#অনিরডাইরি #হাওড়ারগপ্প
আমার জন্ম সুদূর মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে হলেও, বেড়ে ওঠা পুরোপুরিই হাওড়া শহরে। ৫০০ বছরের বুড়ি, 'কুলিকামিন'দের শহর। ধনী দক্ষিণ ছাড়ুন, বনেদি উত্তর কলকাতা, মায় সিঁথি-বরানগর অধিবাসী জনগণও,"মফঃ" বলে আওয়াজ দিত। মফঃ অর্থাৎ মফস্বলী। PIN লিখতে গিয়ে ওরা কলকাতা লিখত যে, আর আমরা লিখতাম হাওড়া ৭১১১০১।
মহানগরের ঘনিষ্টতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও, স্বকীয়তা বজায় রেখেছিল আমার শহর। ,"মফঃ" বলে তাচ্ছিল্য করা জনগণের থেকে বেশ অনেকটাই আলাদা, স্বতন্ত্র ছিল আমাদের মেয়েবেলা। যেখানে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সমানে সমানে টক্কর দিত বাংলা ক্যালেন্ডার আর পাঁজি। পাঁজি বস্তুটার মাথামুণ্ডু ঐ বয়সে না বুঝলেও এক দুর্বোধ্য আকর্ষণ ছিল পাঁজির বিজ্ঞাপনগুলির প্রতি। কৈশোরের অলস দুপুরে লুকিয়ে পাঁজির বাংলা বিজ্ঞাপন পড়ার যে কি সাংঘাতিক রোমাঞ্চ।
বাংলা ক্যালেন্ডার এবং পাঁজির সৌজন্যে রইরই করে টিকে ছিল বাঙালির বারো মাসের ১৩ পার্বণ। মিহিদানা আর গজায় মাখামাখি হয়ে আসত নববর্ষ আর অক্ষয়তৃতীয়ার হালখাতা। আমাদের ক্ষীরেরতলা গলির কালিবাড়িতে অক্ষয়তৃতীয়ার দিন আবার পাঁঠা বলি হত। জ্যাঠাইমার পিত্রালয় হবার সৌজন্যে ফি বছর নিমন্ত্রণ থাকলেও, সজ্ঞানে বলি হতে কেবল একবারই দেখেছি। ছাগ বলির নিয়মকানুন ছিল বেশ কঠোর। ওই সময় ভয় পেলেও চোখ বন্ধ করা যেত না, এমনকি কাউকে জড়িয়ে ধরাও যেত না। অক্ষয়তৃতীয়ায় কতজন যে দণ্ডী খাটত আমাদের পাড়ায়। কে জানে, কি মনস্কামনা পূরণ করতেন দেবী, যে বৈশাখের তীব্র দাবদাহে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে তাঁর পদতলে গিয়ে পড়ত মানুষ। তেমন তেমন মানত পূরণ হলে বুক চিরে রক্তও দিতে দেখেছি।
বৈশাখের শনিবার গুলি দখল করতে আসতেন রক্ষাকালী মাতা। প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়ে পূজিত হতেন খর্বকায়া, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, রক্তচক্ষু, লোলজিহ্বা দেবী। চাঁদা যেমন উঠত, দেবীর উচ্চতাও সমানুপাতিক হারে বাড়ত বা কমত। চাঁদা তোলার ভার থাকত পাড়ার পুঁচকেগুলোর উপর। মাটির সরা হাতে, হাফ প্যান্ট সামলে, কুঁচোকাচারা দৌড়ত পথচারীদের পিছন পিছন, চাঁদা তুলবে বলে। "ও কাকু/ ও জেঠু, একটা টাকা দিয়ে যাও না।" " ও ঠাকমা/পিসিমা/কাকিমা, রক্ষাকালী পুজো হবে দুটো টাকা চাঁদা দিয়ে যাও না গো।" সস্তা গণ্ডার দিনকাল ছিল। এক টাকা চাইলে, চার বা আট আনা দিত লোকজন। পাঁচ- দশ পয়সাও চাঁদা দিতে দেখেছি আমি। অনেকে তো দিতেনই না। কতবার দেবে আর কতজনকেই বা দেবে। প্রত্যেক গলির মুখেই তো ছেঁকে ধরত কচিকাঁচাদের দল।
চাঁদা যা উঠত, তাই দিয়েই ধুমধাম করে মাইক বাজিয়ে "রক্ষাকালী মাঈ কি জয়" হত। সেখান থেকেও পয়সা বাঁচিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক ভক্তবৃন্দের ইয়ে সেবনের ব্যবস্থা হত। তবে সে সবই হত মধ্যরাত্রে। সকালে উঠে দেখতাম শূন্য মণ্ডপ ফেলে বিসর্জন গিয়েছেন মা। নিরুদ্দেশ মায়ের কারণসেবী বাছারা। পাড়ার কুকুরগুলো কেবল সেদিন একটু বেশি ঘুমাত। বাবা বলত,মাত্রাতিরিক্ত মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করে ভক্তবৃন্দ বমি করেছে, আর সেই বমি ভক্ষণ করে মাতাল হয়েছে পাড়ার সারমেয় কুল।
