মহানগর কলিকাতা
শনিবার, ১০ই আশ্বিন, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ
ওগো,
তুমি শুনলে নির্ঘাত পুলকিত হবে, তোমার কন্যা এই আধবুড়ো বয়সে,মধ্যরাতে বসে ‘সহজপাঠ’ পাঠ করছে।
সেই যে সহজপাঠ, বড় আশা করে যা কিনে দিয়েছিল আমার বাবা। তুত্তুরীর তখন কতই বা বয়স? তিনও হয়নি। বাবার হস্তাক্ষরে লেখা আছে তারিখটা, ১লা জুলাই, ২০১৩। খাবার টেবিলে বসে সেদিন কি যত্ন করে ব্রাউন পেপার দিয়ে মলাট করছিল বাবা। মাঝে মাঝে সুর করে পড়ছিল, ‘ছোটো খোকা বলে অ-আ/শেখে নি সে কথা কওয়া’। ‘খিদে পায়, খুকি ঞ/শুয়ে কাঁদে কিয়োঁ কিয়োঁ। ’ শুনে সে কি খিলখিল করে হেসে উঠেছিল সেদিনের বুজু তুত্তুরী।
সাড়ে তিন বছর বয়সে যেদিন কেড়ে নিয়ে এলাম দাদুর সোনার তুত্তুরীকে, বিষণ্ণ গলায় বলেছিল বাবা, ‘সহজপাঠ গুলো নিয়ে যাস। সময় পেলে একটু পড়ে শোনাস।’ নৈমিত্তিক পড়াশোনার ফাঁকেফোকরে যে পড়তে বসিনি তাও নয়,তবে যা হয় আর কি, বই পড়ার থেকে অনর্গল আগডুম-বাগডুম বকা, ডেট এক্সপায়ার হয়ে যাওয়া জনসন শ্যাম্পু খাওয়া আর দেওয়ালে সাপ-ব্যাঙ-শকুনির ঠ্যাং আঁকার উৎসাহই বেশী ছিল তোমার কন্যার।
যত বড় হতে লাগল, ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল বই পড়া । পাঁচন গেলার মত করে পাঠ্যপুস্তক যাও বা পড়ত, গল্পের বইয়ের নাম করলেই দনুজদলনী হয়ে সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে কৈলাশে রওণা দিত মেয়ে। রীতিমত তাজ্জব হয়ে যেতাম আমরা। পড়ার বই ছেড়ে গল্পের বই পড়ার জন্য ধোলাই খেয়ে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্ম বুঝতেই পারত না, খামোকা গল্পের বইয়ের ওপর এমন বিরাগ কেন! জনৈকা সিনিয়র দিদি খুব ভালো করে বুঝিয়েছিল একবার,স্কুলে ফিরিঙ্গী ভাষার ওপর জোর দেওয়া হয়, আর বাড়িতে আমরা কথা বলি গোদা বাংলায়। ফলে দোঁআসলা তৈরী হচ্ছে আমাদের উত্তর প্রজন্ম।
গল্পের বই পড়লে,পড়ার ছুটি এই প্রলোভন দেখিয়ে যাকে ইলিয়াড-ওডিসি পড়িয়েছিলাম, তিনি সম্প্রতি রবিঠাকুরের জনগণমনের প্রেমে পড়েছেন। হঠাৎ হঠাৎ করে আমাকে আর মাসিকে উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে কারণ তিনি রাষ্ট্র সংগীত গাইবেন। কি জ্বালা মাইরি।
