Friday 14 May 2021

অনির ডাইরি ৯ই এপ্রিল, ২০২১

 


‘কে রে? পুতু এলি?’ দোতলার বারন্দায় কাপড় মেলতে মেলতে প্রশ্ন করে চৈতি। পুতু বা সময়বিশেষে পুটু ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরী  জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে 'তুত্তুরী ভিলা’য় সেঁদিয়ে গেল। ভাগের বাড়িটার নাম বাবা রেখেছে ‘তুত্তুরী ভিলা’। গাড়িতে আনতে আনতে পইপই করে বুঝিয়েছি, একটু ভদ্র সভ্য হয়ে থাকিস বাবু। এক আধবেলা তো নয়, পাক্কা পাঁচরাত ছয়দিন আমাকে/আমাদেরকে ছেড়ে থাকবে মেয়েটা। 


হাওড়ায় নামলেই সাপের পঞ্চম পা দেখে মেয়েটা। তুত্তুরী ভিলায় পা দিলেই আরো দুই জোড়া হাত পা গজায় বোধহয়। সারাদিন দস্যিবৃত্তি করে বেড়ায় বুল্লুর সাথে। শ্রীমতী তুত্তুরীর না হয় সদ্য কেঁদে ককিয়ে পঞ্চম শ্রেণী। বুল্লু বাবুর তো নয়। আর বছর দুয়েক বাদে মাধ্যমিক দেবে ছেলেটা।  দাদার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটালে বা মামীকে বেশী জ্বালাতন করলে বা মামমাম (দিদা) এর সমস্ত ডেটা খরচ করে দিলে যে পিঠের চামড়া আস্ত থাকবে না, তা বুঝিয়ে শুনিয়েই এনেছিলাম। মাইরি বলছি, তাই বলে  বড়মামীর সাথে সম্পূর্ণ বাক্যালাপ বন্ধ করতে শেখাইনি। 


লজ্জায় অধোবদন হয়ে মেয়েটাকে যে দুটো কটু কথা শোনাব তারও উপায় নেই।  তুত্তুরী ভিলায় পদার্পন করার সাথে সাথেই কন্যাকে শাসন করার অধিকার হারাই আমি। আদরের পুতু পাত্তা না দিলেও, নিজেই নেমে এল বড়মামি। আদর সম্ভাষণ শুরু করেছে সদ্য এমন সময়, আমার কন্যা সটান গিয়ে তার গা শুঁকতে লাগল। এই মেয়েটার জন্য কারো সামনে মুখ দেখানো যাবে না, যা দেখি। ধমকানির আগেই সোল্লাসে বলে উঠল তুত্তুরী, ‘বড়মামি, তোমার গায়ে কিসের যেন গন্ধ? তুমি চাউমিন করেছ বোধহয়। ’ হাওড়ায় মেয়েকে গচ্ছিত রেখে চুঁচুড়া যাব, নির্বাচনী কর্তব্য সারতে, তাই সক্কাল সক্কাল ভরপেট ভাত খাইয়েই এনেছিলাম মেয়েটাকে। একপেট ভাত খেয়েও যে কেউ এইভাবে হ্যাঙলা ইয়ের মত চাউমিনের গন্ধ শুঁকে বেড়ায়, এ আমি বাপের জন্মেও দেখিনি। চৈতির অবশ্য বিকার নেই, পরম হর্ষে তার পুতুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছে, ‘করেছি তো। চল তুই আর দাদা খাবি। তার আগে দাদাকে ঘুম থেকে টেনে তুলবি চল।’


মানে মানে কেটে পড়লাম হাওড়া থেকে। দিন পাঁচেক পর এসে সবাইকে সুস্থ দেখলে হয়। চুঁচুড়ায় পৌঁছে ফোনে জানতে চাইলাম কি করছে মেয়েটা। জবাব পেলাম, ‘দাদার সাথে ক্রিকেট খেলছি মা। স্মাইলি বল দিয়ে ক্রিকেট। ’  বুঝতে পারলাম স্বর্গীয় ছোটকাকুর সাধের বৈঠকখানায় এখন চলছে জমজমাট ক্রিকেট ম্যাচ। বোঝাতে গেলাম হোক স্মাইলি বল, তবু সাবধানে খেলো বাবু, অনেক মূল্যবান ছবি আছে ঐ ঘরটায়। অতীতে মাখামাখি এমন কিছু সাদাকালো আর রঙীন ছবি, যেখানে থমকে আছে সময়। ঘুরিয়ে জবাব পেলাম, না ছবিতে বল লাগেনি বটে, তবে প্রথম শটেই বড়মামার দাড়ি কামানোর গ্লাসের জলে বল ফেলেছিল তুত্তুরী। তখন ক্রিকেট চলছিল দোতলায়। 


ওই ম্যাচ পণ্ড হবার পর, পরের ম্যাচ বৈঠকখানায় শুরু হতে না হতেই  বড়মামির পেটে শট মেরেছে তুত্তুরী। কি যেন কাজে ঘরে ঢুকেছিল বড়মামী। দাদা অর্থাৎ বুল্লু বলছে, মায়ের পেটে বল মারতে পারা মানে চার, তুত্তুরীর দাবী ছয় রান তো দিতেই হবে।   


দপ্তরী কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে মায়ের ফোন। তুলতেই ওপাশ থেকে তুত্তুরীর অভিমানী গলা, ‘মা বড়মামী খুব বাজে। খালি কাজই করে চলেছে। একটুও সময় দিচ্ছে না আমায়। এদিকে মামমামের ফোনের সব ডেটাও যেন কিভাবে শেষ করে ফেলেছে মামমাম।  তুমি একটু কাকিমার নম্বরটা দাও তো। একটু কাকিমার সাথে কথা বলি। ’ পেটে বলের গুঁতো খাবার পরও যে বড়মামি,তুত্তুরীর সাথে সম্পর্ক রেখেছে এতেই আমি কৃতার্থ, তারপর আবার সময় কেন দেবে বুঝতে পারলাম না। আর  মামমাম বেচারা শুধু ফোন করতে পারে, কষ্টেসৃষ্টে ধরতে পারে আর ফেসবুক খুলতে পারে। আর কিছুই তেমন পারে না। তিনি কিভাবে দেড় জিবি ডেটা শেষ করলেন, এটা আর কেউ না বুঝতে পারলেও তুত্তুরীর মা বেমালুম বোঝে। 


বেলা বাড়ে, পশ্চিম আকাশে এক মুঠো লাল আবির ছড়িয়ে পাটে বসেন সূর্য দেব। কর্মব্যস্ততার ফাঁকেও মেয়ের  জন্য  টনটন করে হৃদয়। কেমন আছে মেয়েটা?  কি করছে মেয়েটা?ফোন করলাম মেয়েটাকে, প্রফুল্ল হয়ে শ্রীমতী তুত্তুরী জানায়, ‘দিদির গলা টিপছি মা। ’ দিদি অর্থাৎ আমার আদরের একমাত্র পিসি। হায় হায়! দিদির গলা টিপছ কেন? জবাবে বুঝলাম, বড়মামা হল আসল কালপ্রিট। বড়মামা অর্থাৎ শ্রীমান অয়ন খেলাচ্ছলে দিদিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমার কোথায় ব্যথা দিদি?’  দিদি সরল ভাবে জানিয়েছে, আপাততঃ গলা ছাড়া আর কোথাও তেমন ব্যথা নেই। অতঃপর দিদির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দুই ভাইবোন এবং ধেড়ে মামার গলা টেপা এবং তদজনিত সুড়সুড়ি এবং তদজনিত সম্মিলিত অট্টাহাস্যে বেশ বুঝতে পারলাম, ভালোই আছে মেয়েটা।  


রাতের মত কাজ মিটিয়ে হোটেলে ঢুকেলাম, কাল সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছাতে হবে কন্ট্রোল রুমে। নৈশাহার সেরে সবে শুয়েছি, টং করে চৈতির মেসেজ। ‘দেখো পুতু আমায় কেমন সাজিয়েছে-’। চৈতির ফটফটে মুখ, কালিঝুলি মাখা চোখ, ঘেঁটে যাওয়া লিপস্টিক দেখে প্রথম চোটে আঁতকে উঠতে হয়। স্বীয় কন্যার বাঁদরামিতে যৎপরনাস্তি লজ্জিত হয়ে লিখলাম, ‘আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। গিয়েই উদোম ঠ্যাঙাব ব্যাটাকে। ’ 


সঙ্গে সঙ্গে চৈতির উত্তর, ‘কেন গো? ওর কি দোষ? আমরা সবাই মিলে খুব মজা করছি। ’ যেমন পুতু তেমনি তার বড়মামী। যা পারে করুক গে- 


 কয়েকটা ঘন্টাই তো কেবল ঘুমাব, অর্ধ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি, বড়মামা ওরফে অয়নের ফোন। ফোনের ওপাশ থেকে তুত্তুরীর আর্ত চিৎকার, ‘আমি না। আমি না। বড়মামা, প্লিজ তুমি কথা বল। মা নাহলে ফোনের ওপাশ থেকেই ঠাস করে চড় মারবে আমায়। হ্যাঁ গো। মা সব পারে-’।  

চৈতি, অয়ন এবং তুত্তুরীর সম্মিলিত জবানবন্দি থেকে যা বুঝলাম, সকাল থেকেই প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিল বড়মামী। দিনের বেলাটা গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকলেও সন্ধ্যাটা শুধু পুতু আর তার বড়মামীর। সন্ধ্যা নামতেই হিসেব বুঝে নিতে হাজির হয়েছে তুত্তুরী। প্রথম আব্দার, বড়মামী তোমার গয়না দেখাও। বড়মামী কোন গয়নাই পরে না, কিন্তু যত্ন করে সাজিয়ে রাখে কঁচের চুড়ি, ঝুটো গয়নার ডালি। ঐ ডালির প্রতি ভয়ানক লোভ তুত্তুরীর।  চৈতির যাবতীয় গয়নার খুঁটিনাটিও ঠোঁটস্থ মেয়েটার। চৈতির কৈশোর তথা তরুণী বয়সের বেশ কিছু গয়না বগলদাবাও করেছে মেয়েটা। 


