Sunday, 9 April 2023

অনির ডাইরি ৬ই এপ্রিল, ২০২৩

 


#গুরুচণ্ডালী #তাম্রলিপ্তকড়চা 


মাননীয় মুখ্যসচীব যে ৪ তারিখে দুয়ারে সরকারের শিবির পরিদর্শন করতে চলেছেন, এ তথ্য আগেই পেয়েছিলাম। অনুগ্রহ পূর্বক সূত্র শুধাইয়া, লজ্জা দিবেন নি। বিগত দিন দুয়েক ধরে গৃহকর্তাকে মণ মণ তৈল মর্দন করিয়া, এইটুকু তথ্য কেবল উদ্ধার করিতে সক্ষম হই, যে তিনি দীঘা হইতে কলিকাতা যাইবার পথে বেশ কয়েকটি শিবির পরিদর্শন করিতে ইচ্ছুক।


দীঘা হইতে কলিকাতার মধ্যে যেমন কাঁথি পড়ে, তেমনি পড়ে মোদের তমলুক মহকুমা। মাননীয় মুখ্য সচীবের গন্তব্য সম্পর্কে অবহিত হইবার সাথে সাথেই আমার ইন্সপেক্টর বর্গকে সচেতন করি। ভাই সব/ বাবারা রেডি হইয়া যাও, কাহার কাহার এমন ক্যাম্প আছে, যেগুলি পাকা সড়কের ধারে, যেখানে স্বচ্ছন্দে বড় গাড়ির কনভয় পৌঁছাইতে পারে?


নন্দকুমার হইতে রঞ্জিৎ হাত তোলে, তমলুক ব্লক হতে যোশুয়া আর হাত তুলে চণ্ডীপুরের শান্তনু। শ্রী শান্তনু কয়াল, আমার তিন নবীন ইন্সপেক্টরের মধ্যে নবীনতম। এখনো বছর ঘুরেনি চাকরির।পুঁচকে, অনভিজ্ঞ, গোবলু ছেলেটির গায়ে এখনও মাখামাখি হয়ে আছে বিদ্যালয়ের সৌরভ। নার্ভাস হলেই হাসে, বকাবকি করলে এমন প্রবল বেগে হাত কচলায় যে যুগপৎ মায়াও লাগে আবার হাসিও পায়। পাছে ভয় পায়, তাই বলি, একটু অগ্রিম প্রস্তুতি নিয়ে রাখো বাবু । সিনিয়র দাদাদের সাথে একটু কথা বলে নিও। একটু পড়াশোনা ঝালিয়ে রাখো। আর ফর্ম, রেজিস্টার গুলি কিঞ্চিৎ গোচগাছ করে রাখো, বলা তো যায় না, কি দেখতে মর্জি হয় তাঁর। কাছাকাছি থাকে এমন কয়েকজন  মিষ্ট ভাষী বেনিফিশিয়ারিকে ঠিক করে রেখো, যাদের হাতে শুভেচ্ছা বার্তা তুলে দেওয়া যায়। আর হ্যাঁ, শুভেচ্ছা বার্তা গুলি যেন অবশ্যই রঙ্গিন হয়। সাদাকালো শুভেচ্ছা বার্তা আবার আমাদের বড় সাহেবের দুই চক্ষের বিষ।


গতকাল সন্ধ্যায় খবর আইল, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই ঘনাইতে চলিয়াছে সন্ধ্যা। তিনি চণ্ডীপুরেই যাইবেন। হলদি নদীর অদূরে, নরঘাট মাদ্রাসায় বসিবে দুয়ারে সরকারের শিবির। আর সেখানেই পড়িতে চলিয়াছে মাননীয় মুখ্য সচীবের পদধূলি। তিনি তো আর একা আসিবেন না, সঙ্গে নির্ঘাত আসিবেন মাননীয় জেলাশাসক, অতিরিক্ত জেলা শাসকগণ। এমনকি সঙ্গ দিতে পারেন অন্যান্য দপ্তরের সচীববৃন্দও।


