Thursday 8 October 2020

অনির ডাইরি ৮ই অক্টোবর, ২০২০


কত মত। কত পথ। কত জ্ঞান- পাল্টা জ্ঞান। সমালোচনা। বাদ-বিবাদ। ছিছিক্কার। এইসব কিছু থেকে অনেক অনেক দূরে বাস করে মানু। জানেন মানু কিন্তু বাঙালী নয়,মারাঠি মুল্গি। যদিও বললে মানু হেসে গড়াগড়ি যেত। বলত, "আমি মুল্গি নই গো ম্যাডাম দিদি। মুল্গি হল কচি। ডবকা মেয়ে। আমার বয়স কত জানো? দুই কুড়ি পাঁচ। ” তারপরই বলত, "কিছু নেবে নাকি? নাও না। আসল সোনার বাউটি আছে, বালা আছে, চুড়ি আছে, পলা আছে। ” এই বলেই চিৎকার করত মানু। আসল ল্যাকমে কোম্পানির  গয়না বেচত বলে মানুর মাটিতে পা পড়ত না। আরেঃ এ ল্যাকমে ঐ দামী কসমেটিক ব্রাণ্ড নয়, যার মুখপাত্র তৈমুরের মা। এ হল লোকাল ট্রেনের লোকাল ব্রাণ্ড। তো যা বলছিলাম, এক বাঙালী ছেলের সাথে পালিয়ে বঙ্গদেশে পা দিয়েছিল মানু। এইসব গল্পে যা হয় আরকি। দেশে এসে দেখে ঘরে জাজ্বল্যমান সতীন। মানুর গর্ভে তখন তিলে তিলে বাড়ছে লক্ষ্মী। এই নামই দিয়েছে মানু তার মেয়ের। মেয়ে নিয়ে আলাদাই থাকে মানু। শিয়ালদা মেন লাইনের ট্রেনে হকারী করে চলে যায় দুটো প্রাণ। থুড়ি চলে যেত। পুজো আসার মাস দুয়েক আগে থেকে হুহু করে বিক্রি বেড়ে যেত মানুর। অনেক অনেক টাকার গয়নাগাটি মুখ দেখে দিয়ে দিত মানু। পয়সা পরে বা কিস্তিতে দিলেও চলত। একবার এই করতে গিয়ে এক মহিলা ৫০০টাকার জিনিস নিয়ে আর পয়সা না দিয়েই কেটে পড়েছিল। সেই দুঃখের গল্প শুনে খুব ধমকেছিলাম গত বছর। আবার অনেক সময় অনেক মহিলা যাত্রী এমনিই দু-পাঁচশ টাকা দিয়ে দিত মানুর হাতে। “মিষ্টি খাস মানু।” অথবা “পুজোয় অন্তত একটা নতুন শাড়ি কিনিস মানু।” এবছর কি করে সংসার চলছে মানুর কে জানে? কি খাচ্ছে মা-মেয়েতে? 

সুদেব গুড়বাদাম বিক্রি করত ট্রেনে। লেডিজেই বেশী ছিল খরিদ্দার। জন্মান্ধ সুদেব হকারী করতে গিয়ে ট্রেন থেকে পড়ে কব্জি থেকে হারিয়েছে বাঁ হাত। তবুও ছাড়েনি হকারী। বিগত সাড়ে তিনবছর ধরে, দেখে আসছি, আজ অবধি নিজের অবস্থার কথা বলে কোন সহানুভূতি চায় না সুদেব। আমার দেখা সবথেকে পজিটিভ মানুষ। কতই বা বয়স? বছর চল্লিশ অথবা আরো কম। দীর্ঘ ক্ষয়াটে চেহারা। একদিন ফাঁকা ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘যতদিন গতর চলবে, খেটে খাব দিদি। অন্ধ বলেই কি হাত পাততে হবে বলুন?’ জীবনিশক্তির এমন জলচ্ছবি কেমন আছে কে জানে? আছে কিনা তাই বা কে জানে।লকডাউন আর কোভিড আতঙ্কের মধ্যেই দক্ষিণ এশিয়া আর আফ্রিকার প্রায় তিন কোটি মানুষ অর্ধাহার বা অনাহার জনিত কারণে অপুষ্টি-আক্রান্ত। এটাও মাস খানেক আগেকার তথ্য। এখন হয়তো আরো বেড়েছে। প্রসঙ্গতঃ খাদ্যের কিন্তু অভাব নেই। অভাব সুষ্ঠ বিলিবন্টনের। সৌজন্য- অবশ্যই কোভিড। শ্রীলেদার্সের ভিড় নিয়ে জম্পেশ একটা পোস্ট দিয়েছেন তো? 


তনিমা একজন আধাসরকারী কর্মচারী। অন্তত তনি তাই মনে করে। চুপি বলি, আসলে তনি পাতি এজেন্ট। যেমন যেমন কাজ করে বদলে কমিশন পায়। তনির একটা পুঁচকে ছানা আছে। লকডাউনের মধ্যেই হারিয়ে গেছে তার অনেকগুলো ভ্যাকসিনের ডেট। তনি পারেনি ছানাটাকে ইঞ্জেকশন দেওয়াতে। লকডাউনে বন্ধ ছিল ওর বরের কারখানা।বন্ধ ছিল তনির আপিসও। মাঝে এমন একটা দিন এল, যখন গোটা বাড়ি খুঁজেও একটা টাকা বার করতে পারেনি কর্তাগিন্নীতে। এখন হাঁড়ি চড়ছে কোনমতে। ওসব ভ্যাকসিন-ট্যাকসিনের কথা চিন্তাও করতে পারছে না ওরা। শুধু ওরা নয়, আফ্রিকা আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় দেড় কোটি বাচ্ছা পায়নি কোন ইম্যুনাইজেশন। এই বাচ্ছাগুলো পরে বড় হয়ে কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে কে জানে? আপাততঃ ওদের বাবা-মাও হয়তো তনিদের মতোই ভাবছে,  দেখা হলেই যেমন প্রশ্ন করে তনি, “আবার লকডাউন হবে না তো ম্যাডাম? না খেয়ে মরে যাব এবার।” 


আর আমার সেই বান্ধবী, যার বাড়িতে ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তীব্র শোকের মধ্যেও  হেসে উঠেছিল সে, “অনি রে যখন পুলিশ এল,কি ভিড় প্রতিবেশীদের। সবাই ভিড় করে কেচ্ছা দেখতে এসেছে বুঝলি। আর মেজোবাবু যখন বললেন, “কেউ একটু আসুন। বডিটা নামাতে হবে”। তখন কেউ এল না জানিস। কেউ না। এত করোণার ভয় মানুষের অনি?  আমার বৃদ্ধ অসহায় বাবা, যে কিনা সক্কাল সক্কাল আবিষ্কার করেছে তার মৃত পুত্রের দেহ, আমার নার্ভাস হয়ে বসে পড়া বর আর আমি ছাড়া কেউ ছিল না অনি। আমি। আমি। আমি নামালাম জানিস। তারপর থেকে আর চোখ বোজাতে পারছি না। চোখ বুজলেই, চোখে ভেসে উঠছে ঐ দৃশ্য। ” মাত্র চারজনের কথা লিখলাম। শ্রমদপ্তরে চাকরী করি, সপরিবারে জয় করেছি কোভিডকে এরকম আরো চল্লিশজনের উদাহরণ দিতে পারি, যাদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে এই ব্যাধি। নাঃ এরা কেউ আক্রান্ত হয়নি। আক্রান্ত হয়েছে এই সমাজ। ভয় যদি পান, বাড়িতে বসে থাকুন। আপনি ভাগ্যবান, বাড়িতে বসে সোশাল মিডিয়ায় বিপ্লব করছেন। কিন্তু সবাই এত ভাগ্যবান নয়। আর এদের গরিষ্ঠাংশেরই কোন সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নেই, যে বিরুদ্ধ মতটাও আপনার গোচরে আনবে। আপনি বেঁচে থাকুন। আমাদের মত খেটেখাওয়া মানুষগুলোকেও একটু বাঁচতে দিন। করোনায় না মরলেও অর্ধাহারে অনাহারে মরেই যাবে হয়তো।

Sunday 4 October 2020

অনির ডাইরি, ১লা অক্টোবর, ২০২০

 