পুতুর আব্দার ফেলতে না পেরে নতুন করে গয়নার ডালি নিয়ে বসেছিল মামী আর তুত্তুরী। গয়নার পর পাড়া হয় মামীর অন্যান্য সাজুগুজুর জিনিস। মামীর লিপস্টিক, কাজল, কমপ্যাক্ট। বড়ই অল্প প্রসাধন করে চৈতি। সাংসারিক চাপে সময় পায় কোথায়? তাও যা শখ করে কেনে পড়েই থাকে। 

ডেট এক্সপায়র হতে বসা এমনি একরাশ প্রসাধন দ্রব্য দিয়ে মামীকে সাজিয়েছে তুত্তুরী। কি সাজাচ্ছে তা শুধু মামী জানত আর তার পুতু। বড়মামা শুদ্ধ মাঝপথে ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করেছে, ‘হ্যাঁরে তুই কি মামীকে মা তারা সাজাচ্ছিস?’ জবাব এসেছে, ‘না গো। রক্তখেগো শাঁকচুন্নি সাজাচ্ছি। ’


প্রশ্ন ভেসে আসে, কেমন লাগছে, তুত্তরী 'শাঁখচুন্নি ম্যাডামকে'? রাগব না হাসব বুঝতে পারলাম না। ফোনের ওপাশে সম্মিলিত হর্ষধ্বনি আর থামছেই না। অয়ন বলছে, ‘ন্যায্য  কথা। শাঁখচুন্নি ম্যাডামই বটে। দেখ না রক্ত খেয়ে কেমন রোগা করে দিয়েছে আমায়। ’ আমি প্রতিবাদ করার আগেই লাফিয়ে ওঠে চৈতির পুতু, ‘হ্যাঁ তাই তো। একদম মায়ের মত রোগা হয়ে গেছ তুমি বড়মামা। ’ ' হ্যাঁ রে, তুই কার ভাগ্নি রে?' কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে নামে তুত্তুরীর বড়মামা।  কি বলব বুঝতে পারলাম না। নিজেদের মধ্যেই ঝগড়ায় ব্যাপৃত সব, একবার ভাবলাম ফোন কেটে দি, একবার ভাবলাম বলি, আপদগুলো নিজেরা শাঁখচুন্নি, বেহ্মদত্যি, খোক্ষস যা খুশি সাজ না বাপ, খামোকা আমায় ধরে কেন টানাটানি। বললাম না, থাক, আরো খানিক নীরবে শুনি ওদের খুনসুঁটি। তারপর না হয়, ঘুমোব। বড় জব্বর ঘুম আসবে আজ। ঘুমের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসবে রামধনু রঙা একরাশ স্বপ্ন। গুলিয়ে যাবে, মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে আমার ছেলেবেলা আর তুত্তুরীর মেয়েবেলা। মা হওয়ার এটাই তো মজা-

Monday 10 May 2021

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২১

 

আজকের দিনে মায়ের সঙ্গে একখান ছবি না দিলে কি এ সমাজ আমায় মেনে নেবে? মুস্কিল হচ্ছে মায়ের সঙ্গে আমার একাকী ছবি খুব বেশী নেই। যা আছে সেসবই আমার বিয়ের আগে পরে তোলা। তখন অত ছবিই বা কোথায় তোলা হত। সবথেকে দামী মোবাইলের ক্যামেরাও হত মেরেকেটে ১.৩ মেগাপিক্সেল।  তাও ছবিটবি যা তুলতাম, তাতে থাকতে মোটেই আগ্রহী ছিল না মা। অন্তঃপুরবাসিনী বা হলেও অন্তরালে থাকতেই বরাবর ভালোবাসে মা। 


বিগত সপ্তাহদুয়েক ধরেই ভাবছি কি উপহার দেব মাকে? শাড়ি দেবো কি? শাড়ি রাখার জায়গা নেই মায়ের আলমারিতে। পুজো, নববর্ষ বা জামাইষষ্ঠী মার্কা অনুষ্ঠানে শাড়ি কেনা যেখানে বাধ্যতামূলক, মা ফরমান জারি করে, কিনলেও তার জন্য যেন ছাপা শাড়ি কেনা হয়। ভালো শাড়ি, ভারী শাড়ি মা পরবে কোথায়? যখন শখ ছিল তখন সাধ্য ছিল না।  আর যখন সাধ্য উপচে গেল, মায়ের আর কোন শখ নেই।  


গয়না কিনে দেব কি? এককালে গয়নার প্রতি বড় লোভ ছিল মায়ের। খুব একটা তো ছিল না। যা ছিল তাও, যৌথ পরিবারের ঝড়ঝাপটায়, বাবার পাশে দাঁড়াতে অকাতরে খুলে দিয়েছে মা। চাকরী পেয়ে দিয়েছিলাম টুকটাক কিছু, যার মধ্যে একটা সেট ছিল খোদ পিসি চন্দ্র থেকে কেনা। মায়ের স্বপ্নের দোকান। বাবা-মায়েদের স্বপ্নপূরণের জন্যই তো আমাদের বড় হয়ে ওঠা। মুস্কিল হল, একটি বারও পরেনি মা। যত্ন করে তুলে রেখেছে ব্যাঙ্কের গোপন লকারে। ঝুটো সিটি গোল্ড পরে ঘোরে আজকাল। 


এটাই আমার মা। যা চায়, তা ভুল করে চায়।  আর যা পায়, তা মোটেই চায় না।  কি যে চায় মা। ভালো খাবার দাবার অর্ডার করে পাঠাব কি? বিরিয়ানি খেতে বড় ভালোবাসে মা। ভালোবাসে আমার হাতের পায়েস। তাতেও ঘোর আপত্তি মায়ের। চিরকালই পেটের রোগে ভোগা বাঙালী, গল ব্লাডার হারিয়ে এখন তো হজমশক্তি আরো ক্ষীণ। তাহলে চকলেট,কেক বা মিষ্টি? চকলেট বস্তুটার প্রতি তেমন আকর্ষণ কোনদিনই বোধ করেনি মা। মিষ্টি গোটা কোনদিন খেতে পারে না মা। কোনা ভেঙে একটুকরো বড়জোর।  


তাহলে কি কোন শোপিস অর্ডার দেবো? বা বাঁধিয়ে পাঠাব কোন স্মৃতি বিজড়িত ছবি। শোপিস পেলেই শোকেসে গুদামজাত করবে মা। আঃ বাইরে থাকলে ধুলো পড়বে যে। পুরুলিয়া থেকে কিনে আনা অমন সুন্দর ছৌ নাচের মুখোশকে প্লাস্টিকে মুড়ে কোন সিন্দুকে তুলেছে আর মনেই করতে পারেন না তিনি।  ফুল পাঠাব? এই তো সেদিন বিবাহবার্ষিকীতে পাঠালাম, একরাশ তাজা রক্তগোলাপ।এখনও সপ্তাহ ঘোরেনি তার।


ইন্সটলমেন্টে একটা টিভি কিনে দেবো কি? বাড়ির টিভিটা এলইডি নয়। তুত্তুরীর থেকেও বুড়ো এলসিডি। মাঝে মাঝেই ক্ষীণ হয়ে আসে, বন্ধ হয়ে যায় আওয়াজ। মিস্ত্রি দিয়ে সদ্য তার স্পিকার বদলেছে বাবা। এখন নতুন টিভি কিনে দিলে ক্রুদ্ধ বৃদ্ধের দাপটে টলে উঠবে মেদিনী। তাহলে ফ্রিজ? বাড়ির ফ্রিজটা সেই সাবেকী ১৬৫লিটারের ওয়ালপুল। যখন কেনা হয়েছিল তখনও আসেনি বর্তমান সহস্রাব্দ। ভিতরে মালপত্র ঠেসে রাখে মা। সপ্তাহে একদিন মনে করে ডিফ্রস্ট করে বাবা। বিবর্ণ হয়ে গা থেকে খুলে আসছে রঙ। বার দুয়েক আলো বদলানো আর গ্যাস ভরা ছাড়া আজ অবধি সার্ভিস করতে হয়নি তাকে। কষ্টার্জিত অর্থে কেনা ফ্রিজটার প্রতি বাবার টান সন্তানস্নেহের মতই। ওকে পাল্টে ফেলতে চাইলেই হাঁ হাঁ করে উঠবে বৃদ্ধ। হয়তো মাও। 


তবে কি ওয়াশিং মেসিনটা বদলে দেব? সেটাও প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে বিগত বছর। বছরে একবার আখতার মিস্ত্রি এসে স্ক্রু দিয়ে কি সব এঁটে যায়, আর বাকি বছরটা দিব্য ঘোরে ব্যাটা। দিনে দুই থেকে তিনবার কাপড়কাচা হয় আমাদের বাড়িতে। মায়ের ঘরের কাপড় সাতসকালে মা নিজে কাচে। আর বাবার পোশাক বাবা। ভালো পোশাক যদি কেউ পরে,সেগুলো অবশ্য একসাথেই কাচে বাবা। অবসর নেবার সময় পাওয়া অর্থে কষ্টেসৃষ্টে  কেনা, তাই ওর ওপর ভয়ানক টান বাবার। 


অনেক ভেবেচিন্তে একটা সিংগোনিয়াম গাছই পাঠালাম মাকে। একঝলক টাটকা বাতাস। সুদৃশ্য পোর্সিলিন প্ল্যান্টারে বসানো। প্ল্যান্টারের গায়ে মায়ের আর আমার ছবি দেওয়া। সব ব্যবস্থা ওয়েবসাইটই করে দিল। পার্সোনাল মেসেজটাও ডেলিভার করবে ওরা সুদৃশ্য কার্ডে ভরে। মাদার্স ডের দিন দুয়েক আগেই পৌঁছে যাবে মায়ের উপহার। 