জ্যৈষ্ঠ মাস মানেই জয় মঙ্গলবার আর দুধ- চিড়ে- মুড়কি-আম -কলার ফলার। পরিবার ভেদে তারতম্য ছিল জয় মঙ্গলবারের সংখ্যায়। আমাদের চাটুজ্জে বংশে যেমন ছিল দুটো আর দিদিভাইদের বাঁড়ুজ্জে বংশে চারটে। আষাঢ়ে রথের পাশাপাশি অম্বুবাচী আর দশহরা। অম্বুবাচীতে ঋতুমতী হতেন বসুন্ধরা। তিনি সুস্থ না হয়ে ওঠা অবধি একাহারী থাকতেন পিতমহী। চার দিন অন্ন গ্রহণ করতেন না বলে থরে থরে ফল আর মিষ্টি দিয়ে যেত সবাই। ঠাকুমা স্বয়ং খেতেন না প্রায় কিছুই, ফল কেটে, মিষ্টি সাজিয়ে ছেলেপুলে, নাতিনাতনিদের মুখের সামনে ধরতেন তিন বেলা।
দশহরায় ঘুম ভাঙিয়ে কাঁচা দুধ আর কাঁচা উচ্ছে, চিবাতে বাধ্য করত পিসি। নাহলে নাকি মা মনসা ক্রুদ্ধ হন। দশহরার দিন বৃষ্টি হবার প্রতীক্ষায় বসে থাকতাম আমরা, পিসি বলত দশহরা দিন যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে সাপের বিষ নাকি ১০ গুন চড়ে যায়।
আসত যেত বিপত্তারিণীর পুজো, ঠান্ডা উপোস। ভাদ্র মাসে জন্মাষ্টমী, রান্না পুজো, বিশ্বকর্মা পুজো, চাপড়া ষষ্ঠী। মা ষষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে, বাটনা বাটার শিলের উপাসনা হত সেদিন। চাপড়া ষষ্ঠী থেকে দিন গোনা শুরু করতাম আমরা। ঠিক এক মাস পরের ষষ্ঠীটা যে দুর্গা ষষ্ঠী।
আশ্বিন কার্তিক জুড়ে রাজত্ব করতেন দুই দেবী। লুকিয়ে লুকিয়ে আসতেন কার্তিক চন্দর। বুক কাঁপত নববিবাহিত দম্পতিদের, এই বুঝি বাড়ির সামনে কার্তিক ফেলে গেল কেউ। অগ্রহায়ণ মাসে হত নবান্ন, ইতু পুজো। মাটির সরার উপর কয়েকটি ছোট ছোট ঘট বসিয়ে ইতুর উপাসনা হত। রবিবার -রবিবার শাঁখ ঘন্টা বাজিয়ে পুজো করত জেঠু নিজে। একবার ছোটবেলায় খেলতে খেলতে ঐ ইতু পুজোর ঘট দিয়ে সটান আমার নাকে মেরেছিল এক তুতো ভাই। সে কি রক্তারক্তি কাণ্ড।
পৌষে হত বাউনি, পুলি পিঠে,মাঘে বাগদেবীর আরাধনা,শীতল ষষ্ঠী। ফাল্গুনের দোল, ঘেটু পুজো। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সং সেজে চাল -আলু আর পয়সা যাচ্ঞা করত। চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজো,অন্নপূর্ণা পূজা, অশোক ষষ্ঠী, রামনবমী আর নীল ষষ্ঠী।
চৈত্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন নীল। নীল অর্থাৎ মহাদেব, তাঁর পাশাপাশি ঐ দিন আমাদের মধ্য হাওড়ায় মা ষষ্ঠীরও উপাসনা করা হয়। আমরা ছোট থেকে দিনটাকে নীল ষষ্ঠী বলেই জানি। ঠাকুমা-পিসি-জ্যাঠাইমা-মা-কাকীমাকে দেখতাম নিরম্বু উপবাস করত নীলের দিন। তবে উপবাসের স্থায়িত্ব ছিল মধ্যাহ্ন অবধি। সূর্য মধ্যগগনে পৌঁছালেই শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত।
