Saturday 19 August 2023

অনির ডাইরি ১৮ই জুলাই, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


জানলার বাইরে ঘনাচ্ছে সন্ধ্যা। একে একে জ্বলে উঠছে রাজ সড়কের সোনালী নিয়ন আলো গুলো।পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্ব মিটিয়ে সপ্তাহান্তে সপরিবারে মহানগর ফিরছি আমরা। বাপ মেয়ের খুশির সীমা নেই। এক আমারই হৃদয় ভারাক্রান্ত। খুব রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। তার থেকেও বেশি হচ্ছে লজ্জা আর অপরাধ বোধ। এখুনি ফোন করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, আমি আসছি কি না জানতে। জয়ন্ত বাবু পেশায় আমাদের SLO। আজ ওনার মেয়ের বিয়ে, এটি দ্বিতীয়া।


 প্রথমার শুভ বিবাহেও সপরিবারে নিমন্ত্রণ ছিল আমার। তখন সদ্য বদলি হয়ে এসেছি তাম্রলিপ্ত নগরী। কিছুই চিনি না।কাউকেই চিনি না। সংশ্লিষ্ট ব্লকের ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করলাম, CKCO কে জিজ্ঞাসা করলাম সঙ্গী হবে কি না। কেউই রাজি হল না। দুজনেরই অন্য কোথাও নিমন্ত্রণ ছিল। একা যাবার সাহস জোটাতে পারিনি। সেবারও বিয়ের দিন সন্ধ্যা বেলায় জয়ন্ত বাবু ফোন করেছিলেন। জানতে চাইছিলেন, "ম্যাডাম কখন আসছেন, কচি ( তুত্তুরী) কে নিয়ে আসবেন কিন্তু -"। যেতে পারছি না বলার সময়, আক্ষরিক অর্থেই মনে হচ্ছিল ধরণী দ্বিধা হলে মন্দ হত না। 


দ্বিতীয়ার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে যখন এলেন, লাফিয়ে পড়ে বললাম, "এবার আমি যাবোই। কেউ যাক আর নাই যাক, আমি যাব।"অথচ এবারেও কথা রাখতে পারলাম না। প্রায় দেড় মাস পর বাড়ি ফিরছে আমার বর। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তাকে তো সঙ্গ দিতেই হয়।  


বাড়িরও অভিমান থাকে, ফাঁকা ঘর গুলোও ভোগে নিঃসঙ্গতায়। প্রতি বার মহানগরে প্রত্যাবর্তন পূর্বক ফ্ল্যাটের দরজাটা খুললেই টের পাই, অভিমানে ভারী বাতাস। এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। বড় সাধ করে ফ্ল্যাটটা কিনেছিল আমার বর। তাও বিয়ের ছ মাসের মাথায়। বিয়ের আগে থেকেই বলতো, "নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট চাই। আমাদের নিজস্ব বাড়ি"। অঞ্জন দত্তের সেই অমর লাইন," সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে তোমার আমার লাল নীল সংসার।"


 যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা আমার রক্ষণশীল মন, ছিছি করে উঠেছিল। হায় হায়, বিয়ে হতে না হতেই শাশুড়ি মায়ের সোনার সংসারে ভাঙ্গন ধরাব কিনা আমি। ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে আমার থেকেও বেশি আপত্তি ছিল আমার বাবার। শ্বশুরমশাই কে সেটা জানতেও দ্বিধা বোধ করেনি বাবা। এত বড় পরিবার আমাদের আর ওদের, বিয়ে হতে না হতেই আলাদা হয়ে গেলে লোকে কি বলবে।