বিবাহবার্ষিকীর দিন এক কেলো বাঁধিয়োছিল বাবা।  সারপ্রাইজ দেব বলে জানাইনি কেক আর ফুল পাঠিয়েছি ক্যুরিয়র মারফৎ। যোগাযোগ করার জন্য দিয়োছিলাম বাবার মোবাইল নম্বর। শর্ত ছিল,কোন কারণে ডেলিভারি ফেল হলে টাকা ফেরৎ দেবে না ওয়েবসাইট। সকাল থেকে ফোন করিনি। প্রতি মুহূর্তে ভাবছি এই বুঝি ডেলিভার হল উপহার আর খুশি খুশি কণ্ঠে ফোন করল বাবা বা মা। ফোন আর আসেই না। শেষে ধুত্তোর বলে ফোন করেই ফেলল তুত্তুরী। ভাগ্যিস করল, ঠিক সেই সময়ই ফোন করেছিল ক্যুরিয়রের ছেলেটা আর বাবা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকে ভাগিয়ে দিচ্ছিল। ‘আরেঃ হাম ও অলোক চ্যাটার্জি নেহি হ্যায়। হাম কুচ অর্ডার নেহি দিয়া। ’ 


আবার যাতে কেলো না বাঁধায়, ভোর ভোর বাবাকে জানিয়ে রাখলাম,মায়ের জন্য কিছু পাঠাচ্ছি। বলো না যেন। কি পাঠাচ্ছি, কেন পাঠাচ্ছি কিচ্ছু বললাম না যদিও। আপিস পৌঁছে যখন নৈমিত্তিক খবর দিচ্ছি, ‘জ্যান্ত পৌঁছেছি মা।’ ক্যাঁক করে চেপে ধরল মা, ‘ কি পাঠালি? কেন পাঠালি?’ বৃদ্ধের পেটে যদি কোন কথা থাকে। 


সারাদিন ওয়েবসাইটে অর্ডার ট্রাক করেই কাটল। দে রে ভাই ডেলিভারি। এরমধ্যে দুবার ফোন করল বাবা, স্নান করতে আর ইয়ে করতে যাবে কি না। যদি এসে পড়ে ডেলিভারি বয়। এমন ফাজলামির কোন মানে আছে? 


সাতবার মেল করলাম, ‘পাঠা বাপ। পাঠা। বৃদ্ধ বৃদ্ধা বড়ই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। ’ অবশেষে বেলা তিনটের সময় ভিডিও কল, ‘মানা। এসেছে তোমার উপহার। এই দেখো আমি আনপ্যাক করছি। মা মোবাইল ধরল আয় বিশ্বকর্মার মত ছুরি আর কাঁচি দিয়ে কাটতে বসল বাবা। সুদূর দিল্লী থেকে পার্সেল হয়ে আসা গাছ, ঈশ্বরের কৃপায় তখনও ঝকঝকে। কাঁচি দিয়ে টেপ গুলো কাটতে আসতে আসতে দৃশ্যমান হচ্ছে পোর্সিলিন প্ল্যান্টার আর তাতে লেখা আই লাভ ইউ মা। উৎসাহের চোটে থিরথির করে কাঁপছে মায়ের হাতের ক্যামেরা ফোন। ধমকাচ্ছে বাবা, ‘আঃ ঠিক করে ধরো। ’ এবার বেরোচ্ছে মায়ের আর আমার ছবি। উল্লাসে সুড়ুৎ করে উঠল মা, ‘সন্তুর আর আমার ছবি দেওয়া কাপ। ’ সব উৎসাহে একরাশ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল কেউ। সন্তু অর্থাৎ তুত্তুরীর সঙ্গে আমার মায়ের আর মাদার্স ডের কি সম্পর্ক রে ভাই? মা টা তো আমারই নাকি। ভাগো এখান থেকে বলে ধমকে উঠতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে, মাকে সেরা উপহার তো দিয়েই দিয়েছি আমি এক দশক আগে। জীবনের বদলে জীবন। আর সেই নতুন জীবনকে ঘিরেই নতুন করে বাঁচুক মা। সন্তু অর্থাৎ তুত্তুরীকে আঁকড়ে নতুন করে শিকড় ছড়াও মা। হ্যাপি মাদার্স ডে।

অনির ডাইরি ৮ই মে, ২০২১

 



বলতেই পারেন, সুখের অসুখ। মাথার ওপর ছাত আছে, থালা ভরা গরম ভাত আছে, প্রিয়সান্নিধ্য আছে, তুত্তুরীর বকবকম আছে, হাত বাড়ালেই বন্ধু আছে, তবুও কেন জানি না দম বন্ধ হয়ে আসে কেবল। 


নৈমিত্তিক ব্যস্ত জীবন, দুরন্ত বেগে ছুটে চলা সময় আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেলে বোধহয় এমনি হয়। অজান্তেই তৈরি হয়ে যায় অনন্ত, ঘোর কৃষ্ণগহ্বর। অসুস্থ পৃথিবীর গর্ভ থেকে উঠে আসে এক তীব্র ভালো না লাগা, ভালো না থাকার বিষবাষ্প। যাতে ক্রমশঃ আক্রান্ত হয় হৃদয়। ভালো লাগছে না। কিছুই যেন, কিছুই কেন ভালোলাগছে না? 


ভালোলাগে বৈকি, ভালোলাগে ভোরের কাঁচা রোদ মাখা, পেলমেট থেকে ঝুলন্ত আমার সোনা রঙ ঝুমকো লতার দিকে তাকিয়ে থাকতে। ভোরের আলো মেখে আলতো করে কেমন ছুঁয়ে দিয়ে দিল কোণার টবে রাখা মাকড়সা গাছের হাত। বারন্দার একটেরে জানলা গলে যখন মুখ বাড়ায়, একটি দুটি লালচে গোলাপী রঙা নয়নতারা তখন তো দিব্য ভালোলাগে। শিরা-উপশিরা-রক্তজালক থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় গভীর ভালোলাগা-ভালোবাসার তরঙ্গ। ভরে ওঠে মন। ভালোলাগে ঝাঁকড়া অপরাজিতার শাখে শাখে হন্যে হয়ে কুঁড়ি খুঁজে বেড়াতে। ‘ফুল ফোটাবি কি না বল, নইলে ছেঁটেই দেব ব্যাটা তোদের আজ’। এমনকি ভালো লাগে ভোর ভোর রোদে দিতে গিয়ে ক্যাকটাসের কাঁটার খোঁচা খেতেও-  বাকিটা সবটুকুই কেমন যেন নিকষ দমবন্ধ করা আঁধার।


ভাবছি পালিয়েই যাব। মহানগর থেকে অনেকদূর।  ভাবছি মোজাম্মেল সাহেবকে ধরব। একখান চাকরী দেবেন আমায়? ভদ্রলোক আমাদের দপ্তরেরই মজুরী পরিদর্শক ছিলেন, অবসর নেবার পর গ্রামের পৈত্রিক ভিটেতে একখান নার্সারি বানিয়েছেন। যতবার গেছি, একরাশ চারার সাথে সাথে এক অদ্ভূত প্রশান্তি মেখে ফিরেছি নিজ গৃহে। 


 অজগাঁ, চতুর্দিকে ঘন আমবাগানের ভিতর দিয়ে টলটল করতে করতে এগোয় গাড়ি। দিনের বেলাও কেমন যেন ছায়াচ্ছন্ন পথঘাট। আমবাগানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে বড় গ্রীলের দরজা ঠেলে ঢুকতে হয়। ঢুকতেই বাঁদিকে একখান অতিকায় লিচু গাছ। বয়স তার সত্তর। তিনতলার ছাতে মাথা ঠেকিয়ে দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে বোধধয়। সীমানা বরাবর পাহারা রত মহীরুহের দল আর তাদের মাঝে যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। হরেক রকম পাতাবাহারের গাছ, মরসুমি ফুলের গাছ, বারোমেসে ফুলের গাছ, ফলের গাছ, ত্রিপল আর জাল টাঙিয়ে গুচ্ছ খানেক ক্যাকটাস আর সাক্যুলেন্ট, শ্যাওলা ধরা চৌবাচ্ছায় ঢলঢল পদ্ম-শালুক, কি নেই? কে নেই? 


 অফিস ফেরৎ পড়ন্ত বিকেলে যখন গেছি, তখন গাছে জল দেবার সময়। কান পাতলেই শোনা যায় সদ্যসিক্ত গাছের পাতা থেকে কেমন টুপ করে খসে পড়ে মুক্তোর দানার মত জলকণা। কেমন সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়ায় গ্রীষ্মের ভিজে মাটি।  


ভালো লাগে না বললে তো আর জীবন শোনে না। কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যেও ঠিক পথ খুঁজে নেয় জীবন।  ভালো লাগিয়ে নিতে হয়। দেহের সাথে সাথে যত্নআত্তি  করতে হয়, খাতির করতে হয় মনটাকেও।  মনকে সেলাম জানিয়ে, মনের যত্ন নিতেই ঠিক করলাম আজ বিরিয়ানি রাঁধব। রাঁধব বললেই তো আর রান্না হয়ে যায় না, বিশেষতঃ এমন বাদশাহী খানা। তার জন্য লাগে সহস্র উপকরণ।  মিটশেফ ঘেঁটে পেলাম আধ প্যাকেট বাসমতী চাল, হাফ বোতল করে গোলাপ আর কেওড়ার জল। সুগন্ধী আতর ভেবে যেটা বেরোল, ভালো করে শুঁকে দেখলাম ঐটি নিম তেল। গাছের পোকা মারতে কিনে এনেছিলাম কবে যেন। 


একখান প্লাস্টিকের কৌটোয় বিরিয়ানি মশলা খানা বানিয়ে রেখেছিলাম, তা হল বেশ কিছুদিন। কিন্তু সে ব্যাটা লুকালো কোথায়। আবাসনে একখান বিশেষ দোকান আছে, তাকে বিরিয়ানী মশলা বললেই, নিঁখুত ভাবে ওজন করে একরাশ গোটা মশলা গছিয়ে দেবে। কি থাকে না তাতে? বড় এলাচ,ছোট এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জায়ফল, জয়িত্রি, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, কাবাবচিনি, সাজিরা,সামরিচ আর কি যেন একটা ধুলো-ধুলো ঝুরো ঝুরো পাতা। সবটুকু মশলা চাটুতে নেড়ে,শিলে বেটে গুঁড়ো করে রাখতে হয়। চলেও অনেকদিন। বিগত পুজোয় বানিয়েছিলাম, গেল কোথায় ব্যাটা। কৌটো খুঁজে ঢাকা খুলতেই মন মাতানো সুবাসে ভরে উঠল রান্নাঘর। 