তোমারই তো মেয়ে,তাই রাজকাহিনীর জনগণমন তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি খুঁজে বার করেছেন স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তের গান। রাত এগারোটার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই শুনলাম। যত বলি,ওরে এটা জাতীয় সংগীত নয়, এটা নিছক রবীন্দ্র সংগীত। শুনলে তো? আজ যে কার মুখ দেখে উঠেছি, আপিস থেকে ফিরে শুনলাম তিনি গীতবিতান নামিয়ে, জনগণমন খুঁজে, পুরো কবিতাটা মুখস্থ করেছেন। শুধু সুরটা এখনও সামান্য টলটলে আছে। আগামী ২৬শে জানুয়ারীর মধ্যে ঠিক করে নেবেন তিনি, বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।
এই অবধি ঠিকই ছিল,তারপর তিনি শুরু করলেন,এই গানটির নীচে কে,কি মন্তব্য করেছেন। বিমোহিত সুরে বললেন,‘জানো, একজন লিখেছে,আমি এই প্রথম বেঙ্গলি ভার্সানটা শুনলাম। এটা হিন্দি ভার্সনের থেকে অনেক গুণে ভালো। ওরা যে কেন ইয়ামুনা বলে,যমুনা বললেই তো পারে।’ অতঃপর যা হয় আর কি, দৈনিক ক্লান্তি ভুলে লম্বা একখানি বক্তব্য রাখলাম আমি। তুমি না থাকায়,স্বর্গীয় সুকুমার রায়কে উদ্ধৃত করেই বলি, ‘ছুটলে কথা থামায় কে? আজকে ঠেকায় আমায় কে?’ যে কিনা ইউনিট টেস্টেই সংসদ আর সংবিধান পড়েছে,সে জানে না, কেন বাংলা গানটা গাওয়া হয় না? বেশ খানিক ইতিহাস চব্য করার পর দেখি তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্য জানতে চাইলাম,যে মহাপুরুষ এই প্রথম বাংলা জনগণ শুনলেন,তিনি কি অবাঙালী? ঘাবড়ে যাওয়া জবাব পাই, ‘নাঃ বাঙালী তো। ’
বাঃ! তা তাঁর বয়স কত? একগাল হেসে তুত্তুরী জানায়,এই প্রশ্নটা অারো অনেকে করেছে,‘ভাই তোর বয়স কত?’ ও বলেছে ওর বয়স নাকি ২২বছর। ’ ব্রাশ করছিলাম, শুনে প্রবল বিষম খেলাম। আমাদের যুগে না গুগলু কাকু ছিল না উট্যুব পিসি। তাও ভাই, মনে হয় বাইশের অর্ধেকেই শুনেছিলাম। চার আনা বাজি ধরতে পারি,আরো আগেই শুনে থাকতে পারি। জ্যাঠাইমা আর শ্রীমান অয়নের গান আর ছোটকাকুর সেতারের দৌলতে গানবাজনার চর্চা বেশ ভালোই হত বাড়িতে।
তোমার কন্যার পুলক আর ধরে না। বলল, লোকজন জানতে চেয়েছে, ভাই তুই কি এই সদ্য রবি ঠাকুরের নাম শুনলি? জবাবে তিনি বলেছেন, মোটেই না, নামটা তিনি চার বছর আগেই শুনেছিলেন। তবে এই গানটা এই প্রথম শুনলেন। বলতে বলতেই বোধহয় অনুভব করলেন, নিজের জ্ঞানের অগভীরতা আর রবির প্রসারতা। রবিই যে সকল শক্তির উৎস,তা মেনে নিয়ে রাত পৌনে বারোটায় ধুলো মুছে উদ্ধার হলেন সহজপাঠ প্রথম ভাগ। তিনি এখন সুর করে পড়ছেন,
‘গগনে গগনে বরষণ-শেষে
মেঘেরা পেয়েছে ছাড়া-
বাতাসে বাতাসে ফেরে ভেসে ভেসে
নাই কোন কাজে তাড়া। ’
আর ক্ষণে ক্ষণে কইছেন, উফঃ কি ভালো লিখতেন বলো মা, পড়তে পড়তে মনটা যেন কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তাই না মা? সাক্ষাৎ জ্ঞানপাপী বুঝলে।
ইতি
অনিন্দিতা
No comments:
Post a Comment