Sunday 9 April 2023

অনির ডায়েরি ৮ই এপ্রিল, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #হাওড়ারকথা




মনস্থ করেই বেরিয়েছি, আজ হাওড়া যাবই। পৃথিবী উল্টে গেলেও যাব। আমি না গেলে পেনশনটাও তুলতে পারেনা মা আজকাল। সংসার চলবে কি করে? বয়স বাড়ার সমানুপাতিক হারে কমেছে দৈহিক শক্তি আর গুনোত্তর প্রগতিতে কমেছে মানসিক জোর। সবকিছুতেই আজকাল, "অ্যাই মানা-", বলে বসে থাকে মা। মানা আমার বাবামায়ের দেওয়া সাধের ডাক নাম।

 

গতবার মাকে নিয়ে পেনশন তুলতে গিয়ে যা কাণ্ড হল। আধ বেলা ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম মাকে নিয়ে গিয়ে পেনশন তুলে বেলা বারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতে পারব। সাড়ে বারোটা নাগাদ যদি বেরোই রাস্তাটাও ফাঁকা পাব। দুটোর মধ্যেই পৌঁছে যাব অফিস।


সেই মতো ভোর ভোর উঠে, স্নানাদি সেরে, আমরা তো বেলা সাড়ে দশটার মধ্যে রেডি, বিশ্বাসঘাতকতা করল রিক্সাটা। আমাদের মধ্য হাওড়ায় ইদানিং টোটোর দাক্ষিণ্যে রিক্সা বড় দুর্লভ। দশ টাকা টোটো ভাড়া দিয়ে যেখানে ঘোরা যায়, কেন লোকে ৪০/৫০ টাকা রিক্সা ভাড়া দেবে?


তাও ছিল মায়ের "কাশী"। আমার থেকে একটু বড় একটা লোক, ফোন করলেই চলে আসত, যতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখত বাবা বা মা দাঁড়াতো, একদম ঘরের সামনে থেকে তুলত এবং নামাত। দরকারে বাবার হাত থেকে বাজার ব্যাগটা নিয়ে নিজেই বাড়ি পৌঁছে দিত। জীবনেও মুখ ফুটে ভাড়া চাইত না। যা দিত বাবা বা মা এমনকি আমিও,  কপালে ঠেকিয়ে বলত, " এত দিলে কেন?"


কাশী থাকতে অফিস ফেলে ছুটতে হত না আমায়। মা আর গুটি কয়েক স্কুলের বাচ্ছা ছাড়া ইদানিং তেমন ভাড়া জুটত না বলে, সম্প্রতি রিক্সা চালানো ছেড়ে কারখানায় কাজে লেগেছে কাশী। ফলে মা পড়েছে আতান্তরে। অগত্যা সবেতেই, "অ্যাই মানা-"।


আমার ছোট্টবেলার এক পাড়াতুতো বন্ধুকে, অবশ্য খুঁজে বার করেছে বাবা।সে এখনও রিক্সা টানে। তবে যাত্রী বহন করে না। স্থানীয় কারখানার মালমশলা দেওয়া নেওয়া হয় তার রিক্সায়। আগেভাগে জানিয়ে রাখলে, ফাঁকেফোকরে মায়ের কাজটাও করে দেয় সে। এই আগে জানানোটাই হয়নি সেবার মায়ের। দোষ অবশ্য পুরোপুরি মায়ের নয়। ইদানিং সরকারি দপ্তর গুলির ওপর এমন হঠাৎ হঠাৎ বেমক্কা চাপ চলে আসছে, আমি নিজেই জানতাম না কবে যেতে পারব। হুট করেই গিয়ে পৌঁছেছিলাম আগের দিন সন্ধ্যায়। দীর্ঘদিন বাদে একমাত্র দুহিতাকে কাছে পেয়ে, ফোন করার কথা মনে ছিল না মায়ের। আমারও ছিল কি?


সেদিন সকাল দশটা নাগাদ যখন ফোন করেছে মা,  বন্ধুবর বলল, " ইশ্ জেঠিমা, তুমি আগে বলোনি! আমি তো মাল নিয়ে বালটিকুরি চলে এসেছি গো। কাল নিয়ে যাব পাক্কা। আজকের দিন টা একটু ক্ষমা ঘেন্না করে দাও প্লিজ-"। 


সকাতর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল মা, যদি পিছানো যায় আজকের অ্যাডভেঞ্চার থুড়ি পেনশন তোলা।  আমিও নিরূপায়। জনমানসে সরকারি দপ্তর বা সরকারি কর্মচারীদের যে চিত্রই থাকুক না কেন, বাস্তব বড়ই নিঠুর। বিশেষতঃ ফিল্ডঅফিস গুলোতে, সুস্থ শরীরে পরপর দুইদিন অফিস কামাই করা আপাতত অসম্ভব। বললাম, "চলো না। গলির মুখ থেকে হাজার হাজার টোটো পাব।" সেটা মার্চ মাস। গরমটাও এমন তীব্র নয়, ঠিক পারবে মা।