আজকের সকালটা বড় মনোরম। অক্টোবর পড়েই গেছে, ভোরের বাতাসে লেগেছে হাল্কা হিমেল একটা আমেজ। মায়ের আসছেন, আর তো কটা দিন। আকাশে-মেঘে-রোদে সর্বত্র খুশির গন্ধ। শুধু গুটি কয়েক মিটিং সালটে দিতে পারলেই, মাঝারি লম্বা একটা সপ্তাহান্ত।  

মিটিংগুলোও বড় ভুলভাল। প্রথম কেসটিতে যাঁকে নিয়ে মিটিং তিনি অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজারের পদে কর্মরত ছিলেন। লাখ বারো টাকা তহবিল তছরুপের অভিযোগে খুইয়েছেন চাকরীখানা। ভালো করে বুঝিয়েছিলাম, ম্যানেজার পদাধিকারীদের পাশে দাঁড়ানোর এক্তিয়ার নেই আমার। শ্রম দপ্তর তথা শ্রম আইন শুধুই শ্রমিকদের জন্য।  তহবিল তছরুপ নিয়ে কিছু বলিনি,কারণ নীতি পুলিশগিরিটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। 


ভদ্রলোক সেই শুনে এমন কান্নাকাটি জুড়লেন কি বলি। মহিলাদের অশ্রু তাও হজম হয়, পূর্ণ বয়সী পুরুষের চোখের জল সহ্য করা বেশ দুষ্কর। ওণার বক্তব্য আমার অপরিচিত নয়, ‘নামেই অমন ম্যানজার ম্যাডাম। বেতন কত দিত শুনবেন?’ ভুল কিছু বলেননি,বেতন যেকোন সিকিউরিটি গার্ডের থেকে ইতরবিশেষ। ওণার পোশাকপরিচ্ছদও সোচ্চারে তাই ঘোষণা করে। তহবিল তছরুপ নিয়েও উনি অনড়, “আমি এট্টা নয়া পয়সাও চুরি করিনি দিদি। ’ এরা যখন কান্নাকাটি  জোড়ে, তখন হঠাৎ ম্যাডাম থেকে দিদি হয়ে যাই-এটা আগেও দেখেছি। 


কিছু করতে পারব না, হাতপা বাঁধা বললেও যদি কমলি না ছাড়ে, তখন বাধ্য হয়েই মাথা গলাতে হয়। ইনি আবার আত্মঘাতী  হবার ভয় দেখালেন। কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, লকডাউনের আগে একটা মোটা অঙ্কের টাকার চেক ওণাকে দেওয়া হয় ব্যাঙ্কে জমা করার জন্য। ব্যাঙ্কে ঐ সময় অসম্ভব ভিড় আর চাপ। উনি চেকটা জমা করে চলে আসেন। 


মাসখানেক পর যখন প্রথম আনলক ডাউন হয়, আপিসে গিয়ে দেখেন টাকাটা ওনার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ঢুকে বসে আছে। তৎক্ষণাৎ ব্যাঙ্কে দৌড়ে চিল্লাচিল্লি করে টাকাটা আবার আপিসের অ্যাকাউন্টে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেন উনি। দুটি অ্যাকাউন্ট একই ব্যাঙ্ক তথা ব্রাঞ্চে। ফলে অসুবিধা হয়নি। টাকাপয়সা যথাস্থানে পাঠিয়ে যখন উনি দপ্তরকে জানাতে গেলেন তখনই বাঁধল গোল। এতদিন এসব কেউ জানতও না। খোঁজও করেনি। জানার সাথে সাথেই শোকজ এবং পরদিন টার্মিনেশন। তাজ্জব ব্যাপার, এতো ঠাকুমার ভাষায়, ‘কলিযুগে উপকারীকে বাঘে খায়’ কেস। সবথেকে বড় প্রশ্ন যেটা একটা সরকারী ব্যাঙ্ক এমন কেলো করল কি করে? চেক ক্রশ করা ছিল না? কার নাম ছিল চেকে? চেকের ফটোকপিতে লেখা দেখলাম,‘ সেল্ফ’। সই করেছেন প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি। তো সেই চেক আপনার অ্যাকাউন্টে ঢোকাল কেন? শুনলাম ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ইতিমধ্যে বদলী হয়ে গেছেন। তবে এর আগেও এইরকম দপ্তরী টাকাপয়সা ভদ্রলোকের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে এবং তা ওণার দপ্তরের অনুমোদন সহ। অনুমোদন পত্রের ফটোকপি দেখালেন, যেখানে লেখা আছে, ইব্যাঙ্কিং ইত্যাদির জন্য ওণার অ্যাকাউন্ট দপ্তরী কাজে ব্যবহার করা যাবে।  


গুপি কেস মাইরি। সবকাগজ ঘাঁটলে বোঝাই যায়, টাকা চুরি হয়নি, পাইপয়সা ঢুকেছে যথাস্থানে। সেই টাকা থেকে ওণার দপ্তর খরচাও করছে দেদার, অথচ লোকটাকে চোর অপবাদ দিয়ে বিতাড়ন করে বসে আছে। এমন কেসে তো হস্তক্ষেপ করতেই হয়।


 এইসব কেসে সাধারণত  চিঠি পাঠিয়ে বিপক্ষের বক্তব্য জেনে তবেই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকা হয়। লোকটার আর্থিক তথা মানসিক যাতনা দেখে সোজা ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডেকে বসে আছি। পোস্টাফিসের মাধ্যমে চিঠি পাঠালে পাছে দেরীতে পায় বা ঐ অজুহাত দেখায়, আমাদের শান্তনু স্বয়ং গিয়ে দিয়ে এসেছে  মিটিং এর শমন।  

বাদী এসেছে যথাসময়ে, বিবাদী বলতে এসেছেন এক বয়স্ক ব্যক্তি। শুনলাম তিনিই নাকি প্রেসিডেন্ট। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ হাবভাব সবই অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকদের মত। পরিচয় দেবার সাথে সাথে বুঝলাম আমার অনুমান অব্যর্থ। এবার চেপে ধরতে সুবিধে হল। ‘কি মশাই, আপনি সরকারী লোক হয়ে, তুচ্ছ অভিযোগে একটা ছেলের চাকরী খেয়ে নিলেন? তাও আবার চুরির বদনাম দিয়ে? আমি হলে তো সর্বাগ্রে মানহানির মামলা ঠুকতাম। চুরির দায়ে তাড়ালেন, অথচ পুলিশকে জানালেন না? ব্যাঙ্ককে কিছু বললেন না।  আর যে পাইপয়সা ফিরিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা আপনাদের দৃষ্টিগোচর করল, তাকে দিলেন ভাগিয়ে? বেশ মজা না?’ উনি থতমত খেয়ে জানালেন, ‘আমি জানি ম্যাডাম। চূড়িন্ত অন্যায় হয়েছে ওর সাথে। আমি প্রতিবাদ করেছিলুম। এইভাবে রাতারাতি কাউকে ছাঁটাই করা যায় না। কেউ কর্ণপাত করলে না। আসলে দলাদলি-’। 


অ্যাঁ? দল? তুমি কোন দল করো ভাই? গ্রামের দিকে দলাদলি এসে গেলেই তো কেস জণ্ডিস। উভয়েই আশ্বস্ত করলেন না, তেমন কোন ব্যাপার নয়। সবাই একই দল,তবে ঐ গোষ্ঠিবাজি একটু আধটু আর কি। বললাম, তাহলে লিখে দিন, ওর ছাঁটাই অনৈতিক। আপনি চান ও চাকরী ফিরে পাক। বৃদ্ধ দেখলাম সটান পেন বার করে প্রস্তুত। আহাঃ প্রথম মিটিংটাই নির্বিঘ্নে মিটে গেল- যেই ভেবেছি, ম্যানেজারের চিঠি। তিনি সবিস্তারে লিখেছেন, যে পুরাতন বোর্ড আপাততঃ মুলতুবি। ফলে ঐ বোর্ডের নেওয়া সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না। এব্যাপারে যদি কিছু করতেই হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সরকারী অাধিকারির সঙ্গে যেন যোগাযোগ করা হয়।  