হবু শ্বশুর বাড়ির বাইরের ঘরে বসে আড্ডা হচ্ছিল, শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, " আজ নয় টুকলু ( আমার দেওর) খুব ছোট, ওর বিয়ের কথা ভাবা যায় না। কাল তো যাবে। এই তিন কামরার ফ্লাটে দুই ছেলে দুই পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি নিয়ে থাকা যায় না।" আর শাশুড়ি মা বলেছিলেন," এই ফ্লাট আমার জিনিসপত্রেই ভর্তি, ও বিয়ে হয়ে এলে ওরও তো কিছুটা নিজস্ব জায়গা আর প্রাইভেসি দরকার।"


শর্ত একটাই ছিল,ফ্ল্যাটটা হতে হবে আমার শ্বশুর বাড়ির ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। যাতে সকাল বিকাল বৃদ্ধবৃদ্ধাকে দেখে আসতে পারি আমরা। কার্য ক্ষেত্রে দেখা গেল, মহানগরের এই "nouveau riche" এলাকায় এমন ফ্ল্যাট কিনতে চাওয়া আর ফ্ল্যাট কেনার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। 


নেহাৎ কপাল জোরেই ফ্ল্যাটটার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল বলতে পারেন। শৌভিক তখন প্রবেশনার, আলিপুরের কোন এক সিনিয়র অফিসারের ঘরে কি যেন কাজে গিয়ে এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ। অমায়িক পরোপকারী বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত আমলা। অবসর গ্রহণের পর ইউনেস্কোর কি যেন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই কাজের সূত্রে আলিপুরের জেলা শাসকের কারণে পদার্পণ। ভয়ানক আড্ডাবাজ বৃদ্ধ প্রথম দর্শনে শৌভিকের সুহৃদ এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েন। তারপর যখন জানা যায় যে উভয়ে একই আবাসনের বাসিন্দা আরো দৃঢ় হয় বন্ধন। সদ্য বিবাহিত শৌভিককে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই প্রস্তাব দেন," আমার পাশের ফ্ল্যাটটা ফাঁকা পড়ে আছে, মালিক কোনদিন থাকেনি। আর এখন তো ওরা সল্টলেকে একটা বাড়ি না ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছে। এটা বেচতে চায়,আমাকেই খরিদ্দার খুঁজে দিতে বলেছে, দেখো যদি তোমার পছন্দ হয়।"


ফ্ল্যাট দেখতে শৌভিকের সঙ্গে গিয়েছিলেন শাশুড়ি মাতা। তখন লিফট ছিল না, হাঁটুর ব্যথা তুচ্ছ করে, জ্যেষ্ঠ পুত্রের হাত ধরে সিঁড়ি ভেঙে ওঠেন চার তলায়। পরোপকারী বৃদ্ধ নিজেই চাবি খুলে ঘুরিয়ে দেখান ফ্ল্যাটটা। অতঃপর জোর করে ওনার ফ্ল্যাটে, ধরে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ান। ফ্ল্যাট এবং প্রতিবেশী উভয়ই ভয়ানক পছন্দ হয়ে যায় শাশুড়ি মাতার। তৎকালীন মালিকের সাথে বাকি কথা বলে নেন প্রতিবেশী বৃদ্ধ আর শ্বশুরমশাই। ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত ডাক বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। যে দামে ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন তার ওপর তৎকালীন ফিক্সড ডিপোজিট এর সুদ ধরে অংক কষে মূল্য নির্ধারণ করেন। আজকের বাজারদরে শুনলেও হাসি পাবে হয়ত, কিন্তু সদ্য চাকরিতে ঢোকা এক সরকারি কর্মচারীর পক্ষে তা তখন বেশ অনেকটাই বেশি ছিল।


লোন তো নিতেই হত, কুড়ি বছরের লোনের প্রথম মাসিক কিস্তি দেবার পরই আমরা অনুভব করলাম," পাগলা খাবি কি?"ফ্ল্যাট তো কেনা হল, বসবাস আর করা হল কই। ততদিনে পশ্চিম মেদিনীপুরে বদলি হয়ে গেল শৌভিক। আমাদের "লালনীল" সংসার হল বটে, তবে মহানগরের অঞ্চল ছায়ায় নয়, মাদপুর নামের গাঁয়ে, ধান ক্ষেত আর পুকুরে মোড়া বিডিও কোয়ার্টারে।


ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু হতে লাগল আরও বছর পাঁচেক। ততদিনে বদলে গেছে প্রতিবেশী। সহৃদয় বৃদ্ধ সপরিবারে সরে গেছেন অন্য কোথাও। তাও গৃহ প্রবেশের দিন তাকে ফোন করেছিল শৌভিক। গৃহপ্রবেশই বা সেই ভাবে হয়েছিল কোথায়, আমি লতা দি আর তুত্তুরী হাওড়া থেকে মালপত্র নিয়ে পৌঁছিয়ে ছিলাম। শৌভিক তখন মগরাহাটের বিডিও। ব্লক সামলে বেশ অনেক রাতে ফিরেছিল সেদিন বউ বাচ্ছার কাছে, নিজের ফ্ল্যাটে। 


 পুজো আচ্ছা সেভাবে কিছুই হয়নি, শৌভিক একে তো নাস্তিক তায় পেশাদারী ব্যস্ততা আর শ্বশুরমশাইয়ের অসুস্থতা মিলিয়ে কিছুই আর করা হয়নি। হাওড়া ছেড়ে আসার সময় দুটি ঠাকুর মূর্তি উপহার দিয়েছিল আমার পিসি, সাথে ধূপ, মোমবাতি, সিঁদুর আর মিছরি ইত্যাদি। বিয়ের দানের চৌকিতে তেনাদের বসিয়ে ধূপ, দীপ, সিঁদুর দিয়ে ওই তেল সিঁদুরই ঈশ্বরের নামে সব দরজায় ফোঁটা দিয়েছিলাম। ন বছর আগের সেই তেল সিঁদুরের ফোঁটা গুলো ধুলিমলিন হয়েছে বটে, টিকে আছে আজও। 


ইন্টিরিয়র ডিজাইনার দিয়ে সাজানো ছিল সাধ্য এবং কল্পনাতীত। নিজেদের মত করেই তাই সাজিয়েছিলাম ফ্ল্যাটটাকে। বারান্দা থেকে শোবার ঘর সর্বত্র সবুজ আর সবুজ। বাদ যায়নি শৌচাগার দুটিও। ফেলে দেওয়া কাঁচের বোতলে সাঁতার কাটা মানি প্লান্ট বসানো ছিল সিস্টার্নের ওপর।শৌভিক মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে বলত, "মনে হচ্ছে, জঙ্গলে বাস করছি।"


 বসার ঘরের এক দিকের দেওয়াল জুড়ে টাঙিয়ে ছিলাম শুধুই তুত্তুরীর বেড়ে ওঠার ছবি। বাবার কাঁধে মাথা রাখা ঘাড় না শক্ত হওয়া পুঁচকে তুত্তুরী, মুখে ভাতের দিন সকালে দিদার কোলে লাল চেলি, চন্দন, ফুলের মুকুট পরা তুত্তুরী, বুল্লু দাদার সাথে দোল খেলতে ব্যস্ত নেড়িমুন্ডি তুত্তুরী, প্রথম বার সরস্বতী পুজোয় শাড়ি পরে ঠাম্মার কাঁধে হাত দিয়ে কেত মেরে দাঁড়ানো তুত্তুরী ইত্যাদি প্রভৃতি। ছবির তুত্তুরীদের বয়স থমকে গেছে বছর এগারোয় এসে। তারপরই তো ফ্ল্যাটটা ফেলে চলে আসি আমরা।


