Sunday 11 September 2022

অনির ডাইরি ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২

 


আজ ভাবতে বসলে মনে হয় যেন ভিন্ন কোন যুগের গল্প। ভীষণ লোডশেডিং হত তখন, প্রায় প্রতি রাতই থাকত নিষ্প্রদীপ। হ্যারিকেন বা লম্ফের আলোয় রাতের রান্না খাওয়ার পাট চুকিয়ে, শতরঞ্চি আর বালিশ বগলে বাবা-মায়ের সাথে ছাতে শুতে যাবার সে কি উন্মাদনা। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই,  চাঁদোয়া টাঙানো মসিকৃষ্ণ আকাশ, আকাশ জুড়ে ছড়ানো হীরের কুচির মত অগণিত ঝকঝকে তারা। মায়ের যে ছাতে শুতে যাবার খুব একটা উৎসাহ থাকত তাও নয়, ভোর পাঁচটা থেকে উঠে যৌথ পরিবারের যাবতীয় সাংসারিক কাজকর্ম সেরে, পোস্ট অফিসের কাউন্টার ডিউটি করে বাড়ি ফিরে আমাকে পড়ানো, রাতের রান্না- খাওয়ার ব্যবস্থা করতে করতে এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ত মা, যে শুলেই ঘুমিয়ে পড়ত, সে মাথার ওপর ঘরঘরে ডিসি পাখা চলুক আর ছাই নাই চলুক।  খোলা ছাতে শুয়ে আকাশের তারা দেখতে দেখতে তাত্ত্বিক আলোচনা করাটা ছিল বাবার আর আমার সবথেকে প্রিয় সময়। সদ্য ‘অ লেখ রে ভাই দাগে দাগে’ শুরু করেছে মা, তাতে কি, তাও  বাবা গল্প শোনাত শ্রেণীহীন এক সমাজের। 


তেমনি কোন রাতের কথা, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে মা, গল্পে মত্ত আমরা বাপ আর মেয়ে। আচমকা গল্প থামিয়ে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল বাবা, লাফিয়ে উঠে পড়ল মাও। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে এক ভয়ংকর কটুগন্ধ। মা বলল, "এতো মানুষ পোড়া গন্ধ। কোথাও আগুন লাগল নাকি?" তখনও নিষ্প্রদীপ, অন্ধকারে আচ্ছন্ন আমাদের মহল্লা। শুধু আমরাই নই, দোতলায়  জেঠু আর একতলায় ঠাকুমাও পেয়েছে গন্ধটা। আমাদের বাড়িতে তখন সাকুল্যে বারো - তেরো জন অধিবাসী। দম দেওয়া একতলা আর দোতলার দেওয়াল ঘড়ি একটু আগেই জানিয়েছে যে মধ্য রাতি পার করেছি আমরা। ফলতঃ আমরা কজন ছাড়া মোটামুটি সবাই গভীর তন্দ্রাচ্ছন। তবুও সব ঘর দেখা হল, ছাত থেকে, দোতলার বারন্দা থেকে  এদিক ওদিকও দেখল ভালো করে বাবা আর জেঠু। আসেপাশের কোন বাড়ি থেকে আসছে না কোন সাড়া শব্দ। তাহলে কি নিছক মনের ভুল? ঘুমঘুম গলায় জ্যাঠাইমা ধমক দিল জেঠুকে, "তোমাদের যত আজগুবি ব্যাপার স্যাপার।"  ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে জ্যাঠাইমাকেও, আটটার মধ্যে ভাত খেয়ে, টিফিন বাক্স বগলে আপিস বেরোবে জেঠু। তাই জ্যাঠাইমার বিরক্তি ভয়ানক ন্যায়সঙ্গত। বাড়ির বড় গিন্নিমার ধমক খেয়ে সবাই ফিরে গেল যে যার শয়নকক্ষে। বাবা মায়ের হাত ধরে ছাতে গেলাম সেদিনের আমি। এক অজানা আতঙ্কে ছাতে শোবার ইচ্ছে ততোক্ষণে উধাও। মাও আর ছাতে শুতে ইচ্ছুক নয়, কিন্তু বাবার জেদ, ছাতেই শোবে। গন্ধটা আর নেই বটে কিন্তু ছাতের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ঝাঁপিয়ে পড়া বেলগাছের ডালপালার নীচে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা কেমন যেন সচল মনে হল। চোখ বন্ধ করে নাকটা বাবার খোলা পিঠে ঠেকিয়ে বলেই ফেললাম বাবাকে, ‘ ওখানে মনে হচ্ছে কেউ আছে। আমার ভীষণ ভয় করছে, নীচে চল।’ বরাবরই ডাকাবুকো আমার বাপ, হো হো করে হেসে উঠল প্রথমে। তারপর বলল, ‘কিসের ভয়? ভূতের? একটা জিনিস সব সময় মাথায় রাখবি, মানুষ যতটা ভূতকে ভয় পায়, তার থেকে ঢের বেশি ভূত মানুষকে ভয় পায়। ভূত হোক বা মানুষ যখনই কেউ ভয় দেখাবে, তার থেকে পালাবি না। চোখ সরিয়ে নিবি না, বরং ঘুরে চোখে চোখ রেখে তাকাবি, দেখবি সে কেমন তোকে ভয় পায়।’ 

