয়া হ্যায় (গীতা দত্ত❤️)✔️

১৪। আকাশ কেন ডাকে,মন ছুটি চায়✔️

১৫। বদনাম হবে জেনেও ভালোবেসেছিলাম


খেলা শেষে মেলাতে বসে দেখা গেল, ছিমতী তুত্তুরীর ১৫টা গানের মধ্যে ৬টা আমার মনোমত। যেগুলির পাশে ✔️ দেওয়া আর কি। আর আমার ১৫র মধ্যে ১০টাই ভীঈঈঈষণ প্রিয় তুত্তুরীর। ফলতঃ আমি বিজয়ী হইলাম এবং গতরাতে চাটুজ্জে বাড়ির বড় তরফের রাজাদার কাছ থেকে উপহার পাওয়া বিশাল বড় সিল্ক আর ক্যাডবেরী ফ্রুট এন্ড না্ট দুটোর ওপরেই আমার অধিকার স্বীকৃত হল। তবে জিতেও শান্তি নেই, তুত্তরী তালিকার বাকি ৯টা গান এবার আমায় শুনতে হবে এবং বিশদে বোঝাতে হবে কেন আর  দ্বিতীয়বার শুনতে আমি আগ্রহী নই👺👹👹। মা হওয়া কি মুখের কথা।😡😡

Sunday 26 September 2021

অনির পুজোর ডাইরি ২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০৩১

 

শৌভিকের গৃহত্যাগের সবথেকে কুপ্রভাব যার ওপর পড়েছে তিনি হলেন ছিমতী তুত্তুরী। একে বাবা থাকে না, তারওপর মাও মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ত। দিনের সাড়ে এগারো থেকে বারো ঘন্টা রাস্তাতেই কেটে যায়, বাকি বারোর মধ্যে ঘন্টা সাত-আটেক কাটে ঘুমে, বা চেপ্পে ধরে ঘুম পাড়ানোর বৃথা প্রচেষ্টায়। রইল হাতে চার, যার মধ্যে ঘরের কাজ-কাচাকুচি- দোকানবাজার- স্নান-খাওয়া আর পড়তে বসার হাকুচ তেতো ঘন্টা কতক বাদ দিলে হাতে পড়ে থাকে পেন্সিল। অবকাশ পেলেই হয় তমলুক নয়তো হাওড়ার টিকিট কাটি  মা-মেয়ে। দীর্ঘদিন অদর্শনে যদি আমাদের ভুলে যায় বাবা অথবা তুত্তুরী হীনতায় নতুন করে অবসাদে ভুগতে শুরু করে মামমাম। বয়স যে বড় অসহায়, বড় শিশুসুলভ বানিয়ে দেয় প্রিয়জনদের। 


বামন অবতারের মত তিনটি পা তিন জায়গায় রেখে ভারসাম্য বজার রাখার দিব্যি চেষ্টা করে চলেছি । ভুলেও তাই বলে ভাববেন না  ঘ্যানঘ্যান করছি। জীবন সিংহাসনে বসিয়েছেই যখন, মুকুট পরার যাতনা তো ভোগ করতেই হবে। সেটা  উভয়েই জানি এবং বুঝিও। শুধু দিনগুলো যদি ২৪ ঘন্টার জায়গায় ৩০ ঘন্টার হত- 


এদিকে বৎসরান্তে দরজায় কড়া নাড়ছেন দশভুজা, ওদিকে কিছুই যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি আমাদের। বামন অবতারগিরি করতে গিয়ে সারা বাড়ি ধূলিমলিন। পুবের দেওয়ালে নতুন করে কলম মক্স করেছে কে যেন। ছিমতি তুত্তুরী জোর গলায় বলছেন, উনি নন। কালপ্রিট অন্য কেউ। কে করল, সেটা উদ্ধার করতে মিঃ বক্সী বা মিঃ মিটারকে খবর দেব ভাবছি। আমি বা তুত্তুরী ব্যতীত এ বাড়ির বাসিন্দা বলতে তো মাসি। তবে কি মাসিই অপরাধী? তুত্তুরীকে দেখিয়ে দেখিয়েই বেচারী মাসিকেই খুব এক চোট চোখ পাকিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে ধমকে দিলাম, চা খাওয়া বন্ধ করার এমনকি বাড়িতে আর চা পাতা না আনার কঠোর হুমকিও দিলাম। কোন লাভ হল না যদিও, অপরাধী গোবেচারা মুখে বত্রিশ পাটি প্রদর্শন পূর্বক 'শ্রীময়ী' ধারাবাহিক দর্শনে মনোনিবেশ করলেন। 


