আজকের দিনে মায়ের সঙ্গে একখান ছবি না দিলে কি এ সমাজ আমায় মেনে নেবে? মুস্কিল হচ্ছে মায়ের সঙ্গে আমার একাকী ছবি খুব বেশী নেই। যা আছে সেসবই আমার বিয়ের আগে পরে তোলা। তখন অত ছবিই বা কোথায় তোলা হত। সবথেকে দামী মোবাইলের ক্যামেরাও হত মেরেকেটে ১.৩ মেগাপিক্সেল। তাও ছবিটবি যা তুলতাম, তাতে থাকতে মোটেই আগ্রহী ছিল না মা। অন্তঃপুরবাসিনী বা হলেও অন্তরালে থাকতেই বরাবর ভালোবাসে মা।
বিগত সপ্তাহদুয়েক ধরেই ভাবছি কি উপহার দেব মাকে? শাড়ি দেবো কি? শাড়ি রাখার জায়গা নেই মায়ের আলমারিতে। পুজো, নববর্ষ বা জামাইষষ্ঠী মার্কা অনুষ্ঠানে শাড়ি কেনা যেখানে বাধ্যতামূলক, মা ফরমান জারি করে, কিনলেও তার জন্য যেন ছাপা শাড়ি কেনা হয়। ভালো শাড়ি, ভারী শাড়ি মা পরবে কোথায়? যখন শখ ছিল তখন সাধ্য ছিল না। আর যখন সাধ্য উপচে গেল, মায়ের আর কোন শখ নেই।
গয়না কিনে দেব কি? এককালে গয়নার প্রতি বড় লোভ ছিল মায়ের। খুব একটা তো ছিল না। যা ছিল তাও, যৌথ পরিবারের ঝড়ঝাপটায়, বাবার পাশে দাঁড়াতে অকাতরে খুলে দিয়েছে মা। চাকরী পেয়ে দিয়েছিলাম টুকটাক কিছু, যার মধ্যে একটা সেট ছিল খোদ পিসি চন্দ্র থেকে কেনা। মায়ের স্বপ্নের দোকান। বাবা-মায়েদের স্বপ্নপূরণের জন্যই তো আমাদের বড় হয়ে ওঠা। মুস্কিল হল, একটি বারও পরেনি মা। যত্ন করে তুলে রেখেছে ব্যাঙ্কের গোপন লকারে। ঝুটো সিটি গোল্ড পরে ঘোরে আজকাল।
এটাই আমার মা। যা চায়, তা ভুল করে চায়। আর যা পায়, তা মোটেই চায় না। কি যে চায় মা। ভালো খাবার দাবার অর্ডার করে পাঠাব কি? বিরিয়ানি খেতে বড় ভালোবাসে মা। ভালোবাসে আমার হাতের পায়েস। তাতেও ঘোর আপত্তি মায়ের। চিরকালই পেটের রোগে ভোগা বাঙালী, গল ব্লাডার হারিয়ে এখন তো হজমশক্তি আরো ক্ষীণ। তাহলে চকলেট,কেক বা মিষ্টি? চকলেট বস্তুটার প্রতি তেমন আকর্ষণ কোনদিনই বোধ করেনি মা। মিষ্টি গোটা কোনদিন খেতে পারে না মা। কোনা ভেঙে একটুকরো বড়জোর।
তাহলে কি কোন শোপিস অর্ডার দেবো? বা বাঁধিয়ে পাঠাব কোন স্মৃতি বিজড়িত ছবি। শোপিস পেলেই শোকেসে গুদামজাত করবে মা। আঃ বাইরে থাকলে ধুলো পড়বে যে। পুরুলিয়া থেকে কিনে আনা অমন সুন্দর ছৌ নাচের মুখোশকে প্লাস্টিকে মুড়ে কোন সিন্দুকে তুলেছে আর মনেই করতে পারেন না তিনি। ফুল পাঠাব? এই তো সেদিন বিবাহবার্ষিকীতে পাঠালাম, একরাশ তাজা রক্তগোলাপ।এখনও সপ্তাহ ঘোরেনি তার।
ইন্সটলমেন্টে একটা টিভি কিনে দেবো কি? বাড়ির টিভিটা এলইডি নয়। তুত্তুরীর থেকেও বুড়ো এলসিডি। মাঝে মাঝেই ক্ষীণ হয়ে আসে, বন্ধ হয়ে যায় আওয়াজ। মিস্ত্রি দিয়ে সদ্য তার স্পিকার বদলেছে বাবা। এখন নতুন টিভি কিনে দিলে ক্রুদ্ধ বৃদ্ধের দাপটে টলে উঠবে মেদিনী। তাহলে ফ্রিজ? বাড়ির ফ্রিজটা সেই সাবেকী ১৬৫লিটারের ওয়ালপুল। যখন কেনা হয়েছিল তখনও আসেনি বর্তমান সহস্রাব্দ। ভিতরে মালপত্র ঠেসে রাখে মা। সপ্তাহে একদিন মনে করে ডিফ্রস্ট করে বাবা। বিবর্ণ হয়ে গা থেকে খুলে আসছে রঙ। বার দুয়েক আলো বদলানো আর গ্যাস ভরা ছাড়া আজ অবধি সার্ভিস করতে হয়নি তাকে। কষ্টার্জিত অর্থে কেনা ফ্রিজটার প্রতি বাবার টান সন্তানস্নেহের মতই। ওকে পাল্টে ফেলতে চাইলেই হাঁ হাঁ করে উঠবে বৃদ্ধ। হয়তো মাও।