শান্তনুকে ফোনে জানিয়ে দিলাম, চিন্তার কোন সম্যক কারণ নাই। আমিও থাকব তোমার সাথে, তোমার পাশে। ঝড়-ঝাড়-ঝঞ্ঝা যা আসবে, ভাগ করে খাওয়া যাবে খন। শান্তনু উৎসাহিত হয়ে বলল," হ্যাঁ ম্যাডাম। হ্যাঁ ম্যাডাম। এইতো আমি মিনিমাম ওয়েজেস অ্যক্ট পড়তে বসেছি। আর কোন কোন আইন পড়ব যদি একটু বলে দেন।"

হাসি চেপে বললাম, "অতো পড়তে হবে না বাপ। উনি তোমাকে আইনকানুন শুধাবেন না কো। বরং প্রকল্পটি সম্পর্কে একটু ভালো করে পড়ে রাখ। বিশেষতঃ ঐ যে ৪৬ টি অসংগঠিত শিল্প আর ১৫ টি স্বনিযুক্তি পেশার নাম, ঐগুলি বড় গুলাই আমি।" এছাড়া কোন প্রকল্পে কত পেনশন দেওয়া হয়, কি কাগজ পত্র লাগে এই ধরনের টুকটাক, খুঁটিনাটি। বেশি চাপ নিও না, বাকিটা তোমার বিডিও সাহেব বলেই দিবেন।


আজ সকাল ঠিক দশটায় মেসেজ পাঠালো শান্তনু, " ম্যাডাম আমরা সদলবলে ক্যাম্পে উপস্থিত হইয়াছি। মোরা এক্কেবারে রেডি।" আমি যখন গিয়া হাজির হইলাম তখন সূর্য মধ্যগগনে দেদীপ্যমান। বিডিও সাহেব স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন ক্যাম্পে। শান্তনু এসে নিয়ে গেল আমাদের স্টলে। মন খারাপ হয়ে গেল সামান্য। দুই তলার সদ্য নির্মিত ফাঁকা ক্লাস রুম খানি বরাদ্দ হইয়াছে মোদের জন্য। এমনিতে মন্দ নহে তবে বড্ড, বেপট গরম। মাননীয় মুখ্য সচীব কি আদৌ দোতলায় উঠবেন? কেউই তো উঠেনা সাধারণত।


বাচ্ছাদের স্কুলের বেঞ্চির একদিকে বসেছেন আমাদের এসএলও শ্রী স্বপন কুমার মান্না অন্যদিকে কমলেশ সাহু। মাঝে আমাদের শান্তনু আর তার ল্যাপটপ। ল্যাপটপটার ওপর ইড়িংবিড়িং স্টিকার মারা। DS নম্বর ফেলছিল শান্তনু। আমার জন্য কাজ ফেলে, কোথা থেকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে আনলো ছেলেটা। " ম্যাডাম আপনি বসুন।" বাক্যব্যয় না করে বসে পড়লাম, বসে বসে পড়াশোনা করতে লাগলাম। এই পেশা আর কাজের লিস্ট আমার জীবনে মুখস্ত হয় না। হাতে গুনে পাঁচটা করে টুকে মায়ের whatsapp নম্বরে পাঠিয়ে রাখলাম। আমার যাবতীয় গূঢ় তথ্য এই একজনকেই তো পাঠাই। মা কোনদিন খুলেও দেখে না। খোলে কেবল তুত্তুরী, যখন তিনি হাওড়া যান।


কাঁথির এএলসি সাহেবকে বলে রেখেছিলাম, আগে উনি আপনার ওখানে যাবেন, কি পড়া ধরছেন বিশদে জানাবেন কিন্তু।  আর কাঁথির এসডিওকে বলে রেখেছিলাম, ভাই উনি বেরোলেই জানাবি কিন্তু। সাড়ে বারোটা নাগাদ মহকুমা শাসকের ফোন, " এই বেরোলেন রামনগর থেকে-"। হিসেব করলাম তার মানে আর বড়জোর ঘন্টা- সোয়া ঘন্টার ব্যাপার। 