সময়াভাব বা আমার বরের ভাষায় টাইম ম্যানেজমেন্টের গড়বড়ে যেখানে শৌভিকের সাধের বাড়িরই এই হাল, সেখানে কেনাকাটা, সাজুগুজু, আর ইয়ে পুজো স্পেশাল রোগা হওয়ার কথা তুলে আর হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। সব কিছুই সময় থাকতে করতে হত,বেশ বুঝতে পারছি। কি ভিড় সর্বত্র বাপস্। তারওপর আবার ছিমতী গুলাবোর হুংকার। আশ্বিন মাসে এত ঝড়ঝঞ্ঝা বৃষ্টিপাত কেন রে বাপু? দেবী তো নৌকায় নয়, বরং ঘোটকে আসছেন আর দোলায় রওনা দিচ্ছেন। 


কটার সময় যেন আসার কথা গুলাবের,তার আগেই তড়িঘড়ি টেনে নিয়ে গেলাম মেয়েটাকে চুল কাটতে। তখনও ভালো করে খোলেওনি পার্লার। চলছে ঝাঁট দেবার পালা। শ্রীমান সুরজিৎ আজ বছর আটেক ধরে ছুরি কাঁচি চালাচ্ছেন আমাদের মা আর মেয়ের মাথায়। তিনি তখন বসে বসে ঢুলছিলেন। কোন মতে চোখ রগড়ে,লাল মুছে বলল, ‘একদম ঠিক সময়ে এসেছ। কাল রাত বারোটায় বাড়ি ফিরেছি, চিন্তা করতে পারছ। ঘুমিয়েছি রাত দুটোয়। কাল সারাদিন খেতেও পাইনি। ’ জানালাম, ভিড়ের ভয়ে জলদি জলদি এসেছি বটে, তবে আজ আমাদের কোন তাড়া নেই। তুই বাবা ভালো করে খেয়ে,ঘুমিয়ে তবেই কাজে নাম। শেষে টাকলা মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলে, আর আমায় আস্ত রাখবে কেউ?শ্বশর-শাশুড়ির কথা তো ছেড়েই দিলাম আমার জন্মদাতা এবং দাত্রীই আমাকে 'তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি'র হুকুম শোনাবে। তারওপর আছেন ছিমতী তুত্তুরীর বন্ধুবান্ধবদের দলবল। 


যাই হোক, প্রভাতী ফাঁকা পার্লারে অনেকটা সময় দিয়ে ভালো করে ঘষে ঘষে ছ্যাম্পু করে, কণ্ডিশনার লাগিয়ে, খুস্কি নাশের কিসব লোশন লাগিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বকবক করে, কেশ কর্তন পূর্বক ব্লো ড্রাই করে পিলে চমকানো মার্কা একখান বিল ধরালো আমায়। তার সাথে সাথে কন্যার মাথায় এটাও ঢোকালো মাথায় শ্যাম্পু দেবার পর অন্তত পাঁচ মিনিট ধরে মাথা ধুতে হয় আর নিজের চিরুনি অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দিতে নেই। পরিণাম স্বরূপ বাড়ি এসে সবকটা চিরুনি তথা হেয়ার ব্রাশ কুক্ষিগত করেছেন তিনি। ভাবছি শ্রীমান Shouvik Bhattacharya কে বলব, মেয়ের কেশ কর্তনের বিলটার সাথে সাথে আমার প্যাডল ব্রাশ আর শ্যাম্পু কম্ব গুলোর দামটাও যদি একটু ট্রান্সফার করে। হামি গরিব লেবার আছি কি না।

ইতি অনিন্দিতা

 মহানগর কলিকাতা 

শনিবার, ১০ই আশ্বিন, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ


ওগো, 


তুমি শুনলে নির্ঘাত পুলকিত হবে, তোমার কন্যা এই আধবুড়ো বয়সে,মধ্যরাতে বসে ‘সহজপাঠ’ পাঠ করছে। 


