#অনিরডাইরি
ATM ব্যাপারটা মন্দ না হলেও, PTM শুনলেই আমার পিলে চমকায়। আমি সেই সব সংখ্যালঘু অপদার্থ মায়েদের মধ্যে পড়ি, যাদের সাধারণত স্কুল বা শিক্ষক(ইকা)দের বিরুদ্ধে কোন অনুযোগ/অভিযোগই থাকে না। নাই থাকে স্কুলকে সুপরামর্শ দেবার মত জ্ঞান। মহানগর থেকে কাঁথি পর্যায়ক্রমে তিনটে স্কুল পাল্টেছে তুত্তুরী, প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে এই স্কুলটা তো বেশ ভালো। প্রতিবার,প্রতিটি ক্লাস টিচারকে দেখেই আক্ষরিক অর্থে গলে গেছি আমি। মনে হয়েছে আমি "একটি নিয়েই গলদঘর্ম" আর এই মহাপুরুষ/মহীয়সী নারী একসাথে এতগুলি মনুষ্য শাবকরূপী জন্তুকে সামলান, তাও নামমাত্র ঠেঙিয়ে অথবা বিন্দুমাত্র না ঠেঙিয়ে , কি করে পারেন? এনাকে তো টুপি খুলে কুর্নিশ জানানো উচিৎ রে বাবা। তাই লিখে এসেছি প্রতিবার কমেন্ট বক্সে। শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছি আগামী দিনগুলির জন্য।
তাই পেরেন্টস টিচার মিটিং এ টিচারের সাথে বাক্যালাপ করতে আমার কোন সমস্যা হয় না। ভয় লাগে অন্য পেরেন্টসদের দেখে। আসলে ভয় নয় বলতে পারেন লজ্জা। রীতিমত হীনমন্যতায় ভুগি অন্যান্য অভিভাবকদের সিরিয়াসনেস দেখে। তাই শনিবার যখন PTM এর নোটিফিকেশন এল, সোজা তা পাঠিয়ে দিলাম শৌভিকের মুঠোফোনে। তুই যা ভাই, আমায় এবারের মত খ্যামা দে। বহুৎ নির্যাতন সয়েছি বিগত কয়েক বছরে, আর নয়।
ও বাবা, তিনি নির্বাচনের কাজে নাকি এমনি ব্যস্ত যে ঘন্টা দুয়েকের জন্য মেয়ের ইস্কুলে যেতে পারবেন না। বাড়ি ফিরে আমায় বললেন, " ছেড়ে দে। কাউকেই যেতে হবে না। ও সোমবার গিয়ে রেজাল্ট নিয়ে নেবে।" প্রস্তাবটা অপছন্দ হল না। রেজাল্ট অর্থাৎ ইউনিট টেস্টের রেজাল্ট, তাতে যে তিনি বেশ কয়েক বস্তা নম্বর পাবেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিৎ। যা সিরিয়াস পূব মেদিনীপুরের ছেলেমেয়েরা, তাদের বাবামায়েদের সামনে ওই রেজাল্ট আনতে না যাওয়াই ভালো, ভেবে ঠিক করলাম আর যাবোই না।কিন্তু এমন ইমোশনাল অত্যাচার করতে শুরু করলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, যে যেতেই হল।
আটটা থেকে দশটা দুঘন্টার PTM, এতক্ষণ বাঁচলে হয়। স্কুলের মস্ত গেটটা দিয়ে যখন ঢুকলাম, জনৈক স্টাফ এগিয়ে এসে কোন ক্লাস, সেকশন জেনে, জানাল তুত্তুরীর ক্লাস তিনতলায় হচ্ছে। অতঃপর চেহারা দেখে করুণা হল বোধহয় বলল, "এদিক দিয়ে যান, লিফট আছে।" প্যাঁচার মত বেশ খানিক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর ভাবে বললাম, আমি সিঁড়ি ভাঙতে পারি। ছেলেটি এক গাল হেসে বলল, "ও পারেন-"। আর কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে সিঁড়ি ধরলাম। শুরুটাই যদি এমন হয়-
উঠতে গিয়ে বুঝলাম,ছেলেটা আমার মতই তলা আর ফ্লোরে গুলিয়েছে। থার্ড ফ্লোর অর্থাৎ চার তলায় বসেছে মিটিং। বাতানুকুল ঘর, সৌম্য দর্শন স্যার খোশ মেজাজে কি যেন বলতে শুরু করেছেন। অনুমতি নিয়ে বলির পাঁঠার মত ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম। ঘর ভর্তি নারী-পুরুষ। এক নজর দেখলেই বোঝা যায় যদিও একজন অভিভাবককে আসতে বলা হয়েছে, অনেকেই যুগলে এসেছেন। জীবনেও একটা PTM অ্যাটেন্ড করেনি আমার বর। পাক্কা ইয়ে একটা, মনে মনে টিপিক্যাল হাওড়ার গালাগাল দিয়ে, একদম প্রথম বেঞ্চের এক কোণায় বসলাম।