আধিকারিক বসেন বিডিও আপিসে। তাঁর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনিও মানলেন যে অন্যায় হয়েছে। তাঁর রিপোর্টেও তিনি নাকি এটা লিখেছেন। সর্বোপরি, বাদীকে আমার কাছে পাঠানোর পিছনেও তিনিই আসল কলকাঠি নেড়েছেন। সে তো হল, এবার এর কি হবে? এর উত্তর আধিকারিকের কাছে নেই। তিনি জানালেন, জেলাস্তরীয় আধিকারিককে বলে যদি আমি কিছু করতে পারি। তিনি আবার পাশের বিল্ডিং এ বসেন।  

বেশ তাই হোক তাহলে। সুকন্যার সাথে শলা করে, যুৎ করে চিঠি লিখলাম, সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে। গোটা গোটা করে লিখলাম, এই ভাবে পুশিলকে না জানিয়ে, একদিনের নোটিশে, কাউকে ছাঁটাই করা শুধু শ্রম আইনই নয়, বাদীর মৌলিক অধিকারেরও পরিপন্থী। অবিলম্বে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে বাধিত করুন। 


 ধীমান চিঠি নিয়ে রওণা দেবার পর, ভদ্রলোককে বললাম, আমার দৌড় এখানেই শেষ। এবার আমার সমমর্যাদার অন্য দপ্তরীয় আধিকারিকের পালা। আশা করি তিনি আপনাকে নিরাশ করবেন না। যদি হয়, নির্ঘাত হবে, অবশ্যই আমাকে জানিয়ে যাবেন,কেমন? 


এবার দ্বিতীয় মিটিং এর পালা। সূর্য মধ্যগগন ছেড়ে পশ্চিমাভিমুখী। এটা বোনাসের মিটিং। দুপক্ষই পূর্বপরিচিত। এর আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কয়েকবার মিটিং হয়েছে। শ্রমিকদের মুখপাত্র যিনি, ট্রেড ইউনিয়নের এক বয়ঃজেষ্ঠ্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা, শুনলাম তিনি অসুস্থ। উনি থাকলে আমায় বিশেষ আর মুখ খুলতে হয় না। ভদ্রলোক রীতিমত সব্যসাচী। দুহাতে ব্যাট চালান। কখনও মালিককে ধমকান তো কখনও শ্রমিকদের। আজ তিনি নেই,মানে কপালে দুঃখ আছে। 


আসতে বললাম, দুই পক্ষকে। একদল অচেনা লোক ঢুকে এল হুড়মুড় করে। আপনারা কারা মশাই? ট্রেড ইউনিয়নে কি নেতৃত্ব বদল হয়েছে? আমার সামনের চেয়ারে ধপ করে বসা স্থূলাঙ্গ ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিতে বুঝলাম, এরা ঐ মিটিং এর সঙ্গে সম্পর্ক বহির্ভূত। ইনি স্থানীয় বড় রাজনৈতিক নেতা। আর সঙ্গের লোকগুলি প্যাণ্ডেল তথা ডেকরেশনের কাজ করে। অন্যান্য বছর এইসময় ঐ গ্রামগুলি পুরুষ বিবর্জিত থাকে। সবাই ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তে পুজোর কাজ করতে। এবারে কোন কাজ নেই। সংসার চলছে না। সপরিবারে আত্মঘাতী হবে সবাই, তাই আমাকে জানাতে এসেছে। 


কি যন্ত্রণা। সবাই আত্মঘাতী হবার হুমকি এই অধমকেই দেয় কেন? কি চাই বাবাসকল? আমার প্যাণ্ডেল বাঁধানোর কোন ক্ষমতা নেই। টাকাপয়সা, চাল বা অনুদান দেবার মতও কোন সাধ্য নেই। একেবারেই অকর্মণ্য  অধম আমি। ওণারা দেখলাম আমার এই অসহায় স্বীকারোক্তিতে বেশ সন্তুষ্ট  হলেন। নেতা মশাই বললেন,‘ আপনি অন্তত আমাদের কথা তো শুনলেন। অমুক সাহেবের কাছে গেলুম, তিনি তো দেখাই করলেন না। জানেন?’ বেচারা অমুক সাহেব। তাঁর যে কত যন্ত্রণা, আমি তো বুঝি। আরো খানিক অনুযোগ শুনে, দুই বড় সাহেবের সরকারী নম্বর আর ইমেল আইডি দিয়ে তাঁদের রওণা করলাম। ওপরমহলে পৌঁছাক ওদের আর্তি। জানি আগামী দিনে এরকম আরো অনেক আবেদন আর্তি ভেসে আসবে।  পুজো হলে রাজ্যটা কেরালা হয়ে যাবে, আর না হলে, মানুষ অভুক্ত হয়ে মরবে। এযেন ক্ষুরস্য ধারা।  


এবার বোনাসের মিটিং এর পালা। দরাদরিটা আমার মোটেই আসে না, তবে তাই করতে হবে এখন। কত দেবেন? কত চাও? বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই প্রশ্ন করে যেতে হবে। যতক্ষণ না উভয়পক্ষ আসে একে অপরের কাছাকাছি। তখন দিতে হবে মোক্ষম চাপ। যা হবে আজকেই মিটিয়ে নিন আপনারা। ষষ্ঠীর দিন বিকালে এসে বোনাসের মিটিং যদি আমায় করতে হয়, তাহলে কারো রক্ষা নেই। অার যত তাড়াতাড়ি দেবেন বা পাবেন ততো জলদি যাবেন দোকানে। ভিড় জমে ওঠার আগেই কিনতে পারবেন বাচ্ছার জামা। বা বউয়ের শাড়ি। তারাও তো বসে আছে এই মিটিংএর দিকে তাকিয়ে। মিটিয়ে ফেলুন না মশাই, কেন ঝঞ্ঝাট পাকান আপনারা। 

পুনশ্চ-ছবিতে মিটিং শেষে সকলে। ১৮ শতাংশ বোনাস পাবে শ্রমিকরা। উপকৃত হবে শতাধিক পরিবার। পুজো ইস্পেশাল খুশি বলতে তো এইটুকুই।তাই বা কম কি? নামধাম না হয় উহ্যই থাকুক।  

Saturday 3 October 2020

 অনির ডাইরি, ৩রা অক্টোবর, ২০২০


এক ঝলক দেখে মনে হবে আটচালা হিন্দু মন্দির বুঝি। চুনকামের ফাঁকফোকর গলে এখনও বেরিয়ে আসে টুকটাক পোড়া মাটির ভাস্কর্য। নাম- হেনরী মার্টিনের প্যাগোডা।  


শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে, বড় বড় মহীরুহ আর সদ্য বর্ষার বেয়াড়া ঝোপজঙ্গলের মাঝে নিরালা নিঃসঙ্গ চুনকাম করা এক প্যাগোডা, আর কয়েকশ বছরের নীরব ইতিহাস। অন্তর্জাল ঘাঁটলে শোনা যায় নানা কিস্যা। শোনা যায় জনৈক রুদ্ররামের আখ্যান।  সে অনেককাল আগের কথা, ষোড়শ শতক। দিল্লীর দখল নিয়ে তখনও লড়াই করেই চলেছেন বাদশা হুমায়ুন।  বাংলায় তখন নড়বড়ে সুলতানী শাসন। ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছেন  এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ পাঠান, নাম, শের শাহ সুরী। এই জটিল রাজনৈতিক দাবাখেলা থেকে বহুদূর তৎকালীন শ্রীরামপুরের চাটরা অঞ্চলে মাতুলালয়ে বড় হয়ে উঠছিলেন বাবু রুদ্ররাম। সাংসারিক জটিলতা থেকে বহুদূর, পবিত্র গঙ্গা কিণারে, গভীর জঙ্গলের হৃদপিণ্ডে, নির্জনে ধ্যানে বসেছিলেন বাবু রুদ্ররাম। ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই দর্শন পেলেন, তাঁর। কৃষ্ণবর্ণ, অনুপম রূপবান বংশীধারী অনুরোধ করলেন একটি মন্দির স্থাপনের জন্য। কিন্তু কোথায় গড়ে উঠবে এই মন্দির? কেন, যেখানে ধ্যানে বসেছেন রুদ্ররাম। কালে কালে ঐ অঞ্চলই তো খ্যাত হবে বল্লভপুর নামে। শুধু মন্দির স্থাপন করলে হবে না, নির্দেশ এল, মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতার মূর্তি তৈরী করতে হবে, এক বিশেষ কষ্টিপাথর দিয়ে। আর সেই কষ্টিপাথর আনতে হবে,সুদূর গৌড় নগরী হতে। জনৈক যবন শাসকের অট্টালিকার সিংহদুয়ারের মাথা থেকে খুলে। গৌড় তখন সুলতানী বাংলার রাজধানী, এতো রীতিমত বাঘের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজ- 


