মাঝে মাঝে ভিতরটা কি রকম যেন ফাঁপা লাগে। কিছুই যেন ঠিকমত সামলে উঠতে পারি না। বাবাকে ডাক্তার দেখানো হয় না। ডাক্তারের কাছে যাবার কথা বললেই বাবা বলে,‘ওসব এখন থাক। তুত্তুরীর দিকে নজর দাও। পুজোর পর হবে খন।’ বুঝতে পারি, আমাদের বিব্রত করতে চায় না বৃদ্ধ। আমাদের মুখ চেয়ে ক্ষুদ্র শারীরিক সমস্যা গুলোকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় হয়তো, কিন্তু সমস্যা গুলো তো আর সত্যিই উড়ে যায় না। জমে থাকে, বংশ বাড়ায় অজানা, অচেনা কোন খন্দে।
শ্বশুরমশাইয়ের এই সঙ্কোচটা নেই। শারীরিক অসামর্থতা নিয়ে নেই কোন লুকোচুরিও। নিজেই বলেন, ‘অ্যাপয়ন্টমেন্ট আমি নিয়ে নেব, তোদের মধ্যে যে হোক কেউ যদি একটু কষ্ট করে চলে আসিস।’ বৃদ্ধের কাতর স্বরে ভিজে যায় চোখ। কষ্টের কি আছে? এটা তো আমাদের কর্তব্য। সেই কর্তব্যটুকুও কি ঠিকঠাক পালন করতে পারি সবসময়? বয়স সুলভ ছোট একটা অপারেশন করতে হবে বৃদ্ধের, ডাক্তার বলেছে, ‘জলদি নেই। ধীরে সুস্থে করিয়ে নিন। না হলে কিডনিতে চাপ পড়বে কিন্ত।’ ঐ বয়সী বৃদ্ধের অপারেশন তো আর এমনি এমনি হয় না, তার আগে দেখাতে হয় অন্য বেশ কিছু বিশেষজ্ঞকে। তেমনি কোন বিশেষজ্ঞের সাথে মোলাকাতের দিনই পড়ে যায় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ভিসি। না শৌভিক নড়তে পারে, না আমি। কাতর নিবেদন করতে হয় বৃদ্ধের কাছে, অনুগ্রহ করে ডেটটা যদি একটু পিছিয়ে দেওয়া যায়। অন্য যে কোন ডেট, যে কোন সময় হোক না কেন ঠিক পৌঁছে যাব যে কেউ একজন।
মন খারাপ থাকে তুত্তুরীর জন্যও। আর একটু ভালো করে যদি দেখতে পারতাম মেয়েটাকে। আর একটু খেটে যদি পড়াতে পারতাম। কিছুই পারি না। কিছুই হয় না আমার দ্বারা। পরীক্ষা চলছে মেয়েটার, কে জানে কেমন দিচ্ছে সে। পরীক্ষার আগে চেপে পড়াতে নিষেধ করে শৌভিক আর পরীক্ষা হয়ে গেলে প্রশ্নোত্তর মেলানোয় ভয়ানক অলসতা আমার। সব মিলিয়ে বেপোট মজায় আছে তুত্তুরী। পরীক্ষা কেমন হল রে, জিজ্ঞাসা করলেই জবাব আসে, ‘খুব ভালো।’দাঁড়ান, দাঁড়ান সত্যি সত্যি ভালো ভেবে বসবেন না আবার তাই বলে। ফল বেরোলে রীতিমত ব্যাগে করে নম্বর আনতে হয় আমায়। বাবা যদিও উৎফুল্ল হয়ে যায় ঐ পচাগলা রেজাল্ট দেখেও। ভদ্রলোকের এক কথার মতই শৌভিকের এক বুলি,‘তুই কোনদিন এত নম্বর পেয়েছিস? আমি তো পাইনি।’ নাঃ আমিও পাইনি। তখন এত নম্বর দেবার দস্তুর ছিল নাকি? কে বোঝাবে বাপ আর মেয়েকে?
তবুও স্কুল বেরোনোর সময় বলি, ভালো করে পরীক্ষা দিও। সাবধান করি,ছুটির সময় আমি বা শৌভিকের ড্রাইভার পলাশ ছাড়া অন্য কারো সাথে না ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বেরিয়ে পড়ে স্কুল থেকে। কেউ যদি বলে, খুকি তোমার মা ডাকছে তাহলে তার ওপর যেন ভুলতে বসা ক্যারাটের দুচারটে মার প্রয়োগ করে ইত্যাদি প্রভৃতি। শৌভিকের ভ্রু কুঞ্চন অপেক্ষা করে বাগুইআটির গল্পটা শোনাই। গাড়িতে উঠতে উঠতে ঘুরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী, ‘তোমাদের দেরী হলে কি করব?’ চেহারাটাই বড় হয়েছে, মগজে যদি ছিটেফোঁটাও ঘিলু থাকে মেয়েটার,হেঁকে বলি, অপেক্ষা করবি। আবার কি? প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরে গিয়ে বসে থাকবি। ‘আচ্ছা এবার থাম’ বলে থাবড়া মেরে থামিয়ে দেয় শৌভিক।
সাড়ে ১২টার মধ্যে হাজিরা দিতে হবে ভিসিতে। তার আগে টুকটাক কাজ গুছিয়ে নিই। রঙিন প্রিন্ট নিয়ে নিই রিপোর্টের। বড় সাহেবের সঙ্গে আরেকবার ঝালিয়ে নিই পড়া। উনি হলদিয়া থেকে থাকবেন আর আমি তমলুক থেকে। নিমতৌড়ি ডিএম আপিসের এ ব্লকের তিন তলার সব থেকে বড় মিটিং হলে হবে ভিসি। সাড়ে বারোটা নাগাদ যখন পৌঁছালাম বেশ ভিড় হয়ে গেছে। পিছনের সিট গুলোর আকর্ষণ শক্তি বড়ই প্রবল, কিন্তু ঐ ফাঁদে পা দিলেই চিত্তির। ঠিক মিটিং শুরুর আগে কেউ না কেউ অনুরোধ করবেন,‘পিছনের রো এর লোকজন একটু সামনে চলে আসেন-।’