মাস্ক পরে আতর কিনতে নামলাম বটে, আতর শুনলাম মার্কেট থেকে বেপাত্তা। অন্য দোকান থেকে একটা আতর আনিয়ে দিল বটে দোকানি, কিন্তু সাবধান করে দিল, ‘খুব অল্প দেবেন ম্যাডাম। এটা সস্তা আতর, বেশী দিলে গা গুলোবে। ’ 


মশলা তো হল। চালও হল। এবার মাংসের পালা। বিরিয়ানি যে রাঁধব, সে তো বেলা সাড়ে নটায় সিদ্ধান্ত নিলাম। ততোক্ষণে বাজার দোকান সেরে স্নান করতে গেছে শৌভিক। মাংস এনেছে বটে, কিন্তু তা গরগরে ঝোলের মাংস। মাংস আনলেই আলু দিয়ে লম্বা ঝোল করতে বলে শৌভিক, এমন ঝোল যাতে চলে যাবে দুইবেলা।  বাবার ভাষায় এমন ঝোল যাতে গামছা পরে নেমে তুলে আনা যায় মাংসের টুকরো বা হাড়। স্নান করতে যাবার আগে ফরমাইশ ও জানিয়ে গেছে ছাপোষা উচ্ছে আলু ভাতে আর মাংসের ঝোল রাঁধলেই চলবে। পরিশ্রমও কম হবে, আবার বাসনও পড়বে কম। যে বাড়িতে সবাই এত আমার কথা ভাবে, সেই বাড়িতে কি আদৌ মন খারাপ করে থাকা যায়? 


খানিক মাংস তুলে রাখলাম। পরে স্ট্যু বানিয়ে দেবো ক্ষণ। বড় ভালেবাসে এরা মাখন আর চিজ দেওয়া আমার হাতের চিকেন স্ট্যু। বাকি মাংসে তিন টেবল চামচ টক দই, এক চামচ লেবুর রস, নুন,লঙ্কা গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, পরিমাণ মত মধু, রসুন বাটা, অল্প আদা বাটা আর বিরিয়ানি মশলা ভালো করে মাখিয়ে বেশটি করে চটকে মেখে রেখে দিলাম। 


থাকুক ঘন্টা খানেক ব্যাটারা অমনি ভাবে। বাসমতী চালকে তিনবার ধুয়ে, ভিজিয়ে রাখলাম। ওরাও থাকুক। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আমার সবথেকে ভালো লাগে। আলু থাকে না বটে, তবে ঐ যে বেরেস্তা ছড়ায়, প্রতি গরাসে সুবাসি ভাতের সাথে টুকরো মাংস আর ভাজা পেঁয়াজের তরজা কেমন যেন নবাবী অনুভূতি জাগায়। তবে এ বাড়িতে মাংসের সাথে আলুর যা নিবিড় যোগাযোগ। বিরিয়ানিতে আলু না দিলে ছোটটা কিছু বলবে না হয়তো, বড়টা বড়ই বিমর্ষ হয়ে পড়বে।  অগত্যা- 


সবার আগে খোসা ছাড়ানো গোটা আলুগুলো নুন হলুদ মাখিয়ে সর্ষের তেলে ভেজে, অল্প সিদ্ধ করে তুলে রেখে, ঐ তেলেই গোটা দুই চামচ ঘি, অল্প জিরে, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা আর সামান্য গোটা গরম মশলা দিয়ে কুচানো পেঁয়াজ গুলো ভাজতে দিলাম। প্রাণে ধরে সবটুকু পেঁয়াজ দিতে পারলাম কই, বেরেস্তা বানাব থাক। বেরেস্তাই তো এই বিরিয়ানির প্রাণ। 


পেঁয়াজে রঙ সোনালী হলে মাখিয়ে রাখা মাংস গুলো ঢেলে কষতে হয়, বিরিয়ানি মশলা, টকদই, রসুন আর লঙ্কাগুঁড়োর সংমিশ্রণে ছড়ানো সুবাস, কানে কানে বলে যায়, পথটা ঠিকই ধরেছ যে । আদা বস্তুটা এরা মোটেই দেখতে পারে না, তবুও আরো একছটাক আদা না দিলে কেমন মন কেমন করে যেন। কষা শেষ হয়ে আসলে সামান্য ফেটানো টক দই, আরো খানিক বিরিয়ানি মশলা, অল্প লঙ্কা গুঁড়ো মেশাতে হয় মাংসে।  কষতে কষতে যখন মাংস ফেলে বুড়বুড়ি কেটে লাফিয়ে ওঠে শুধুই তেল, তখন ভেজানো বাসমতী চাল সাবধানে ছড়িয়ে দিতে হয় মাংসের ওপর। হাতা বা ছোট বাটি দিয়ে চেপে চেপে সমান করে দিতে হয় চাল। তারপর ঢালতে হয় নুন মেশানো জল। এই জল ঢালাটাই সবথেকে চাপের ব্যাপার। জল এমন হবে যাতে চাল হবে সুসিদ্ধ, কিন্তু বিরিয়ানি হবে ঝরঝরে। আমার নিজের হিসেব যতকাপ চাল তার থেকে ঠিক এক থেকে দেড় কাপ বেশী জল। 


জল গরম-ঠান্ডা যাই দেওয়া হোক কিছু যায় আসে না। শুধু নুনটা ঠিকমত হয়েছে কিনা দেখে, পাত্র ঢেকে মাঝারি গ্যাসে বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা। মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে দেখে নেওয়া লবণ কম হয়ে গেল নাতো। যখন ঢাকা খোলা হবে তখন অল্প করে দুধে গোলা জয়িত্রি বা কেশর, আর অল্প বেরেস্তা ছড়িয়ে দেওয়া। যেহেতু চাল হাফ সিদ্ধ, তাই খুন্তি দিয়ে সাবধানে সামান্য নাড়াচাড়া করে নিলেও কোন সমস্যা হয় না। বরং দেখে নেওয়াই ভালো, তলাটা ধরে গেলে গ্যাস কমিয়ে দেওয়া যায় যাতে। বেরেস্তা মেশানো হয়ে গেলে, ভাতও ঝরঝরে হয়ে আসবে, তখন সামান্য গোলাপ আর কেওড়ার জলের সাথে দু-চার ফোঁটা বিরিয়ানির আতর মিশিয়ে দিলেই হবে। চাল সামান্য শক্ত থাকতে থাকতে গ্যাস অফ করে ঢাকা দিয়ে দিতে দিলেই ব্যাস্ প্রায় অনায়াসেই তৈরি হয়ে এক কড়া বিরিয়ানি। 


দেখতে শুনতে তো বেশ ভালোই হয়েছিল, স্বাদেও অতি চমৎকার। অন্তত জনগণ তাই বলল, অবশ্যি ছিঁচকাঁদুনে  বলে এরা যে হারে আমায় প্যাম্পার করে, এদের কথায় না বিশ্বাস করাই ভালো। তবে খেতে বসে পুনরায় অনুধাবন করলাম উদরের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক বড়ই রগরগে মাইরি। সেই যে মা বলতো না, ‘ভুঁড়ি ঠাণ্ডা তো মুড়ি ঠাণ্ডা’। দেহের বয়স বাড়লেও জীবন হাতেনাতে শিখিয়ে দেয়, মনের বয়স আজো আটকে আছে সেই মায়ের হলুদের গন্ধ মাখা আঁচলের তলে।

Saturday 1 May 2021

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২১

 অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২১

তখন অনেক রাত। দেওয়াল ঘড়ির বড় আর ছোট কাঁটা এক হয়েও পুনরায় বিচ্ছিন্ন।  পাশের ঘরে ফুললতা আঁকা মিটমিটে ল্যাম্পের আলোয় মোৎজার্টের কত নম্বর যেন সুরের মূর্ছনায় মোহিত শৌভিক। আধা ঘুমন্ত তুত্তুরীকে ঠেলে তুলে কানে ফোন চেপে ধরল তুত্তুরীর মা। ‘আঃ এখন কেন? যখন ওরা বিয়ে করেছিল তখন শুভেচ্ছা জানাব। ’ গত বছরেও এসব কথা বলত না মেয়েটা।  ইদানিং জ্যাঠাইমার ভাষায় পিপুল পাকছে।  সব বিষয়েই সুচিন্তিত মতামত দেয়, না চাইলেও। যার অধিকাংশই বাবার রঙে রঞ্জিত।  তা হোক। যত বয়স বাড়বে মায়ের সাথে শত্রুতা ততো বাড়বে আমি জানি। কারণ শাসন করার তিক্ত দায়িত্ব যে শুধু মায়ের। বাবা মানে তো অখণ্ড প্রশ্রয় আর অনাবিল বন্ধুত্ব।  


জোর করেই মেয়ের কানে ফোনটা ধরলাম। প্রিয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনও পরে বা কাল থাকতে নেই।  কে জানে কাল কি হয়। বিরক্ত হয়ে শুভ বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাল তুত্তুরী। মা অবশ্য তাতেই বিগলিত। বাবাও কিছু মনে করল না দেখি, তবুও অর্বাচীন সন্তানের জননী হিসেবে মার্জনা চাইলাম উভয়ের কাছে। বড্ড বদমেজাজী মেয়েটা আমার। অবশ্য ঐ বয়সে আমিও তাই ছিলাম। ভয়ানক অমিশুক এবং উন্নাসিক। 


ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল বাবার গমগমে গলার ধমক, ‘ নাঃ ও বদমেজাজি নয়। ও ঠিক আমার মতই অভিমানী। তুমি কি জানো আমি ওর বয়সে কি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়েছিলাম?’ এতরাতে বৃদ্ধবৃদ্ধার ঘুম ভাঙিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি জানলে তুলকালাম করবে শৌভিক। এখনও নেভেনি অবশ্য পাশের ঘরের আলো, কি যেন একখান আফ্রিকান গান চালালো শৌভিক। মাঝে মাঝে আমাকেও ডেকে শোনায়। যাই হোক তার মানে শুতে আসতে দেরী আছে আরো কিছুক্ষণ। 


বলো না বাবা গল্পটা। বেশী পিড়াপিড়ি করতে হল না, বৃদ্ধ বলবে বলেই উঠে এসে বসল ডাইনিং টেবিলে, ‘দাঁড়াও একটা ধূম খাই। ’ ধূম অর্থাৎ সিগারেট। ধোঁয়া ছেড়ে গল্প শুরু করল বাবা, ‘আমি তখন বছর নয়েক।  আমি তখন চতুর্থ শ্রেণী। কি কারণে যেন ভীষণ অভিমান হয়েছিল, সম্ভবতঃ ছোটকাকার কাছে প্যাঁদানি খেয়েছিলাম। তোমাকে তো বলেছি, আড়ালে ছোটকাকাকে আমরা চোরা (মহিষাসুর) বলে ডাকতাম। তেমনি চেহারা ছিল। নিয়মিত মুগুর ভাঁজত। ইয়া বড় বড় ছিল হাতের গুলি। ’ আঃ বাবা, প্রসঙ্গান্তরে যেও না। ‘না। না। তো সুযোগ পেলেই শাসন করত ছোটকাকা। বকা, কানমলা, ঠ্যাঙানি। বাবা-মা কিছুই বলত না। তো সেদিনও তেমন কিছু হয়েছিল বোধহয়। এত অভিমান হল, ভাবলাম গৃহত্যাগ করব। সকাল নটা নাগাদ বেরোলাম স্কুলে যাব বলে। মোড়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখি একটা ফাঁকা ঘোড়ার গাড়ি। তখনও পঞ্চানন তলা রোড দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চলত।


গাড়ির পিছনে উঠে বসলাম। গাড়োয়ান গুলো করত কি, মাঝে মাঝে পিছন দিকে ছিপটি গুলো ঘোরাত, যাতে কোন দুষ্টু ছেলে যদি উঠে বসে তার গায়ে লাগবে সপাৎ করে। যতবার গাড়ি আস্তে হয় আমি টুক করে নেমে পড়ি, সপাং করে ছিপটি ঘুরিয়ে যেই গাড়ি স্পিড তোলে, আমিও লাফিয়ে উঠি। এইভাবে কতদূর গেলাম জানি না, হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। গাড়োয়ানটা বোধহয় চা খেতে গেল, আমি নেমে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি একদল লোক এসে বসল গাড়িটায়, গাড়িটাও অমনি তাদের নিয়ে ছেড়ে দিল। 


আমি তো বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছি। দেখি সেটা একটা রেল স্টেশন। সামনের সরু সুড়ঙ্গ দিয়ে মানুষ ওঠা নামা করছে, আমি নেমে ওপাশে উঠে দেখি শ্রীরামপুর স্টেশনে আছি। একটা ট্রেন দাঁড়িয়েছিল, চুপচাপ উঠে পড়লাম। উঠে বসে আছি, তো বসেই আছি। ট্রেন ছুটছে, আচমকা অণ্ডাল স্টেশনে আমায় চেকার ধরল-’। 


অণ্ডাল? সে তো অনেকদূর গো বাবা। তুমি অত দূর চলে গেলে ন- দশ বছর বয়সে? ‘হ্যাঁ। তবে আর বলছি কি। চেকার বলল, টিকিট দেখা। বললাম নেই। সে তো মহা হম্বিতম্বি করে, কান ধরে নামিয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, অনেকটা তুলসি চক্রবর্তীর মত দেখতে, ধুতি পরা একটা লোক খালি গায়ে  বসে বসে কি সব কাজ করছে। চেকার বলল, ‘এই দেখুন মাস্টারমশাই, এ হারামজাদা এই বয়স থেকেই  বিনা টিকিটে যাত্রা করছে। ’ মাস্টারমশাই, মাথা তুলে ইশারায় কি বলল, চেকার আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল। 


আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। আচমকা লোকটা মুখ তুলে আমার খেঁকিয়ে উঠল, ‘অ্যাই হতভাগা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হাতপাখাটা দেখতে পাচ্ছিস না? বাতাস কর।’  লোকটার মাথার ওপর একটা বোধহয় বৃটিশ আমলের ডিসি পাখা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছিল। তাও দরদর করে ঘামছিল লোকটা। আমি ভয়ে ভয়ে হাতপাখাটা দিয়ে বাতাস করতে লাগলাম।  


বেশ অনেকক্ষণ পর, লোকটার হিসেব বোধহয় মিলল, মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তুই কে? বাড়ি কোথায়? পালিয়েছিস?’ আমি ভয়ে ভয়ে সব সত্যি কথাই বললাম, তখন লোকটা আমায় নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাইয়ে পরের ট্রেনে গার্ডের কামরায় তুলে দিল। তুলে দেবার সময় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোকে হাওড়ায় নামিয়ে দিলে বাড়ি যেতে পারবি?’ আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম পারব। তখন জানতে চাইল ,‘কি ভাবে যাবি?’ আমি বললাম, বেরিয়ে ৫৩নম্বর বাস ধরে চলে যাব। লোকটা আবার প্রশ্ন করল, ‘ভাড়া কত জানিস?’ বললাম এক আনা। লোকটা পকেট থেকে একটা গোটা টাকা আর একটা আনি বার করে আমায় দিয়ে বলল, ‘সাবধানে বাড়ি চলে যাস। আর কোথাও পালাস না বাপ। ’ আর গার্ডকে বলল, ‘এর কাছে টিকিট নেই।  হারামজাদাকে হাওড়া স্টেশন থেকে বার করে ৫৩ নম্বর বাসে তুলে দিয়ে কন্ডাক্টরকে একটু বলে দেবেন ক্ষীরেরতলা স্টপে যেন নামিয়ে দেয়। ছোঁড়া মহা বিচ্ছু। ’ গার্ড আমায় এনে ৫৩নম্বর বাসে তুলে দিল, আমি যখন নাচতে নাচতে বাড়ি ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে। আমার পকেটে তখনও ঠংঠং করছে একটা গোটা টাকা-’।  


এই দুর্ধর্ষ ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাব্দী যে কি ভাবে ঘর করেছে মা তা বোধহয় কেবল মাই জানে। আজ এঁণাদের বিবাহের পাক্কা ৪৭ বছর পুরো হল। পরিকল্পনা তো ছিল অনেক, থাক না হয় অন্য কখনও হবে। আপাততঃ সুস্থ হয়ে উঠুক পৃথিবী। ততোদিনে আরো গভীর হোক এঁদের প্রেম, আরো মধুর হোক দাম্পত্য। কাটুক মায়ের মনের যাবতীয় মেঘ, সিগারেট ছাড়ুক বাবা, আর পারলে মিষ্টিটাও। বড্ড মিষ্টি খাও মাইরি বাবা তুমি, বললেই অবশ্য গোঁসা হবে তোমার- তা হোক তবুও বলি যেমন আছো তেমনি থাকো তোমরা শুধু সিগারেট আর মিষ্টিটাকে মারো গুলি।



Thursday 29 April 2021

কোভিড কথা

 কোভিড কথা - ২৯শে এপ্রিল, ২০২১


১। বাতাসের শতকরা ২১ ভাগই হল অক্সিজেন। এমনিতে একজন সুস্থ মানুষ এই ২১ শতাংশ অক্সিজেন নিয়ে দিব্য থাকতে পারে, কিন্তু কোভিডে ধরলে বা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তা মোটেই যথেষ্ট নয়। তখন প্রয়োজন শতকরা ৯৮ ভাগ বিশুদ্ধ অক্সিজেন। যা পাওয়া যায় অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে এবং বর্তমানে যার তীব্র আকাল সমগ্র দেশ জুড়ে। 


২। জানেন কি, আমাদের দেশে অক্সিজেনের আদতে কোন ঘাটতি নেই? যেখানে এই পরিস্থিতিতেও দেশের মোট চাহিদা দৈনিক ৭০০০ মেট্রিকটন মাত্র, ভারতের  উৎপাদন ক্ষমতা ৭৮০০ মেট্রিকটন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সরকার যা বাড়িয়ে করেছেন ৯০০০ মেট্রিকটন। 


২। আমাদের সমস্যা উৎপাদন নয়, সমস্যা হল পরিবহন। অক্সিজেন গ্যাসকে তো আর এমনি পরিবহন করা যায় না।  -১৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তরল অক্সিজেন পরিবহন করতে প্রয়োজন বিশেষ ধরণের ট্যাঙ্কার, যাদের বলে ক্রাইওজোনিক ট্যাঙ্কার। 


৩। কি ভাবছেন এই ক্রাইওজেনিক ট্যাঙ্কার আমাদের নেই? নাঃ মশাই,দিব্যি আছে। কিন্তু যখন আচমকা ফিরে এল মহামারী, দেখা গেল সংখ্যা অপ্রতুল হলেও আছে তো, কিন্তু ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে। 


৪। ভারতে অক্সিজেন মূলতঃ তৈরী হয় রাউড়কেল্লা, দুর্গাপুর, ভাইজাগ ইত্যাদি স্টিল প্ল্যান্ট গুলিতে। খালি ট্যাঙ্কার গুলিকে এই প্ল্যান্টে পৌছানো  এবং ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে যাওয়ার জন্য আপাততঃ কোমর বেঁধে নেমেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং ভারতীয় রেল।  


৫। বায়ুসেনার সবথেকে বড় যুদ্ধ বিমান সি-১৭ গ্লোব মাস্টারে ভর্তি করে আনা হচ্ছে খালি ট্যাঙ্কার, আবার ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে দৌড়চ্ছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।  