সেই যে সহজপাঠ, বড় আশা করে যা কিনে দিয়েছিল আমার বাবা। তুত্তুরীর তখন কতই বা বয়স? তিনও হয়নি। বাবার হস্তাক্ষরে লেখা আছে তারিখটা, ১লা জুলাই, ২০১৩।  খাবার টেবিলে বসে সেদিন কি যত্ন করে ব্রাউন পেপার দিয়ে মলাট করছিল বাবা। মাঝে মাঝে সুর করে পড়ছিল, ‘ছোটো খোকা বলে অ-আ/শেখে নি সে কথা কওয়া’।  ‘খিদে পায়, খুকি ঞ/শুয়ে কাঁদে কিয়োঁ কিয়োঁ। ’ শুনে সে কি খিলখিল করে হেসে উঠেছিল সেদিনের বুজু তুত্তুরী। 


 সাড়ে তিন বছর বয়সে যেদিন কেড়ে নিয়ে এলাম দাদুর সোনার তুত্তুরীকে, বিষণ্ণ গলায় বলেছিল বাবা, ‘সহজপাঠ গুলো নিয়ে যাস। সময় পেলে একটু পড়ে শোনাস।’ নৈমিত্তিক পড়াশোনার ফাঁকেফোকরে যে পড়তে বসিনি তাও নয়,তবে যা হয় আর কি, বই পড়ার থেকে  অনর্গল আগডুম-বাগডুম বকা, ডেট এক্সপায়ার হয়ে যাওয়া জনসন শ্যাম্পু খাওয়া আর দেওয়ালে সাপ-ব্যাঙ-শকুনির ঠ্যাং আঁকার উৎসাহই বেশী ছিল তোমার কন্যার। 


যত বড় হতে লাগল, ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল বই পড়া । পাঁচন গেলার মত করে পাঠ্যপুস্তক যাও বা পড়ত, গল্পের বইয়ের নাম করলেই দনুজদলনী হয়ে সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে কৈলাশে রওণা দিত মেয়ে। রীতিমত তাজ্জব হয়ে যেতাম আমরা। পড়ার বই ছেড়ে গল্পের বই পড়ার জন্য ধোলাই খেয়ে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্ম বুঝতেই পারত না, খামোকা গল্পের বইয়ের ওপর এমন বিরাগ কেন! জনৈকা সিনিয়র দিদি খুব ভালো করে বুঝিয়েছিল একবার,স্কুলে ফিরিঙ্গী ভাষার ওপর জোর দেওয়া হয়, আর বাড়িতে আমরা কথা বলি গোদা বাংলায়। ফলে দোঁআসলা তৈরী হচ্ছে আমাদের উত্তর প্রজন্ম। 


গল্পের বই পড়লে,পড়ার ছুটি এই প্রলোভন দেখিয়ে যাকে ইলিয়াড-ওডিসি পড়িয়েছিলাম, তিনি সম্প্রতি রবিঠাকুরের জনগণমনের প্রেমে পড়েছেন। হঠাৎ হঠাৎ করে আমাকে আর মাসিকে উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে কারণ তিনি রাষ্ট্র সংগীত গাইবেন। কি জ্বালা মাইরি।


 তোমারই তো মেয়ে,তাই রাজকাহিনীর জনগণমন তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি খুঁজে বার করেছেন স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তের গান। রাত এগারোটার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই শুনলাম। যত বলি,ওরে এটা জাতীয় সংগীত নয়, এটা নিছক রবীন্দ্র সংগীত।  শুনলে তো? আজ যে কার মুখ দেখে উঠেছি, আপিস থেকে  ফিরে শুনলাম তিনি গীতবিতান নামিয়ে, জনগণমন খুঁজে, পুরো কবিতাটা মুখস্থ করেছেন। শুধু সুরটা এখনও সামান্য টলটলে আছে। আগামী ২৬শে জানুয়ারীর মধ্যে ঠিক করে নেবেন তিনি, বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। 