ভোকাল টনিক খাইয়ে রাস্তায় তো বার করলাম, মা আর নড়তেই পারে না। সদর দরজা থেকে বেরিয়ে গলিপথ ধরে এক মিনিট লাগে চওড়া রাস্তায় পৌঁছতে, শেখান থেকে তিন মিনিট হাঁটলেই রাজপথ। সেখানে বসে টোটোর মেলা। এক মিনিটের পথটাই মা নিলো পাক্কা তিন থেকে চার মিনিট। 


মাঝারি রাস্তায় উঠে লোলুপ দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায় মা, একটাও রিক্সা গোচর হয় না।" উরি, উরি বাবা" করতে করতে আরো খানিক এগোই দোঁহে। ক্ষীরেরতলা মাঠের বুড়ো শিবের মন্দিরের উল্টোদিকে, আচমকা হয়তো দেবাদিদেবের মহিমায় আবির্ভূত হয় একখানি টোটো। ঠেলে দেয় মা। "যা গিয়ে দেখ, কদমতলা পোস্টঅফিস যাবে কিনা!" 


বাধ্য ছাত্রীর মত এগিয়ে যাই আমি। কটকটে লাল পোলো নেক গেঞ্জি পরে, ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ, থলথলে টোটোওয়ালা আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে সোজা হয়ে বসে। পোস্টঅফিস বললে নির্ঘাত যাবে না, তাই বলি, "কদমতলা বাজার যাবে, ভাই?" ছেলেটি মিষ্টি করে হেসে বলে, " ভাড়া আছে গো দিদি। দুটো বাচ্ছাকে নিয়ে যাব।" তারপর খানিক কি ভেবে বলে, " আচ্ছা চলো, একটু ঘুরে যেতে হবে কিন্তু।"


এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে যেতে বললেও নির্ঘাত রাজি হয়ে যাবে মা। ইশারায় ডাকি মাকে। ৩২ টা বাঁধানো দাঁত বার করে (এটা লেখার জন্য, নির্ঘাত এই বুড়ো বয়সে চপেটাঘাত প্রাপ্য আমার) দৌড়ে আসতে চায় মা। বাস্তবে যদিও সামান্য নড়ে মা। হাত ধরে টেনে আনবো বলে এগিয়ে যাচ্ছি, টোটোওয়ালা ছেলেটি জানতে চায়, " মা?"  সম্মতি পেয়ে বলে, " দাঁড়াতে বলো। দাঁড়াতে বলো। আমি আসছি।" টোটো এগিয়ে আসে, উল্টোদিক থেকে ছুটে আসেন দুটি ফুটফুটে বাচ্ছা সমেত দুই মা। আমরা একটু থতমত খাই, আমরা একটু অপ্রস্তুত হই। বোকার মত হাসি। টোটোটা তো ওঁরাই বুক করিয়েছিলেন, আমরাই উটকো আপদ। ভালো চওড়া সিটটা ওদের জন্য ছেড়ে, ড্রাইভারের পিছনের অপেক্ষাকৃত সরু সিটটায় বসতে উদ্যত হয় মা।


হাঁ হাঁ করে ওঠে দুজনে,"জেঠিমা, আপনার এদিকে বসতে কষ্ট হবে। আপনি ওটায় বসুন"।  কৃতজ্ঞ চিত্তে উঠতে চেষ্টা করে মা, অসফল হয়। টোটোগুলো বড় উঁচু। ঠেলি আমি, টোটোওয়ালা নেমে এসে ধমকায়,' তুমি কেন এগিয়ে এলে মাসি! তোমাকে হাত দেখিয়ে বললাম, দাঁড়াও ওই সিঁড়িওলা বাড়িটার সামনে যাচ্ছি। সিঁড়ি থেকে তোমার উঠতে সুবিধা হত গো।" 


টোটোয় উঠে বসি মোরা দুজনে। ছুটে চলে টোটো, পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরের গলি পথ ধরে। আমাদের ক্ষীরেরতলা গলির ও মাথা দিয়ে বেরিয়ে, বেলিলিয়াস রোড ধরে কদমতলা বাজার। বাজারেই নামব বলেছি আমি, দুশ্চিন্তা বাড়ছে এই ভিড়ে ভরা বাজার পথ ধরে মাকে হাঁটাব কেমন করে? এমন সময় ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চায়," বাজারে কোথায় নামবে মাসি?" মা বলে,"কদমতলা পোস্ট অফিসে নামিয়ে দিবি বাবা? খুব ভালো ছেলে তুই। সোনা ছেলে" ইত্যাদি প্রভৃতি। মা ঐ রকমই করেই কথা বলে, সবাইকে কথায় কথায় আদর আর প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়।


আমার মায়ের আদরে ভাসতে ভাসতে আব্দেরে টোটোওয়ালা বাজারের মধ্যে, ভিড়ে ভরা পোস্ট অফিসের সামনে বাহন থামায়। মা আবার নামার চেষ্টা করে। আমি আবার টানাটানি করি। পিছনের গাড়ি ভোঁপু বাজাতেই থাকে। আর এইসবের মধ্যে ছেলেটা আবার নেমে আসে।" কই মাসি দেখিতো-" বলে সটান চাগিয়ে নামিয়ে দেয় মাকে। 