বদলির চাকরি,এই নিয়ে আর অনুযোগ কি। তমলুক থাকতে তাও হয়তো কিছুটা ঘনঘন যাওয়া হত, কাঁথি আসার পর চুকেছে সে পাট। যত দূরত্ব বাড়ছে, ততোই বাড়ছে বাড়ির অভিমান। প্রতিবারই নতুন নতুন উপদ্রব করছেন তিনি। কখনও খারাপ হয়ে বসে থাকছে কলিং বেল, তো কখনও পুটটি খসিয়ে উলঙ্গ হয়ে পড়ছে জানলার কাঁচ। কখনও জল আসছে না বাথরুমের কলে, তো কখনও ফুটো হয়ে যাচ্ছে রান্না ঘরের পাথরের সিঙ্ক। এমতবস্থায় ফুরিয়ে যাওয়া গ্যাস সিলিন্ডার বা AMC পুনর্নবীকরণ না করানো ওয়াটার পিউরিফায়ার যে কি বিভীষিকা তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। 


প্রতিবার ফ্ল্যাটের তালা খুলেই বাজারে ছোটে শৌভিক, কফি আর বিস্কুট আনতে। এক কেজি চাল আর খানিক ডাল ছাড়া মুদি খানার কোন জিনিসই আমরা রেখে যাই না। নষ্ট হয়ে যায়। প্লাস্টিকের কৌটোর গন্ধ ছেড়ে যায়। এমনকি খারাপ হয়ে যায় সর্ষের তেল ও। কেমন যেন বোঁটকা তেলচিটে গন্ধ হয়ে যায়। গরম করলেও যায় না সেই গন্ধ। এবারে তাই কফি আর বিস্কুট নিয়েই এসেছি কাঁথি থেকে। খালি পায়ে গোটা ফ্ল্যাটে তুরতুর করে ঘোরে তুত্তুরী, পোশাক বদলে গেরস্থালির কাজে লেগে পড়ি দোঁহে। জানলা দরজা খুলি, পর্দা সরাই, এসি টাকে চালিয়ে রাখি যাতে  দূষিত হাওয়া বেরিয়ে যেতে পারে। গত বারের ঘরে পরা জামাকাপড় গুলো মেশিনে কাচতে দেয় শৌভিক। আমি ঢুকি রান্না ঘরে। আগে জল ভরবো। তারপর সসপ্যান,কাপ, চামচ ইত্যাদি মেজে কফির জল চড়াব। তারপর রাতের খাবার বাসন মাজব। প্রতিবার মেজে রেখে যাওয়া হয় সবকিছু, তাও - 


রান্না ঘরে পা দিতেই ছপাস করে উঠল জল। কি সর্বনাশ মাটিতে এত জল এল কোথা থেকে। জানলা খুলে গিয়েছিল নাকি? আমার হাউমাউ শুনে দৌড়ে এসেছিল শৌভিক, ওই আবিষ্কার করল ব্যাপারটা। কল থেকে আকোয়া গার্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল যে পাইপটা, সেটি খুলে পড়ে গেছেন। ফলে না জানি কবে থেকে জল থৈথৈ সর্বত্র। 

দেখা গেল পাইপের মুখটা ফাটা। আগের বার সার্ভিস করতে আসা ছেলেটি বলেছিল বটে, তালা বন্ধ ফ্ল্যাট, আলো হাওয়া খেলে না, পাইপটা ঘনঘন পাল্টানো উচিৎ। তাই বলে এমন হবে তা কে জানত। অনলাইন কল বুক করে শৌভিক, আর আমি কোমর বাঁধি সাফাই কার্যে। এই তো জীবন কালি দা। মনের মধ্যে কেবল খচখচ করতে থাকে একটাই কাঁটা, জয়ন্ত বাবুকে দেওয়া কথার খেলাপ না করলে হয়তো এমন টা হত না। অথবা হত। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন বড্ড জটিল। পেশাদার আর সাংসারিক জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা বেশ চাপের। যারা পারেন তাঁদের কুর্নিশ। কেন যে আমি কোনটাই ভালো পারি না -

No comments:

Post a Comment