আমাদের ক্ষীরেরতলা মাঠের বুড়ো শিবের সেদিন যে কি খাতির! আজও নীলের দিন মন্দির উপচে পড়ে বিভিন্ন বয়সের সুন্দরী সুসজ্জিতা রমণীতে। সবার আগে কাঁচা দুধ আর গঙ্গা জলে স্নান করানো হয় বৃদ্ধকে। গলায় পরানো হয় আকন্দ ফুলের মালা। পিনেটের ওপর রাখা হয় বেল সহ পাঁচটা গোটা ফল। কাঁটাওয়ালা ধুঁতরো ফল দেওয়া হয়। ওটা নিয়ে ভোলে বাবা কি করেন উনিই জানেন। এছাড়াও দেওয়া হয় সিদ্ধি পাতা, সন্দেশ, পৈতে ইত্যাদি। ধূপ আর দীপ ও থাকে। যদিও ওগুলো মন্দিরে জ্বালানোর অনুমতি নেই।
ঠাকুমা কোনদিন মন্দিরে যেত না। বাড়ির পঞ্চাননের মাথায় জল ঢেলেই পূজা সমাপন করত। তারপর লাইন দিয়ে বাতি জ্বালাত। সন্তান - সন্ততি, জামাতা, নাতি-নাতনীদের নামে। একতলার ঠাকুর ঘরটা সেদিন আলোয় আলো।
সেই হিসেবে মায়ের শুধু আমার নামে বাতি জ্বালানোর কথা। কিন্তু ছোট থেকে মাকে দেখেছি আমার পাশাপাশি বাবার নামে, দাদাদের নামে, দিদিভাই, জামাইবাবু ইত্যাদি মায়ের যতজন স্নেহভাজন পুত্রকন্যা সমতুল্য লোক আছে মা তাদের সবার নামে বাতি দিত। বাবা মাঝে মাঝে মস্করা করে বলত, "ষষ্ঠীর দিন তুমি খামোখা আমার নামে বাতি জ্বালাও কেন? আমি কি তোমার ষষ্ঠীর বাছা?" বললেই নীল আর ষষ্ঠীর কি একটা জটিল তত্ত্ব শোনাত মা। মোদ্দা কোথায় দেব এবং দেবীর এই বিশেষ দিনে মহাদেবের চরণে সমস্ত প্রিয়জনের নামেই বাতি জ্বালানো যায়।
কত বছর আগে পেরিয়ে এসেছি সেই সব দিন। ভুলে গেছি কত কি। কত দূরে সরে এসেছি নিজের জেলা আর শহর থেকে। আজকাল আর কেউ মফঃ বলে সম্বোধন করার সাহস পায় না। কিন্তু ভিতরে, ভিতরে আজও সেই হাওড়ার মফঃ মেয়েটাই আছি।একদম মায়ের মতই ছটা ষষ্ঠী করি গুনেগুনে। পেশাগত ব্যস্ততার জন্য নীলের দিন মধ্যাহ্ন অবধি নিরম্বু উপবাস করতে পারি না বটে, যত ক্ষণ পারি করি। আর অবশ্যই অবশ্যই বাতি জ্বালাই। প্রচুর বাতি জ্বালাই। সব প্রিয়জনের নামে জ্বালাই। যাদের মধ্যে মা আর পিসিও থাকে। আহাঃ কেউ কোনদিন জ্বালায়নি যে ওদের নামে। প্রতি বছর চিৎকার করে মা আর পিসি, "তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা এই বুড়ি গুলোর নামে আর বাতি জ্বালাস না বাপু। আর বাঁচতে চাই না।" সে ওরা না চাইতেই পারে, আমি তো চাই। আমার মাথার ওপর ছাতা গুলো আরো বহু বহু বছর টিকে থাকুক।
আমার বাতিমালায় এবছর একখান বাতি বেড়েছে। শ্রীমতী ফুলঝুরি ধরা ধামে অবতীর্ণ হয়েছেন কি না। বাকিদের জন্য অনেক কিছু প্রার্থনা করলেও এই গুড়গুড়িটার জন্য কি চাই ঠাকুরের কাছে। বড্ড ছোট যে। ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক এটা তো দৈনন্দিন প্রার্থনা। এছাড়াও কিছু তো স্পেশাল চাইতে হয় আজকের দিনে। তাই ভোলে বাবাকে বললাম, সারা বছর আমাদের ফুলু যেন আশ মিটিয়ে দুষ্টুমি করতে পারে। উত্তরোত্তর ডানপিটে হয়। হনুমান যেমন ন্যাজে আগুন দিয়ে লঙ্কা দহন করেছিলেন, ফুলু যেন তেমনি সবার ইয়েতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।
আজ সকালে, এটা পাঠিয়েছে উমা, "এই যে জেম্মা, দেখো, কি করছে তোমার ফুলঝুরি।সাইকেলের মালকিনকে জোর করে নামিয়ে দিয়ে নিজে কেত দেখাচ্ছে। তোমার বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে, খুশি হও আর কি!" আহা সবই বাবার মহিমা বাবা🙏🏼😝।
No comments:
Post a Comment