Wednesday 26 April 2023

অনির ডায়েরি ২০শে এপ্রিল, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

গত বছরেও তো পরিস্থিতি এমন ছিল না। গত বছরেও তো জানতাম না, যে বিধর্মীদের ইফতার দেবার বা ইফতারে অংশগ্রহণ করা অনুচিত। গত বছরেও জানতাম না, যে যারা রোজা রাখে না তাদের জন্য ঈদ মোটেই খুশির উৎসব নয়। তাদের ঈদের খুশিতে শামিল হওয়াও ধর্মীয় অনুশাসন বিরোধী।

আমি বর্ণ হিন্দু, কিন্তু রমজান মাস বা ঈদ আমার কাছেও খুশির উৎসব। ছোটবেলায় মায়ের সহকর্মীদের বাড়ি থেকে আসত ঈদের পাকোয়ান। থাকত ঈদের নিমন্ত্রণ। বড় হয়ে দুই বয়োজ্যেষ্ঠ মুসলিম সহকর্মী পেলাম। তাদের সৌজন্যে আর সংস্পর্শে চার্চ লেনের মাহে রমজানে লাগত সত্যিই চাঁদের ছোঁয়া।

আপিসে নিত্য আলোচ্য ছিল, কে কি সেহেরী খেলেন, রাতের জন্য কার বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে, কে কত টাকার ফল কিনলেন, কি কি উপহার কিনলেন ইত্যাদি। উফ কি আনন্দ নিয়েই না আসতো ঈদের সকাল। ঈদের নামাজ পড়েই ফোন করতেন দুই প্রৌঢ়, " ঈদ মোবারক, অনিন্দিতা।" ঈদের পর অফিস খুললেই চলে আসত, নাজিম সাহেবের গিন্নীর হাতে বানানো ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি পরোটা আর শাহী চিকেন। সাথে কাজু কিশমিশে লটপট সুতোর থেকেও সরু শিমাই।  পেট ভরে খেয়ে, কৌটো ভরে বাড়ি আনতাম। বিজয়ার দিন তেমনি ঠাকুর জলে পড়লেই ফোন করতে হত আমাকে। বেশি দেরি করলে গোঁসা করতেন নজরুল সাহেব, মুঠো ফোনের ভিতর থেকে ভেসে আসত অভিমানী কণ্ঠস্বর, " ভাবলাম তুমি ভুলেই গেছো বোধহয়।"

লেবার কমিশনারেটের মস্ত বড় অফিসের কোন এক উপেক্ষিত কোণায় বসতাম আমরা তিনজন, ভিন্ন বয়সের, ভিন্ন ধর্মের তিন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। খুব খুব ইচ্ছে করত ওনাদের ইফতার দেবার। না না কারণে আর হয়ে ওঠেনি। সেই অপূর্ণ সাধ মিটিয়েছিলাম তাম্রলিপ্ত নগরীতে এসে।


হক বাবুর জন্য ইফতার আয়োজন করে, আমরা যতটা খুশি হয়েছিলাম, ততোটাই খুশি হয়েছিলেন হক বাবু নিজেও। সকলের অগোচরে বলেই ফেলেছিলেন," ম্যাডাম কোনদিন ভাবিনি, অফিস আমাকে ইফতার দেবে। আজ আমি খুব খুশি।"

এবারেও রমজান মাস পড়তেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আমাদের ইফতার পার্টির পরিকল্পনা। তিন নবীন ইন্সপেক্টর সন্দীপ-মনীশ আর শান্তনুর ওপর অর্পিত হয়েছিল ইফতার পার্টি আয়োজনের দায়িত্ব। যদিও অনভিজ্ঞতাবশতঃ শেষ পর্যন্ত প্রায় ম্যাচ ঝুলিয়েই দিয়েছিল ব্যাটারা। ভাগ্যে শ্লগ ওভারে শুভাশিস আর অরূপ ব্যাট করতে নেমেছিল।


যাই হোক আমাদের ইফতার পার্টির দিনক্ষণ স্থির হবার সাথে সাথেই বিভিন্ন মাধ্যমে ভেসে আসতে লাগল একের পর এক বিদগ্ধ মানুষের কলমের অগ্নিবান। ইফতার দেবার অধিকার নাকি আমার নেই। ঈদের খুশিও নাকি আমার জন্য নয়। কোন অ বা অর্ধশিক্ষিত মানুষ বললে হয়তো আমি ভ্রূক্ষেপও করতাম না, কিন্তু ইসলামী শাস্ত্রে পণ্ডিত মানুষজনের বক্তব্য ফেলি কি করে? 


ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, জানেন। থাকতে না পেরে একদিন অফিস টাইমে জনৈক বিদগ্ধ ব্যক্তিকে ফোনই করে ফেললাম, " স্যার আমাদের এক রোজাদার সহকর্মীর জন্য আমরা সামান্য ফলজলের ব্যবস্থা করতে চাই। সেটাও কি ধর্ম বা নীতিবিরুদ্ধ হবে?" সরাসরি না বললেও প্রশ্নটা যে ওনার খুব একটা মনঃপুত হয়নি বেশ বুঝতে পারলাম। বললেন অভুক্ত সহকর্মীর জন্য ফল - জলের আয়োজন করতেই পারি,তবে তাকে ইফতার নাম না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। 


অনেক ভেবে চিন্তে শেষে হক বাবুকেই একদিন শুধালাম, "হক বাবু এবারেও যদি আমরা আপনার জন্য ইফতার পার্টি থুড়ি সামান্য ফলজলের আয়োজন করি, আপনার আপত্তি নেই তো?" হক বাবু বিস্তর লজ্জা পেয়ে, আসন্ন ঈদ উপলক্ষে সুন্দর টেরি কাটা চুলে বার কয়েক হাত বুলিয়ে বললেন, "আজ্ঞে ম্যাডাম আপনি যা ভালো বোঝেন। তবে নামাজের ওয়াক্ত আজই বিকাল ৫ টা ৫২। বেলা যে রেটে বাড়ছে যেদিন আয়োজন করবেন সেদিন হয়তো নামাজ পড়তে পড়তেই সন্ধ্যে ছটা সোয়া ছটা বেজে যাবে। আপনারা সকলেই অনেক দূরে দূরে ফিরবেন। আমার জন্য সবার বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে, এই আর কি-"।

এ আবার কেমন কথা, আমাদের হক বাবুর জন্য আমরা একটা দিন দেরি করে বাড়ি ফিরতে পারবো না?

হাতে সময় ছিল খুব অল্প। রাত পোহালেই হয়তো দেখা যাবে ঈদের চাঁদ। সাধারণত ঈদের আগের দিনটা ছুটি নেন হক বাবু, কি ভাগ্যি এবারে নেন নি। আমাদের হক বাবুর জন্য, ঝটপট রাধামণি বাজার থেকে বেছে বেছে ফল কিনে আনল অরূপ।  আনা হল কুচানো আদা আর ভিজে ছোলা। নিচের ক্যান্টিন থেকে আনানো হল, টক দইয়ের সাথে কুচানো বাদাম আর মরিচ গুঁড়ো মেশানো ওদের সেই বিখ্যাত লস্যি। গত বার বিদ্যুৎ বেকারি থেকে আনা হয়েছিল পুদিনা দেওয়া আলুভাজা আর কাঠি কাবাব। কিন্তু আপাতত জেলাধীশের নির্দেশে, নিমতৌড়ির এই প্রশাসনিক চত্বর থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয়েছে বিদ্যুৎ বেকারিকে। ফলে লোকাল দোকানের এগ চিকেন রোল আর চিকেন পকোড়াই জোগাড় করতে পেরেছিলাম আমরা। আয়োজন হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু উৎসাহ, আন্তরিকতা, ভালোলাগা আর ভালোবাসাটুকু ছিল একেবারে নিখাদ।


 জানিনা ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক। স্বধর্ম বা পরধর্ম কারো বিন্দুমাত্র অসম্মান করার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই আমার নেই। আমি শুধু জানি জীবন বড় সংক্ষিপ্ত। আজ টক্কা, তো কাল সব ফক্কা। যে কয়দিন থাকি, যেখানেই থাকি কিছু ভালো স্মৃতি তো রেখে যাই।

No comments:

Post a Comment