Monday 10 May 2021

অনির ডাইরি ৮ই মে, ২০২১

 



বলতেই পারেন, সুখের অসুখ। মাথার ওপর ছাত আছে, থালা ভরা গরম ভাত আছে, প্রিয়সান্নিধ্য আছে, তুত্তুরীর বকবকম আছে, হাত বাড়ালেই বন্ধু আছে, তবুও কেন জানি না দম বন্ধ হয়ে আসে কেবল। 


নৈমিত্তিক ব্যস্ত জীবন, দুরন্ত বেগে ছুটে চলা সময় আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেলে বোধহয় এমনি হয়। অজান্তেই তৈরি হয়ে যায় অনন্ত, ঘোর কৃষ্ণগহ্বর। অসুস্থ পৃথিবীর গর্ভ থেকে উঠে আসে এক তীব্র ভালো না লাগা, ভালো না থাকার বিষবাষ্প। যাতে ক্রমশঃ আক্রান্ত হয় হৃদয়। ভালো লাগছে না। কিছুই যেন, কিছুই কেন ভালোলাগছে না? 


ভালোলাগে বৈকি, ভালোলাগে ভোরের কাঁচা রোদ মাখা, পেলমেট থেকে ঝুলন্ত আমার সোনা রঙ ঝুমকো লতার দিকে তাকিয়ে থাকতে। ভোরের আলো মেখে আলতো করে কেমন ছুঁয়ে দিয়ে দিল কোণার টবে রাখা মাকড়সা গাছের হাত। বারন্দার একটেরে জানলা গলে যখন মুখ বাড়ায়, একটি দুটি লালচে গোলাপী রঙা নয়নতারা তখন তো দিব্য ভালোলাগে। শিরা-উপশিরা-রক্তজালক থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় গভীর ভালোলাগা-ভালোবাসার তরঙ্গ। ভরে ওঠে মন। ভালোলাগে ঝাঁকড়া অপরাজিতার শাখে শাখে হন্যে হয়ে কুঁড়ি খুঁজে বেড়াতে। ‘ফুল ফোটাবি কি না বল, নইলে ছেঁটেই দেব ব্যাটা তোদের আজ’। এমনকি ভালো লাগে ভোর ভোর রোদে দিতে গিয়ে ক্যাকটাসের কাঁটার খোঁচা খেতেও-  বাকিটা সবটুকুই কেমন যেন নিকষ দমবন্ধ করা আঁধার।


ভাবছি পালিয়েই যাব। মহানগর থেকে অনেকদূর।  ভাবছি মোজাম্মেল সাহেবকে ধরব। একখান চাকরী দেবেন আমায়? ভদ্রলোক আমাদের দপ্তরেরই মজুরী পরিদর্শক ছিলেন, অবসর নেবার পর গ্রামের পৈত্রিক ভিটেতে একখান নার্সারি বানিয়েছেন। যতবার গেছি, একরাশ চারার সাথে সাথে এক অদ্ভূত প্রশান্তি মেখে ফিরেছি নিজ গৃহে। 


 অজগাঁ, চতুর্দিকে ঘন আমবাগানের ভিতর দিয়ে টলটল করতে করতে এগোয় গাড়ি। দিনের বেলাও কেমন যেন ছায়াচ্ছন্ন পথঘাট। আমবাগানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে বড় গ্রীলের দরজা ঠেলে ঢুকতে হয়। ঢুকতেই বাঁদিকে একখান অতিকায় লিচু গাছ। বয়স তার সত্তর। তিনতলার ছাতে মাথা ঠেকিয়ে দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে বোধধয়। সীমানা বরাবর পাহারা রত মহীরুহের দল আর তাদের মাঝে যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। হরেক রকম পাতাবাহারের গাছ, মরসুমি ফুলের গাছ, বারোমেসে ফুলের গাছ, ফলের গাছ, ত্রিপল আর জাল টাঙিয়ে গুচ্ছ খানেক ক্যাকটাস আর সাক্যুলেন্ট, শ্যাওলা ধরা চৌবাচ্ছায় ঢলঢল পদ্ম-শালুক, কি নেই? কে নেই? 