বসার সাথেসাথেই পাশে বসা বোরখাওয়ালি, মুখমণ্ডল অনাবৃত করে শুধাল, " এই, কম্পিউটারে কোন কোয়েশ্চন আনসার করিয়েছে গো?" প্রমাদ গুনলাম। রোজই অফিস থেকে ফিরে তুত্তুরীর স্কুলের গপ্প শুনি, তার বেশির ভাগ জুড়েই থাকে বন্ধুদের সাথে কথোপকথন। ক্লাসে কি পড়াল, সাধারণত সে প্রসঙ্গ তোলেই না তুত্তুরী। আমিও খোঁচাই না। যেহেতু তুত্তুরীর পড়াশোনার দায়িত্ব টা আমরা দুজনে ভাগাভাগি করে বহন করি, তাই প্রতিনিয়ত বুঝতে পারি যে ও শিখছে। আবার কি চাই। কাজেই এই প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা।
বেশ কয়েকবার ঢোঁক গিলে মাথা এমন ভাবে নাড়লাম, যার অর্থ হ্যাঁ বা না দুই হতে পারে। উনি নাই ধরলেন, এবং সোচ্চারে ক্লাস টিচারের কাছে অনুযোগ করলেন, কেন করানো হয়নি। কম্পিউটার স্যারকে তলব করা হল। দেখা গেল তিনি অনুপস্থিত। অন্য ক্লাসের কম্পিউটার স্যার ছুটে এসে আশ্বাস দিলেন, তিনি নিজে ব্যাপারটা দেখবেন। অবশ্যই দেখবেন যাতে প্রশ্নোত্তর করানো হয়। তিনি বিদায় নেবার সাথে সাথেই তিনজন অভিভাবক নালিশ করলেন, ক্লাশে অত্যাধিক ভায়োলেন্স এবং গালিগালাজ চলে। এটা অবশ্য সত্যি, রোজই তুত্তুরী অভিযোগ করে, ছেলেগুলো নাকি খুব মারপিট করে, তাও মেয়েদের দেখিয়ে দেখিয়ে। একে অপরের অস্থানে কুস্থানে লাথি ঘুঁষি মারে আর "স্কুইশু" বলে চিৎকার করে। গালিও দেয়। কয়েকটা গালি শিখে এসে আমাদেরকেও শুনিয়েছে তুত্তুরী। শুনে বেশ আশাহত হয়েছি,আমাদের সমসাময়িক আমাদের জেলার ছেলেরা ছাড়ুন, মেয়েরাও এদের থেকে ভালো খিস্তিখেউর করত।
বেচারী স্যার দেখলাম খুব দুঃখিত ভাবে মাথা নাড়লেন, আশ্বস্ত করলেন ভবিষ্যতে খিস্তি করা ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেন রে বাপু, এই বয়সের ছেলেপুলে দুটো গালমন্দ, একটু আধটু ঝাড়পিঠও করতে পারবে না? তাহলে বয়ঃসন্ধি কালের হর্মন গুলো ক্ষরিত হবে কিভাবে, বলতে গিয়েও বললাম না। কয়েকজন মা সোচ্চারে ফিসফিসিয়ে বললেন, " আর ওইটা স্যার। ওইটা একটু দেখবেন, আমরা খুব ভয়ে আছি।" ব্যাপারটা কি জানতে উৎসুক হলাম, কিন্তু স্যার দেখলাম সুকৌশলে ধামাচাপা দিয়ে দিলেন।
মিটিং গড়ালো,তলব করা হতে লাগল একের পর এক বিষয়ের স্যার/ম্যামকে।যত চুলচেরা চর্চা হতে লাগল প্রতিটা বিষয়, প্রতিটা চ্যাপ্টার নিয়ে, ততো লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলাম আমি। কি খারাপ মা আমি, কি অপদার্থ মা যে কোন খবরই রাখি না। এমনকি মেয়ের রোল নম্বরটাও জানি না। ঘন্টা দুয়েক পরেও মিটিং শেষ হবার কোন লক্ষণ দেখতে পেলাম না। ততক্ষণে রীতিমত মাথা ঘুরছে আমার। পাশের বোরখাওয়ালি দেখলাম উঠে পড়লেন, ওনার আরেকটা বাচ্ছা ক্লাস থ্রি তে পড়ে, ওই ক্লাসের PTM এও খানিকটা সময় দেবেন বলে। পিছন পিছন লাইন দিলাম আমিও।
