জীবনের প্রথম পোস্টিং এ ইনসপেক্টর হিসেবে যাঁদের পেয়েছিলাম, মাত্র গুটি তিনেক বাদে, তাঁরা সকলেই বয়সে ছিলেন পিতৃব্যতুল্য আর স্বভাবে নমস্য। পশ্চিম মেদিনীপুর ছেড়ে আসার পরও বেশ অনেকদিন পর্যন্ত দুঃস্বপ্নে আসতেন তাঁরা।
চুঁচুড়ায় আসতে না আসতেই ধীমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানিয়েছিল, ‘জানেন ম্যাডাম, এই আপিসে লোক টেকে না।’ কথাটা যে কতখানি অকাট্য, হাতে কলমে প্রমাণ পেলাম, চুঁচুড়ায় আসার একপক্ষ কালের মধ্যেই বদলী হয়ে গেল জনৈকা সিকেসিও আর প্রোমোশন পেয়ে আপিস ছাড়লেন তিন জন ইন্সপেক্টর। আর চতুর্থ ব্যক্তির সম্পর্কে কি আর বলি? তাঁর নিরুদ্দেশের আখ্যান রোজ ফোনে লাগাতে হত তৎকালীন বড়সাহেবকে। ‘স্যার এরকম মিস্ গায়েব মার্কা লোক নিয়ে আমি কাজ করব কি করে?’ কাজ করতেই তো এসেছি, নেহাৎ হাই তুলে সময় কাটাতে তো পাঠাননি আপনারা আমায় এ জেলায়।
ক্রমাগত নালিশে ঝালাপালা হয়ে তৎকালীন নব মহাকরণের বড় সাহেব খোদ আমার নামেই নালিশ করেছিলেন আমার ব্যাচমেটদের কাছে। ‘আরেঃ এত ঘ্যানঘ্যান করলে হয়? তোমরা তো করো না। ওকে একটু বোঝাও-’। তা বোঝানোর চেষ্টাও করেছিল বটে তারা। পেরেছিল কি? আজ আমার পাঁচটা ব্লক আর দুটো পৌরসভার ইন্সপেক্টরই বলুন বা সিকেসিও ভ্যাকান্সি উভয় ক্ষেত্রেই কেবল একটি করে। বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে ঘ্যানঘ্যানানিও যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা এই জেলা আমায় শিখিয়েছিল। আর তার থেকেও বেশী দরকার স্নেহশীল আর নির্ভরযোগ্য ওপরওয়ালা,যার থেকে কখনও বঞ্চিত করেনি আমায় চন্দননগর। পর-পর তিনজন ভালো ওপরওয়ালা কোথাও না কোথাও বাড়িয়ে দিয়েছেন আত্মবিশ্বাস আর নির্ভরশীলতার পারদ। পরোক্ষ ভাবে ট্রেনিং আর উৎসাহ যুগিয়েছেন নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার। শিখিয়েছেন,আমার প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু আমিই, অন্য কেউ না।
ছবিতে আমার অন্যতম প্রিয়তমা ইন্সপেক্টর শ্রীমতী সঞ্চিতা দাস পোদ্দারের সাথে।যদিও আমার সাতজন ইন্সপেক্টরই আমার সমান প্রিয়, তবুও সঞ্চিতার খাতির সামান্য হলেও একটু বেশী। নির্মল যদিও প্রায়ই নালিশ করে, বেশ বেশী। সে তো হবেই। চুঁচুড়ায় আসার সাথে সাথেই পর পর ঝামেলা বাঁধে জনৈকা ইন্সপেক্টর এবং মহিলা সিকেসিওর সাথে। উভয়েই ত্যাগ করেন মোরে। তারপর আর ছাপ পড়তে সময় লাগেনি, মহানগরের মাননীয় মহানাগরিকেরা খড়কে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন,‘কে অনিন্দিতা? ও মেয়েদের সাথে কাজ করতে পারে না। ’ যেন ফাঁকিবাজ আর দুর্নীতিগ্রস্ত পুরুষ সহকর্মীদের ঝাড়তে আমি কোন কসুর করি। যাই হোক, এই ধরণের হামবাগ জনগণের মুখে ‘টাইট স্ল্যাপ(ফিরিঙ্গী ভাষায় না কইলে ঠিক অনুভূতিটা বোঝানো যায় না)’ কষিয়ে বিগত সাড়ে চার/পৌনে পাঁচ বছর ধরে দিব্যি ঘর করছি সঞ্চিতা আর আমি। চুপি চুপি বলি, এই চূড়ান্ত সৎ এবং কর্তব্যপরায়ন ভদ্রমহিলাকে ভয়ানক ভালোবাসি আমি, তবে তার থেকেও ভয় পাই কয়েক শতগুণ। সঞ্চিতা প্রথম চোটে চিৎকার করবে,তারপর হাত পা ছুঁড়বে,তারপর কাঁদতে বসবে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। প্রতিনিয়ত আয়না দেখি এই ভদ্রমহিলার মধ্যে।
No comments:
Post a Comment