 অফিস ফেরৎ পড়ন্ত বিকেলে যখন গেছি, তখন গাছে জল দেবার সময়। কান পাতলেই শোনা যায় সদ্যসিক্ত গাছের পাতা থেকে কেমন টুপ করে খসে পড়ে মুক্তোর দানার মত জলকণা। কেমন সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়ায় গ্রীষ্মের ভিজে মাটি।  


ভালো লাগে না বললে তো আর জীবন শোনে না। কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যেও ঠিক পথ খুঁজে নেয় জীবন।  ভালো লাগিয়ে নিতে হয়। দেহের সাথে সাথে যত্নআত্তি  করতে হয়, খাতির করতে হয় মনটাকেও।  মনকে সেলাম জানিয়ে, মনের যত্ন নিতেই ঠিক করলাম আজ বিরিয়ানি রাঁধব। রাঁধব বললেই তো আর রান্না হয়ে যায় না, বিশেষতঃ এমন বাদশাহী খানা। তার জন্য লাগে সহস্র উপকরণ।  মিটশেফ ঘেঁটে পেলাম আধ প্যাকেট বাসমতী চাল, হাফ বোতল করে গোলাপ আর কেওড়ার জল। সুগন্ধী আতর ভেবে যেটা বেরোল, ভালো করে শুঁকে দেখলাম ঐটি নিম তেল। গাছের পোকা মারতে কিনে এনেছিলাম কবে যেন। 


একখান প্লাস্টিকের কৌটোয় বিরিয়ানি মশলা খানা বানিয়ে রেখেছিলাম, তা হল বেশ কিছুদিন। কিন্তু সে ব্যাটা লুকালো কোথায়। আবাসনে একখান বিশেষ দোকান আছে, তাকে বিরিয়ানী মশলা বললেই, নিঁখুত ভাবে ওজন করে একরাশ গোটা মশলা গছিয়ে দেবে। কি থাকে না তাতে? বড় এলাচ,ছোট এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জায়ফল, জয়িত্রি, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, কাবাবচিনি, সাজিরা,সামরিচ আর কি যেন একটা ধুলো-ধুলো ঝুরো ঝুরো পাতা। সবটুকু মশলা চাটুতে নেড়ে,শিলে বেটে গুঁড়ো করে রাখতে হয়। চলেও অনেকদিন। বিগত পুজোয় বানিয়েছিলাম, গেল কোথায় ব্যাটা। কৌটো খুঁজে ঢাকা খুলতেই মন মাতানো সুবাসে ভরে উঠল রান্নাঘর। 


মাস্ক পরে আতর কিনতে নামলাম বটে, আতর শুনলাম মার্কেট থেকে বেপাত্তা। অন্য দোকান থেকে একটা আতর আনিয়ে দিল বটে দোকানি, কিন্তু সাবধান করে দিল, ‘খুব অল্প দেবেন ম্যাডাম। এটা সস্তা আতর, বেশী দিলে গা গুলোবে। ’ 


মশলা তো হল। চালও হল। এবার মাংসের পালা। বিরিয়ানি যে রাঁধব, সে তো বেলা সাড়ে নটায় সিদ্ধান্ত নিলাম। ততোক্ষণে বাজার দোকান সেরে স্নান করতে গেছে শৌভিক। মাংস এনেছে বটে, কিন্তু তা গরগরে ঝোলের মাংস। মাংস আনলেই আলু দিয়ে লম্বা ঝোল করতে বলে শৌভিক, এমন ঝোল যাতে চলে যাবে দুইবেলা।  বাবার ভাষায় এমন ঝোল যাতে গামছা পরে নেমে তুলে আনা যায় মাংসের টুকরো বা হাড়। স্নান করতে যাবার আগে ফরমাইশ ও জানিয়ে গেছে ছাপোষা উচ্ছে আলু ভাতে আর মাংসের ঝোল রাঁধলেই চলবে। পরিশ্রমও কম হবে, আবার বাসনও পড়বে কম। যে বাড়িতে সবাই এত আমার কথা ভাবে, সেই বাড়িতে কি আদৌ মন খারাপ করে থাকা যায়? 


খানিক মাংস তুলে রাখলাম। পরে স্ট্যু বানিয়ে দেবো ক্ষণ। বড় ভালেবাসে এরা মাখন আর চিজ দেওয়া আমার হাতের চিকেন স্ট্যু। বাকি মাংসে তিন টেবল চামচ টক দই, এক চামচ লেবুর রস, নুন,লঙ্কা গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, পরিমাণ মত মধু, রসুন বাটা, অল্প আদা বাটা আর বিরিয়ানি মশলা ভালো করে মাখিয়ে বেশটি করে চটকে মেখে রেখে দিলাম। 


থাকুক ঘন্টা খানেক ব্যাটারা অমনি ভাবে। বাসমতী চালকে তিনবার ধুয়ে, ভিজিয়ে রাখলাম। ওরাও থাকুক। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আমার সবথেকে ভালো লাগে। আলু থাকে না বটে, তবে ঐ যে বেরেস্তা ছড়ায়, প্রতি গরাসে সুবাসি ভাতের সাথে টুকরো মাংস আর ভাজা পেঁয়াজের তরজা কেমন যেন নবাবী অনুভূতি জাগায়। তবে এ বাড়িতে মাংসের সাথে আলুর যা নিবিড় যোগাযোগ। বিরিয়ানিতে আলু না দিলে ছোটটা কিছু বলবে না হয়তো, বড়টা বড়ই বিমর্ষ হয়ে পড়বে।  অগত্যা- 