তবুও রওণা দিলেন রুদ্ররাম, সম্বল বলতে শ্রীধরের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস আর অগাধ প্রেম। গৌড় নগরী  পৌঁছে অবিশ্বাস্য ভাবে আলাপ হল, ঐ শাসকের প্রধান অমাত্যের সাথে। যিনি আবার ধর্মে ছিলেন হিন্দু।  রাধামাধবের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা তাঁরও ছিল না।  বাকি গল্পের ওপর পড়েছে ইতিহাসের ধুলো।  কিভাবে যে কয়েকমণ ওজনের কষ্টি পাথর খোলা হল, সিংহদুয়ার থেকে, আর কিভাবে যে তা এসে পৌঁছাল সুদূর দক্ষিণবঙ্গের এক অনামা ঘাটে তা সম্পূর্ণ রহস্যাবৃত। শোনা যায় গঙ্গা নদী স্বয়ং ভাসিয়ে আনেন প্রস্তরখণ্ড খানি। বল্লভপুর ঘাটে এসে আটকে যায় পাথর। অতঃপর ঐ পাথর থেকে তৈরী করা হয় রাধাবল্লভের মূর্তি।  গড়ে ওঠে আটচালা মন্দির।  

অতঃপর কেটে যায় আরো এক শতক। হিন্দুস্তানে এসে পৌঁছয় শ্বেতাঙ্গ বণিকের দল। প্রথমে দক্ষিণ, পরে পশ্চিম হয়ে, পূব উপকুলেও এসে পৌঁছয় পালতোলা জাহাজের সারি। গঙ্গার খাত বরাবর কেউ আস্তানা গড়ে তোলে কলিকাতায়, কেউ বা চন্দননগরে, কেউ আবার চুঁচুড়া বা শ্রীরামপুরে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন দেশীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে, ড্যানিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমোদন তথা ফরমান দিয়ে যান নবাব আলিবর্দী খাঁ। সন ১৭৫৫। অচীরেই শ্রীরামপুরে গড়ে ওঠে ড্যানিশ উপনিবেশ। আসে ক্রিশ্চান মিশনারির দল। 


ইতিমধ্যে ঘটে গেছে অনেককিছু, বিপজ্জনক ভাবে এগিয়ে আসা গঙ্গানদী এবং যবন স্পর্শ বাঁচিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাধাবল্লভকে। 

পরিত্যক্ত মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল দখল করে গড়ে উঠেছে এক অনুপম বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। যার পোশাকী নাম অলড্রিন(নাকি অলডিন) হাউস। ১৮০৩ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রোভস্ট রেভারেণ্ড ডেভিড ব্রাউন কিনে কেন মন্দির সংলগ্ন এই বিশাল চত্বর। বছর তিনেক পর, শ্রীরামপুরে এসে উপস্থিত হন, হেনরী মার্টিন নামক জনৈক ধর্মযাজক। তিনি হ্যামলেটের দেশের বাসিন্দা নন। জাতে আগমার্কা বৃটিশ। শ্রীরামপুরে পৌঁছে স্বদেশীয় ব্রাউন সাহেবের কাছে প্রার্থনা করলেন আশ্রয়। বাংলোর নিকটবর্তী পোড়ো মন্দিরে ঠাঁই হল তাঁর। পরিত্যক্ত মন্দিরটিকে প্যাগোডা বলে পরিচয় করানো হয় ওণার সাথে। রাতের অন্ধকারে, নদীর তীরে নির্জন প্যগোডায় থাকতে প্রথম দিকে বেশ ভয়ই পেয়েছিলেন মার্টিন, ওণার ভাষায়, “ My habitation assigned to me by Mr. B, is a pagoda in his grounds, on the edge of the river. Thither i retired at night and really felt something like superstitious dread, at being in a place once inhabited as it were by devils.” ডেভিল অর্থাৎ রাধামাধব। ধীরে ধীরে এই প্যাগোডাতেই গড়ে ওঠে ওণার পাকাপাকি আস্তানা। নিয়ে আসেন অর্গান।  জমায়েত হতে থাকেন অন্যান্য মিশনারীরা। লোকশ্রুতি যে ভারতবর্ষের প্রথম ধর্মান্তর এখানেই সংঘটিত হয়। খ্রীষ্ট ধর্মমতে বিবাহও সংঘটিত হয়েছে এই প্যাগোডায়। 


তারপর যা হয়, আবার ছড়ি ঘোরায় ইতিহাস। কানপুরের উদ্দেশ্য রওণা দেন হেনরী মার্টিন।  ১৮১২ সালে মারা যান ব্রাউন সাহেবও। পুনরায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে অলডিন হাউস এবং হেনরী মার্টিনের প্যাগোডা। ১৮৪৫সাল নাগাদ এই মন্দির থেকে রূপান্তরিত চার্চটিতে গড়ে ওঠে মদের কারখানা। যার পোশাকী নাম ছিল প্যাগোডা রাম ডিসটিলারি। ১৮৯৩এ আবার ভোল বদল, এবার সমগ্র চত্বর দখল করে হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কস্। গড়ে ওঠে বিশাল বিশাল জলাধার। ভূতের বাড়ি হয়ে পড়ে থাকে অলডিন হাউস আর হেনরী মার্টিনের সাধের প্যাগোডা।

হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কসের জলাধারের পাশ দিয়ে, এবড়োখেবড়ো মেঠো রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে দর্শন মেলে এই জনহীন প্যাগোডার। বড় মনোরম পরিবেশ। শুধু যদি যান, একটু সচেতন থাকবেন, কিছুদিন আগেই একটি চন্দ্রবোড়া সাপের হদিশ পাওয়া গিয়েছিল এই তল্লাটে। তিনি আপাততঃ বনদপ্তরের অতিথি, তবে তাঁর আত্মীয়স্বজন- পাড়াপ্রতিবেশী তো থাকতেই পারে।  ©অনিশৌভিক


             একনজরে অলডিন হাউস, শ্রীরামপুর

অলডিন হাউস, শ্রীরামপুর। যাবার পথ এবং প্রহরীবৃন্দ

               হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা

     হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা থেকে উল্টো দিকে গান্ধী ঘাট

                     অলডিন হাউস, ক্লোজ আপ

Thursday 1 October 2020

দাদু আর তুত্তুরীর বৈঠকী গপ্প

 


“দাদু একটা গল্প বলো না।” “রোজ রোজ কি আর গল্প বানাব বলো তো? আচ্ছা আজ তোমাকে শম্ভু দার গল্প শোনাই। শম্ভু মিত্তির।”


“শম্ভু মিত্র? যিনি নাটক -”।


 না না এ অন্য শম্ভু মিত্তির। তাহলে গোড়া থেকে বলি শোন। শম্ভুদার বাবা ছিলেন বৃটিশ আমলে পুলিশের বেশ বড় অফিসার। শম্ভুদারা তিন ভাই। বড় দুভাই পড়াশোনা শিখে বড় চাকরী পেলেও, শম্ভুদার আর লেখাপড়া করা হয়ে উঠল না। শম্ভুদার মাথায় ঢুকল বিপ্লব-”।  “চ্যাটার্জী?” “ধ্যাৎ। এমন ফাজলামি মারলে কিন্তু আর গল্প বলব না। বিপ্লব মানে বিপ্লব। রেভোল্যুশন। দেশ সমাজ বদলে দেবার স্বপ্ন।”


“অ। তারপর?” “ তারপর আর কি? তারপর ঘোষিত হল নির্বাচন। পার্টি দাঁড়িয়ে গেল ভোটে-। বিপ্লব আর হল না। মাঝখান থেকে শম্ভুদাই পড়ে রইল অর্ধশিক্ষিত বেকার ভবঘুরে হয়ে। তখন শম্ভুদার দাদারা করল কি, একে তাকে ধরে, শম্ভুদাকে হোম-পলিটিক্যাল দপ্তরে একটা ড্রাইভারের চাকরী জুটিয়ে দিল। দিনে ড্রাইভারী করত- যাকেই দেখত, বাঁ হাত মুঠো করে বলত লাল সেলাম।  আর ডিউটি শেষ হলে এক পেট মদ গিলে বাড়ি ফিরত। "


“মদ খেত? এ বাবা। ” “হ্যাঁ।  তারপর শোনোই না। আমাদের সাথে যখন শম্ভুদার প্রথম দেখা, তখন আমরা ইছাপুরে একটা নাইটস্কুল চালাতাম। কোথা থেকে যেন শম্ভুদা জেনেছিল, আমার রাজনৈতিক পরিচয়-” 


“রাজনৈতিক পরিচয় মানে কি, দাদু?” “মানে আমি কোন মন্ত্রে দীক্ষিত-”। “ তোমার দীক্ষা হয়েছিল নাকি? তোমার গুরু কে দাদু?” 