"বেঁচে থাক বাবা" বলে ছেলেটার থুতনিতে আঙুল ছুঁইয়ে চুম্বন করে মা। ভাড়া চুকিয়ে পোস্ট অফিসে ঢুকছি আমরা, ছেলেটি প্রশ্ন করে, "তোমার কতক্ষণ লাগবে মাসি?" মা বলে," কতক্ষণ আর, আধঘন্টা চল্লিশ মিনিট বড় জোর। তুই দাঁড়াবি বাবা?" ছেলেটা বলে," আমি একবার দাশনগর যাব। কিছু মাল নামাতে হবে। ফিরে আসতে পারব মনে হয়, সময়মত।"


পেনশন তোলা ছাড়াও আরো কিছু টুকিটাকি কাজ ছিল। বাস্তবে তাই পোস্ট অফিসের পাট চুকিয়ে বেরোতে লাগলো ঘন্টা দুই। পনেরো বছর আগে রিটায়ার করেছে মা, মায়ের সমসাময়িক কেউই আর নেই এই পোস্ট অফিসে। তাও যা খাতির পেল মা, বলার নয়। বাইরের দরজা থেকে হাত ধরে ভিতরে কাউন্টারের পিছনে নিয়ে গেল কেউ। চেয়ার এগিয়ে দিল কেউ। চা দিয়ে গেল কেউ। খোশগল্প করে গেল না জানি কত জনায়।


পোস্টমাস্টার মশাই নিজে এসে পেনশন তোলার ফর্ম দিয়ে গেলেন। পাশবই চেয়ে নিয়ে আপডেট করে দিয়ে গেলেন। আমাকেও একজন চা দিতে এলেন, না বলায় বেজায় অখুশি হলেন প্রৌঢ়। মা বসে বসে কুশল বিনিময় করছে, মায়ের পেনশন তোলার ফর্ম ফিলাপ করে দিচ্ছে অন্য কেউ। ফিসফিস করে মাকে বললাম, " তোমার এখনও কি খাতির গো!"  ফর্মে সই করতে করতে মা বলল, "দেখছিস তো, ব্যবহারটাই আসল। ব্যবহারটাই থেকে যায়।"


সত্যিই হয়তো তাই, বেলা দুটোর প্রখর রৌদ্রে আমরা যখন পোস্ট অফিস থেকে বেরোলাম, রাস্তা শুনশান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলল, " টোটোওয়ালাটা নেই না?" আমি হ্যাঁ বা না বলার আগেই এসে দাঁড়ালো টোটোটা। পাশের গলিতে ছায়ায় এতক্ষণ বসে ছিল ছেলেটা। না বলতেই নেমে এসে সাহায্য করল মাকে তুলে দিতে। বাকিটা তো দশ পনেরো মিনিটের রাস্তা। এবারে আর মাঝারি রাস্তা বা গলির মুখ নয় সোজা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো মায়ের টোটো। এতক্ষণ দাঁড়িয়েছে বলে, একটু বেশি ভাড়া দিলাম ছেলেটাকে। ছেলেটা কুড়ি টাকা কেটে বাকিটা ফেরৎ দিতে এলো।


আমিও নেব না, ছেলেটাও শুনবে না। "এটা তুমি ঠিক করছো না মাসি, আমার খারাপ লাগছে। আমার কষ্ট হচ্ছে। কেন বেশি দিচ্ছ?"  ছেলেটার ঘেমো মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে মা বলল," নে বাবা। মাসির আশীর্বাদ হিসেবে নে। খুব ভালো ছেলে তুই। সোনা ছেলে তুই। তোর অনেক অনেক ভালো হোক।" থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে আবার চুমু খেলো মা।


ছেলেটা এক গাল হেসে বলল," আচ্ছা নিলাম। তোমার মন রাখতে, এবারের মত। এবার তুমি আমার ফোন নম্বরটা নাও। যখনই দরকার পড়বে ডেকে নেবে।"


ফোন নম্বর সেভ করে, নড়তে নড়তে দেড়শো বছরের বুড়ো সদর দরজার দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল মা, ভাবছিলাম সরল সাদাসিধে, গ্রাম্য, প্রাণ খোলা কথাবার্তার জন্য, কোথায় না অসম্মানিত অপমানিত হয়েছে আমার মা। কত লোক তাচ্ছিল্য করেছে। প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পর, মায়ের অপমানে ফুঁসে উঠেছি আমি। মা কিন্তু সয়েই গেছে। প্রতিবাদ করার মতো বুদ্ধি বা সাহস হয়তো মায়ের ছিলও না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের কথা অনুসারে, সয়ে গেছে বলেই হয়তো, রয়ে গেছে আমার মা। ঠিকই তো বলে বৃদ্ধা, কিছুই থাকে না, অর্থ, প্রতিপত্তি, রূপ,যৌবন  সবকিছু গিলে খেয়ে নেয় সময়। কেবল ভদ্র ব্যবহারটুকুই থেকে যায়।

No comments:

Post a Comment