রিপোর্ট কার্ড নেবার কাগজে সই করছি যখন, তখনও চলছে বিশ্লেষণ। অন্যদের কথা শুনতে শুনতে স্যার শুধালেন, " আপনার কোন বক্তব্য নেই?" অসহায় ভাবে ঘাড় নেড়ে মনে পড়ল, ওনার হয়তো আছে, মানে যদি কিছু থাকে যেমন ধরুন - তুত্তুরী থুড়ি পুরোযা টাইমে প্রজেক্ট কমপ্লিট করে না, সর্বক্ষণ কথা বলে, পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা,খাতা বই ঠিকঠাক নিয়ে আসে না,অঙ্ক খাতায় ভূগোলের হোমওয়ার্ক করে, বন্ধুদের ভেংচি কাটে ইত্যাদি প্রভৃতি। থাকতেই পারে কারণ তুত্তুরী এই সবগুলোই করে।
উনি কিছু বললেন না যদিও, খোদা হাফিজ জানিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চেপে প্রথমেই মেসেজ করলাম প্রিয় বন্ধুদের গ্রুপে, "PTM থেকে ফিরলাম। রীতিমত অসুস্থ বোধ করছি। মানুষ এত প্রশ্ন করতে পারে 😔। বাপরে বাপরে বাপ।" চার মিনিটের মাথায় মেসেজ করল এক বন্ধু, "ফেরাটা একটা achievement বটে। গত ১৭ তারিখে আমাদের PTM ছিল, গিয়ে বুঝতে পারলাম,ভগবান কিছু অদ্ভুত জীব তৈরি করেছে মাইরি। একদল বলে মাঠে খেলায় না তাহলে গেমস এর টাকা নেয় কেন? আর একদল বলে আমার ছেলেকে রোদ্দুরে দাঁড় করিয়ে রাখা চলবে না। একজন পেরেন্ট তো বাথরুম ইন্সপেকশন করতে যেতে চাইছিল জানো।"
হ্যা হ্যা করে এমন সজোরে হেসে উঠলাম যে নূপুর বাবু গাড়ি চালাতে চালাতে চমকে পিছন ফিরে তাকালেন। হাসি চেপে জানতে চাইলাম, কেন খামোখা বাথরুম ইন্সপেকশন করতে চাইল? জবাব এল, "ওনার সু পূত্তুর বলেছে বাথরুম নোংরা থাকে।" এটা অবশ্য কমন প্রবলেম। আমাদের ইস্কুলের বাথরুমের কথা ভাবলে এখনও বিবমিষা জাগে। তুত্তুরী তো ছোটবেলায় স্কুলের বাথরুমে পা রাখতেও চাইত না। রীতিমত মেরে ধরে বোঝাতে হয়েছে স্কুল বা গণ শৌচালয় কখনই বাড়ির মত সাফ থাকে না। এই ভীতি একবার জন্মে গেলে আর জীবনেও কাটে না। খেটে খাওয়া মানুষদের অত নেকুপুসু হলে চলে না। বন্ধুটিও সহমত জানালো দেখলাম। বলল," আমি বসে বসে কোল্ড ড্রিংক খেয়ে আর জ্ঞান শুনে চলে এলাম। ভাবছিলাম বলবে আপনার বাচ্ছা টাইমে টাইমে প্রজেক্ট কমপ্লিট করে না, সর্বক্ষণ কথা বলে, পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা,খাতা বই ঠিকঠাক নিয়ে আসে না-।" আরেক বন্ধু বলল, " ওরে আমিও আছি তোমাদের দলে -"।
শুনতে শুনতে মনে হল এতো পুরো আমার আর তুত্তুরী গল্প। বললাম, আয় ভাই বুকে আয়, রতনে যথার্থই রতন চেনে মাইরি। নাহলে আমাদের এত ভাব হয় কি করে। যাদের মা গুলোই এমন গুণধরী, তাদের বাচ্ছা গুলো আর মানুষ হয় কি করে। নাই বা হল মানুষ, সবাই যদি মানুষ হবে তাহলে দুনিয়াটা চলবে কি করে। হোক না দুচারটে আমাদের মত সংখ্যালঘু, অপগণ্ড, অপদার্থ। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঁদুর দৌড়ে অংশ না নিয়ে, প্রাণ ভরে বাঁচুক না আমাদের ছানাগুলো। জীবন এটাই তো শিখিয়েছে, এই পৃথিবীর রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ উপভোগ করে প্রতিটা মুহূর্ত আশ মিটিয়ে বাঁচাটাই আসল, বাকি হিসেব ঠিক মিলেই যায় সময়ের সাথে সাথে।
No comments:
Post a Comment