‘কে রে? পুতু এলি?’ দোতলার বারন্দায় কাপড় মেলতে মেলতে প্রশ্ন করে চৈতি। পুতু বা সময়বিশেষে পুটু ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরী জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে 'তুত্তুরী ভিলা’য় সেঁদিয়ে গেল। ভাগের বাড়িটার নাম বাবা রেখেছে ‘তুত্তুরী ভিলা’। গাড়িতে আনতে আনতে পইপই করে বুঝিয়েছি, একটু ভদ্র সভ্য হয়ে থাকিস বাবু। এক আধবেলা তো নয়, পাক্কা পাঁচরাত ছয়দিন আমাকে/আমাদেরকে ছেড়ে থাকবে মেয়েটা।
হাওড়ায় নামলেই সাপের পঞ্চম পা দেখে মেয়েটা। তুত্তুরী ভিলায় পা দিলেই আরো দুই জোড়া হাত পা গজায় বোধহয়। সারাদিন দস্যিবৃত্তি করে বেড়ায় বুল্লুর সাথে। শ্রীমতী তুত্তুরীর না হয় সদ্য কেঁদে ককিয়ে পঞ্চম শ্রেণী। বুল্লু বাবুর তো নয়। আর বছর দুয়েক বাদে মাধ্যমিক দেবে ছেলেটা। দাদার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটালে বা মামীকে বেশী জ্বালাতন করলে বা মামমাম (দিদা) এর সমস্ত ডেটা খরচ করে দিলে যে পিঠের চামড়া আস্ত থাকবে না, তা বুঝিয়ে শুনিয়েই এনেছিলাম। মাইরি বলছি, তাই বলে বড়মামীর সাথে সম্পূর্ণ বাক্যালাপ বন্ধ করতে শেখাইনি।
লজ্জায় অধোবদন হয়ে মেয়েটাকে যে দুটো কটু কথা শোনাব তারও উপায় নেই। তুত্তুরী ভিলায় পদার্পন করার সাথে সাথেই কন্যাকে শাসন করার অধিকার হারাই আমি। আদরের পুতু পাত্তা না দিলেও, নিজেই নেমে এল বড়মামি। আদর সম্ভাষণ শুরু করেছে সদ্য এমন সময়, আমার কন্যা সটান গিয়ে তার গা শুঁকতে লাগল। এই মেয়েটার জন্য কারো সামনে মুখ দেখানো যাবে না, যা দেখি। ধমকানির আগেই সোল্লাসে বলে উঠল তুত্তুরী, ‘বড়মামি, তোমার গায়ে কিসের যেন গন্ধ? তুমি চাউমিন করেছ বোধহয়। ’ হাওড়ায় মেয়েকে গচ্ছিত রেখে চুঁচুড়া যাব, নির্বাচনী কর্তব্য সারতে, তাই সক্কাল সক্কাল ভরপেট ভাত খাইয়েই এনেছিলাম মেয়েটাকে। একপেট ভাত খেয়েও যে কেউ এইভাবে হ্যাঙলা ইয়ের মত চাউমিনের গন্ধ শুঁকে বেড়ায়, এ আমি বাপের জন্মেও দেখিনি। চৈতির অবশ্য বিকার নেই, পরম হর্ষে তার পুতুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছে, ‘করেছি তো। চল তুই আর দাদা খাবি। তার আগে দাদাকে ঘুম থেকে টেনে তুলবি চল।’
মানে মানে কেটে পড়লাম হাওড়া থেকে। দিন পাঁচেক পর এসে সবাইকে সুস্থ দেখলে হয়। চুঁচুড়ায় পৌঁছে ফোনে জানতে চাইলাম কি করছে মেয়েটা। জবাব পেলাম, ‘দাদার সাথে ক্রিকেট খেলছি মা। স্মাইলি বল দিয়ে ক্রিকেট। ’ বুঝতে পারলাম স্বর্গীয় ছোটকাকুর সাধের বৈঠকখানায় এখন চলছে জমজমাট ক্রিকেট ম্যাচ। বোঝাতে গেলাম হোক স্মাইলি বল, তবু সাবধানে খেলো বাবু, অনেক মূল্যবান ছবি আছে ঐ ঘরটায়। অতীতে মাখামাখি এমন কিছু সাদাকালো আর রঙীন ছবি, যেখানে থমকে আছে সময়। ঘুরিয়ে জবাব পেলাম, না ছবিতে বল লাগেনি বটে, তবে প্রথম শটেই বড়মামার দাড়ি কামানোর গ্লাসের জলে বল ফেলেছিল তুত্তুরী। তখন ক্রিকেট চলছিল দোতলায়।