৬। তেমনি একসাথে অনেকগুলি খালি বা ভর্তি ট্যাঙ্কার বহনের জন্য ভারতীয় রেল চালু করেছে RO-RO Train Service। সোজা কথায় Roll-on/roll-off। শয়ে শয়ে ট্যাঙ্কার একলপ্তে পরিবাহিত হচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।  


৭। এছাড়াও সিঙ্গাপুর থেকে বেশ কিছু ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার আমদানি করেছে ভারত। বেশ কিছু ট্যাঙ্কার আনিয়েছে টাটাও।  


৮। পাশে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।ভারতীয় সেনাদের জন্য  DRDOর বানানো বিশেষ ভাবে তৈরী অক্সিজেন সিলিণ্ডারও দেওয়া হচ্ছে নানা হাসপাতালে।  


৯। জার্মানি থেকে ২৫ খানা পোর্টেবল অক্সিজেন জেনারেশন প্ল্যান্ট কিনেছে ভারত। যা ঝটপট বাতাস থেকে নিঙড়ে নেবে বিশুদ্ধ অক্সিজেন।  


১০। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তবে রাতারাতি তো আর বদলাবে না। বদলাতে লাগবে সময়। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই বারংবার বলে চলেছেন আগামী ১৫-২০শে মে’র মধ্যে শীর্ষে পৌছাবে করোণার দ্বিতীয় ঢেউ। যখন দৈনিক সংক্রমণের মাত্রা ছোঁবে ৫ থেকে ১০ লাখ। প্রত্যহ মারা যাবেন পাঁচ থেকে দশ হাজার মানুষ। তাই এই মুহূর্তে সবথেকে জরুরী যেটা, সেটা হল সাবধানে থাকুন। নিয়ম মেনে চলুন। মাত্র কটা দিন। চায়ের ঠেকের মাতব্বররা যাই বলুক না কেন, সরকার সচেতন হয়েছে, লোহার বাসরঘরের ফুটোও মেরামত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পরিস্থিতি বদলাবেই।  আপাততঃ যেটা করবেন- 

ক) মাস্ক, স্যানিটাইজার, দূরত্ববিধি ছাড়াও রোজ জিঙ্কওয়ালা একটা ভিটামিন খান নিয়ম করে। 

খ) খান ভিটামিন সি।  

গ) মাপতে থাকুন অক্সিজেন। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ এর সামান্য নীচে নামলেই অক্সিজেন খুঁজতে বেরোবেন না। প্রুনিং পোজিশনে শুয়ে পড়ুন। জানেন তো আমাদের দুই ফুসফুসেরই কিছুটা অংশ বিশেষতঃ মাঝের অংশটুকু সাধারণ ভাবে অব্যবহৃত থেকে যায়।  এমতবস্থায় যদি বুকের নীচে দুটো বালিশ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, ফুসফুসে যে চাপ পড়ে, তাতে চলতে শুরু করে ঐ অংশটুকুও। সকাল বিকাল আধঘন্টা করে অমন শুয়ে থাকুন। মাঝে মাঝে পাশ ফিরে শোন।  তবে দুটো হাতই যেন একদিকে থাকে। তারপর পীঠে বালিশ ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ বসুন। এতেই কাজ হবে।


সবশেষে বলি আবারও সাবধানে থাকুন, অযথা আতঙ্কিত হবেন না। ভরসা রাখুন। এই অন্ধকারেও আমরা একা নই। বন্ধুরা আছেন। রাশিয়া যেমন কথা দিয়েছে প্রতি সপ্তাহে ৪ লক্ষ করে রেমডেসিভার পাঠাবে। পাঠাবে অক্সিজেন। ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার। এমনকি পাশে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানও। 


ভিরাফিনের গল্প শুনেছেন তো? আমাদের নিজেদের তৈরী ওষুধ, বানায় আমাদের ঘরের কোম্পানি Zydus Cadila। ভিরাফিন কিন্তু অনেক দিন ধরেই বাজারে চলে, হেপাটাইটিস-বি এর ওষুধ হিসেবে। ভিরাফিন যেটা করে তা হল আমাদের শরীরে ইন্টারফেরন আলফা নামক কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। যারা মুখোমুখি যুদ্ধ করে শরীরে অনুপ্রবেশকারী যে কোন অবাঞ্ছিত অতিথির সাথে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসও  RNA ভাইরাস আর কোভিডও তাই।  পরীক্ষা করে দেখা গেছে মাত্র সাতদিনে কোভিডকে ঠেঙিয়ে বের করে দেয় এই ওষুধ। রাতারাতি ভারত সরকার অনুমতি দিয়েছে ভিরাফিন ব্যবহারের, তবে শুধু মাত্র হাসপাতাল গুলিতে।  


যাই হোক মোদ্দা কথা আবার বলি- সাবধানে থাকুন। অন্তত ২০শে মে অবধি টিকে থাকুন।  তারপর পরিস্থিতি বদলাবেই।  আমি ভয়ানক আশাবাদী।  


কোভিড কথা- ৩০শে এপ্রিল, ২০২১


আজকের পরিসংখ্যান দেখেছেন নাকি? সরকারি বুলেটিন অনুযায়ী গত ২৪ ঘন্টায় রাজ্যে নতুন করোনা আক্রান্ত ১৭,৪১১, মোট নমুনা পরীক্ষার(৫৩,২৪৮) প্রায় ৩২.৬৯% । মৃত ৯৬ জন।


সারা ভারতের আজকের পরিসংখ্যান এখনও সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু গতকালই আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষ। মৃত সাড়ে তিন হাজার। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে এই পরিসংখ্যান খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি আমি, দেখাচ্ছি আমার টিমকে। কারণ যাই হোক, আপিসটা তো করতে হবে-। আবার পিতৃদত্ত প্রাণটাও বাঁচাতে হবে।  তো যা বলছিলাম, নিয়মিত পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে যেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখা দেয় তা হল, প্রতিনিয়ত যে সংখ্যক মানুষ খাতায়কলমে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন তার শতকরা ১ ভাগ মানুষ। 


এমতবস্থায় আজকে আত্মপ্রকাশ করা মাননীয় মূখ্য সচীবের যে অর্ডারটিকে (618-ISS/2M-22/2020 dated 30th April, 2021) ঘিরে এত বিতর্ক, এত বিশেষ ভাবে অজ্ঞ মতামতের আদানপ্রদান চলছে, সেটা যদি একটু কষ্ট করে পড়ে দেখেন, তাতে কোথাও 'আংশিক লকডাউন' শব্দবন্ধটি ব্যবহারই করা হয়নি। 


এতে বলা হয়েছে যে বিগত ২৫ এবং ২৯ তারিখে প্রকাশিত ভারত সরকারের স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ দপ্তরের দুটি নির্দেশনামা অনুসারে এবং বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ২২ নং ধারা অনুসারে-


'১। সমস্ত শপিং কমপ্লেক্স, মল, বিউটি পার্লার, সিনেমা হল,  জিম, সুইমিং পুল, স্পা, রেস্তোরাঁ, বার সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।  কিন্তু হোম ডেলিভারি এবং যাবতীয় অনলাইন সার্ভিস খোলা থাকবে।'


অর্থাৎ রেস্তোরাঁ বন্ধ বলে যারা হাহুতাশ বা মুণ্ডপাত করছিলেন, তা কিন্তু যথার্থ নয়। গিয়ে বসে খেতে পারবেন না বটে, সুইগি, জ্যোমাটো কিন্তু এনে দিতেই পারে। মল বন্ধ বটে কিন্তু চলতেই পারে অ্যামজন, মিন্ত্রা বা নাইকাতে শপিং।  


'২।যাবতীয় সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক বা বিনোদনমূলক জমায়েত নিষিদ্ধ। '


এখন এই নিয়ে যদি আপনার মটকা গরম হয়, তো দাদা/দিদি আইসব্যাগ কিনে নিন না একটা।


 

'৩। বাজার/হাট খোলা থাকবে  সকাল ৭-১০টা আর বিকাল  ৩-৫টা।  কিন্তু যাবতীয় মুদির দোকান, ওষুধের দোকান বা মেডিক্যাল ইকুইমেন্টের দোকান ইত্যাদি আপদকালীন পরিষেবা মূলক দোকানগুলি এই নিয়মের মধ্যে পরে না। '


আর বলা হয়েছে যে 'কাউন্টিং হল বা বিজয়ীদের মিটিং, মিছিল , রালি ইত্যাদি কেবল মাত্র নির্বাচন কমিশনের ২৭ শে এপ্রিলের নির্দেশ নামা মেনেই হবে। বলা হয়েছে কেউ যদি এই নির্দেশনামা উলঙ্ঘন করেন তবে বিপর্যয় মেকাবিলা আইন এবং আইপিসি অনুসারে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'  


মোটামুটি আক্ষরিক তর্জমা করে দিলাম, অর্ডার নম্বরটিও দিলাম, পারলে একবার আসল অর্ডারটি পড়ে নিন। ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে নিজগুণে মার্জনা করবেন। 


এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন এই নির্দেশনামা কবে থেকে বলবৎ হবে? উত্তর হল আজ থেকেই। পড়তে গেলেই দেখতে পাবেন লেখাই আছে, ‘This order will take immediate effect’।  কতদিন পর্যন্ত? যতদিন না পরবর্তী নির্দেশনামা বেরোচ্ছে।  ততদিন পর্যন্ত সাবধানে থাকুন, নিয়ম মেনে চলুন, মাস্ক পরুন, হাত সাফ রাখুন, ভিটামিন খান, অক্সিজেন মাপুন আর প্লিজ প্লিজ উল্টোপাল্টা গুজব ছড়াবেন না বা তাতে কান দেবেন না। কেমন?