এই অবধি ঠিকই ছিল,তারপর তিনি শুরু করলেন,এই গানটির নীচে কে,কি মন্তব্য করেছেন। বিমোহিত সুরে বললেন,‘জানো, একজন লিখেছে,আমি এই প্রথম বেঙ্গলি ভার্সানটা শুনলাম। এটা হিন্দি ভার্সনের থেকে অনেক গুণে ভালো। ওরা যে কেন ইয়ামুনা বলে,যমুনা বললেই তো পারে।’ অতঃপর যা হয় আর কি, দৈনিক ক্লান্তি ভুলে লম্বা একখানি বক্তব্য রাখলাম আমি। তুমি না থাকায়,স্বর্গীয় সুকুমার রায়কে উদ্ধৃত করেই বলি, ‘ছুট‌লে কথা থামায় কে? আজকে ঠেকায় আমায় কে?’ যে কিনা ইউনিট টেস্টেই সংসদ আর সংবিধান পড়েছে,সে জানে না, কেন বাংলা গানটা গাওয়া হয় না? বেশ খানিক ইতিহাস চব্য করার পর দেখি তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্য জানতে চাইলাম,যে মহাপুরুষ এই প্রথম বাংলা জনগণ শুনলেন,তিনি কি অবাঙালী? ঘাবড়ে যাওয়া জবাব পাই, ‘নাঃ বাঙালী তো। ’ 


বাঃ! তা তাঁর বয়স কত? একগাল হেসে তুত্তুরী জানায়,এই প্রশ্নটা অারো অনেকে করেছে,‘ভাই তোর বয়স কত?’ ও বলেছে ওর বয়স নাকি ২২বছর। ’ ব্রাশ করছিলাম, শুনে প্রবল বিষম খেলাম। আমাদের যুগে না গুগলু কাকু ছিল না উট্যুব পিসি। তাও ভাই, মনে হয় বাইশের অর্ধেকেই শুনেছিলাম। চার আনা বাজি ধরতে পারি,আরো আগেই শুনে থাকতে পারি।  জ্যাঠাইমা আর শ্রীমান অয়নের গান আর ছোটকাকুর সেতারের দৌলতে গানবাজনার চর্চা বেশ ভালোই হত বাড়িতে। 


তোমার কন্যার পুলক আর ধরে না। বলল, লোকজন জানতে চেয়েছে, ভাই তুই কি এই সদ্য রবি ঠাকুরের নাম শুনলি? জবাবে তিনি বলেছেন, মোটেই না, নামটা তিনি চার বছর আগেই শুনেছিলেন। তবে এই গানটা এই প্রথম শুনলেন। বলতে বলতেই বোধহয় অনুভব করলেন, নিজের জ্ঞানের অগভীরতা আর রবির প্রসারতা। রবিই যে সকল শক্তির উৎস,তা মেনে নিয়ে রাত পৌনে বারোটায় ধুলো মুছে উদ্ধার হলেন সহজপাঠ প্রথম ভাগ। তিনি এখন সুর করে পড়ছেন, 

‘গগনে গগনে বরষণ-শেষে 

মেঘেরা পেয়েছে ছাড়া- 

বাতাসে বাতাসে ফেরে ভেসে ভেসে 

নাই কোন কাজে তাড়া। ’ 


আর ক্ষণে ক্ষণে কইছেন, উফঃ কি ভালো লিখতেন বলো মা, পড়তে পড়তে মনটা যেন কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তাই না মা? সাক্ষাৎ জ্ঞানপাপী  বুঝলে। 


ইতি

অনিন্দিতা

Tuesday 21 September 2021

অনির ডাইরি ১৮ই সেপ্টেম্বর,২০২১

 


জীবনের প্রথম পোস্টিং এ ইনসপেক্টর হিসেবে যাঁদের পেয়েছিলাম, মাত্র গুটি তিনেক বাদে, তাঁরা সকলেই বয়সে ছিলেন পিতৃব্যতুল্য আর স্বভাবে নমস্য। পশ্চিম মেদিনীপুর ছেড়ে আসার পরও বেশ অনেকদিন পর্যন্ত দুঃস্বপ্নে আসতেন তাঁরা। 