ওই ম্যাচ পণ্ড হবার পর, পরের ম্যাচ বৈঠকখানায় শুরু হতে না হতেই বড়মামির পেটে শট মেরেছে তুত্তুরী। কি যেন কাজে ঘরে ঢুকেছিল বড়মামী। দাদা অর্থাৎ বুল্লু বলছে, মায়ের পেটে বল মারতে পারা মানে চার, তুত্তুরীর দাবী ছয় রান তো দিতেই হবে।
দপ্তরী কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে মায়ের ফোন। তুলতেই ওপাশ থেকে তুত্তুরীর অভিমানী গলা, ‘মা বড়মামী খুব বাজে। খালি কাজই করে চলেছে। একটুও সময় দিচ্ছে না আমায়। এদিকে মামমামের ফোনের সব ডেটাও যেন কিভাবে শেষ করে ফেলেছে মামমাম। তুমি একটু কাকিমার নম্বরটা দাও তো। একটু কাকিমার সাথে কথা বলি। ’ পেটে বলের গুঁতো খাবার পরও যে বড়মামি,তুত্তুরীর সাথে সম্পর্ক রেখেছে এতেই আমি কৃতার্থ, তারপর আবার সময় কেন দেবে বুঝতে পারলাম না। আর মামমাম বেচারা শুধু ফোন করতে পারে, কষ্টেসৃষ্টে ধরতে পারে আর ফেসবুক খুলতে পারে। আর কিছুই তেমন পারে না। তিনি কিভাবে দেড় জিবি ডেটা শেষ করলেন, এটা আর কেউ না বুঝতে পারলেও তুত্তুরীর মা বেমালুম বোঝে।
বেলা বাড়ে, পশ্চিম আকাশে এক মুঠো লাল আবির ছড়িয়ে পাটে বসেন সূর্য দেব। কর্মব্যস্ততার ফাঁকেও মেয়ের জন্য টনটন করে হৃদয়। কেমন আছে মেয়েটা? কি করছে মেয়েটা?ফোন করলাম মেয়েটাকে, প্রফুল্ল হয়ে শ্রীমতী তুত্তুরী জানায়, ‘দিদির গলা টিপছি মা। ’ দিদি অর্থাৎ আমার আদরের একমাত্র পিসি। হায় হায়! দিদির গলা টিপছ কেন? জবাবে বুঝলাম, বড়মামা হল আসল কালপ্রিট। বড়মামা অর্থাৎ শ্রীমান অয়ন খেলাচ্ছলে দিদিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমার কোথায় ব্যথা দিদি?’ দিদি সরল ভাবে জানিয়েছে, আপাততঃ গলা ছাড়া আর কোথাও তেমন ব্যথা নেই। অতঃপর দিদির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দুই ভাইবোন এবং ধেড়ে মামার গলা টেপা এবং তদজনিত সুড়সুড়ি এবং তদজনিত সম্মিলিত অট্টাহাস্যে বেশ বুঝতে পারলাম, ভালোই আছে মেয়েটা।
রাতের মত কাজ মিটিয়ে হোটেলে ঢুকেলাম, কাল সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছাতে হবে কন্ট্রোল রুমে। নৈশাহার সেরে সবে শুয়েছি, টং করে চৈতির মেসেজ। ‘দেখো পুতু আমায় কেমন সাজিয়েছে-’। চৈতির ফটফটে মুখ, কালিঝুলি মাখা চোখ, ঘেঁটে যাওয়া লিপস্টিক দেখে প্রথম চোটে আঁতকে উঠতে হয়। স্বীয় কন্যার বাঁদরামিতে যৎপরনাস্তি লজ্জিত হয়ে লিখলাম, ‘আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। গিয়েই উদোম ঠ্যাঙাব ব্যাটাকে। ’
সঙ্গে সঙ্গে চৈতির উত্তর, ‘কেন গো? ওর কি দোষ? আমরা সবাই মিলে খুব মজা করছি। ’ যেমন পুতু তেমনি তার বড়মামী। যা পারে করুক গে-