“আমার কি আর একটা গুরু তুত্তুরী। আমার পাঁচ পাঁচখানা গুরু। তাদের নাম শুনতে চাও- মহান লেনিন,---”।  “নাঃ থাক। পরে শুনব। গল্পটা বল।”  


“ মোদ্দা কথা আমায় ভীষণ স্নেহ করত শম্ভুদা।  শম্ভুদার ছেলের নাম ছিল করালী। তাকে আমাদের নাইট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শম্ভুদা। স্কুল শেষে আমরা যখন বড়কর্তার চায়ের দোকানে আড্ডা জমাতাম, টলতে টলতে বাড়ি ফিরত শম্ভুদা। এক পেট মদ খেয়েও বসে পড়ত,আমাদের সাথে এক ভাঁড় চা খাবে বলে। এই চাটা আমাকেই খাওয়াতে হত, এটাই ছিল শম্ভুদার আব্দার। যেদিন শম্ভুদা এসে শুনত, যে করালী ক্লাশ করতে আসেনি, সেদিন কিন্তু আর চা খেত না। টলতে টলতে চলে যেত সোজা বাড়ি। শম্ভুদার খুব দুঃখ ছিল, লেখাপড়াটা করেনি বলে, প্রায়ই বলত, 'আমার ছেলেটাকে একটু লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ বানিয়ে দিও তোমরা",  করালী নাইট ইস্কুলে আসেনি শুনলেই,তাই বাড়ি গিয়ে কি করত জান? সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলে, খাটের তলা থেকে একটা মস্ত কাতান বার করে তাড়া করত ছেলেটাকে- আর চিৎকার করত, ‘কালীর বাচ্ছাটাকে আজ কেটেই ফেলব। ’ শম্ভুদার মায়ের হাউমাউ চিৎকারে কতবার আমরা দৌড়ে গেছি করালীকে বাঁচাতে তার ইয়ত্তা নেই। ”


“ হা-হা-হো- হো। কি বললে দাদু, নেন্টু হয়ে কাতান নিয়ে তাড়া করত-। আচ্ছা কালীর বাচ্ছা বলত কেন? ওটা তো শম্ভুর বাচ্ছা-”। 


“সেই খানেই তো মজা। তাহলে তোমাকে শম্ভুদার বিয়ের গল্প শোনাতে হয়। তখন আমাদের এই নতুনরাস্তা- ইছাপুর-সৌম্যচণ্ডীতলা এই সব জায়গা ধুধু করছে ফাঁকা জলাভূমি। এই জলাভূমির মাঝেই ছিল ভটকার জঙ্গল। প্রায় ৭৫বিঘে ঘন জঙ্গল। রাত নামলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাও লোকে ঐ জঙ্গলটা এড়িয়ে যেত।  লোকে বলত ঐ জঙ্গলে পেত্নী থাকে। শম্ভুদা একপেট মদ খেয়ে রাতের বেলা ঐ জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। কেউ জিগ্যেস করলে বলত, ‘পেত্নী খুঁজছি।  বে করব। পেত্নী ছাড়া আমায় আর কে বিয়ে করবে?’ 


একদিন হয়েছে কি, একটি মেয়ে মনের দুঃখে ঐ জঙ্গলে এসেছে গলায় দড়ি দেবে বলে। প্রগাঢ় আঁধারে, হঠাৎ বাবলা গাছের তলায় দুজনের দেখা। মাতাল শম্ভু ভাবল এই তো এট্টা পেত্নী পেয়েছি। সোজা মেয়েটাকে কাঁধে ফেলে দৌড়। পরদিন সকালে মায়ের বেনারসী পরিয়ে পাঠশালার মোড়ের মন্দিরে গিয়ে বিয়ে- বিয়ের পর বৌদির একটা ভালো নাম দেয় শম্ভুদা, তবে বিয়ের আগের নাম ছিল কালী। মদ খেলেই শম্ভুদা বৌকে কালী বলে সম্বোধন করত- আর চিৎকার করত, কালীর বাচ্ছাটাকে আজ কেটেই ফেলব”। 



“কি বাজে লোক।” আরে না না মোটেই বাজে লোক নয়। খুব রঙীন লোক। শম্ভুদার যে এমন কত মজার মজার গল্প আছে-” । 


“দাদু জানো তো মদ খাওয়া মোটেই ভালো নয়। প্রথম প্রথম খেতে ভালোই লাগে। তারপর একদিন লিভারে পচন ধরে। তারপর একদিন মানুষ চোখ খুলে দেখে সে হাওয়ায় ভাসছে আর পিছনে একটা ভয়ানক দর্শন যমদূত দাঁড়িয়ে আছে।  তার হাতে একটা ইয়া বড় ত্রিশূল। পক করে পিছনে খোঁচা মারে আর বলে, ‘এই মদ খাবি?’ লোকটা তো লোভে লোভে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। খাব। খাব’ অমনি কাঁটা চামচ দিয়ে চিলি ফিশ গাঁথার মত ত্রিশূল দিয়ে লোকটাকে গেঁথে ফুটন্ত তেলের কড়ায় চোবায় আর বলে,‘ খা।  খা।  আরো খাবি? আরো খাবি?’ আবার কখনও কখনও বলে, ‘এই পেন্টুল খোল’ লোকগুলো তখন ভয়ে ভয়ে বলে, ‘কেন যমদূত জী?’  আর যমদূত বলে, “জ্বলন্ত উনুনের ওপর বসতে হবে না?’ মরার পর তো আর কেউ মরতে পারে না দাদু।”

Thursday 24 September 2020

অনির ডাইরি,১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০

 অনির ডাইরি,১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০


বিমানবন্দরের সীমানা ছাড়িয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বালি ব্রীজ, একদিনে তিনজনে ঘর ছেড়ে হয়েছি বার- ।  অন্যান্য দিনে অসভ্যের মত ট্রাফিক জ্যাম হয় এই পথে, আজ রবিবার, সদ্য বিগত হয়েছে মধ্যাহ্ন, তাই বোধহয় যানজট কিছুটা ভদ্রোচিত। জানলার বাইরে টলটলে নীলাকাশে ঘন মেঘের ঘনঘটা, কাঁচ নামালেই অল্পস্বল্প জোলো বাতাস । “একপশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না” বলল শৌভিক। বিবেকানন্দ সেতুতে উঠে, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের চূড়া লক্ষ্য করে প্রণতি জানাতে না জানাতেই, অাবছায়া জানলার কাঁচ। 

ধূলাগড় টোলে, একপিঠের মূল্য ১০৫টাকা। ফিরব তো এই পথেই, তবুও দুপিঠের টোল কাটে না ওরা। টোল প্লাজার হাল্কা যানজট কাটতেই,ফাঁকা রাজপথ। গাড়ি দৌড়য় একশ কিলোমিটার গতিতে। উল্টোদিকে ছুটে যেতে থাকে, বাউরিয়া, চেঙ্গাইল, ফুলেশ্বর। উলুবেড়িয়ায় সামান্য দেরী হয় জট কাটতে, তারপর আসে বীরশিবপুর, বাগনান। দেউল্টি আসার সাথে সাথেই রাজপথ ছেড়ে বাঁদিকে নেমে যাই আমরা। তারপর ডানদিকে বাঁকলেই, রবিবার দুপুরের মরা বাজার। বাজারের সীমানায় মস্ত সাইনবোর্ড, সামতাবেড় শরৎবাবুর কুঠী ঐ পথেই। 