বিডিও সাহেব এবং এসডিও সাহেব (তমলুক) এসে ঘুরে গেলেন প্রতিটা স্টল। দিয়ে গেলেন শেষ মুহূর্তের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী। খানিক বাদে এক ভদ্রলোক এসে হুকুম করলেন," আসুন "। প্রশ্ন করলাম কোথায় যাব? জবাব এলো," আসুন"। বাধ্য ছাত্রীর মত, শান্তনুদের দোতলায় ফেলে, তাঁকে অনুসরণ করে নীচের একটি ফাঁকা কক্ষে গিয়ে হাজির হলাম। বুঝলাম এটি অফিস ঘর। বেশ ঠান্ডা, মাথার উপর ফ্যানের হাওয়াটি বড়ই মধুর। গরমে কষ্ট পাচ্ছি দেখে বিডিও সাহেবের নির্দেশেই যে এই ঘরে বসতে দেওয়া হল, তা অনুধাবন করতে সময় লাগল না। 


বসে আছি তো বসেই আছি। সময় যেন  কাটতে চাইছে না। ব্লকের জনৈক স্টাফ এসে চা আর জল দিয়ে গেল। আরো বার তিনেক সেধে গেল চা খাবার জন্য। এক গাল হাসি নিয়ে এক ভদ্রলোক এসে পরিচয় জেনে গেলেন- বাড়ি কোথায়, কি করি, আমার বর কি করে, ছানাপোনা আছে কিনা, শ্রীমতী তুত্তুরী কোন ইস্কুলে পড়েন, কোন ক্লাসে পড়েন ইত্যাদি। দুই মহিলা নবজাতক শিশু সন্তান সহ এসে স্তন্যপান করিয়ে গেলেন। কয়েকটি দুরন্ত বাচ্ছাকে আমার পাশে বসিয়ে বিভিন্ন  ফর্ম তুলতে গেল কয়েকজন মহিলা।তাদের মধ্যে একটি আবার, আমাকে, 'আপ আপ' করে প্রবল ধমকও দিয়ে গেল।


পাখির চোখের মতোই আমার দৃষ্টি কেবল বিডিও আর এসডিও সাহেবের দিকে। ওনারা ঘুরছেন, ফিরছেন, তদারকি করছেন তো আমিও নিশ্চিন্তে বসে আছি। দৃষ্টির অগোচর হলেই উঠে দাঁড়াচ্ছি, কোথায় গেল? তিনি এসে গেলেন নাকি? বেলা গড়ায়, আসর জমায় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের বাউলের দল। খানিক পরে বন্ধ হয়ে যায় গান। মাইক ধরেন বিডিও সাহেব স্বয়ং। ঘাম মুছতে মুছতে, ঘোষণা করতে থাকেন, "এই মুহূর্তে কেউ প্লিজ সিট ছেড়ে নড়বেন না।" " কাউন্টারের সামনে অকারণ ভিড় করবেন না," ইত্যাদি।  বুঝতে পারি তিনি আর বেশি দূরে নেই।


অবশেষে তিনি এলেন, আমার অঙ্ক যথার্থ প্রমাণ করে, মুখ্য দ্বারের দিকে যুগলে এগিয়ে গেলেন মাননীয় সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক এবং মহকুমা শাসক মহোদয়। আমিও গেলাম গুটি গুটি পায়ে, তবে উল্টো দিকে। দোতলায় আমার টিমের কাছে। তখনও ডিএস ফেলেই যাচ্ছে শান্তনু। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। " আরে, আমারটা আগে করে দাওনি", বলে হল্লা করছে। জানতে চাইলাম পাশবই/শুভেচ্ছা বার্তা  তুলে দেবার মত কেউ আছে তো শান্তনু?  "এই যে ম্যাডাম এনাদের অনুরোধ করেছি। একটু দাঁড়িয়ে যাবার জন্য"।  ফিসফিস করে জানতে চাই, " বেশি ক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখোনি তো? এনারা খুশি তো? উল্টোপাল্টা নালিশ জুড়বেন না তো?"  সম্প্রতি এই নালিশের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে উঠেছি আমরা। যে নালিশের অধিকাংশই আমাদের দপ্তরের সঙ্গে সংসর্গ রহিত।