কয়েকটা ঘন্টাই তো কেবল ঘুমাব, অর্ধ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি, বড়মামা ওরফে অয়নের ফোন। ফোনের ওপাশ থেকে তুত্তুরীর আর্ত চিৎকার, ‘আমি না। আমি না। বড়মামা, প্লিজ তুমি কথা বল। মা নাহলে ফোনের ওপাশ থেকেই ঠাস করে চড় মারবে আমায়। হ্যাঁ গো। মা সব পারে-’।
চৈতি, অয়ন এবং তুত্তুরীর সম্মিলিত জবানবন্দি থেকে যা বুঝলাম, সকাল থেকেই প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিল বড়মামী। দিনের বেলাটা গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকলেও সন্ধ্যাটা শুধু পুতু আর তার বড়মামীর। সন্ধ্যা নামতেই হিসেব বুঝে নিতে হাজির হয়েছে তুত্তুরী। প্রথম আব্দার, বড়মামী তোমার গয়না দেখাও। বড়মামী কোন গয়নাই পরে না, কিন্তু যত্ন করে সাজিয়ে রাখে কঁচের চুড়ি, ঝুটো গয়নার ডালি। ঐ ডালির প্রতি ভয়ানক লোভ তুত্তুরীর। চৈতির যাবতীয় গয়নার খুঁটিনাটিও ঠোঁটস্থ মেয়েটার। চৈতির কৈশোর তথা তরুণী বয়সের বেশ কিছু গয়না বগলদাবাও করেছে মেয়েটা।
পুতুর আব্দার ফেলতে না পেরে নতুন করে গয়নার ডালি নিয়ে বসেছিল মামী আর তুত্তুরী। গয়নার পর পাড়া হয় মামীর অন্যান্য সাজুগুজুর জিনিস। মামীর লিপস্টিক, কাজল, কমপ্যাক্ট। বড়ই অল্প প্রসাধন করে চৈতি। সাংসারিক চাপে সময় পায় কোথায়? তাও যা শখ করে কেনে পড়েই থাকে।
ডেট এক্সপায়র হতে বসা এমনি একরাশ প্রসাধন দ্রব্য দিয়ে মামীকে সাজিয়েছে তুত্তুরী। কি সাজাচ্ছে তা শুধু মামী জানত আর তার পুতু। বড়মামা শুদ্ধ মাঝপথে ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করেছে, ‘হ্যাঁরে তুই কি মামীকে মা তারা সাজাচ্ছিস?’ জবাব এসেছে, ‘না গো। রক্তখেগো শাঁকচুন্নি সাজাচ্ছি। ’
প্রশ্ন ভেসে আসে, কেমন লাগছে, তুত্তরী 'শাঁখচুন্নি ম্যাডামকে'? রাগব না হাসব বুঝতে পারলাম না। ফোনের ওপাশে সম্মিলিত হর্ষধ্বনি আর থামছেই না। অয়ন বলছে, ‘ন্যায্য কথা। শাঁখচুন্নি ম্যাডামই বটে। দেখ না রক্ত খেয়ে কেমন রোগা করে দিয়েছে আমায়। ’ আমি প্রতিবাদ করার আগেই লাফিয়ে ওঠে চৈতির পুতু, ‘হ্যাঁ তাই তো। একদম মায়ের মত রোগা হয়ে গেছ তুমি বড়মামা। ’ ' হ্যাঁ রে, তুই কার ভাগ্নি রে?' কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে নামে তুত্তুরীর বড়মামা। কি বলব বুঝতে পারলাম না। নিজেদের মধ্যেই ঝগড়ায় ব্যাপৃত সব, একবার ভাবলাম ফোন কেটে দি, একবার ভাবলাম বলি, আপদগুলো নিজেরা শাঁখচুন্নি, বেহ্মদত্যি, খোক্ষস যা খুশি সাজ না বাপ, খামোকা আমায় ধরে কেন টানাটানি। বললাম না, থাক, আরো খানিক নীরবে শুনি ওদের খুনসুঁটি। তারপর না হয়, ঘুমোব। বড় জব্বর ঘুম আসবে আজ। ঘুমের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসবে রামধনু রঙা একরাশ স্বপ্ন। গুলিয়ে যাবে, মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে আমার ছেলেবেলা আর তুত্তুরীর মেয়েবেলা। মা হওয়ার এটাই তো মজা-
No comments:
Post a Comment