শৌভিকের গৃহত্যাগের সবথেকে কুপ্রভাব যার ওপর পড়েছে তিনি হলেন ছিমতী তুত্তুরী। একে বাবা থাকে না, তারওপর মাও মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ত। দিনের সাড়ে এগারো থেকে বারো ঘন্টা রাস্তাতেই কেটে যায়, বাকি বারোর মধ্যে ঘন্টা সাত-আটেক কাটে ঘুমে, বা চেপ্পে ধরে ঘুম পাড়ানোর বৃথা প্রচেষ্টায়। রইল হাতে চার, যার মধ্যে ঘরের কাজ-কাচাকুচি- দোকানবাজার- স্নান-খাওয়া আর পড়তে বসার হাকুচ তেতো ঘন্টা কতক বাদ দিলে হাতে পড়ে থাকে পেন্সিল। অবকাশ পেলেই হয় তমলুক নয়তো হাওড়ার টিকিট কাটি মা-মেয়ে। দীর্ঘদিন অদর্শনে যদি আমাদের ভুলে যায় বাবা অথবা তুত্তুরী হীনতায় নতুন করে অবসাদে ভুগতে শুরু করে মামমাম। বয়স যে বড় অসহায়, বড় শিশুসুলভ বানিয়ে দেয় প্রিয়জনদের।
বামন অবতারের মত তিনটি পা তিন জায়গায় রেখে ভারসাম্য বজার রাখার দিব্যি চেষ্টা করে চলেছি । ভুলেও তাই বলে ভাববেন না ঘ্যানঘ্যান করছি। জীবন সিংহাসনে বসিয়েছেই যখন, মুকুট পরার যাতনা তো ভোগ করতেই হবে। সেটা উভয়েই জানি এবং বুঝিও। শুধু দিনগুলো যদি ২৪ ঘন্টার জায়গায় ৩০ ঘন্টার হত-
এদিকে বৎসরান্তে দরজায় কড়া নাড়ছেন দশভুজা, ওদিকে কিছুই যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি আমাদের। বামন অবতারগিরি করতে গিয়ে সারা বাড়ি ধূলিমলিন। পুবের দেওয়ালে নতুন করে কলম মক্স করেছে কে যেন। ছিমতি তুত্তুরী জোর গলায় বলছেন, উনি নন। কালপ্রিট অন্য কেউ। কে করল, সেটা উদ্ধার করতে মিঃ বক্সী বা মিঃ মিটারকে খবর দেব ভাবছি। আমি বা তুত্তুরী ব্যতীত এ বাড়ির বাসিন্দা বলতে তো মাসি। তবে কি মাসিই অপরাধী? তুত্তুরীকে দেখিয়ে দেখিয়েই বেচারী মাসিকেই খুব এক চোট চোখ পাকিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে ধমকে দিলাম, চা খাওয়া বন্ধ করার এমনকি বাড়িতে আর চা পাতা না আনার কঠোর হুমকিও দিলাম। কোন লাভ হল না যদিও, অপরাধী গোবেচারা মুখে বত্রিশ পাটি প্রদর্শন পূর্বক 'শ্রীময়ী' ধারাবাহিক দর্শনে মনোনিবেশ করলেন।
সময়াভাব বা আমার বরের ভাষায় টাইম ম্যানেজমেন্টের গড়বড়ে যেখানে শৌভিকের সাধের বাড়িরই এই হাল, সেখানে কেনাকাটা, সাজুগুজু, আর ইয়ে পুজো স্পেশাল রোগা হওয়ার কথা তুলে আর হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। সব কিছুই সময় থাকতে করতে হত,বেশ বুঝতে পারছি। কি ভিড় সর্বত্র বাপস্। তারওপর আবার ছিমতী গুলাবোর হুংকার। আশ্বিন মাসে এত ঝড়ঝঞ্ঝা বৃষ্টিপাত কেন রে বাপু? দেবী তো নৌকায় নয়, বরং ঘোটকে আসছেন আর দোলায় রওনা দিচ্ছেন।
কটার সময় যেন আসার কথা গুলাবের,তার আগেই তড়িঘড়ি টেনে নিয়ে গেলাম মেয়েটাকে চুল কাটতে। তখনও ভালো করে খোলেওনি পার্লার। চলছে ঝাঁট দেবার পালা। শ্রীমান সুরজিৎ আজ বছর আটেক ধরে ছুরি কাঁচি চালাচ্ছেন আমাদের মা আর মেয়ের মাথায়। তিনি তখন বসে বসে ঢুলছিলেন। কোন মতে চোখ রগড়ে,লাল মুছে বলল, ‘একদম ঠিক সময়ে এসেছ। কাল রাত বারোটায় বাড়ি ফিরেছি, চিন্তা করতে পারছ। ঘুমিয়েছি রাত দুটোয়। কাল সারাদিন খেতেও পাইনি। ’ জানালাম, ভিড়ের ভয়ে জলদি জলদি এসেছি বটে, তবে আজ আমাদের কোন তাড়া নেই। তুই বাবা ভালো করে খেয়ে,ঘুমিয়ে তবেই কাজে নাম। শেষে টাকলা মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলে, আর আমায় আস্ত রাখবে কেউ?শ্বশর-শাশুড়ির কথা তো ছেড়েই দিলাম আমার জন্মদাতা এবং দাত্রীই আমাকে 'তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি'র হুকুম শোনাবে। তারওপর আছেন ছিমতী তুত্তুরীর বন্ধুবান্ধবদের দলবল।
যাই হোক, প্রভাতী ফাঁকা পার্লারে অনেকটা সময় দিয়ে ভালো করে ঘষে ঘষে ছ্যাম্পু করে, কণ্ডিশনার লাগিয়ে, খুস্কি নাশের কিসব লোশন লাগিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বকবক করে, কেশ কর্তন পূর্বক ব্লো ড্রাই করে পিলে চমকানো মার্কা একখান বিল ধরালো আমায়। তার সাথে সাথে কন্যার মাথায় এটাও ঢোকালো মাথায় শ্যাম্পু দেবার পর অন্তত পাঁচ মিনিট ধরে মাথা ধুতে হয় আর নিজের চিরুনি অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দিতে নেই। পরিণাম স্বরূপ বাড়ি এসে সবকটা চিরুনি তথা হেয়ার ব্রাশ কুক্ষিগত করেছেন তিনি। ভাবছি শ্রীমান Shouvik Bhattacharya কে বলব, মেয়ের কেশ কর্তনের বিলটার সাথে সাথে আমার প্যাডল ব্রাশ আর শ্যাম্পু কম্ব গুলোর দামটাও যদি একটু ট্রান্সফার করে। হামি গরিব লেবার আছি কি না।
No comments:
Post a Comment