শান্তনু, কমলেশ আর স্বপন বাবুকে কাজ করতে দিয়ে, দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। নীচে প্রশস্ত উঠানের মাথায় খাটানো হয়েছে বিশাল সামিয়ানা। সামিয়ানার তলে, বর্গক্ষেত্রের আকারে বসেছে বিভিন্ন দপ্তরের স্টল। সামিয়ানার ফাঁকফোঁকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে, মাননীয় মুখ্য সচীব ঘুরছেন, ফিরছেন, কথা বলছেন বিভিন্ন স্টলে গিয়ে। হাত মিলাচ্ছেন, ফর্ম দেখছেন, শুভেচ্ছা বার্তা তুলে দিচ্ছেন উপভোক্তাদের হাতে। ফটাফট হাততালি পড়ছে , পটাপট ছবি উঠছে। ততো খারাপ হয়ে যাচ্ছে মন। ইশ আমাদেরও যদি নীচে সামান্য ঠাঁই জুটত। 


"সিএস স্যার বোধহয় আর আসবেন না, তাহলে DS ফেলতে যাই ম্যাডাম?" মন খারাপের সুরে প্রশ্ন করে শান্তনু। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,কাজ ফেলে উঠে এসেছিল ছেলেটা। ওকে ফেরৎ পাঠিয়ে দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি, এবার বোধহয় বিদায় নেবার পালা। মাননীয় অতিথিবর্গ বিদায় নিলেই, বেরিয়ে পড়বো আমি। সব অঙ্ক, সব হিসেব গুলিয়ে দিয়ে আচমকা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসেন বিডিও সাহেব। ইঙ্গিত ধরতে অসুবিধে হয় না। দৌড়ে চলে যাই নিজেদের  কাউন্টারে। শান্তনুকে শুধাই শেষবারের মতো, " রেডি তো?" আত্মবিশ্বাসী জবাব আসে, "হ্যাঁ ম্যাডাম।"


মাননীয় মুখ্য সচিব আসেন, উপস্থিত শ্রমিকদের সাথে বাক্যালাপ করেন। উল্টেপাল্টে দেখেন ফর্ম, বেনিফিশিয়ারির কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পাতা উল্টে দেখেন পাশবই।  আলগা দু-চারটে প্রশ্ন করেন। ঋণাত্মক জবাব দেয় না কেউই। আবার নকল হাসিতেও গলে পড়ে না কেউ। সাহস সঞ্চয় করে শান্তনুর আর আমার পরিচয় দিই আমি। অনুরোধ করি দুটি পাস বই আর শুভেচ্ছা বার্তা যদি প্রদান করে বাধিত করেন। ব্যাপারটা অত্যন্ত গর্বের হয় আমাদের পক্ষে। সানন্দে সম্মতি জানান উনি। শান্তনুর সাথে, ফাঁকে ফাঁকে খানিক খোশ গল্পও করে নেন। চাকুরী জীবনের বছর ঘোরার আগেই মাননীয় মুখ্য সচিবের সঙ্গে খোশ গল্প করা কতজনের ভাগ্যে জোটে মশাই! ছেলেটা তো যাকে বলে মন্ত্রমুগ্ধ। 


 চাকরী জীবনের শুরুতে এমন কিছু মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছিলাম, আজও তাঁরা মাঝে মাঝে স্বপ্নে এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যান। ছেনি হাতুড়ি দিয়ে মগজ প্রক্ষালন পূর্বক এনারা শেখাতে চেয়েছিলেন, বড় সাহেব/ মেম সাহেবের উপস্থিতিতে তাঁর থেকে বড় সাহেব/মেম সাহেবের সামনে মুখ খোলা, এমন কি ক্ষেত্রবিশেষে মুখ দেখানোও ঘোরতর দণ্ডনীয় অপরাধ। আর এ ছোকরা তো, আমার পাশে দাঁড়িয়ে দিব্য খোশ গল্প করল মশাই, তাও কেন যে গোঁসা না হয়ে এত আনন্দ আর গর্ব হচ্ছে কে জানে। নাহ্ যা দেখছি,আমি দেখি মোটেই ভালো ছাত্রী হতে পারিনি।

No comments:

Post a Comment