বাজার থেকে বেশ কিছুটা দূরে, পথের ওপরেই ওণার দ্বিতল কুঠী বাড়ি। চতুর্দিক টালির চাল দেওয়া বারন্দা দিয়ে ঘেরা। নিকানো তকতকে আঞিনা। আঙিনা ঘিরে যতনচর্চিত বাগিচা। আছে ওণার স্বহস্তে রোপিত পেয়ারা গাছ, ঝড়ে উপড়ে গেছে গোড়া, সংরক্ষিত শুধু শুষ্ক কাণ্ডখানি। ১৯২৬থেকে ১৯৩৮, দীর্ঘ একযুগ কাটিয়েছেন এই গৃহে। তখন নাকি সীমান্ত পাঁচিল স্পর্শ করে খলবলিয়ে বয়ে যেত রূপনারায়ণ নদ। এখন সরে গেছে বেশ কিছুটা দূরে।   তিনি তখন হাওড়া জেলা কংগ্রেসের বড় নেতা। কত তাবড় তাবড় বিপ্লবীর পদধূলিধন্য এই গৃহ। রাতের বেলা এসে মিটিং করে গেছেন খোদ নেতাজী। সবুজ শিকলাগানো দরজায় ঝুলছে তালা, সাড়ে তিনটের আগে খুলবে না। দরজার উল্টোদিকেই এক শান বাঁধানো পুকুর। এই পুকুরেই কার্তিক-গণেশের বাস ছিল বলে জনশ্রুতি। 

ঘড়িতে সোয়া তিন, এরই মধ্যে ভিড় জমেছে ভালোই। অনেক মানুষ আসে দেখতে। লকডাউন তথা করোণার আতঙ্কে জনজোয়ারে কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়লেও মন্দ কিছু নয়। রাস্তায় না দাঁড়িয়ে থেকে সীমান্ত প্রাচীরের গা বরাবর চললেই সামনে শ্যামল ধানক্ষেত, ক্ষেতের ওপারে চিকচিক করছে নদ। ক্ষেতের পাশ দিয়ে নদের ধারে যাবার রাস্তা ঢালাই হয়েছে পঞ্চায়েতের সৌজন্যে। পথের ধারে লাল ক্রোটন আর চায়না টগর গাছের সমারোহ। ফুটে আছে গুড়ি গুড়ি সাদা ফুল। বড় বড় নোটিশ টাঙানো, আবর্জনা ফেলবেন না। ভ্যাট ব্যবহার করুন। পচনশীল আর অপচনশীল আবর্জনার জন্য আলাদা রঙের ভ্যাটও রাখা আছে। তবুও পড়ে আছে শিখর জাতীয় গুটকার প্যাকেট। নদের পাড় বরাবর আছে অনেকগুলি বাঁধানো বসার জায়গা। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। পার বরাবর কাশ ফুটেছে। ওপাড়ে কোলাঘাট থার্মাল থেকে ভুসভুস করে বের হচ্ছে সাদা ধোঁয়া। আয়নার মত নীলাকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের দল, মুখ দেখতে নামছে নদের বুকে। গুটি কয়েক আগন্তুকের ক্ষণিক উচ্ছাস ছাড়া এপাড়ে বিরাজমান  অখণ্ড নীরবতা। 

শরৎবাবুর কুঠীতে ঢুকতে কাটতে হয়না কোন টিকিট। যে বয়স্ক কেয়ারটেকার ঘুরিয়ে দেখান, উনি শুধু দাবী করেন, যদি কিছু খুশি হয়ে দিয়ে আসেন। জুতো খুলে উঠতে হয় দাওয়ায়। লাল সিমেন্টের চকচকে মেঝে। বাঁদিকের ঘরে রাখা ওণার আরাম কেদারা। পাশের ঘরে পাতা ফরাশ, রাখা তাকিয়া। ওণার গড়গড়া। লণ্ঠন। বাতিদান আরও কত কি। ঐ লণ্ঠনের অালোয় নাকি কোন এক রাতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মন্ত্রণায় বসেছিলেন কথাশিল্পী আর নেতাজী। কি কথা হয়েছিল, জানে শুধু সময়, আর জানে বোবা লণ্ঠন। ভিতর দিকে আছে শস্যের গোলা। ছিল এক রসুইঘর, যা আটাত্তরের বন্যায় ধূলিসাৎ হয়েছে। শূণ্য ভিত আজও বিদ্যমান। 

কাঠের রেলিং দেওয়া লাল সিমেন্টের সিঁড়ি নিয়ে যায় দোতলা। দোতলায়ও চারদিকে ঘিরে আছে বারন্দা। বারন্দা থেকে রূপার পাতের মত লাগে নদীকে দেখতে। দোতলাতেই ছিল তাঁর শয়নকক্ষ। আছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি। ওণার নাতি জয় বাবু বোধহয় বর্তমান মালিক। বুড়ো কেয়ারটেকার তো তাই শোনাল- 

ওণার কুঠী থেকে অল্পদূরেই আছে সাড়ে  তিনশ বছরের পুরাতন মেল্ল্যকের মদনগোপাল জীউ এর মন্দির। দীর্ঘদিনের অযতনে নষ্ট হতে বসা, আটচালা পোড়া মাটির মন্দিরটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। সামতাবেড় থেকে গাড়িতে লাগে মিনিট দশ। পদব্রজে আরো একটু  বেশী সময় লাগবে হয়তো, তবে রাস্তাটা পায়েচলার পক্ষেই অধিক সুগম। ইঁটপাতা সরু রাস্তা, রাস্তার একপাশে কোথাও জনবসতি, কোথায় বা শুধুই ঝোপজঙ্গল।  অপরদিকে সবুজ ধানক্ষেত, গোচারণভূমি আর পুকুর। বড়ই মনোরম এই পথ। বাঁধের ধারে গাঁয়ের দুর্গামণ্ডপ, প্রস্তুত দেবীর কাঠামো। তারওপর পড়েছে মাটি। বাঁধের ওপর গাড়ি ছেড়ে বাকিটা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সরু পায়ে চলা পথের ধারে ফলে আছে কয়েৎবেল। ধরেছে বাতাবি লেবু। পুকুরের ধারে চরছে ছাগল ছানা। আর এদের সবাইকে পিছু ফেলে এগিয়ে গেলে হঠাৎ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সাড়ে তিনশ বছরের বুড়ো মন্দির। বুড়ো বললাম কি, তার শরীরে এখনও ঢলঢল করছে যৌবন।

ফেরার সময় ঝক্কি অনেক কম। আবার সেই পানা পুকুর, ছাগলছানা, বাতাবি লেবু, তেঁতুল আর কয়েতবেল গাছের তলা দিয়ে এসে উঠতে হয় বটে বাঁধে। এখান থেকে একটা সরু রাস্তা সোজা এসে ওঠে বম্বে রোডে। শুধু যদি মন্দির দেখতে চান, ওই রাস্তা ধরে যাওয়াই বোধহয় সহজ হবে। তবে মনে রাখবেন, ওখানে নেট থাকে না, জিপিএস কোন কাজে আসে না। স্থানীয় মানুষই ভরসা।

                  শরৎবাবুর কুঠী

লাল প্রাকারের এপার থেকে - বার্মিজ স্টাইলে লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কুঠি

বন্ধ খিড়কি দুয়ার থেকে শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কুঠি

বারান্দা থেকে দূরে রূপনারায়ণ নদ

এই পুকুরেই বাস ছিল কার্তিক আর গনেশ চন্দ্রের, সৌজন্য রামের সুমতি

নিঃসঙ্গ রূপনারায়ণ নদ, দেউল্টি

মদনগোপাল জীউ এর মন্দির মেল্ল্যক

©Anindita&ShouvikBhattacharya


তুত্তুরী উবাচ


তুত্তুরী উবাচ ১৮ই নভেম্বর, ২০২০


 👩🏻- একি রে! তোর হাতে এত মৌরি লাগল কি করে?

👧🏻- ঐ হাতটা ধুয়ে এসে, তুলে খেতে গিয়ে লেগে গেছে মা। 

👩🏻- হাত দিয়ে তুলেছ? ছি ছি,  চামচ দিয়ে তুলবে তো? 