তবে কি ওয়াশিং মেসিনটা বদলে দেব? সেটাও প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে বিগত বছর। বছরে একবার আখতার মিস্ত্রি এসে স্ক্রু দিয়ে কি সব এঁটে যায়, আর বাকি বছরটা দিব্য ঘোরে ব্যাটা। দিনে দুই থেকে তিনবার কাপড়কাচা হয় আমাদের বাড়িতে। মায়ের ঘরের কাপড় সাতসকালে মা নিজে কাচে। আর বাবার পোশাক বাবা। ভালো পোশাক যদি কেউ পরে,সেগুলো অবশ্য একসাথেই কাচে বাবা। অবসর নেবার সময় পাওয়া অর্থে কষ্টেসৃষ্টে কেনা, তাই ওর ওপর ভয়ানক টান বাবার।
অনেক ভেবেচিন্তে একটা সিংগোনিয়াম গাছই পাঠালাম মাকে। একঝলক টাটকা বাতাস। সুদৃশ্য পোর্সিলিন প্ল্যান্টারে বসানো। প্ল্যান্টারের গায়ে মায়ের আর আমার ছবি দেওয়া। সব ব্যবস্থা ওয়েবসাইটই করে দিল। পার্সোনাল মেসেজটাও ডেলিভার করবে ওরা সুদৃশ্য কার্ডে ভরে। মাদার্স ডের দিন দুয়েক আগেই পৌঁছে যাবে মায়ের উপহার।
বিবাহবার্ষিকীর দিন এক কেলো বাঁধিয়োছিল বাবা। সারপ্রাইজ দেব বলে জানাইনি কেক আর ফুল পাঠিয়েছি ক্যুরিয়র মারফৎ। যোগাযোগ করার জন্য দিয়োছিলাম বাবার মোবাইল নম্বর। শর্ত ছিল,কোন কারণে ডেলিভারি ফেল হলে টাকা ফেরৎ দেবে না ওয়েবসাইট। সকাল থেকে ফোন করিনি। প্রতি মুহূর্তে ভাবছি এই বুঝি ডেলিভার হল উপহার আর খুশি খুশি কণ্ঠে ফোন করল বাবা বা মা। ফোন আর আসেই না। শেষে ধুত্তোর বলে ফোন করেই ফেলল তুত্তুরী। ভাগ্যিস করল, ঠিক সেই সময়ই ফোন করেছিল ক্যুরিয়রের ছেলেটা আর বাবা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকে ভাগিয়ে দিচ্ছিল। ‘আরেঃ হাম ও অলোক চ্যাটার্জি নেহি হ্যায়। হাম কুচ অর্ডার নেহি দিয়া। ’
আবার যাতে কেলো না বাঁধায়, ভোর ভোর বাবাকে জানিয়ে রাখলাম,মায়ের জন্য কিছু পাঠাচ্ছি। বলো না যেন। কি পাঠাচ্ছি, কেন পাঠাচ্ছি কিচ্ছু বললাম না যদিও। আপিস পৌঁছে যখন নৈমিত্তিক খবর দিচ্ছি, ‘জ্যান্ত পৌঁছেছি মা।’ ক্যাঁক করে চেপে ধরল মা, ‘ কি পাঠালি? কেন পাঠালি?’ বৃদ্ধের পেটে যদি কোন কথা থাকে।
সারাদিন ওয়েবসাইটে অর্ডার ট্রাক করেই কাটল। দে রে ভাই ডেলিভারি। এরমধ্যে দুবার ফোন করল বাবা, স্নান করতে আর ইয়ে করতে যাবে কি না। যদি এসে পড়ে ডেলিভারি বয়। এমন ফাজলামির কোন মানে আছে?
সাতবার মেল করলাম, ‘পাঠা বাপ। পাঠা। বৃদ্ধ বৃদ্ধা বড়ই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। ’ অবশেষে বেলা তিনটের সময় ভিডিও কল, ‘মানা। এসেছে তোমার উপহার। এই দেখো আমি আনপ্যাক করছি। মা মোবাইল ধরল আয় বিশ্বকর্মার মত ছুরি আর কাঁচি দিয়ে কাটতে বসল বাবা। সুদূর দিল্লী থেকে পার্সেল হয়ে আসা গাছ, ঈশ্বরের কৃপায় তখনও ঝকঝকে। কাঁচি দিয়ে টেপ গুলো কাটতে আসতে আসতে দৃশ্যমান হচ্ছে পোর্সিলিন প্ল্যান্টার আর তাতে লেখা আই লাভ ইউ মা। উৎসাহের চোটে থিরথির করে কাঁপছে মায়ের হাতের ক্যামেরা ফোন। ধমকাচ্ছে বাবা, ‘আঃ ঠিক করে ধরো। ’ এবার বেরোচ্ছে মায়ের আর আমার ছবি। উল্লাসে সুড়ুৎ করে উঠল মা, ‘সন্তুর আর আমার ছবি দেওয়া কাপ। ’ সব উৎসাহে একরাশ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল কেউ। সন্তু অর্থাৎ তুত্তুরীর সঙ্গে আমার মায়ের আর মাদার্স ডের কি সম্পর্ক রে ভাই? মা টা তো আমারই নাকি। ভাগো এখান থেকে বলে ধমকে উঠতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে, মাকে সেরা উপহার তো দিয়েই দিয়েছি আমি এক দশক আগে। জীবনের বদলে জীবন। আর সেই নতুন জীবনকে ঘিরেই নতুন করে বাঁচুক মা। সন্তু অর্থাৎ তুত্তুরীকে আঁকড়ে নতুন করে শিকড় ছড়াও মা। হ্যাপি মাদার্স ডে।
No comments:
Post a Comment