নাঃ বাবার এই অমৃত নির্দেশ আমি আজও পালন করতে পারিনি। ভয় দেখানো পার্থিব বা বায়বীয় কারো দিকেই ফিরে তাকানোর হিম্মত আমার আজও হয়নি। নেহাৎ উপরে কেউ আছেন, নেহাৎ কর্মফল আছে তাই বোধহয় আমাদের মত ছাপোষা, মধ্যমেধা, মধ্যমানের মানুষ গুলো অতি প্রতিকৃল অবস্থার মধ্যেও লড়ে যায় এবং জিতেও যায়। তাই মনে হয় মাঝেমাঝে যে সবই তেনার ইচ্ছা। 


তো এহেন অমৃতবাণীতেও যখন আমার ভয় কাটল না, তখন হাই চেপে বাবা বলল,‘এক কাজ কর। মাকে ছুঁয়ে থাক। মা ছুঁয়ে থাকলে ভূত প্রেত দত্যি দানা তো কি, খোদ যমরাজও কিছু করতে পারে না।’ এই হল না, ‘মন কি বাত।’ খপ্ করে মায়ের হাতটা টেনে নিজের পেটের ওপর রাখলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিল মা, আবার। অন্যদিন হলে ঘুমন্ত মায়ের গায়ে হাত দিলেও খ্যাঁক করে উঠত মা। সেরাতে কি যে হল, কিছু তো বললই না, উল্টে ঘুমের ঘোরে আর একটু কাছে সরে এল মা। জড়িয়ে ধরল সেদিনের ছোট্ট আমাকে। তাও কেন যে কাটে না ভয়টা। এবার বাবার একটা হাত টেনে নিলাম পেটের ওপর। দুদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরল দুজনে। পলকে গায়েব হয়ে গেল যত ভয়। মনে হল এর থেকে বড় নিরাপত্তাবলয় আর কি হতে পারে। সেদিনের সেই অনুভূতি আজও হৃদয়ে টাটকা। আজও ধাক্কা লাগলে, হোঁচট খেলে, সমস্যায় জর্জরিত, আতঙ্কিত হলে, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে শুধু একটা ফোন করতে লাগে, ‘বাবা তুমি একবার বলো তো, যে এটা হয়ে যাবে। মা তুমি একবার বলো তো যে আমি পারব- ব্যাস্ তাহলেই আমি পারব। সব পারব।’ 


 ইয়ে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি,যে রাতে অমন মানুষ পোড়া গন্ধে সাময়িক ভাবে ভরে গিয়েছিল চরাচর, তার পরের দিন জানতে পারা যায় যে কেউ আগুনে পুড়ে মরেনি বটে, গলায় দিয়েছিল,পাশের পাশের বাড়ির একটি বউ। মৃত্যুর সময়টা ছিল, আনুমানিক মধ্যরাত্রি।

No comments:

Post a Comment