👧🏻- (ভয়ে ভয়ে) চামচ দেখতে পাইনি তো?

👩🏻-চোখের সামনেই তো রাখা ছিল, বাবা- আমি নিলাম, আর তুমিই পেলে না?

👧🏻-ও হ্যাঁ, তাই তো! সত্যি মা,  হেঁ হেঁ, আমি একটা কুতকুতে হোঁদল। 

👩🏻-(হাসতে হাসতে প্রায় বিষম খেয়ে) কি অসাধারণ আত্মবিশ্লেষণ। আহাঃ।

👧🏻-( উৎফুল্ল স্বরে) আর তুমি হলে, জ্যান্ত ছানাওয়ালা পান্তু। ঐ যে দাদু 👴🏻 আমায় প্রায়ই ডাকে না,‘পান্তুর জ্যান্ত” বলে।

তুত্তুরী উবাচ ২২শে সেপ্টেম্বর,২০২০

👨🏻-(বাবা, ওষুধের বাক্স গোছাতে গোছাতে) আচ্ছা এই নরফ্লক্সটার ডেট ওভার হয়ে গেছে। এটা ফেলে দে। 

👧🏻-এ বাবা! এতো এক পাতা নতুন ওষুধ গো! এটা ফেলে দেবে?

👨🏻-(বাবা হাসি চেপে) এটা পেট খারাপের ওষুধ, তোদের হয়নি কেন? 

👧🏻- না বাবা, ফেলো না। এগুলো গুঁড়ো করে গাছের গোড়ায় দিয়ে দেবে মা। এই মা, একটু গুগল করে দেখো তো, গাছের গোড়ায় নরফ্লক্সের গুঁড়ো দিলে কি হয়?

👨🏻-( বাবা, খুকখুক করে হাসতে হাসতে) কি আর হয়? গাছের ইয়ে বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের গাছের কোষ্ঠকাঠিন্য হলে মা তোকে আর আস্ত রাখবে? তুই বরং ওটা ফেলেই আয়।

তুত্তুরী উবাচ, ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২০

👩🏻-(মা, কেজো স্বরে) অনেক বেলা হয়েছে, এবার একটু পড়তে বসো, না? 

👧🏻-(কয়েক মুহূর্ত পড়ার নাটক করে) চোখে অন্ধ, মুখে গন্ধ। মা তুমি এমন কাউকে চেন?

👩🏻- (মা হতভম্ব হয়ে) না তো? কেন?

👧🏻-এই একটু মনে হল। তোমার মোবাইলটা দাও তো দেখি, ধৃতরাষ্ট্রের মুখে দুর্গন্ধ ছিল না? 

👩🏻- (মা বিরক্ত হয়ে) যত ফালতু কথা, কি পড়ার সময়ই মনে পড়ে?

👧🏻- ( আরো খানিকক্ষণ নীরবে বইয়ের পাতা উল্টে) মা, পরের দিন যখন কুট্টুসের 🐕 সাথে দেখা হবে, কাকিমাকে ভিডিও কল করব, কেমন? কাকিমা কুট্টুসকে দেখতে চেয়েছে। 

👩🏻-(মা, আরো ক্রুদ্ধ স্বরে) যত বাজে কথা। কাকিমা মোটেই এমন কিছু বলেনি। আমি জানি। 

👧🏻-(আহ্লাদী সুরে) কাকিমা বলেনি তো। আমিই কাকিমাকে বলেছি, পরের দিন কুট্টুস দেখাব। কুট্টুসের কাণ্ডকারখানা শুনে কাকিমা তো হেসেই খুন। জানো তো মা, কুট্টুস এত ভালো, ওকে কামড়ে দিলেও কিছু বলে না। 

👩🏻-(মা, আতঙ্কিত স্বরে) মানে? তুই কুট্টুসকে কামড়ে দেখেছিস নাকি?

👧🏻-( আহ্লাদী সুরে) হ্যাঁ তো। ও বারবার আমায় কামড়াচ্ছিল, তাই বললাম, “আমিও কামড়াতে পারি দেখবি?” বলে ওর কানে কট করে কামড়ে দিলাম। 

👩🏻-(মা, আতঙ্কিত স্বরে) কি সর্বনাশ! এষা পিসি জানে? তুই তার কুতুয়াকে কামড়েছিস?

👧🏻-(দুষ্টু স্বরে) না বোধহয়। তোমরা তখন গল্প করছিলে।

👩🏻-(মা, মনখারাপী সুরে) জানতে পারলে, আর আসবে না এষা পিসিরা। তুই ওদের কুতুয়াকে কামড়েছিস- 

👧🏻-(আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে) আরে না না। ওরা কিছু বলবে না। আমি কুট্টুসের পিঠের ওপর বসে ক্যাসল স্টোরি খেললাম। তারপর ওর চোখে আলো ফেললাম, তারপর ওর সঙ্গে ভৌ ভৌ করে গল্প করলাম, তারপর ও আমায় কামড়াল, আমিও- 

👩🏻-(মা, অবসন্ন সুরে) থাক মা। তুমি ঐসবই করো। পড়াশোনা আর করে কি লাভ? আর করতে হবে না। 

👧🏻-(তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বইখাতা বন্ধ করে) হ্যাঁ মা। চলো গরু চরাই।🐄

অনির ডাইরি ২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২০

 


এনআরসির নাম শুনেই পুরানো মাসি যেন কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল অবশ্য, “দ্যাশে যাইতেছি বওদি। সেখেনে অনেক কাজ আছে জানো। কবে ফিরব জানি না। আর কি কইব বলো? সবই আমার কপাল!” তা সে অনেককাল আগের কথা, তখনও শীতের আমেজে ভাসছে নগর কলিকাতা। মাসির কপালের ভরসায় বসে রইলাম, বেশ কিছু দিন। ফোন করলাম বেশ কয়েকবার, কিছুই হল না ওপাশে। উল্টে গম্ভীর গলায় ফিরিঙ্গী ভাষায়, জনৈকা মেসিনকণ্ঠী আমাকে বেশ খানিকটা ধমকে নিলেন। 

আবাসনের বাসিন্দাদের কাছে কাজের মাসি খুব দুর্লভ কিছু না।  নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে, এমন অনেক মাসির নম্বর থাকে, বললেই গুটি কয়েককে পাঠিয়ে দেয়। নতুন মাসিকে তেমন ভাবেই পাওয়া। সদ্য বইতে শুরু করেছে বাসন্তী হাওয়া, মাসি এসে নাড়লেন কড়া। প্রথম দিন এসেছিলেন রাত আটটা নাগাদ, কথাবার্তা পাকা করতে। সেদিনই শুনলাম, মাসি বিধবা। আবাসনের পিছনের গলিতেই মাসির বাড়ি। দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে রিক্সা টানে, তার বাড়িতেই থাকে মাসি। ছোট ছেলে রদ্দিওয়ালা। পাশেই থাকে।  মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের পাড়াতে, জামাই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করে। সবই বেশ ভালো, বেতনেও পুষিয়ে গেল। দুবার আসা নিয়েও টালবাহানা করল না মাসি। বুঝিয়ে দিলাম, আমি বাড়ি থাকি না।  আমার অনুপস্থিতিতে বাড়ির গিন্নী বলতে মেয়ের মাসি, তার সঙ্গে ঝামেলা না বাঁধে। 


পরদিন ভোর ভোর কাজে এল মাসি, দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখি,পিছন পিছন এসেছে একটি ফুটফুটে বালিকা। সাগ্রহে জানতে চাইলাম, “মাসি এটা কে গো?” জবাব পেলাম মাসির নাতনী। ভেবেছিলাম ওণার জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ পুত্রের কন্যা, পরে বুঝলাম, আসলে দৌহিত্রী। মেয়েটি প্রায় আমার তুত্তুরীরই বয়সী, বছর আট- নয়। বেশ শান্ত, ভীরু ভীরু চোখে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, ওর সামনে যে প্রশ্নটা করতে পারলাম না, তা হল, “তবে যে মাসি বলেছিলে, মেয়ের সদ্য বিয়ে হয়েছে, বছর দুয়েক হবে?”প্রশ্ন করতে হল না, বাসন মাজতে মাজতে মাসি নিজে থেকেই বলল, ফিসফিস করে, “এটা ওর পথম পক্ষের মেয়ে গো বৌদি। অল্প বয়সে একটু, ঐ যা হয় আরকি-। পাড়ারই ছেলে সে-। ভিভোস হয়ি গেছে,বুঝলে। ওর বাপও বিয়ে করি নিয়েছে। তার তো ছেইলেপিইলেও হয়ে গেছে, ও আমার কাছেই থাকে”।  মেয়েটি তখন তুত্তুরীর সাথে বসে ওর পুতুলগুলো নিয়ে ঘাঁটছে, মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হল, আহা রে। বেচারা। 