মাঝাামাঝি রো সবথেকে সেফ। মাঝামাঝি লাগানো টিভির সামনে বসলাম জমিয়ে। পৌনে একটা নাগাদ মাননীয় মহকুমা শাসক ফোন করে জানতে চাইলেন,‘পৌঁছেছিস?’ জবাবে জানতে চাইলাম,‘তুই কোথায়?’ যেখানে বলল, বেশ খানিক উঁকিঝুঁকি মেরে চেনা মাথাটা খুঁজে পেলাম বটে। সময় গড়ায়, মস্ত মিটিং হলের দু প্রান্ত থেকে চলে খুনসুটি ভরা মেসেজ আদানপ্রদান। নবান্ন থেকে কে যেন ধমকে ওঠে,‘সবাই ঢুকেছেন? ম্যাডাম কিন্তু এখুনি এসে পড়বেন। আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না কিন্তু-’।
মাননীয়া তাঁর আসন গ্রহণ করেন। আসন নেন অন্যান্য মান্যগণ্য প্রশাসক এবং মন্ত্রীবর্গ। মিটিং শুরু হয়, সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায় আমাদের মেসেজ চালাচালি। গোটা কয়েক ফোন এসে, বেজে কেটে যায়। পৌনে দুটো নাগাদ ফোন করে শৌভিকের ড্রাইভার পলাশ। যেদিন আমি যেতে পারি না, তুত্তুরীকে স্কুল থেকে আনতে পলাশই যায়। মেয়েটাকে স্কুল থেকে বাড়িতে নামিয়ে প্রত্যেক বারই আমায় জানিয়ে দেয়। ‘ম্যাডাম, তুত্তুরীকে লাবিয়ে দিলাম।’ ভাবলাম আজও তাই বলছে হয়তো।তাই জন্যই ধরলাম, নতুবা পলাশের স্যার ফোন করলেও ধরতাম না ঐ মুহূর্তে। কিন্তু পলাশের আজকের বক্তব্যটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, হতভম্ব গলায় পলাশ বলল,‘ ম্যাডাম, তুত্তুরীকে কি আনতে হবে?’
হে ভগবান, পরীক্ষা বলে তুত্তুরীর ছুটি হবার কথা সোয়া একটায়, আধ ঘন্টা আগে। এখনও তাকে আনতে যায়নি পলাশ? ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। পলাশ ও প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে, তোতলাতে তোতলাতে বলল,‘এই মাত্র বললেন স্যার। আমি এখুনি যাচ্ছি। এখুনি যাচ্ছি।’ কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রাখতে না রাখতেই পলাশের স্যারের মেসেজ,‘ বুজুকে( অর্থাৎ তুত্তুরী) আনার কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। এখন বললাম।’ সাথে একটা দুঃখের ইমোজি। ভাগ্যে মিটিং হলটা মস্ত, আর দুজন দুপ্রান্তে বসেছি। নইলে খুনই করতাম ব্যাটাকে। মিটিং এর এমনি মোহ যে মেয়েকে ভুলে গেছে।
উদ্গত ক্রোধ চেপে বললাম, ‘আধ ঘন্টা আগে ওর ছুটি হয়ে গেছে। CA (আপ্ত সহায়ক)কে বল স্কুলে ফোন করতে এখুনি। কি যে হল আমার মেয়েটার।’ ১টা ৫০ এ মেসেজ ঢুকল,‘বলে দিয়েছি। CA সাহেব খোদ প্রিন্সিপ্যালকেই বলেছেন তাঁর ঘরে বসিয়ে রাখতে।’ এর পরের ১৫টা মিনিট যে কি ভাবে কাটল তা শুধু ভগবানই জানে। মনে মনে হিসেব করছিলাম আমি, কতক্ষণে স্কুলে পৌঁছাবে পলাশ। দুটো পাঁচে ফোন করলাম পলাশকে। হাঁপাতে হাঁপাতে পলাশ বলল,‘তুত্তুরীকে খুঁজে পেয়েছি ম্যাডাম।’ এর ঠিক দুমিনিটের মাথায় পলাশের স্যারের মেসেজ,‘গাড়িতে উঠে গেছে।’ দাঁত কিড়মিড়ের ইমোজিটা খুঁজে পেলাম না, তাই এমনিই লিখলাম, ‘জানি। বাড়ি আয়, তোকে আজ খুনই করব।’ ভেবেছিলাম আরেকটা স্যাড ইমোজি আসবে বা দুঃখ প্রকাশ করে কোন মেসেজ, কচু, ঘেঁচু, টিকটিকি। উল্টে তিনি বললেন,‘সব তোর দোষ। উত্তমকুমারকে তো পাঠাতেই পারতিস-’।
সবথেকে মজার কথা যেটা, তুত্তুরী এবং খোদ উত্তমকুমারও দেখলাম ঐ একই কথা বলল। ‘ আপনি আমায় একবার বললেই তো পারতেন ম্যাডাম। আমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পলাশদার সাথেই গল্প করছিলাম।’ আর তুত্তুরী বলল, ‘বেচারা বাবাটা আমার। তুমি কেন বলোনি উত্তম মামাকে।’ মানতে বাধ্য হলাম, সবই আমার দোষ রে বাবা। শাশুড়ী মা কি সাধে বলেন,‘বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।’
No comments:
Post a Comment