সবার আগে খোসা ছাড়ানো গোটা আলুগুলো নুন হলুদ মাখিয়ে সর্ষের তেলে ভেজে, অল্প সিদ্ধ করে তুলে রেখে, ঐ তেলেই গোটা দুই চামচ ঘি, অল্প জিরে, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা আর সামান্য গোটা গরম মশলা দিয়ে কুচানো পেঁয়াজ গুলো ভাজতে দিলাম। প্রাণে ধরে সবটুকু পেঁয়াজ দিতে পারলাম কই, বেরেস্তা বানাব থাক। বেরেস্তাই তো এই বিরিয়ানির প্রাণ। 


পেঁয়াজে রঙ সোনালী হলে মাখিয়ে রাখা মাংস গুলো ঢেলে কষতে হয়, বিরিয়ানি মশলা, টকদই, রসুন আর লঙ্কাগুঁড়োর সংমিশ্রণে ছড়ানো সুবাস, কানে কানে বলে যায়, পথটা ঠিকই ধরেছ যে । আদা বস্তুটা এরা মোটেই দেখতে পারে না, তবুও আরো একছটাক আদা না দিলে কেমন মন কেমন করে যেন। কষা শেষ হয়ে আসলে সামান্য ফেটানো টক দই, আরো খানিক বিরিয়ানি মশলা, অল্প লঙ্কা গুঁড়ো মেশাতে হয় মাংসে।  কষতে কষতে যখন মাংস ফেলে বুড়বুড়ি কেটে লাফিয়ে ওঠে শুধুই তেল, তখন ভেজানো বাসমতী চাল সাবধানে ছড়িয়ে দিতে হয় মাংসের ওপর। হাতা বা ছোট বাটি দিয়ে চেপে চেপে সমান করে দিতে হয় চাল। তারপর ঢালতে হয় নুন মেশানো জল। এই জল ঢালাটাই সবথেকে চাপের ব্যাপার। জল এমন হবে যাতে চাল হবে সুসিদ্ধ, কিন্তু বিরিয়ানি হবে ঝরঝরে। আমার নিজের হিসেব যতকাপ চাল তার থেকে ঠিক এক থেকে দেড় কাপ বেশী জল। 


জল গরম-ঠান্ডা যাই দেওয়া হোক কিছু যায় আসে না। শুধু নুনটা ঠিকমত হয়েছে কিনা দেখে, পাত্র ঢেকে মাঝারি গ্যাসে বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা। মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে দেখে নেওয়া লবণ কম হয়ে গেল নাতো। যখন ঢাকা খোলা হবে তখন অল্প করে দুধে গোলা জয়িত্রি বা কেশর, আর অল্প বেরেস্তা ছড়িয়ে দেওয়া। যেহেতু চাল হাফ সিদ্ধ, তাই খুন্তি দিয়ে সাবধানে সামান্য নাড়াচাড়া করে নিলেও কোন সমস্যা হয় না। বরং দেখে নেওয়াই ভালো, তলাটা ধরে গেলে গ্যাস কমিয়ে দেওয়া যায় যাতে। বেরেস্তা মেশানো হয়ে গেলে, ভাতও ঝরঝরে হয়ে আসবে, তখন সামান্য গোলাপ আর কেওড়ার জলের সাথে দু-চার ফোঁটা বিরিয়ানির আতর মিশিয়ে দিলেই হবে। চাল সামান্য শক্ত থাকতে থাকতে গ্যাস অফ করে ঢাকা দিয়ে দিতে দিলেই ব্যাস্ প্রায় অনায়াসেই তৈরি হয়ে এক কড়া বিরিয়ানি। 


দেখতে শুনতে তো বেশ ভালোই হয়েছিল, স্বাদেও অতি চমৎকার। অন্তত জনগণ তাই বলল, অবশ্যি ছিঁচকাঁদুনে  বলে এরা যে হারে আমায় প্যাম্পার করে, এদের কথায় না বিশ্বাস করাই ভালো। তবে খেতে বসে পুনরায় অনুধাবন করলাম উদরের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক বড়ই রগরগে মাইরি। সেই যে মা বলতো না, ‘ভুঁড়ি ঠাণ্ডা তো মুড়ি ঠাণ্ডা’। দেহের বয়স বাড়লেও জীবন হাতেনাতে শিখিয়ে দেয়, মনের বয়স আজো আটকে আছে সেই মায়ের হলুদের গন্ধ মাখা আঁচলের তলে।

No comments:

Post a Comment