মাসি একদিন ছুটি চাইল, জানাল ফুল্কির জন্মদিন। ফুল্কি মাসির দৌহিত্রী। ফুল্কির জন্মদিন বলে কথা, ছুটি দেবে না, এত সাহস কার? পরের দিন মাসি একাই কাজে এল, জানাল আগের রাতে ফুল্কি খুব ক্লান্ত ছিল, আজ আর উঠতে পারেনি। তুত্তুরী সাগ্রহে জানতে চাইল, ফুল্কি কি কি খেল, কি কি পেল-। মাসি ঝাঁট দিতে দিতে শোনাল, একটা পুতুল কিনে দিয়েছে। তার সামনে ফুল্কি যাই বলছে, সেও অমনি ঘুরিয়ে বলছে। ফুল্কি খুব খুশি, তবে মাসির পুত্র তথা পুত্রবধূ বেশ রুষ্ট, বড় দাম পুতুলটার কি না-। জানতে চাইলাম ওর বাবা-মা কি দিল? বাবার প্রসঙ্গে মাসি মুখবিকৃতি করল, জানাল, দুপুরের খাবারটা ঠাকুমা ডেকে খাইয়েছে। একটা জামাও দিয়েছে। আর মা? মাসি মাথা নীচু করে ঝুলো ফেলতে ফেলতে বলল, ‘ওর মা আর আসতে পারেনি। আমার জামাই সন্ধ্যেবেলা এসে কিছু দিয়ে গেছে।’ টুকটাক উপহার আর কি। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মাসি, সৎ মেয়ের জন্মদিনে কে আর অমন আপিস ফেরৎ উপহার নিয়ে আসে?সত্যি হয়তো, তবুও সদ্য পরিচিত এক শিশুকন্যার জন্য, কে জানে না, কোন অব্যক্ত বেদনায় বিধুর হয়ে উঠল এক মায়ের হৃদয়।


তারপর তো লকডাউন। বন্ধ হয়ে গেল মাসির আসাযাওয়া। মাসে একবার লুকিয়ে এসে বেতন নিয়ে যেত মাসি, প্রতিবারই মুণ্ডপাত করে যেত লকডাউন নামক বস্তুটির। “আর কদ্দিন এমন চলবে বল দিকি বউদি। আমার নেহাৎ উপায় নেই, তাই আসি মাইনা নিতে, বিশ্বাস করো বউদি। নইলে গতরে না খেটে পয়সা নিতে আমার ঘেন্না করে-”। প্রতিবারই ফুল্কির খবর নিতাম আমরা। শুনতাম ফুল্কি ভালো আছে। শুধু বাড়িতে থেকে একটু বদমেজাজী হয়ে গেছে। মাঝেমাঝেই দিদার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে- বুঝতাম ওগুলো দিদার সোহাগী ব্যাজস্তুতি মাত্র।  


তারপর এল আনলক ডাউন। আবার কাজে আসতে শুরু করল মাসি। তবে ফুল্কি আর আসে না। বাচ্ছা মানুষ, যদি ইনফেকশন ধরে যায়, তাই আনত না মাসি। তারওপর ফুল্কির লেখাপড়াও তো আছে। পাড়াতেই এক দিদিমণির কাছে ভর্তি করিয়েছে মাসি, নিজের বলত, ‘আমি মুক্কু মেয়েমানুষ, ওর মা তো বারো কেলাশের পরীক্ষাই দিল না। পালিয়ে গিয়ে বে করল- ও যদি তোমাদের মত পাশটাস দিয়ে কিছু করে’। ইতিমধ্যে ফুল্কির মা সরে গিয়েছে আরো দূরে, তার বর কর্মসূত্রে বদলী হয়ে গেছে সুদূর দক্ষিণ শহরতলীতে। কর্মস্থলের কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেছে কপোতকপোতী। এসেছে সুখের খবর, পুনরায় সন্তানসম্ভবা ফুল্কির মা। এর আগে একবার মিসক্যারেজ হয়েছিল, তাই এবার ওরা ভীষণ সতর্ক এবং সাবধানী। সীমিত আয়ে বড় ডাক্তার দেখায় জামাই। ফুল্কির মাকে কায়িক পরিশ্রম যাতে না করতে হয়, বাসনমাজা-ঘরপোঁছার মাসি রেখেছে জামাই বলতে বলতে চিকচিক করে ওঠে মাসির চোখ। ‘এমনকি রান্নাটুকুও করতে দেয় না সবসময় বুঝলে বউদি’ প্রগলভ হয়ে বলে মাসি। 


এই তো গত সপ্তাহের কথা, সেদিন বোধহয় শনিবার।  দুপুরবেলা, অন্য কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে, যেকটা বাসন পড়েছে মাজতে এসেছে মাসি, বাসনের ঠুকঠাকের মাঝেই ফোন।  ঘাড়ে ফোনটা রেখে মাথা হেলিয়ে কথা বলে চলে মাসি। একই সাথে চলে হাত আর মুখ, এটা বেশ পরিচিত দৃশ্য। অন্য বাড়ি থেকে ফোন করে, ছেলেমেয়েরাও করে, ফুল্কি ফোন করে টুকটাক বায়না করে- সেদিন মাসির গলা দেখি ক্রমেই চড়ছে, তর্ক বা বাদানুবাদ চলল, বেশ খানিকক্ষণ। তারপর মাসি কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে উগরে দিল একরাশ নালিশ। ‘মেয়েটা ফোন করে ট্যাকা চাইছে বউদি। ওর ওষুধপত্তরের অনেক দাম। জামাইটা একা একা আর কত টানিবে? সবই বুঝি বউদি। কিন্তু আমিই বা কোথা পাই বলোতো-’। আষাঢ় শ্রাবণের ঘন বাদল মুখে ফিরে গেল মাসি, পরদিন আবার দেখি মেঘ কেটে গেছে। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মাসি, ‘জামাই আমার বড় ভালো গো বউদি। কাল রাতে বাড়ি ফিরে সবশুনেই আমায় ফোন করেছিল, জানাল ট্যাকাপয়সা কিছু চায় না। ওর যা আছে তাতেই ওর ছেলে ভালো করে হয়ে যাবে। চিন্তা করতে নিষেধ করিছে। শুধু বলছে, কটা দিন যদি গিয়ে থেকে আসি, এই সময় মেয়েটাকে একটু যত্নআত্তি-’ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাসি, ‘করতে পারলে তো ভালোই, বলো বউদি? তবে আমি চলে গেলে, ফুল্কিটার যে কি হবে? ওকে কে দেখবে?’ বলতে বলতে আঁচলের খুঁটে চোখ মোছে মাসি। 

কাজটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিল মাসি, মেয়ে বড় অশান্তি করছে, একবার দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, আবার যদি কিছু হয়? বাড়িতে একজন গিন্নিবান্নি কেউ না থাকলে হয়? মাসির ছেলেবউদেরও তাই মত, বুড়ি কটা মাস মেয়ের কাছে থেকে আসুক- আর ফুল্কি? শেষ মাইনেটা হাত পেতে নিয়ে টকটকে লাল জবা ফুলের মত চোখদুটোর ওপর নোংরা আঁচল চেপে ধরা গলায় মাসি বলল,  “ওর বাপের বাড়ির লোকজন তো পাশেই থাকে-।ওরা রাখবে। ফেলে তো আর দেবে না। আর দিলে দেবে, আমি আর কি করব বউদি?রোজের এই অশান্তি আর ভালোলাগে না। কেন যে এত মায়া পড়ে যায় এদের ওপর, সেই তো গতর খাটাব, তবে দুটো খেতে পাব-”।