এনআরসির নাম শুনেই পুরানো মাসি যেন কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল অবশ্য, “দ্যাশে যাইতেছি বওদি। সেখেনে অনেক কাজ আছে জানো। কবে ফিরব জানি না। আর কি কইব বলো? সবই আমার কপাল!” তা সে অনেককাল আগের কথা, তখনও শীতের আমেজে ভাসছে নগর কলিকাতা। মাসির কপালের ভরসায় বসে রইলাম, বেশ কিছু দিন। ফোন করলাম বেশ কয়েকবার, কিছুই হল না ওপাশে। উল্টে গম্ভীর গলায় ফিরিঙ্গী ভাষায়, জনৈকা মেসিনকণ্ঠী আমাকে বেশ খানিকটা ধমকে নিলেন।
আবাসনের বাসিন্দাদের কাছে কাজের মাসি খুব দুর্লভ কিছু না। নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে, এমন অনেক মাসির নম্বর থাকে, বললেই গুটি কয়েককে পাঠিয়ে দেয়। নতুন মাসিকে তেমন ভাবেই পাওয়া। সদ্য বইতে শুরু করেছে বাসন্তী হাওয়া, মাসি এসে নাড়লেন কড়া। প্রথম দিন এসেছিলেন রাত আটটা নাগাদ, কথাবার্তা পাকা করতে। সেদিনই শুনলাম, মাসি বিধবা। আবাসনের পিছনের গলিতেই মাসির বাড়ি। দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে রিক্সা টানে, তার বাড়িতেই থাকে মাসি। ছোট ছেলে রদ্দিওয়ালা। পাশেই থাকে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের পাড়াতে, জামাই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করে। সবই বেশ ভালো, বেতনেও পুষিয়ে গেল। দুবার আসা নিয়েও টালবাহানা করল না মাসি। বুঝিয়ে দিলাম, আমি বাড়ি থাকি না। আমার অনুপস্থিতিতে বাড়ির গিন্নী বলতে মেয়ের মাসি, তার সঙ্গে ঝামেলা না বাঁধে।
পরদিন ভোর ভোর কাজে এল মাসি, দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখি,পিছন পিছন এসেছে একটি ফুটফুটে বালিকা। সাগ্রহে জানতে চাইলাম, “মাসি এটা কে গো?” জবাব পেলাম মাসির নাতনী। ভেবেছিলাম ওণার জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ পুত্রের কন্যা, পরে বুঝলাম, আসলে দৌহিত্রী। মেয়েটি প্রায় আমার তুত্তুরীরই বয়সী, বছর আট- নয়। বেশ শান্ত, ভীরু ভীরু চোখে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, ওর সামনে যে প্রশ্নটা করতে পারলাম না, তা হল, “তবে যে মাসি বলেছিলে, মেয়ের সদ্য বিয়ে হয়েছে, বছর দুয়েক হবে?”প্রশ্ন করতে হল না, বাসন মাজতে মাজতে মাসি নিজে থেকেই বলল, ফিসফিস করে, “এটা ওর পথম পক্ষের মেয়ে গো বৌদি। অল্প বয়সে একটু, ঐ যা হয় আরকি-। পাড়ারই ছেলে সে-। ভিভোস হয়ি গেছে,বুঝলে। ওর বাপও বিয়ে করি নিয়েছে। তার তো ছেইলেপিইলেও হয়ে গেছে, ও আমার কাছেই থাকে”। মেয়েটি তখন তুত্তুরীর সাথে বসে ওর পুতুলগুলো নিয়ে ঘাঁটছে, মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হল, আহা রে। বেচারা।
মাসি একদিন ছুটি চাইল, জানাল ফুল্কির জন্মদিন। ফুল্কি মাসির দৌহিত্রী। ফুল্কির জন্মদিন বলে কথা, ছুটি দেবে না, এত সাহস কার? পরের দিন মাসি একাই কাজে এল, জানাল আগের রাতে ফুল্কি খুব ক্লান্ত ছিল, আজ আর উঠতে পারেনি। তুত্তুরী সাগ্রহে জানতে চাইল, ফুল্কি কি কি খেল, কি কি পেল-। মাসি ঝাঁট দিতে দিতে শোনাল, একটা পুতুল কিনে দিয়েছে। তার সামনে ফুল্কি যাই বলছে, সেও অমনি ঘুরিয়ে বলছে। ফুল্কি খুব খুশি, তবে মাসির পুত্র তথা পুত্রবধূ বেশ রুষ্ট, বড় দাম পুতুলটার কি না-। জানতে চাইলাম ওর বাবা-মা কি দিল? বাবার প্রসঙ্গে মাসি মুখবিকৃতি করল, জানাল, দুপুরের খাবারটা ঠাকুমা ডেকে খাইয়েছে। একটা জামাও দিয়েছে। আর মা? মাসি মাথা নীচু করে ঝুলো ফেলতে ফেলতে বলল, ‘ওর মা আর আসতে পারেনি। আমার জামাই সন্ধ্যেবেলা এসে কিছু দিয়ে গেছে।’ টুকটাক উপহার আর কি। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মাসি, সৎ মেয়ের জন্মদিনে কে আর অমন আপিস ফেরৎ উপহার নিয়ে আসে?সত্যি হয়তো, তবুও সদ্য পরিচিত এক শিশুকন্যার জন্য, কে জানে না, কোন অব্যক্ত বেদনায় বিধুর হয়ে উঠল এক মায়ের হৃদয়।