 অনির ডাইরি ২৭শে এপ্রিল, ২০২১


একসাথে দল বেঁধে সাঁতার কাটত হাঁসগুলো। নালার দৈর্ঘ্য বরাবর গাঁয়ের এমুড়ো থেকে ও মুড়ো অবধি সাঁতরে যেত আবার ফিরে আসত। 'ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে, তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে', দাওয়া থেকে হাঁক পাড়ত দিদা, ‘ আয়- আয়- আয়- চৈ-চৈ-চৈ’। কি ভাবে বুঝত কে জানে, হাঁক শুনলেই, ঠিক দিদার হাঁসগুলো দলচ্যুত হয়ে উঠে আসত পাড়ে। তারপর পশ্চাদ্দেশ বেমক্কা উঁচু করে, উন্নাসিক সুন্দরীদের মত গিয়ে সেঁদিয়ে যেত আপন বাসায়। শেষ হাঁসটা ঢুকে পড়লেই ঝাঁপ ফেলে দিত দিদা। ঝাঁপের ওপর লেখা ছিল, ‘হাঁসেদের বোটেকখানা’-সৌজন্য সেজদা। প্রসঙ্গতঃ বোটেকখানা হল আপনাদের বৈঠকখানা। 


বছরে একবারই যেতাম দিদার বাড়ি। সারা বছর তীর্থের কাকের মত পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত দিদা। অপেক্ষা করত শেষ বাসের জন্য। যদি কেউ নামে। শেষ বাস চলে গেলে অপেক্ষা করত পোস্টম্যানের জন্য। যদি আসে কারো চিঠি- দাদপুরের স্বর্গীয় শিক্ষক মনোরঞ্জন দাশের কন্যা স্বর্গীয়া সুনীতি রাণী ঘোষের মনের জোর ছিল সাংঘাতিক। 


বড় দূরে থাকত দিদা। সেই উত্তরবঙ্গের সীমান্ত ঘেঁষা অজগ্রাম রামনগর। যাবার হ্যাপা কি কম? বেশ কদিনের ছুটি ছাড়া যাওয়া যায় নাকি? কাশ আর শিউলি ফুটলে তবে না যাব দিদার বাড়ি। কাক না ডাকা ভোরে ঘুম থেকে তুলে রেডি করে দিত মা। বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে আমরা যখন বেরোতাম তখন রাতপাহারা শেষে ঘুমের তোরজোর করত পাড়ার নেড়িরা। 


সৎসঙ্গের সামনে থেকে মিনিট তিনেক হেঁটে গলির মোড়। মোড়ের মাথায় তখনও ঝাঁপ বন্ধ সারি সারি দোকান। বরাবরের দিলখোলা বেহিসেবী বাবা, আর কিঞ্চিৎ  বুঝে চলা ঘোর সংসারী মায়ের ছুটকো দাম্পত্য কলহের ফাঁকে চাতক পাখির মত চেয়ে থাকা, হে ভগবান, হে মা দুগ্গা, হে শিবঠাকুর একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাঠিয়ে দাও- 


ট্যাক্সির ফালতু খরচ ভাঁজ ফেলত মায়ের প্লাক না করা ভ্রু যুগলে। বাবার মুখের দরাজ হাসি দেখে বেশ বুঝতে পারতাম, ‘আজি প্রাতে সূর্য ওঠা, সফল হল কার ’। নিজের শহরকে ছেড়ে যাবার যাবতীয় বিষাদকে জানলা দিয়ে উড়িয়ে হলদে ট্যাক্সি দৌড়ত হাওড়া ব্রীজের পেট চিরে। মহাত্মা গান্ধী রোড তখন প্রথম আলোয় সদ্যস্নাত। কলেজ স্ট্রিটের মুখে ডাঁই করে রাখা সবুজ ডাবের পাহাড়, মেহবুব ব্যাণ্ডের বন্ধ দোকান ছাড়িয়ে শিয়ালদা। সকাল আটটার লালগোলা প্যাসেঞ্জার। কুলিকে টাকা দিয়ে চলন্ত ট্রেনে সিট রাখত বাবা। জানলার ধারের সিট। রাণাঘাট অবধি ডিজেল ইঞ্জিন, রাণাঘাট থেকে কয়লা। নাকি উল্টোটা? আজ আর মনে আছে থোড়াই। শুধু এটুকু মনে আছে কয়লার ইঞ্জিন হলে হাওয়ার দিকে বসলে চোখে এসে পড়ত কুটো।  


প্রথম দিকে রান্না করে নিয়ে যেত মা। অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন কৌটো ভরে লুচি তরকারী আর সুজি। কেউ ছুঁতাম না আমরা। ট্রেনে উঠে ঘরের খাবার খাব ক্যান। নৈহাটির ঝালমুড়ি দিয়ে শুরু হত মুখচলা। ঠোঙা ভর্তি কুন্দ ফুলের মত মুড়ি, মাখামাখি ঝাঁঝালো সর্ষের তেল, পেঁয়াজ কুচি, মুড়ি মশলা আর লাল বাদামে। সবার ওপর কাস্তের মত একখানি নারকেলের টুকরো। ঝাঁঝালো তেলের স্বাদে গন্ধে নাকের জলে মিশত চোখের জল।  উঠত কাঁচের বাক্স ভর্তি মিষ্টি। শালপাতার দোনায় কি ছানার রসালো মিষ্টির সোয়াদ বেড়ে যায়?  উঠত মিষ্টি ডালমুট। সুতো দিয়ে কাটা গরম সিদ্ধ ডিম। রাণাঘাটে ইঞ্জিন বদলাত, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত গাড়ি। প্লাটফর্মে বিক্রি হওয়া কচুরি, ঝোল ঝোল কুচো আলুর তরকারী আর ছানার জিলিপি কিনে আনত সেজোমাসি।


খেতে খেতে কখন যে এসে পড়ত দেবগ্রাম ইস্টিশন। আর দুটো ইস্টিশন পরেই নামতে হবে আমাদের।  মাঝে পড়বে পাগলাচণ্ডী নদী। নাকি নদ? ভিখারির মত হাত পেতে বসে থাকতাম যদি একটা পাঁচ বা দশ পয়সা দেয় বাবা। নিদেনপক্ষে যদি ২ পয়সাই দেয়,  ছুঁড়ে ফেলব নীচে নদীর বুকে। ছোট মেসো একবার পঁচিশ পয়সা দিয়েছিল, কি বকেছিল মা সেবার। আর একবার মাকে লুকিয়ে পাক্কা একটি টাকা গছিয়েছিল ছোট মেসো, সেদিনের ফূর্তির কথা ভেবে আজও লিখতে লিখতে হাসির ঢেউ খেলে যাচ্ছে আধবুড়ো ওষ্ঠাধরে।  যাই বলুন শৈশব বড় দামাল, বড় বাচাল, বড় বেশী বেহিসেবী। তাই বুঝি শৈশব এমন মূল্যবান। হারিয়েও হারায় না।  


শৈশব যে সত্যিই হারায় না, বারবার ফিরে ফিরে আসে, তা আমার বৃদ্ধ বাবা-মা-পিসি-শ্বশুর আর শাশুড়িমাতাকে নিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বাপস্!পাঁচ-পাঁচটা ধেড়ে খোকাখুকুকে সামলাতে রীতিমত নাকের জলে চোখের জলে তুত্তুরীর বাবা-মা। তাও আমাদের দাবী অতি সামান্য, দয়া করে ভ্যাকসিনটি নিয়ে আমাদের ধন্য করো। 


যখনই ভ্যাকসিন নেবার দিন ঠিক হয়, কোথা থেকে যে সমস্যা পেড়ে আনে এরা। ওদিক থেকে বাবা হুঙ্কার ছাড়ে, ‘আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেবে না’। তো এদিকে শ্বশুরমশাই বাঁধান জ্বর। তা হ্যাঁ বাবা, যতবার ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে যাব বলব, ততোবার জ্বর বাঁধাবেন আপনি। ওঃ থুড়ি, আজকাল আপনি বললে হেব্বি রেগে যাচ্ছে বৃদ্ধ। বারো বছরের অভ্যেস রাতারাতি বদলে আমায় কইতে হবে তুমি। যতই বলি, ওরে বাবা, আমি সাবেকী বাড়ির মেয়ে, ঠাকুমার কাছে মানুষ,স্বভাব চরিত্রে যতই উগ্র নারীবাদী হই না কেন, মানুষটা বেশ সেকেলে। সময় তো দিতে হবে। রাতারাতি কাউকে আপনি থেকে তুমি আর তুমি থেকে তুই বলতে পারি না আমি। উমা তো সেই কবে থেকে ভয় দেখাচ্ছে, 'আমাকে তুই বলবে কি না,বলো।' তাকেই পারি না। এই তুই কই,তো এই তুমি।  


শেষ পর্যন্ত অবশ্যি শ্বশুরমশাইকে ছাড়াই বাকিদের ছুঁচ ফুটিয়ে আনলাম আমরা। যথারীতি ভ্যাকসিন নেবার দিন সকাল থেকে জ্বরে শালিকপাখির মত চিচি করছিলেন শ্বশুরমশাই। দীনু খুড়োও বলল, ‘জিতেন দাকে তোরা এবার ছাড়। দেখ না মাস তিনেক পর,পাড়ার দোকানে বিক্রি হবে ভ্যাকসিন। তখন শঙ্কর এসে দিয়ে যাবে খন। ’ দা গ্রেট দীনু খুড়োর নির্দেশ শিরোধার্য। লোকটাকে যে বেজায় ভালোবাসি মাইরি- 


চার চারটে নড়বড়ে মানুষকে ভ্যাকসিন ফুটিয়ে গাড়িতে তুলে যার যার কুলায় ফিরিয়ে দিতে দিতে আর দ্বিতীয় ডোজটা নেওয়া হয়নি আমার। গোটা রাস্তা শাশুড়ী মা দুঃখ করতে করতে এলেন, ‘আমাদের সামলাতে গিয়ে তোমারই আর নেওয়া হল না। ’ বোঝাতে পারলাম না, বাবা মা হলে তো এমনিই হয়। তোমরাই তো শিখিয়েছ। 


আর যেটা ওণাকে বলতে পারিনি তা হল,আমার পরিবার যে আসলে বিরাট বড়। শুধু কি রক্ত আর বৈবাহিক সম্পর্কে আমি জননী? দপ্তরী সম্পর্কে নই? তাহলে আপিস মাস্টার মানে কি? নিছক প্রভু? কেবল প্রভুত্ব করব? ভালোবাসব না? 