চুঁচুড়ায় আসতে না আসতেই ধীমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানিয়েছিল, ‘জানেন ম্যাডাম, এই আপিসে লোক টেকে না।’ কথাটা যে কতখানি অকাট্য, হাতে কলমে প্রমাণ পেলাম, চুঁচুড়ায় আসার একপক্ষ কালের মধ্যেই বদলী হয়ে গেল জনৈকা সিকেসিও আর প্রোমোশন পেয়ে আপিস ছাড়লেন তিন জন ইন্সপেক্টর। আর চতুর্থ ব্যক্তির সম্পর্কে কি আর বলি? তাঁর নিরুদ্দেশের আখ্যান রোজ ফোনে লাগাতে হত তৎকালীন বড়সাহেবকে। ‘স্যার এরকম মিস্ গায়েব মার্কা লোক নিয়ে আমি কাজ করব কি করে?’ কাজ করতেই তো এসেছি, নেহাৎ হাই তুলে সময় কাটাতে তো পাঠাননি আপনারা আমায় এ জেলায়। 


ক্রমাগত নালিশে ঝালাপালা হয়ে তৎকালীন নব মহাকরণের বড় সাহেব খোদ আমার নামেই নালিশ করেছিলেন আমার ব্যাচমেটদের কাছে। ‘আরেঃ এত ঘ্যানঘ্যান করলে হয়? তোমরা তো করো না। ওকে একটু বোঝাও-’। তা বোঝানোর চেষ্টাও করেছিল বটে  তারা। পেরেছিল কি?  আজ আমার পাঁচটা ব্লক আর দুটো পৌরসভার ইন্সপেক্টরই বলুন বা সিকেসিও ভ্যাকান্সি উভয় ক্ষেত্রেই কেবল একটি করে। বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে ঘ্যানঘ্যানানিও যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা এই জেলা আমায় শিখিয়েছিল। আর তার থেকেও বেশী দরকার স্নেহশীল আর নির্ভরযোগ্য ওপরওয়ালা,যার থেকে কখনও বঞ্চিত করেনি আমায় চন্দননগর। পর-পর তিনজন ভালো ওপরওয়ালা কোথাও না কোথাও বাড়িয়ে দিয়েছেন আত্মবিশ্বাস আর নির্ভরশীলতার পারদ। পরোক্ষ ভাবে ট্রেনিং আর উৎসাহ যুগিয়েছেন নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার। শিখিয়েছেন,আমার প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু আমিই, অন্য কেউ না। 


ছবিতে আমার অন্যতম প্রিয়তমা ইন্সপেক্টর শ্রীমতী সঞ্চিতা দাস পোদ্দারের সাথে।যদিও আমার সাতজন ইন্সপেক্টরই আমার সমান প্রিয়, তবুও সঞ্চিতার খাতির সামান্য হলেও একটু বেশী। নির্মল যদিও প্রায়ই নালিশ করে, বেশ বেশী। সে তো হবেই।  চুঁচুড়ায় আসার সাথে সাথেই পর পর ঝামেলা বাঁধে জনৈকা ইন্সপেক্টর এবং মহিলা সিকেসিওর সাথে। উভয়েই ত্যাগ করেন মোরে। তারপর আর ছাপ পড়তে সময় লাগেনি, মহানগরের মাননীয় মহানাগরিকেরা খড়কে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন,‘কে অনিন্দিতা? ও মেয়েদের সাথে কাজ করতে পারে না। ’ যেন ফাঁকিবাজ আর দুর্নীতিগ্রস্ত পুরুষ সহকর্মীদের ঝাড়তে আমি কোন কসুর করি। যাই হোক, এই ধরণের হামবাগ জনগণের মুখে ‘টাইট স্ল্যাপ(ফিরিঙ্গী ভাষায় না কইলে ঠিক অনুভূতিটা বোঝানো যায় না)’ কষিয়ে বিগত সাড়ে চার/পৌনে পাঁচ বছর ধরে দিব্যি ঘর করছি সঞ্চিতা আর আমি। চুপি চুপি বলি, এই চূড়ান্ত সৎ এবং কর্তব্যপরায়ন ভদ্রমহিলাকে ভয়ানক ভালোবাসি আমি, তবে তার থেকেও ভয় পাই কয়েক শতগুণ। সঞ্চিতা প্রথম চোটে চিৎকার করবে,তারপর হাত পা ছুঁড়বে,তারপর কাঁদতে বসবে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। প্রতিনিয়ত আয়না দেখি এই ভদ্রমহিলার মধ্যে।