তারপর তো লকডাউন। বন্ধ হয়ে গেল মাসির আসাযাওয়া। মাসে একবার লুকিয়ে এসে বেতন নিয়ে যেত মাসি, প্রতিবারই মুণ্ডপাত করে যেত লকডাউন নামক বস্তুটির। “আর কদ্দিন এমন চলবে বল দিকি বউদি। আমার নেহাৎ উপায় নেই, তাই আসি মাইনা নিতে, বিশ্বাস করো বউদি। নইলে গতরে না খেটে পয়সা নিতে আমার ঘেন্না করে-”। প্রতিবারই ফুল্কির খবর নিতাম আমরা। শুনতাম ফুল্কি ভালো আছে। শুধু বাড়িতে থেকে একটু বদমেজাজী হয়ে গেছে। মাঝেমাঝেই দিদার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে- বুঝতাম ওগুলো দিদার সোহাগী ব্যাজস্তুতি মাত্র।
তারপর এল আনলক ডাউন। আবার কাজে আসতে শুরু করল মাসি। তবে ফুল্কি আর আসে না। বাচ্ছা মানুষ, যদি ইনফেকশন ধরে যায়, তাই আনত না মাসি। তারওপর ফুল্কির লেখাপড়াও তো আছে। পাড়াতেই এক দিদিমণির কাছে ভর্তি করিয়েছে মাসি, নিজের বলত, ‘আমি মুক্কু মেয়েমানুষ, ওর মা তো বারো কেলাশের পরীক্ষাই দিল না। পালিয়ে গিয়ে বে করল- ও যদি তোমাদের মত পাশটাস দিয়ে কিছু করে’। ইতিমধ্যে ফুল্কির মা সরে গিয়েছে আরো দূরে, তার বর কর্মসূত্রে বদলী হয়ে গেছে সুদূর দক্ষিণ শহরতলীতে। কর্মস্থলের কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেছে কপোতকপোতী। এসেছে সুখের খবর, পুনরায় সন্তানসম্ভবা ফুল্কির মা। এর আগে একবার মিসক্যারেজ হয়েছিল, তাই এবার ওরা ভীষণ সতর্ক এবং সাবধানী। সীমিত আয়ে বড় ডাক্তার দেখায় জামাই। ফুল্কির মাকে কায়িক পরিশ্রম যাতে না করতে হয়, বাসনমাজা-ঘরপোঁছার মাসি রেখেছে জামাই বলতে বলতে চিকচিক করে ওঠে মাসির চোখ। ‘এমনকি রান্নাটুকুও করতে দেয় না সবসময় বুঝলে বউদি’ প্রগলভ হয়ে বলে মাসি।
এই তো গত সপ্তাহের কথা, সেদিন বোধহয় শনিবার। দুপুরবেলা, অন্য কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে, যেকটা বাসন পড়েছে মাজতে এসেছে মাসি, বাসনের ঠুকঠাকের মাঝেই ফোন। ঘাড়ে ফোনটা রেখে মাথা হেলিয়ে কথা বলে চলে মাসি। একই সাথে চলে হাত আর মুখ, এটা বেশ পরিচিত দৃশ্য। অন্য বাড়ি থেকে ফোন করে, ছেলেমেয়েরাও করে, ফুল্কি ফোন করে টুকটাক বায়না করে- সেদিন মাসির গলা দেখি ক্রমেই চড়ছে, তর্ক বা বাদানুবাদ চলল, বেশ খানিকক্ষণ। তারপর মাসি কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে উগরে দিল একরাশ নালিশ। ‘মেয়েটা ফোন করে ট্যাকা চাইছে বউদি। ওর ওষুধপত্তরের অনেক দাম। জামাইটা একা একা আর কত টানিবে? সবই বুঝি বউদি। কিন্তু আমিই বা কোথা পাই বলোতো-’। আষাঢ় শ্রাবণের ঘন বাদল মুখে ফিরে গেল মাসি, পরদিন আবার দেখি মেঘ কেটে গেছে। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মাসি, ‘জামাই আমার বড় ভালো গো বউদি। কাল রাতে বাড়ি ফিরে সবশুনেই আমায় ফোন করেছিল, জানাল ট্যাকাপয়সা কিছু চায় না। ওর যা আছে তাতেই ওর ছেলে ভালো করে হয়ে যাবে। চিন্তা করতে নিষেধ করিছে। শুধু বলছে, কটা দিন যদি গিয়ে থেকে আসি, এই সময় মেয়েটাকে একটু যত্নআত্তি-’ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাসি, ‘করতে পারলে তো ভালোই, বলো বউদি? তবে আমি চলে গেলে, ফুল্কিটার যে কি হবে? ওকে কে দেখবে?’ বলতে বলতে আঁচলের খুঁটে চোখ মোছে মাসি।
কাজটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিল মাসি, মেয়ে বড় অশান্তি করছে, একবার দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, আবার যদি কিছু হয়? বাড়িতে একজন গিন্নিবান্নি কেউ না থাকলে হয়? মাসির ছেলেবউদেরও তাই মত, বুড়ি কটা মাস মেয়ের কাছে থেকে আসুক- আর ফুল্কি? শেষ মাইনেটা হাত পেতে নিয়ে টকটকে লাল জবা ফুলের মত চোখদুটোর ওপর নোংরা আঁচল চেপে ধরা গলায় মাসি বলল, “ওর বাপের বাড়ির লোকজন তো পাশেই থাকে-।ওরা রাখবে। ফেলে তো আর দেবে না। আর দিলে দেবে, আমি আর কি করব বউদি?রোজের এই অশান্তি আর ভালোলাগে না। কেন যে এত মায়া পড়ে যায় এদের ওপর, সেই তো গতর খাটাব, তবে দুটো খেতে পাব-”।
No comments:
Post a Comment