প্রায় কান ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম গোটা টিমকে ভ্যাকসিন দিতে। চুঁচুড়ার ইমামবাড়া হাসপাতালের এসিটেন্ট সুপারের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। নাঃ কোন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেননি উনি আমাদের এযাত্রা। প্রথম ডোজের সময় দিতে পারলেও, এ যাত্রা দিতে অপারগ তা প্রথমেই জানাতে কসুর করেননি। আমরাও চাইনি, সকাল থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো অশীতিপর মানুষদের নাকের ডগা দিয়ে গটগট করে ভ্যাকসিন নিতে। তাই কতজন ভ্যাকসিন নেবো জানিয়ে, সুপার সাহেবের বেঁধে দেওয়া সময়ে দলবেঁধে হাজির হয়েছিলাম আমরা। তারপরও হয়তো বেশ খানিকক্ষণ বসতে হয়েছে, দাঁড়াতে হয়েছে। আমাদের সঞ্চিতা আর সায়নী টেনশন করেছে,যদি ভ্যাকসিন ফুরিয়ে যায়।  আমাদের ধীমান টেনশন করেছে যদি লোক বেশি বলে ওকে ফিরিয়ে দেয় ওরা। কৌশিক টেনশন করেছে যদি ভ্যাকসিন নেবার পরও করোণা হয়? বাদল, সোমনাথ আর আমি টেনশন করেছি যদি আবার খুব লাগে? 


সব টেনশন মিটিয়ে প্রায় সন্ধে ছটা নাগাদ ভ্যাকসিন নেওয়া আমরা। ফিরিঙ্গী ভাষায় আমার ফুল অফিস ভ্যাকসিনেটেড, ফুললি ভ্যাকসিনেটেড। এই ভাবেই চলুক না জীবন, কিছুটা শৈশব আর কিছুটা অভিভাবক হয়ে।



Thursday 22 April 2021

অনির ডাইরি ২২শে এপ্রিল, ২০২১

 

বেশ চিন্তিত ছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। মা যেসব রাতে না ফিরতে পারে, মাসি অন্তত থাকে। কিন্তু এবারে যে মা আর মাসির নির্বাচন একই নির্ঘন্টে। কার কাছে থাকবে তুত্তুরী? এমনিতে মা আর মাসির সাথে যত খুনসুটি, বাবার সাথে ততোটাই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শ্রীমতী তুত্তুরীর। তাই বলে বাবা নামক ব্যক্তির সাথে একাকী দিনযাপন অসম্ভব। লোকটা কেমন যেন কলিযুগের হিটলার টাইপ। সবকিছু তার চলে নিখাদ নিয়ম মেনে। মাকে কাবু করতে না পারলেও, তু্ত্তুরীকে কেবলই নিয়মের বেড়াজালে বাঁধতে চায় বাবা। ‘দিনে তিন দান দাবা খেলবি, মিষ্টি খাবি না, দুঘন্টা গল্পের বই পড়বি আর আমার সাথে দেড় ঘন্টা ব্যায়াম করবি’- তুত্তুরীর জন্য এই হল বাবার ফরমান। সবথেকে বড় কথা- ‘অপ্রয়োজনে বেশী বকবক করবি না।’ হ্যাঁ বাবার সেবা করলে থুড়ি বাবাকে আমেজ করে দিলে যেমন ধরুন চুল ঘেঁটে দিলে, কান মুলে দিলে, হাতের বা পায়ের আঙুলগুলিকে টেনে লম্বা করে দিলে অবশ্য আনলিমিটেড বকবকানির অনুমতি মেলে, তবে তা ততক্ষণই স্থায়ী হয়, যতক্ষণ চলে আমেজ। 


এত ঝঞ্ঝাটের পর কেবল আধঘন্টা মোবাইল দেখার অনুমতি মেলে শ্রীমতী তুত্তুরীর। ভাগ্যে মাসির মোবাইলটা সারাদিন গড়াগড়ি যায় হেথায়-হোথায়। মাঝেমধ্যে মুখ বন্ধ রাখার শর্তে অবশ্য মোবাইল দেয় মাও। 


যাই হোক এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মা এবং মাসির অনুপস্থিতিতে শ্রীমতী তুত্তুরী থাকবে কুথায়? নির্বাচনী নির্ঘণ্ট জারি হওয়ার সাথে সাথেই হাওড়া থেকে দাদু বলেছিল বটে, ‘ওকে এখানে রেখে যা’। কিন্তু নিজের দোষেই সেই সুযোগ হারাল তুত্তুরী। ভর সন্ধ্যে বেলা এমন হাঁউমাউ জুড়ল মাসি, ‘সোনা মা এটা কি?’ তুত্তুরী যতই বোঝায় ও কিছু নয়, নিছক  গুগল অ্যাসিস্টান্ট। তুত্তুরীকে সহায়তা করতে চায়, মাসি তো ভয়েই সারা। মোবাইল খুললেই কেবল অনামুখো গুগল বলে, ‘হ্যালো পুরোযা ভট্টাচার্য, আজ কি গান শুনবে? একটু অরিজিৎ সিং শুনে দেখবে নাকি? বা হাড্ডিগুডুম গাড্ডিগুডুম।’ যা না মা পড়তে পারে, না মাসি। উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত কটকটিয়ে ওঠে। 


যাই হোক কথাটা মায়ের থেকে গিয়ে পৌঁছাল বাবার কানে। গম্ভীর মুখে মাসির মোবাইলটায় চোখ বুলিয়ে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ফয়সালা শুনিয়ে দিল বাবা, ‘হাওড়া যাওয়া ক্যান্সেল। ’ একটা দুটো রাতেরই তো ব্যাপার, তুত্তুরী দিনের বেলা থাকবে ঠাম্মা-দাদুর বাড়ি, রাতে আপিস ফেরতা ফেরৎ আনবে বাবা। 


কাকিমা থাকলে এই প্রস্তাবে ধেই ধেই করে নাচত তুত্তুরী। কিন্তু কাকিমা যে সেই সুদূর দুর্গাপুরে।  ঠাম্মার সাথে অবশ্য ভালোই জমে, কিন্তু ঠাম্মা সারাদিন বড় ব্যস্ত থাকে। আর বাবার বাবা, এক্কেবারে বাবার মত। তাঁর সাথে চলে না আবোলতাবোল গল্প। মা দুর্গা বা শ্রীকৃষ্ণের গল্প জুড়লেই দাদু খুলে বসে গীতবিতান। নাহলে শোনায় ম্যাকবেথ বা জুলিয়াস সিজারের হত্যা রহস্য। তারপর গছায় একখান বই, ‘এটা পড় তো চেতা। ’ আর বই দেখলেই পিলে চমকায় চেতা ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরীর। 


বাবাকে পটানোর দিনরাত চেষ্টা চালায় তুত্তুরী, আমেজ করে দেয় আশ মিটিয়ে, পাঁচন খাওয়া মুখে উপেন্দ্র কিশোরের ছোটদের রামায়ন খুলে বসে, এমনকি বীরাঙ্গনা হয়ে হাওয়াই চটি দিয়ে পটাশ করে বাথরুমে উড়ন্ত আরশোলাও হত্যা করে তুত্তুরী। মরা পেচকে যাওয়া আরশোলা দেখে মা ভির্মি খাবে বলে ফুলঝাড়ু আর বেলচা দিয়ে তুলে ডাস্টবিনেও ফেলে আসে তুত্তুরী। এহেন বীরবত্তায় রীতিমত প্রীত হয়ে বাবাজীবন অনুমতি দেন, হাওড়া যাবার। উপরন্তু অনুমতি দেন নিছক দু-এক দিন নয়, পাক্কা ছয় দিন পাঁচ রাত হাওড়ায় থাকতে পারে তুত্তুরী। শর্ত শুধু একটা, ভুঁড়ি না বাড়ে। রোজ ব্যায়াম করতে হবে, আর মিষ্টি খাওয়া একদম নিষেধ। বাধ্য কন্যার মত ঘাড় নাড়ে তুত্তুরী। সেই মত হাওড়ায় দফায় দফায় ফোন করে বলা হয়ে যায়- ‘দাদু মিষ্টি কোল্ডড্রিংক কিচ্ছু এনো না যেন। না চকলেটও নয়। বাবা বারণ করেছে। ’


আপিস যাবার পথে ৯ তারিখ সকালে ব্যাগব্যাগেজ সমেত কন্যাকে বাপের বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে দেখি, ডাইনিং টেবিলের ওপর ইয়া বড় এক বাক্স দেশবন্ধুর দরবেশ রাখা। পাশে এককেজির লাল ঘণ ক্ষীর দই। কিছু বলতে যাবার আগেই ধমকে ওঠে বাবা, ‘আঃ আমি খাব। কেন আমি খেতে পারি না?’ তা তো পারেই, আশি পেরিয়ে সুগারের ঘোড়া টগবগ করে ছুটছে, প্রবল ধূমপানে ফুসফুস আধা জখম, তিনি মিষ্টি খাবেন না তো, কে খাবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ফ্রিজের দরজা খুলে যথারীতি দর্শন পেলাম দুই লিটার থামস্ আপ আর পুঁচকে বোতলে মাজা। মাখন রাখার তাকে গোটা চারেক ডেয়ারি মিল্ক রাখা, ফ্রীজের মাথায় গোটা কয়েক প্যাকেট ওরিও আর অন্যান্য ক্রিম বিস্কুট। একটা ডেয়ারি মিল্ক ব্যাগে ঢোকাতে গিয়ে তড়িদাহত হলাম। খ্যাঁক করে উঠল মা। ঝুলি থেকে বেরোল বেড়াল। তুত্তুরীর জন্য আনা চকলেট আমি ব্যাগে ঢোকাই কোন মুখে! কেমন মা আমি? হ্যাংলা। মধ্যস্থতা করার সুরে বাবা বলল, ‘আচ্ছা নিক। আমি ওবেলা এনে দেবো।’ 


গাড়িতে উঠে শৌভিককে ফোন করলাম, ওগো আমায় তুমি ছাড়া আর কেউ ভালোবাসে না গো।